২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কানে কি পানি ঢুকেছে? মনে হচ্ছে!

-

এটা এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে, বাইডেনের আমেরিকা এবার আফগানিস্তান ছাড়তে মন বেঁধে ফেলেছে যদিও যাদের জানার তাদের জানা ছিল যে, বাইডেনের হাতে এ দেশ ছেড়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো বিকল্প শুধু না, ফেলে পালিয়ে যাবার এক বিরাট সুযোগ। আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা রিপাবলিকান কিংবা ডেমোক্র্যাট যাই হন, ২০০৫ সালের পর থেকে সবাই জেনে গিয়েছিলেন যে, ভুল হয়ে গেছে, পা দেবে গেছে, বিকল্প নেই। সবটাই লস। কিন্তু কিভাবে ফিরে আসবেন, কী করে ফিরে আসবেন এটাই জানা ছিল না। শেষে পাগলা আর গোঁয়াড় যে ট্রাম্প তিনি নির্ধারক সিদ্ধান্তে তালেবানদের সাথে চুক্তি করে ফেলেছিলেন আর বাইডেন খরচ কমানোর এই শেষ সুযোগটা ছাড়তে চাননি।

কিন্তু সারা দুনিয়াতেই দেখা গেছে রাজার চেয়ে রাজার বন্ধু-পারিষদেরাই সমস্যা। তারা রাজার স্টোর-টাঁকশালে কী আছে এর খবর না রেখে বোলচালের দুর্বুদ্ধি-হামবড়া করে গেছেন। এখানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কথিত উন্নত সাত-রাষ্ট্রের গ্রুপ ‘জি-৭’, এরা সেই বন্ধু-পারিষদ। নিজ মুরোদ নাই, বাইডেনের ঘাড়ে চড়তে গেছিলেন। তারা বাইডেনকে ৩১ আগস্টের পরেও আফগানিস্তানে থাকার ‘বুদ্ধি’ বের করতে বলেছিলেন। কিন্তু বাইডেন এসব ‘বাজে পরামর্শ’ ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন। লক্ষণীয়, পশ্চিমের একমাত্র প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সূত্রে বাইডেন ছাড়া এর বাইরে পশ্চিম বা ইউরোপের কারো সাথে তালেবানদের কোনো আলাপ-সম্পর্ক, কথা বা চুক্তি হয়নি। ইউরোপ বরং এটাকে সুবিধা হিসেবে নিয়েছে যে তালেবান-ইউরোপ কোনো চুক্তি নেই ফলে তাদের কোনো প্রত্যক্ষ দায়দায়িত্বও নাই। আর এই সুযোগে ইউরোপের বাইডেনের ঘাড়ে চড়তে চাওয়া!

দুনিয়ার কোনো রাজাই চিরকাল রাজা থাকেননি। গ্লোবাল নেতা আমেরিকাও অনন্তকাল নেতা থাকবেন না।

আঙ্কেল আমেরিকার সঙ্কট অর্থের টানাটানি। সেটি অস্বাভাবিক অবশ্য নয়। আফগানিস্তান ছেড়ে গিয়ে অর্থ সাশ্রয় করা ছোটখাটো অর্থ না। মূলত এ জন্যই তিনি এক সিদ্ধান্তে ফোকাসড। বক্তৃতা দিয়ে সোজা বলছেন- ‘কোনো অনুশোচনা নাই।’ কারণ খরচ কমিয়ে সরকার-দেশ কিছু বাঁচাতে পারলে বাপের নাম! পেন্টাগনের জেনারেলেরাও ৩১ আগস্টের পরে আফগানিস্তানে আরো কিছু দিন থেকে যাবার আবদার না করে বরং বাইডেনকে বিরাট সাপোর্ট দিয়েছেন। খরচের পরিমাণও বিশাল! আফগানিস্তানে আমেরিকার প্রতিদিনের গড়ে খরচ বলা হচ্ছে, ছিল ৩০০ মিলিয়ন ডলার এবং তা টানা ২০ বছর ধরে। ৩০০ মিলিয়ন ডলার মানে কত? এর একটা ধারণা দেয়া যাক। নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেশে যে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা শুরু হয়েছিল তখন প্রতিটা সরকার কামনা করত, প্রতি বছর (এখানে দিন নয়, বছরের কথা বলা হচ্ছে) প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার করে (তিন বছরে এক বিলিয়ন) আইএমএফ লোন পেলে সরকার চালানোটা আরামের হয় আমদানি ব্যয় মেটাতে টানাটানিতে চলতে হয় না।

কেউ প্রভাবশালী গ্লোবাল নেতা অথবা দেশ- কথাটার পেছনের অর্থ হলো যে, দেশের অর্থনীতিতে ঐকালে উদ্বৃত্ত সঞ্চয় সর্বাধিক। আমেরিকা এমন নেতা হিসেবে টানা পঁচাত্তর বছর ধরে দুনিয়ায় মাতব্বরি চালায়। অর্থাৎ সামরিক সক্ষমতা নয়, অর্থনৈতিক সক্ষমতাটাই কোনো রাষ্ট্রের গ্লোবাল নেতা বা পরাশক্তি হওয়া ও থাকার মূল চাবিকাঠি। কারণ অর্থনৈতিক সক্ষমতাটাই একবার হাতে এলে তখন সামরিক সক্ষমতা অর্জন হাতের মুঠোর জিনিস, মাত্র কয়েক বছরের ব্যাপার হয়ে যায়।

এই কথাটাই অনেকে সহজে মানতে বা বুঝতে চায় না। আপনি আমি আমেরিকা বা ব্রিটেনের ভক্ত হতেই পারি, কেউ কেউ শেষ জীবনে সেখানে সেটেলড হবার কথা ও সামর্থ্য থাকলে ভাবতে পারি। মানে নিজ ব্যক্তিস্বার্থ ওর মধ্যে দেখতেই পারি। কিন্তু তাই বলে কেউ যখন কোনো দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার উত্থানের সাথে ওর গ্লোবাল নেতৃত্বে উত্থান বা পতন সম্পর্কিত এটা সে দেখতে পাচ্ছে, অথবা নির্দেশ করে দেখায়- কিন্তু তা বলে এর মানে, সে আমেরিকাবিরোধী বা সে চীনভক্ত তা বুঝায় না। তাই এমন ট্যাগ লাগিয়ে বুঝাবুঝির চেষ্টা অর্থহীন। আবহাওয়ার পূর্বাভাসদাতা তো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস আনার কর্তা নন!

তবে আফগানিস্তানে ক্ষমতায় পরিবর্তন এবার অনেককেই ‘ন্যাংটা’ করে দিয়েছে; অনেক মিথ্যা স্বীকার করিয়ে ছাড়ছে।
আত্মসমালোচনা বা রিভিউ যা আমেরিকা বহু দিন দেখেনি তা এবার কেঁপে কেঁপে বাইরে বের হয়ে আসছে। এমনই এক রচনা প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকান ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে। মূলত এটা দ্বিমাসিক ম্যাগাজিন। কিন্তু প্রবল প্রতিযোগিতার এই কালে তাতে আটকে থাকতে পারছে না। তাই দ্বিমাসিকের বাইরে, এখন প্রতিদিন অনলাইনে বাড়তি এটা ডেইলি ব্রিফিং পাঠাচ্ছে। মানে পুরানা কাস্টমার হিসেবে প্রতিদিন একটা আর্টিকেল ফ্রি পড়তে পাচ্ছি। বলাই বাহুল্য, এটা এক এলিট পত্রিকা। প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯২২ সালে এটা প্রথম প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। আমেরিকার সবচেয়ে বড় ভালো গুণ হলো, দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা থিংকট্যাংক নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান খুলে চালিয়ে থাকে। আর এর মাধ্যমে একটা নীতি-পলিসির পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক জনমত তৈরির প্রক্রিয়া সমাজে জারি রাখে। তেমনি এক প্রতিষ্ঠান হলো কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর)। এরাই ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ ম্যাগাজিনের প্রকাশক। দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে যারা বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের আমলে মন্ত্রী (সেক্রেটারি অব স্টেট) বা ডেপুটি ছিলেন তারাই আমেরিকার ফরেন পলিসি বিষয়ে এখানে লিখে থাকেন। এখানে এখন যার লেখার কথা তুলব তিনি- বেন রোডস। ওবামা আমলে ওই প্রশাসনে তিনি ডেপুটি-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন।

তার লেখার ছোট শিরোনাম তিনি দিয়েছেন- ‘ওরা আর আমরা।’ আর ‘কী করে আমেরিকা নিজ-শত্রুর হাতে তারই ফরেন পলিসি হাইজ্যাক হতে দিয়েছে’- এই ছিল ওর বড় শিরোনাম। এরপর তিনি লিখতে শুরু করেছেন, ‘নাইন-ইলেভেন বা টুইন-টাওয়ার হামলার ঘটনার চেয়ে বেশি একুশ শতকের আর কোনো ঘটনা আমেরিকাকে এত আকার দেয়নি ও এর ভ‚মিকা ঠিক করে দেয়নি।

কোল্ড ওয়ার-পরবর্তী যুগে (সোভিয়েত- ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় আমেরিকাই একক পরাশক্তি ভেবে) আমাদের মধ্যে যে সন্তুষ্টি ভাব তৈরি হয়েছিল এই আক্রমণ তাকে একেবারেই ফুটা করে দিয়ে যায়। সাথে আমাদের মধ্যে ‘আমেরিকার নেতৃত্বের এক গ্লোবালাইজেশনের বিজয়ের ভেতর দিয়েই ইতিহাস শেষ হবে’ বলে যে মিথ্যা ধারণা তৈরি হয়েছিল তাও ভেঙে তছনছ করে দিয়ে গেছে।

‘ওয়ার অন টেরর’ বলতে আমেরিকার সরকারের কাজের ধরন, মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতি এমনকি মানুষের প্রতিদিনের জীবনে যেমন- ভ্রমণ, ব্যাংকের কাজ বা আইডেনটিটি-সংশ্লিষ্ট যেকোনো ইস্যুতে সবার জীবন একেবারেই বদলে গিয়েছিল। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, ফিলিপাইন, সোমালিয়া, ইয়েমেনসহ অনেক রাষ্ট্রের ওপর আমেরিকা সামরিক শক্তি ব্যবহার করেছিল। বিভিন্ন দেশের সাথে ওয়াশিংটনের দ্বিপক্ষী ও বহুপক্ষীয় সম্পর্কের উপরে টেররিজম সবক্ষেত্রে এক মুখ্য ইস্যু হয়ে থেকেছিল। ‘৯/১১’-এর পরে প্রেসিডেন্ট বুশ আমেরিকান পরিচয়কে সংহত করে নয়া প্রজন্মের লড়াইকে সামরিক নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এই যুগের লড়াই ফ্যাসিজম ও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই হিসাবে চলবে।

অর্থাৎ বেন রোডস এখানে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, সোভিয়েত পতনের পরে আমেরিকার একক পরাশক্তি ভাব ও অহংকার এসেছিল যা ভেঙে চূরমার করে দেয় ৯/১১-এর হামলা। পরিণতিতে বুশ ক্ষোভে ফ্যাসিজম ও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা তুলে বিভিন্ন দেশে সামরিক হস্তক্ষেপে সরকার দখল (বাংলাদেশের ‘১/১১’-এর ক্ষমতা দখল যেমন) যাকে খুশি ক্ষমতায় আনা এবং ইচ্ছামতো এর ধরনও বদলে দেয়ার মতো উন্মত্ততায় কাজে নেমে পড়েছিলেন।

তাই এবার স্বীকার করে বলছেন, ‘গ্লোবাল ওই যুদ্ধকে ঠেকানো দুঃসাধ্য ছিল হয়তো; তবে তা আমেরিকার জন্য অনাকাক্সিক্ষত সব পরিণতি ডেকে এনেছিল। আমেরিকা সরকার শিগগিরই তার ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করে সার্ভিলেন্স, ডিটেনশন ও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিল। আলকায়েদা উৎখাতে লক্ষ্য ছাড়িয়ে গেছে আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাকের যুদ্ধ।’

‘‘সামরিক হস্তক্ষেপে সরকার বদলানোর ‘রেজিম চেঞ্জ’- এটা দেশে ও বিদেশে আমেরিকান গণতন্ত্রের হাল খেয়াল করেনি। যেসব বিজয় অর্জনের কথা প্রেসিডেন্ট বুশ অর্জিত হবে বলে দাবি করেছেন যা রক্ষণশীল গোষ্ঠীর মিডিয়া নিরন্তর প্রচার করেছে, তা কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে তা সরকারের ওপর আমেরিকার আস্থা নষ্ট করে আর তাতে নতুন করে অভ্যন্তরীণ অজুহাত খুঁজতে থাকে।’’

এর পরের অংশটা সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং। বেন রোডস এবার ট্রাম্পের মতো চরিত্রের উত্থান কেন তা ব্যাখ্যায় গিয়ে বলছেন, ‘৯/১১ পরবর্তী-যুগের আমেরিকা যে জিঙ্গোইস্ট ন্যাশনালিজম দেখেছিল তা আসলে মূলত মানুষের মনের এক অজানা শঙ্কা আর বিদেশভীতির ককটেল, যা থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প নামে এই প্রেসিডেন্টের জন্ম দিয়েছিল। ট্রাম্প আসলে বাকচাতুরিতে দেশের ভিতর শত্রুর ইঙ্গিত করে তাদের উপর দায় চাপিয়ে গেছেন।’

বেন রোডস-এর এই শেষাংশটা তাদের দুই দলের কামড়াকামড়ি তাই এতে জড়ানো আমাদের কোনো কাজ নয়। তবে এরপর রোডস বাইডেনের পক্ষে ঢোল পিটিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন এইবার বাইডেন আফগানিস্তান থেকে গুটিয়ে সমস্ত শক্তি চীনের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় ব্যবহার করবেন, দুনিয়ায় আমেরিকার হাজির থাকার লক্ষ্য দুনিয়াকে দেখাবেন।

সরি বেন রোডস! আমরা একটুও নড়লাম না, আপনি আমাদের ন্যূনতম আকৃষ্ট করতে পারেননি বলে। এখানে বেন রোডসের দেয়া ২০ বছরের যুদ্ধের খতিয়ানে তিনি বলেছেন, মোট খরচ (দুই ট্রিলিয়ন নয়) নাকি সাত ট্রিলিয়ন ডলার। আর আফগানিস্তান ও ইরাকে মৃত মোট সার্ভিস মেম্বার বলছেন (দুই হাজার নয়) সাত হাজার। তবে তারা এই খরচ বেশি আর কম দেখাক তাতে এতে বাইডেন সরকারের আয় বাড়বে না। এটাই মূল কথা।

তা ছাড়া, বিয়ে শেষ হয়ে যাবার পরে ব্যান্ড পার্টির মধুর সুরও কারোই ভালো লাগবে না। যেমন ধরুন আফগানিস্তান এবং এরপরে পরেই ইরাক থেকে আমেরিকা ও ন্যাটোর প্রত্যাহারের পর সেন্ট্রাল এশিয়া, ইরান, মধ্যপ্রাচ্যসহ (সাউথ চায়না সি এলাকা আর ভারত বাদে) বাইডেনের আমেরিকা এশিয়ায় আর কোথাও নেই। আর সাউথ চায়না সি-তে ওবামার আমলেই তার ‘পিভোট এশিয়া’ পলিসি ফেল করার পর থেকে ওখানে কিছুই আর জাগেনি। সবমিলিয়ে গত পঁচাত্তর বছরের আমেরিকা কখনো এভাবে এশিয়া থেকে উৎখাত হয়নি।

মূল যে কথাটা, তা হলো, আফগানিস্তান থেকে বাইডেন ফিরে গেলে আমেরিকান অর্থনীতিতে সারপ্লাস অ্যাকুমুলেশন বা উদ্বৃত্ত সঞ্চয় বেড়ে যাবার কোনো ঘটনা তো সেটি নয়, তাই সেটি ঘটবে না। ফলে এতে আমেরিকার চীনের সাথে অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রশ্নে আমেরিকার প্রতিযোগী হয়ে ওঠার বাড়তি কোনো কারণ নেই, ঘটনাই নয় তাই। আসলে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য নাকি কখনো ডুববে না বলে গর্ব করত যে ব্রিটিশরা, তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে একচ্ছত্র বিজয়ী আমেরিকার সামনে কেন আর কখনো আসেনি? কারণ সবকিছু ফিরে আসে না! ব্লোয়ারকে কেন বুশের ছোট-তরফের মিথ্যাবাদী গুণ্ডা-রংবাজই হতে হয়?

আবার আমরা লক্ষ করেছি, বেন রোডস নিজ-পরিচয়ে বলেছেন তিনি ওবামার দুই টার্মেই ডেপুটি মন্ত্রী ছিলেন। অথচ তিনি আমেরিকার যেসব দেশে গিয়ে আমেরিকার সামরিক হস্তক্ষেপে সে দেশের সরকার ফেলানোর হিসাব দিয়েছেন- ইরাকের সাদ্দাম, লিবিয়ার গাদ্দাফি, সিরিয়ার আসাদ (ব্যর্থ) ইত্যাদি এসব অন্যায় তো বুশের দায় নয়। এটা তো ‘ভিজা বেড়াল’ ওবামা-হিলারির ‘মহান’ কাজ। তাদের অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে বেনগাজির আমেরিকান রাষ্ট্রদূতসহ সব স্টাফ নিহত হয়েছেন। আর এ নিয়ে সিনেটে-কংগ্রেসে কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছেন হিলারি। আর এখান থেকেই নতুন নামে ‘আইএসের’ উত্থান ঘটেছিল। এই উত্থানে ওবামা-হিলারির দায় আছে। সবকিছু বুশের উপর চাপিয়ে ডেমোক্র্যাটরা হাত ধুয়ে ফেলতে চাইলে কী হবে? ওয়ার অন টেররে ২০ বছরে আমেরিকার দুই পার্টির কারো অবদান কি কম?

এ দুই পার্টির সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো- আমেরিকার চোখে দুনিয়ার মুসলমান মানেই তারা আমেরিকার সম্ভাব্য এনিমি- এই মনোভাবে সেই থেকে পরিচালিত হতে শুরু করা। অথচ এই অ্যাটিচুড নেয়া, আমেরিকান কনস্টিটিউশন ও আইনেরই বরখেলাপ। টুইন টাওয়ারে হামলা চালায় যারা এমন মোট ১৯ জনের ১৫ জন সৌদি, দু’জন দুবাই, একজন লেবানন ও একজন মিসরের ছিল। অর্থাৎ কেউ আফগানি নয়। তাহলে ওই হামলার অজুহাতে সারা আফগানিস্তানে হামলা ও দখল করা কেন? এমনকি, চাইলে যারা বা যেসব গ্রুপ জড়িত কেবল তাদের পুরোটাকেই উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা আমেরিকার ছিল; কিন্তু তা না করে একটা সর্বাত্মক ও লাগাতার যুদ্ধ যাওয়া কেন? এই প্রশ্ন উঠেছিল সেকালেই এবং আমেরিকার ভিতর থেকেই। এর জবাব দেয়া হয়নি, কারণ জবাব ছিল না।

আবার টুইন টাওয়ারে হামলাকারীরা মুসলমান তাই মুসলমানমাত্রই ‘আমেরিকান হোমল্যান্ড সিকুরিটি’ তাদের ধরে এনে শাস্তি দেয়া বা সন্দেহ করা, রিমান্ডে এনে টর্চার করা কেন? এটা তো আমেরিকান কনস্টিটিউশন ও আইনেরই বরখেলাপ। এছাড়া এই চিন্তা গোত্রবাদী, সঙ্কীর্ণ ট্রাইবাল চিন্তা। আমেরিকান রাষ্ট্রেরই এই কাজের এখতিয়ার নেই। এটা কোনো চুরির জন্য চোরের বাপ-মাকে ধরে এনে শাস্তি দেয়ার মতো।

এখানেই শেষ নয়। এর পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। দুনিয়া দুই ভাগ হয়ে গেছে। আপনি মুসলমান-মুক্ত আমেরিকা কায়েম করতে চাওয়ার পথে নেমে যাওয়া মানে, আপনি উসকালেন যেন এখন মুসলমানরা পাল্টা পশ্চিমা বা আমেরিকান-ছাড়া নিজেদের দুনিয়া কায়েমের রাস্তায় যায়। এখন এতে আপনি অবশ্যই দেখাতে পারবেন যে, মুসলমানেরা কত খারাপ, তাদের চিন্তা সঙ্কীর্ণ, তারাই কারো সাথে থাকতে পারে না, চায় না, ইনক্লুসিভ না ইত্যাদি বহু কিছু! কিন্তু দুনিয়া তো আগেই ভাগ করে ফেলেছেন! এর কী হবে? মুসলমানেরা নতুন আফগানিস্তানে আমেরিকানদের নেবে না, দেখতে চায় না-এমন একটা দুনিয়া এখন তাদের কল্পনায় হাজির হয়েছে। এখন এর কী সমাধা করবেন?

জানি, আমেরিকান-মুক্ত নতুন আফগানিস্তান কিংবা বাংলাদেশ-এসব একেবারেই অবাস্তব এবং চরম রাগ-ক্ষোভের প্রকাশ! অত্যাচার, নির্যাতন অপমান ‘রেনডিশন’ ... ইত্যাদি এসব কি সহজে মুছে যাবে...। পরাশক্তির বড়াই? বেন রোডস, আপনি নিজেই বলছেন, লাদেন নয়, তাকে ছাড়িয়ে বুশ ও তার বন্ধুদের ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে ইত্যাদি...।

তাহলে আবার মিথ্যা আশ্বাসের কথা কেন বলছেন? কেন বলছেন, বাইডেন আমেরিকাকে চীনের প্রতিদ্ব›দ্বী করে আবার হাজির ও যোগ্য করে হাজির করতে পারবেন? সমস্যা তো চীনের সাথে প্রতিযোগিতা নয়। দুনিয়ার দ্বিবিভাগ – আমেরিকান ছাড়া মুসলমানের দুনিয়ার কল্পনা হাজির হয়ে গেছে, এর সমাধান কী? মুরোদ দেখান। সবার আগে নিজেদের এক্ট আবার ফিরে চেক করেন, পুনঃমূল্যায়ন করেন। কোথায় ভুল হয়েছে, উপলব্ধি ও স্বীকার করেনিন। এসব ছোট ছোট কিন্তু পাওয়ারফুল পদক্ষেপ ছাড়া মুসলমান বা ইসলাম ইস্যু আমেরিকার পিছু ছাড়বে না। আপনি ভান করতে পারেন যে, আফগানিস্তান বা ইরাক ছেড়ে এসেছেন মানে সব পাপ ধুয়ে গেছে। না, তা একবিন্ধু যাবে না। অন্তত অপরাধী মন নিজেই নিজেকে তাড়া করে ফিরবে! ইতোমধ্যে পশ্চিম বা আমেরিকার বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটা অনেক কর্নার থেকে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়েছে। তা নিশ্চয় আমেরিকার জন্য ভালো কিছু নয়।

আমেরিকা গ্লোবাল নেতা আর না থাকলে কী? সেই আমেরিকার এর পরেও দুনিয়াকে বহুকিছু দেবার যোগ্যতা থাকবে। এখনো লন্ডন বা প্যারিস বহু মানুষকে সেটেলমেন্টের শহর হিসেবে আকৃষ্ট করে। ফলে এসব কোনো বড় ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু মানুষের দ্বিবিভাগ! আমেরিকা-মুক্ত মুসলমান অথবা মুসলমান-মুক্ত আমেরিকা? এটা মানুষের জন্য কোনো ভালো বার্তা নয়! আপনি শাহরুখ খান হলেও বা এক সাধারণ এশিয়ান মুসলমান হলেও আপনাকে ইমিগ্রেশনে অপমানজনকভাবে আটকে থাকতে হতে পারে। আফগানিস্তান বা ইরাক বাইডেন ছেড়ে গেলেও এসব বিভক্তির শেষ হবে না!

অথচ এই বিভক্তি দূর করা, চীনের ওপর প্রতিযোগিতায় বাইডেনের বিজয়ী হওয়ার চেয়েও অনেক বড় ও গুরুত্বপুর্ণ কাজ! 

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement