১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কারা কেন ব্যর্থরাষ্ট্র করতে চাইছে লেবাননকে

কারা কেন ব্যর্থরাষ্ট্র করতে চাইছে লেবাননকে -

ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্র রাষ্ট্র লেবানন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক সঙ্ঘাতের শিকার হয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। এক বছর আগে বৈরুতে ভয়াবহ ট্যাংকার বিস্ফোরণে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা আরো প্রকট করে তোলে। গত এক বছরে তিন দফা সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয় দেশটিতে। কিন্তু রাজনৈতিক পক্ষগুলোর বিরোধে সরকার গঠন সম্ভব হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির ৯ মাসব্যাপী সরকার গঠন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বৈরুত বিস্ফোরণের এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ১০ আগস্ট, ২০২০-এ হাসান দিয়াবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। তিনিও ব্যর্থ হলে নাজিব মিকারি নতুন সরকার গঠনের প্রচেষ্টা শুরু করেছেন।

অব্যাহত পতনের দিকে ছুটে চলা
লেবানন ক্রমবর্ধমান সঙ্কটে অব্যাহতভাবে পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের আর্থিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে এর শুরু, কোভিড মহামারী এ সঙ্কট আরো জটিল ও গভীর করে। আর বিধ্বংসী বৈরুত বন্দর বিস্ফোরণ পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি ঘটায়। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই অপারমাণবিক বিস্ফোরণে ২০০ জন নিহত এবং হাজার হাজার আহত হন। শহরের কেন্দ্রস্থলে বেশ কয়েকটি এলাকা ধ্বংস হয়ে যায়।

এ ঘটনার এক বছরের মাথায় তীব্র জ্বালানি, খাদ্য ও পানি সঙ্কট এখন লেবাননী জনজীবনকে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। বিশ্ব ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে ২০১৮ সালে লেবাননের ৫৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ২০২০ সালে ৩৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ডলারের হিসাবে মাথাপিছু আয় কমে গেছে ৪০ শতাংশের মতো। ২০১৯ সালে জাতীয় অর্থনীতি ৬.৭ শতাংশ সঙ্কুচিত হওয়ার পর ২০২০ সালে ২০.৩ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়ে যায়। ২০২০ সালেই মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয় ১২৯ শতাংশ। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায় ৮৪.৩ শতাংশ। কিছু খাদ্যসামগ্রীর দাম ৬০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ২০২১ সালে জিডিপি আরো ৯.৫ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়ে যাবে বলে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক উল্লেখ করেছে, লেবাননের অর্থনৈতিক মন্দা সম্ভবত ১৫০ বছরের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।

লেবাননের ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, ২৫ শতাংশ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা অব্যাহতভাবে বাড়ছে। জাতিসঙ্ঘের অনুমান, দেশটির ৭৫ শতাংশ পরিবার খাবারের জন্য সংগ্রাম করছে এবং ১২ লাখ লেবাননির জরুরি খাদ্যসহায়তা প্রয়োজন। বিদ্যুৎ ও পানিসহ অপরিহার্য পরিষেবা সরবরাহে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হচ্ছে, ঘনঘন ব্যাকআউট এবং পানিশূন্যতা দেখা দিচ্ছে। ইউনিসেফ সম্প্রতি সতর্ক করেছে, লেবাননের ৭১ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানির অ্যাক্সেস হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে। পাবলিক ওয়াটার সিস্টেম ধ্বংসের পথে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ওয়াটার পাম্পিং স্টেশন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে। স্বাস্থ্য খাতও ভেঙে পড়ছে। হাসপাতালগুলো সংগ্রাম করছে, ফার্মেসিগুলো ধর্মঘটে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। লেবাননের সেনাবাহিনীর মনোবল অব্যাহতভাবে কমছে। ইতোমধ্যে, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। অনেক সৈনিক দ্বিতীয় চাকরি নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

সঙ্কটের মূলে রাজনীতির ভূমিকা
লেবাননের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এমন, যেখানে শিয়া সুন্নি ও খ্রিষ্টানদের রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে মোটা দাগে ঐকমত্য না হলে সরকার গঠন করা সম্ভব হয় না। দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধের পর যে রাজনৈতিক সমঝোতা হয় তার শর্ত অনুসারে লেবাননে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় ম্যারোনাইট খ্রিষ্টান থেকে, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন সুন্নি মুসলিম থেকে আর স্পিকার নির্বাচিত হন শিয়া মুসলিমদের মধ্য থেকে। লেবাননের জাতীয় আইনসভা দেশটির একমুখী সংসদ। এর ১২৮টি আসন খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে সমানভাবে বিভক্ত, দুই সম্প্রদায়ের ১৮টি ভিন্ন ধর্মীয় শাখার মধ্যে আনুপাতিকভাবে এটি ভাগ করা হয়। দেশটি ৬১ শতাংশের বেশি মুসলিম এবং ৩৩ শতাংশের কম জনসংখ্যা খ্রিষ্টান হলেও সংসদেও আসন সমভাবে বরাদ্দ করা।

লেবাননের সংসদ সম্প্রদায়গত আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে চার বছরের মেয়াদের জন্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়। নির্বাহী শাখা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার নিয়ে গঠিত। পার্লামেন্ট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে নবায়নযোগ্য ছয় বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কর হয়। সংসদের সাথে পরামর্শের পর রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেন।

এ ব্যবস্থায় কোনো এক পক্ষের সমর্থন ছাড়া সরকার গঠন সম্ভব হয় না। সুন্নিদের মধ্যে একক দলের সমর্থন না থাকলেও শিয়া অনুসারীর সমর্থন এখন অনেকটা হিজবুল্লাহর প্রতি একক। হিজবুল্লাহর প্রতি ইরানের রয়েছে একচ্ছত্র সমর্থন। অন্য দিকে সুন্নি রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতি একসময় দৌদি আরবের একচ্ছত্র সমর্থন ছিল। এখন সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।

খ্রিষ্টান রাজনৈতিক শক্তির প্রতি ইসরাইল এবং পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব রয়েছে। লেবাননের অধিকাংশ খ্রিষ্টানের পূর্বপুরুষ ক্রুসেডে গাজী সালাউদ্দিনের বিজয় এবং এর পরে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর জেরুসালেম ও এর আশপাশের এলাকা থেকে এসে লেবাননে বসতি স্থাপন করে।

লেবাননের রাজনীতি, অর্থনীতি তথা সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চায় ইসরাইল, ইরান-সিরিয়া ও সৌদি আরব। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত লেবাননের গৃহযুদ্ধে দেশটি রাজনীতি-অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সিরিয়া এবং ১৯৮৫ থেকে ২০০০ পর্যন্ত ইসরাইলের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছিল লেবাননে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মদদপুষ্ট এ সঙ্ঘাত জটিল রূপ নিলে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে একটি আপস ফর্মুলার মধ্য দিয়ে। এরপর এক ধরনের স্থিতি লেবাননে ফিরে এলেও এর মধ্যে বহু লেবাননি দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে অভিবাসী হয়ে পড়েন। এখন লেবাননের অধিবাসী রয়েছে প্রায় ৭০ লাখ। আর বিদেশে বসবাসকারী লেবাননির সংখ্যা ১৭ লাখ। বাইরে চলে যাওয়া লেবাননিদের বড় অংশই খ্রিষ্টান। ফলে রাজনৈতিক সমঝোতার সময় যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংসদের আসন সংখ্যা ভাগ করে দেয়া হয়েছিল সেই অনুপাত এখন নেই। এখনকার জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টন করতে হলে খ্রিষ্টান সংসদ সদস্য নেমে আসবে প্রায় অর্ধেকে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার গণনা অজ্ঞাত কারণে বন্ধ রাখা হয়েছে। এমনকি নাগরিকদের আইডি কার্ডে ধর্মের যে পরিচয় ছিল তাও এখন তুলে দেয়া হয়েছে।

ভূরাজনীতিই কাল হলো লেবাননের?
লেবানন পশ্চিম এশিয়ার একটি দেশ। এর উত্তর ও পূর্বে সিরিয়া এবং দক্ষিণে ইসরাইল অবস্থিত, ভূমধ্যসাগরজুড়ে তার পশ্চিমে অবস্থিত সাইপ্রাস; ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকা এবং আরবীয় অন্তর্দেশের সংযোগস্থলে এর অবস্থান। ৭০ লাখ মানুষের বাসস্থান লেবাননের আয়তন ১০ হাজার ৪৫২ বর্গকিলোমিটার। এটি বিশ্বের ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে একটি, যদিও লেবাননে সভ্যতার প্রাচীনতম প্রমাণ পাওয়া যায় ৭০০০ বছর আগের।

লেবাননে ৪০০ বছর উসমানীয় খেলাফতের শাসন চলার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে লুজান চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এ অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব হারায় তুর্কিরা। এরপর ফরাসি প্রটেক্টরেট রাজ্যে পরিণত হয় লেবানন। ১৯৪৩ সালে স্বাধীনতার পরও লেবাননে ফরাসি প্রভাব থেকে যায়।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় লেবাননে। ১৯৪৮, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের তিন দফা আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর অনেক ফিলিস্তিনি শরণার্থী হিসেবে লেবাননে আশ্রয় নেন। বিগত দশকের শুরুতে আরব বসন্তের জের ধরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ১৭ লাখ সিরীয় লেবাননে আশ্রয় নেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর এ অস্থিরতা লেবাননের নিরাপত্তা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ওপর নানামুখী প্রভাব ফেলে।

লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বিদেশী পক্ষের মধ্যে ইসরাইল লেবাননে সবসময় অস্থিরতা সৃষ্টি করে রাখতে চায়। দক্ষিণ লেবাননে শিয়া মিলিশিয়াদের হামলার মুখে একসময় ইসরাইলকে লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। হিজবুল্লাহ লেবাননে প্রভাবশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার পর ইসরাইলের সাথে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যে আলজিহাদ ও হামাসকে সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে হিজবুল্লাহ। এ কারণে ইসরাইল সবসময় লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি অবদমিত করে রাখতে চায়।

অন্য দিকে ইরানের দেশের বাইরে প্রধান প্রক্সি মিত্রশক্তি হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি তৈরি ও এর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে চোখ বন্ধ করে সমর্থন দেয় তেহরান। সিরিয়ার ইরান মিত্র আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে তার পতনের উপক্রম হলে আসাদকে রক্ষায় গ্রাউন্ডে যুদ্ধ করে হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহর এই ভূমিকা সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে গ্রুপটির গ্রহণযোগ্যতা কমালেও ইরানের সমর্থন অনেক বেড়ে যায়। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর সব কর্মকাণ্ড ইরানকে অনুমোদন করতে দেখা যায়। হিজবুল্লাহর প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে ইরান জ্বালানি সঙ্কটে পড়া লেবাননে এখন বাকিতে তেল সরবরাহ করে যাচ্ছে।

লেবাননে সুন্নি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর একসময় সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রক প্রভাব ছিল। লেবাননের বড় বড় ধনী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা লেবাননের পাশাপাশি সৌদি আরবের নাগরিকত্বও পান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিসহ প্রভাবশালী সুন্নি নেতাদের ব্যবসা বাণিজ্যি রয়েছে সৌদি আরবে। মোহাম্মদ বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর নিজের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে সৌদি আরবের ধনকুবেরদের হোটেলে আটকে রেখে অর্থ আদায়ের কৌশল নেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সাদ হারিরিকেও আটকে রাখা হয় সৌদি আরবে। এ ঘটনা লেবাননে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পরে সাদ হারিরিকে লেবাননে ফিরে যেতে দেয়া হলেও সৌদি আরব দেশটির রাজনীতির ওপর প্রভাব অনেকখানি হারিয়ে ফেলে।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যর্থ সৌদি প্রচেষ্টারও অবদান ছিল। সেটি হলো রিয়াদ চেষ্টা করেছে লেবাননের সরকারি সেনাবাহিনীকে দিয়ে হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে। লেবাননের বাস্তবতায় হিজবুল্লাহর সামরিক সংগঠন ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবস্থায় সৌদি আরব ও তার মিত্র রাজনৈতিক শক্তি ছিল না। বরং এটি করতে গিয়ে লেবাননে রিয়াদ নিজের রাজনৈতিক প্রভাব হারিয়েছে।

এ দিকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ইহুদি রাষ্ট্রটির কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশীদারে পরিণত হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আবুধাবি লেবাননেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। লেবাননে অনেকেই বিশ্বাস করেন, বৈরুতের তেল ট্যাংকারে বিস্ফোরণের সাথে ইসরাইলের যোগসূত্র রয়েছে। এ কারণে এই নাশকতার ঘটনার কার্যকর কোনো তদন্তও হচ্ছে না। এখন ইসরাইলের সম্পূরক ভ‚মিকায় দেখা যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে।

ফ্রান্সও এখন লেবাননে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। এ ব্যাপারে দেশটির প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ উল্লেখ করেছিলেন, প্যারিস যদি লেবাননে সক্রিয় না হয় তাহলে সে স্থান পূরণে এগিয়ে যাবে তুরস্ক। ফ্রান্স অর্থনৈতিক সঙ্কটে আন্তর্জাতিক দাতা সম্মেলন আয়োজনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগসূত্র রেখে কাজ করতে চাইছে।

লেবানন ৪০০ বছর ধরে তুর্কি খেলাফতের অধীনে থাকলেও কামাল আতাতুর্কের আরব থেকে বিচ্ছিন্নতার নীতির কারণে আরব দেশগুলোতে প্রভাব থাকেনি। ২০০২ সালে এরদোগানের নেতৃত্বে একেপি ক্ষমতায় এলে বৈদেশিক নীতি বেশ কিছুটা পাল্টে যায়। সিরিয়া আজারবাইজান লিবিয়া আলজেরিয়া ও তিউনিশিয়ায় সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করে আঙ্কারা। এই ভ‚মিকায় সাফল্য ও ব্যর্থতা মিশ্র ফল দেখা যায়। তবে ২০২৩ সালের তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এরদোগান অভ্যন্তরীণ বিষয়েই বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। ফলে লেবানন সঙ্কটে তুরস্কের ভূমিকা সীমিত থাকছে বলেই মনে হয়।

লেবাননকে একসময় মধ্যপ্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড এবং বৈরুতকে বলা হতো আরবের প্যারিস। সোনালি ঐতিহ্যের দেশটি এখন যে পরিস্থিতির মুখে পড়েছে তার মূল কারণ প্রক্সি ওয়ার বা প্রভাব বিস্তারের খেলা। এক দিকে ইসরাইল অন্য দিকে ইরান কৌশল বাস্তবায়নে লেবাননকে কাজে লাগাতে চাইছে। তবে ইসরাইল যেখানে বিপর্যস্ত লেবাননের মধ্যে স্বার্থ খুঁজে পাচ্ছে, ইরান সেখানে হিজবুল্লাহকে নিয়ন্ত্রক আসনে রেখে লেবাননকে শক্তিশালী দেখতে চায়। সৌদি আরবও এখন নিজস্ব নিরাপত্তাকে আঞ্চলিক ইস্যুর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর মধ্যে বড় সঙ্কট হয়ে দেখা দিচ্ছে আমিরাতের ইসরাইল স্বার্থ রক্ষাকারী ভূমিকা।

রাষ্ট্র ভেঙে পড়লে কী হবে?
লেবানন রাষ্ট্রের পতন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি সার্বিক বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্যও ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। এ ক্ষেত্রে চারটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা দিতে পারে যার মধ্যে রয়েছে- প্রথমত, যখন কোনো দেশ ভেঙে যায়, তখন উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তাশূন্যতা দেখা দেয়। লেবানন ভেঙে গেলে সেখানে চরমপন্থার পুনরুত্থান ঘটতে পারে। বিশেষ করে দরিদ্র, অনুন্নত এবং চরমপন্থা প্রবণ উত্তর লেবাননে, ত্রিপোলি এবং আক্কার মতো এলাকায় এটি ঘটতে পারে। এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া হিজবুল্লাহ সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় পতনের আবহাওয়ার জন্য প্রস্তুত বলে মনে করা হয়। গোষ্ঠীর ক্ষমতার আধিপত্য রয়েছে এবং নিজস্ব নিরাপত্তা অবকাঠামো ও সামাজিক কল্যাণ নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করার ক্ষমতা রয়েছে। হিজবুল্লাহ ইতোমধ্যেই নিজের সম্প্রদায়কে পুরোপুরি ভেঙে পড়ার খারাপ প্রভাব থেকে রক্ষায় সম্ভাব্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে। গত এপ্রিলে হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত দোকানগুলোতে নিজস্ব সমর্থকদের ব্যবহারের জন্য রেশন কার্ড তৈরি করে দেয়। কিন্তু এর ফলে অন্যরা সঙ্কটে পড়ে যাবে। এতে অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য ভেঙে পড়বে।

তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের পতন একটি বড় বাস্তচ্যুতির সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। আনুমানিক ১৭ লাখ সিরীয় শরণার্থীসহ সব মিলিয়ে লেবানন বিশ্বে মাথাপিছু সর্বোচ্চ সংখ্যক শরণার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা করেছে। সিরিয়ার শরণার্থীরা ইতোমধ্যেই লেবাননে অনিশ্চিত জীবনযাপন করছে। লেবাননে সঙ্কট যত গভীর হচ্ছে, লেবাননের হোস্ট এবং সিরীয় শরণার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। সিরিয়ার শরণার্থীরা ক্রমবর্ধমান ‘বলির পাঁঠা’ এবং লেবাননে থাকতে অনিরাপদ বোধ করতে পারে। উপরন্তু, লেবাননের একটি ক্রমবর্ধমান সংখ্যা মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং আরো বেশি সংখ্যক লেবাননী সাইপ্রাসে বিপজ্জনক নৌকা ভ্রমণের চেষ্টা করছে। এটি সার্বিকভাবে ইউরোপমুখী প্রবাহ সৃষ্টি করতে পারে।

চতুর্থত, লেবাননে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা এই অঞ্চলে ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করতে পারে। ইসরাইলি কর্মকর্তারা সম্প্রতি লেবাননের ইসরাইলে বিশৃঙ্খলার সম্ভাব্য ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যদিও এ সঙ্কটের জন্য অনেকে দেশটিকে দায়ী করে। লেবাননের সঙ্কট সিরিয়ার অর্থনৈতিক মন্দার একটি প্রধান চালিকাশক্তি, যা ইতোমধ্যেই ভয়াবহ মানবিক অবস্থাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। লেবাননে রাষ্ট্রীয় পতন উগ্রপন্থী নেটওয়ার্ককে সহজতর করতে পারে।

উদ্যোগ নিতে হবে ওআইসিকে
লেবাননে স্থিতি ও শান্তি ফেরাতে ওআইসিকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। লেবানন ভেঙে পড়লে তা থেকে লাভ তুলবে ইসরাইল। ইসরাইল নিজের চারপাশে কোনো শক্তিশালী দেশ রাখতে চায় না। আশির দশকে ইনোন পরিকল্পনা নেয়ার পর থেকে একে একে শক্তিশালী রাষ্ট্র- ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনকে ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। সুদানকে ভাঙার পেছনে ভূমিকা রেখেছে দেশটি। এখন লেবাননকে ব্যর্থরাষ্ট্র হতে দিলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে তার নিরাপত্তা আশ্রয়ে টেনে নেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বহুদূর এগিয়ে যাবে। ফলে লেবাননকে ব্যর্থরাষ্ট্র হওয়া থেকে বাঁচাতে উদ্যোগ নিতে হবে ওআইসিকে।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিসিডিপি গঠন করা হবে : পরিবেশমন্ত্রী অননুমোদিত জমি ভরাট কার্যক্রমের সন্ধান পেলে দ্রুত ব্যবস্থার নির্দেশ ভূমিমন্ত্রীর ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা ইসরাইলকে পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাতের ব্যাপারে সতর্ক করলো আইআরজিসি সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ১২৮তম প্রয়াণ দিবসে স্মরণ সভা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের শূন্য পদ দ্রুত পূরণের নির্দেশ ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে ঝুলন্ত নারীর লাশ উদ্ধার মধুর প্রতিশোধে সিটিকে বিদায় করে সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ রাজশাহীতে ভুয়া তিন সেনা সদস্য গ্রেফতার ডেঙ্গুতে আরো একজনের মৃত্যু, আক্রান্ত ২৩

সকল