২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন প্রসঙ্গে

-

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক খবরে জানা যায়, সংসদীয় কমিটির সুপারিশক্রমে এ লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একজন সদস্যকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটি ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন বা পরিমার্জন এবং যুগোপযোগী করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ-১৯৯২’ এর মাধ্যমে ১৯৯২ সালে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। ২০১০ সালে ওই আইন সংশোধন করা হয়। জানা যাচ্ছে, নতুন আইনে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগ দেবে এবং বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্য সংখ্যা বর্তমানের ন্যূনতম ৯ জন থেকে বাড়িয়ে ১৫ জন করা হবে। এদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন বা ৩৩ শতাংশ শিক্ষাবিদ থাকবেন। এ যাবৎকাল উপরোক্ত তিন নিয়োগের ক্ষেত্রে বিওটি প্রস্তাব পাঠাত এবং সরকার অনুমোদন দিত। নতুন আইন হলে বিওটির হাতে ওই ক্ষমতা থাকবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এসব কিছু সরকারই করবে।

এর আগে কয়েকটি লেখায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯২ সালের অধ্যাদেশে অনেক ঘাটতি ছিল। তখন দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী যারা সীমিত আসনের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পেত না, তারা বিদেশমুখী হয়ে পড়ে। বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এরা ভিড় করত। এমনও শোনা যায় তখন প্রায় ৫০ হাজার ছাত্র বিদেশে পড়াশোনার জন্য গেছে। শিক্ষার্থীদের এই বিদেশমুখিতা ঠেকাতেই মূলত অধ্যাদেশটি করা হয়েছিল। এর সুফলও পাওয়া যায় কয়েক বছরের মধ্যে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর আমাদের শিক্ষার্থীরা বিদেশে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে দেশেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণে মনোযোগী হয়। তা ছাড়া তখন ছেলেরা বিদেশে পড়তে যেতে পারলেও সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে আমাদের মেধাবী মেয়েরা সেটি পারত না। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবির প্রতি সাড়া দিয়ে সরকার অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে। এ দেশে মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানও অনেক ভালো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণে আওয়ামী লীগ সরকার ভালো ভূমিকা রাখে। ২০১০ সালে আরো বিস্তারিত আইন প্রণয়ন করা হয়। আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর ভিসির দায়িত্ব পালন করার সুবাদে দেখেছি এ আইনের প্রায় সব ধারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশের সাথে সম্পৃক্ত। বিওটি, সিন্ডিকেট, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, শিক্ষক নির্বাচন কমিটি, বিভাগ, অনুষদ সব কিছুই এ আইনের আওতায় আছে। ভিসির কী কাজ, সিন্ডিকেটের পরিধি কেমন হবে, প্রো-ভিসি, ট্রেজারারসহ সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য সুন্দরভাবে ২০১০ সালের আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। সার্বিক বিচারে এ আইনকে অনেকটা পূর্ণাঙ্গ বলতে হবে। এর পরও সময়ের পরিবর্তনে আইনও পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা প্রয়োজন হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ধারণাটি এমন ছিল- যেসব বেসরকারি উদ্যোক্তা শিক্ষার বিস্তারে ভূমিকা রাখতে চান, তারা যেন এগিয়ে আসেন। শুরু থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আইন প্রণয়ন ছাড়া সরকারের আর কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। আইনে বলা আছে, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ মেট্রোপলিটন সিটিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হলে ন্যূনতম তিন বিঘা বা এক একর জায়গা লাগবে। আর ঢাকার বাইরে হলে দুই একর জায়গা থাকতে হবে। ঢাকা শহরে তিন বিঘা জায়গা পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি ব্যয়বহুল। এখন দেশে ১০৭টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে এবং এগুলোতে প্রায় চার লাখ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। বেশ কয়েকটি অত্যন্ত সুনামের সাথে শিক্ষা দিচ্ছে। এগুলোর শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছে। শিক্ষার্থীরা ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে বিদেশে গিয়েও পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে। বিগত তিন দশকে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক অবদান রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে জানি বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ রয়েছে এবং সেখান থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীরা দেশের ওষুধ শিল্পের বিকাশে ভালো ভূমিকা রাখছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা বিস্তারে সরকারকে যে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা করছে, এগুলো না থাকলে সরকার সেটি পেত না।

যারা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা নিজেরাই জায়গা কিনছেন, ভবন তৈরি করছেন। সেখানে তাদের ভিসি থেকে শুরু করে লেকচারার পর্যন্ত নিয়োগ দিতে হচ্ছে। তাদের পকেটের পয়সা খরচ করেই সব কিছু করতে হয়েছে। এরপর হয়তো ছাত্রদের বেতন থেকে বিভিন্ন ব্যয় মেটানোর সুযোগ তারা পাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে খুব বেশি বেতন নেয়া হচ্ছে সেটিও কিন্তু আমার কাছে মনে হয়নি। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন আমার কাছে সহনীয় পর্যায়ে বলে মনে হয়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা বলতে গেলে একরকম বিনা মূল্যে পড়ারও সুযোগ পাচ্ছে। সরকারের নিয়ম অনুযায়ী গরিব মেধাবী ছাত্রদের জন্য ৩ শতাংশ কোটা আছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটাও রয়েছে।

বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের মূল কাজ হলো শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করা। ইউজিসির মাধ্যমে সরকার কাজটি করে থাকে। ‘গুণগতমান নিশ্চিতকরণ’ কমিটি রয়েছে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে সরকারের। বর্তমান আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বোর্ড অব ট্রাস্ট বা বিওটি ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারারের নাম প্রস্তাব করে এবং সরকার তাতে অনুমোদন দেয়। এখানে বিওটি অনেকটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের ভূমিকা রাখে। কারা ভিসি হতে পারবেন, সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে বলা আছে, ১০ বছরের শিক্ষকতা ও শিক্ষকতাসহ প্রশাসনিক ও গবেষণা ক্ষেত্রে মোট ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আর শিক্ষা ক্ষেত্রে স্মাতক ও স্মাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণী থাকতে হবে অথবা পিএইচডি থাকতে হবে। এখানে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে যোগ্যতাকে নির্দিষ্টকরণ করা হয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনেট থেকে নাম পাঠানো হলেও সরকার যাকে ভালো মনে করছে, তাকে নিয়োগ দিচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে আইনের মাধ্যমে এ নিয়োগকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। প্রো-ভিসি, ট্রেজারারের ক্ষেত্রেও যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এমনটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। সেখানে সিনেট যদি সদ্য প্রফেসর হওয়া কাউকে এমন কোনো পদে মনোনয়ন দেয়, তা হলে সরকার তাকে নিয়োগ দিতে পারে। সিনেটের অনুমোদন না পাওয়া গেলে সরকার চাইলে অস্থায়ী ভিত্তিতেও কাউকে নিয়োগ দিতে পারে। সেখানে ভিসি হওয়ার জন্য সিনিয়র-মোস্ট টিচার হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে নাম গেলে তিনি তাকে নিয়োগ দিতে পারেন। ২০১০ সালের আইনের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও নিয়ন্ত্রিত। এখান থেকে পাঠানো নামের কাউকে সরকার নাও নিয়োগ দিতে পারে। আবার নাম পাঠাতে বলতে পারে; অর্থাৎ বর্তমান আইনে সরকারি বা বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদগুলোতে সরকারের পছন্দের বাইরে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। ২০১২ সালে যখন মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হই তখন বিওটি তিনজনের নাম প্রস্তাব করে। সেখানে আমার নাম ১ নম্বরে ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাতেই সায় দেন এবং রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করেন। ২০১৬ সালে চলে আসার পর তিনবার পাঠানো নাম প্রত্যাখ্যান করা হয়। চতুর্থবার পাঠানো প্রস্তাব থেকে ভিসি নিয়োগ করা হয়। এখনো সরকারের পছন্দের লোক নিয়োগ পাচ্ছে কিছুটা পরোক্ষভাবে। এর পরও যদি আইন সংশোধন করা হয়, তা হলে বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আর কী পার্থক্য থাকল?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হলো সিন্ডিকেট। ভিসি থাকাকালে দেখেছি এর ১২ জন সদস্যের মধ্যে ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার সরকারের অনুমোদনে হচ্ছে। সরকার থেকে নমিনেট করা একজন শিক্ষাবিদ থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও একজন সদস্য থাকেন। ফলে ১২ জনের মধ্যে পাঁচজনই সরকারের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তি। তা হলে এর ওপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকছে। শিক্ষক নিয়োগের জন্য যে সিলেকশন কমিটি রয়েছে, সেখানেও সরকারের নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে আমার সময়ে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন খুবই সক্রিয়। কমিশনের সদস্যরা নিয়মিত পরিদর্শন করেন। শিক্ষার মান রক্ষিত হচ্ছে কি না, সেটি দেখার চেষ্টা করেন। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা দেখা হচ্ছে কি না, সেটি যাচাই করেন। এ ক্ষেত্রে নিয়ম ভাঙার সুযোগ নেই। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বরং তালিকার শীর্ষস্থান অধিকারীকে বাদ দিয়ে অনেক নিচের কাউকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। সব ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণী রয়েছে এমন প্রার্থীকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী আছে এমন কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর পরও যদি সরকার সরাসরি ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার নিয়োগ দেয়, তা হলে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ‘ফ্লেভার’ আছে, সেটুকুও থাকবে না। শিক্ষাবিদ নিয়োগ দিলে বিওটির নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি সরকারের হাতে চলে যাবে। তা হলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা কেন এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেবেন? শিক্ষার মানের প্রশ্নটি উঠতে পারে। সরকার চাইলে যেকোনোভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিএইচডি দিতে পারে না। এখানে গবেষণার সুযোগ নেই। মাস্টার্স পর্যায়ে যে গবেষণা হয় তা খুবই সীমিত আকারে। গবেষণা মূলত পিএইচডি পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা করে থাকে। এ জন্য টাকা দরকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের কাছ থেকে কোনো তহবিল পায় না। ছাত্রদের বেতন থেকে সব খরচ মিটিয়ে গবেষণা করার জন্য তহবিল জোগানো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে সম্ভব নয়।

ফলে যে নতুন আইন করার কথা উঠেছে, তা নিয়ে সরকারের আরো চিন্তাভাবনা করা উচিত। সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নামে যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে নিরুৎসাহিত করা হয়, তা হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পিছিয়ে পড়বে। তখন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন প্রতিষ্ঠিত হবে না, তেমনি যেগুলো আছে সেগুলো থেকেও উদ্যোক্তারা ধীরে ধীরে সরে আসবে। বলা হয় যে বিওটির মধ্যে আত্মীয়স্বজন আছে; সেটি নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য অসম্ভব নয়। বর্তমানে বিওটির সদস্য সংখ্যা ৯ থেকে ২১ জন হতে পারে। এটি কমিয়ে ১৫ জন করা যায়। সরকার যদি মনে করে বিওটিতে পাঁচজন শিক্ষাবিদ থাকতে হবে, তা হলে শিক্ষাবিদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া হোক। তখন উদ্যোক্তারাই ঠিক করবেন কাদের তারা বিওটিতে নেবেন। আত্মীয়স্বজনের যে প্রসঙ্গ এসেছে, সেটিও নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সরকার বলতে পারে এদের সংখ্যা তিনজনের বেশি হবে না। তা হলে বিওটি একটি মানের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। ভিসি এখন যেভাবে নিয়োগ হচ্ছে সেভাবে চলতে পারে। কারণ এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। বর্তমান আইন অনুযায়ী ভিসি হলেন প্রধান নির্বাহী। ভিসি যা চান, তাই হয়। সরকার যদি ভিসি নিয়োগ পুরোপুরি নিজের হাতে নেয়, তা হলে তখন উদ্যোক্তারা যা চাইবেন তা নাও হতে পারে। আমি বলতে চাচ্ছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখন সরকারের যে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেটি প্রত্যক্ষ করা হলে বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষার বিস্তার বাধাগ্রস্ত হতে পারে। উপরন্তু ২০১৭ সালে অ্যাক্রেডিটেশন দেয়ার জন্য কাউন্সিল আইন করা হয়।

তাই বর্তমান আইনে বড় কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি হতে পারে, যেমন ডিসিপ্লিনারি কমিটি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ কমিটি ছাত্র-শিক্ষক যে কারো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেখানে বিওটির একজন সদস্য সভাপতি ও ভিসি সদস্য হিসেবে থাকেন। এটি পরিবর্তন করা উচিত। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি সবসময় এ কমিটির চেয়ারম্যান হন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক বিষয়ে অনিয়ম হচ্ছে বলে সরকার সন্দেহ করছে। বর্তমান আইনে এখানকার ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান হন বিওটির একজন সদস্য। আমি মনে করি এ কমিটির চেয়ারম্যান ভিসি বা ট্রেজারারকে করা যেতে পারে। বোর্ডের সদস্যরা কমিটিতে থাকবেন। তখন কমিটি আরো ভারসাম্যপূর্ণ হবে। ভিসি বা ট্রেজারারের হাতে এ কমিটির নিয়ন্ত্রণ থাকলে সেটি পরোক্ষভাবে সরকারের হাতেই থাকল।

অনেক পরিশ্রম, অর্থ ব্যয় ও কষ্ট করে কিছু উদ্যোক্তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তারাই সাধারণত বিওটির সদস্য থাকেন। নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে তারা যে পরিশ্রম করে ও অর্থ ব্যয় করে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নিয়ে সেটি পোষানো যায় না। এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের ওয়াক্ফ বা এনডাওমেন্ট ফান্ডের মতো বিষয়ে পরিণত হয়। কারো কারো মধ্যে ব্যবসায়িক মনোভাব থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু সেটি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সরকার করতে পারে। আমি মনে করি সরকারকে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ঠিক আছে কি না, সেটি নিয়ন্ত্রণকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকের মান ঠিক আছে কি না, শিক্ষা উপকরণ ঠিক আছে কি না, শিক্ষার পরিবেশ ঠিক আছে কি না সেগুলোর প্রতি বেশি নজর দেয়া উচিত। সরকার যদি এখানে গবেষণার জন্য তহবিল দেয়, আরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা দেয় তখন বরং উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবে। সরকার যদি মনে করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকা দরকার, এখানে লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে, এরা বাইরে না গিয়ে দেশে পড়াশোনা করে আমাদের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে, তা হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের মতো করে চলতে দেয়া উচিত। সরকার কোনো দায়িত্ব নেবে না কিন্তু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করবে এটি কোনো অবস্থাতে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করি না।

লেখক : ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স এবং সাবেক ডিন ও অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মেইল : cmhasan@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement