২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

যে আপনার উৎখাত চায় তার ভাষায় কী কথা?

যে আপনার উৎখাত চায় তার ভাষায় কী কথা? -

সব ভেঙে গেছে, ভেঙে পড়ছে। খসে খসে পড়ছে, এক এক করে! আমেরিকান ক্ষমতার সাজানো বাগান। আর লুকানো যাচ্ছে না। শুধু আমার কথা নয় এটা। কোনো বড় শক্তি এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে কি না কখনো এর প্রধান লক্ষণ হয় সাধারণত যখন দেশের অভ্যন্তরীণ সব বিরোধ-মতান্তর উদাম হয়ে যায়। অসংখ্য বিভক্তি প্রকাশ্যে চলে আসে। আর সবচেয়ে বড় লক্ষণ হাজির হয়, সবার গভীরভাবে হতাশ হয়ে পড়া। তাই এখন আফগান-রিলেটেড প্রায় সবাই হতাশায় হাত-পা ছুড়ছে। কে যে কাকে গালাগাল করছে তার কোনো তাল-ঠিকানা নেই। অনেক সময় রাগে ক্ষোভে বা গভীর হতাশায় অথবা নিজেদের আর ভবিষ্যৎ নেই দেখে ফেললে- বড় মানুষও শিশুদের মতো আচরণ শুরু করে; নিজের বাবা-মাকেই গালাগালি শুরু করে; তেমন অবস্থা যেন। কোন ঘটনাটা এত প্রভাব ফেলেছে, কী হয়েছে? আফগানিস্তানে তালেবান ২.০ এর উত্থান ঘটেছে! এরই প্রতিক্রিয়া এগুলো?

রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশ (২০০১-০৯) থেকে শুরু করি। তিনি আফগানিস্তান ও ইরাকে মিথ্যা অভিযোগে হানাদার দখলদারির প্রধান নায়ক। তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বকাবকি শুরু করছিলেন গত মাস থেকেই যে বকাবকিটা ১৫ আগস্টের পরে আবার শুরু করেছেন। বুশের অবস্থান হলো, তিনি আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের একেবারেই বিপক্ষে। তিনি আফগানিস্তান ছাড়তে চান না। কেন? কী যুক্তি তার? তিনি গত মাসে জুলাইয়ে জার্মান ডয়েচে ভেলে’কে বলেছেন, সেনা প্রত্যাহার এক ‘ভুল কাজ’ (মিসটেক)। তিনি আরো বলেন, ‘আফগান নারী ও মেয়েদের বর্ণনাতীত কষ্টের কথা ভেবে আমি উদ্বিগ্ন।’ আচ্ছা তার মানে কি তিনি আফগান নারীদের দুর্দশামুক্তি দিতেই আফগানিস্তান দখল করেছিলেন? তাই কী? না, তা কেউ বলছে না, তিনিও তা দাবি করছেন না। তা হলে, এমন ভুয়া উদ্বিগ্ন কেন তিনি?

বিশাল কারণটা হলো, আমেরিকা আফগানিস্তানে ও ইরাকে জাতিসঙ্ঘের চোখে হানাদার ও দখলদার বাহিনী, আর এই কাজের প্রধান নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ও কর্তা তিনি নিজেই। বুশের এই লিগ্যাল স্ট্যাটাস লজ্জাজনক এটা তিনি জানেন। একবার জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান তা পাবলিকলি উচ্চারণ করেছিলেন। তাই বুশ জানেন, বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে আমেরিকায় এখন প্রশ্ন উঠবে যে আমেরিকার তাহলে লাভ হলো কী? ২০ বছরে মার খেয়ে? দুই ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এবং সবাই প্রেসিডেন্ট বুশের বিরুদ্ধে আঙুল তুলবে? তাই অন্য কারো তাকে বিব্রত করে ফেলার আগেই তার ভান হলো, নারীর জন্য ‘প্রাণ কান্দা’। এ জন্যই তার মুখরক্ষার বয়ান-দর্শন ‘নারী-দুর্দশামুক্তি’। ভাবখানা এমন যেন নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে দেখে তা রক্ষা করতে বুশ বা আমেরিকা আফগানিস্তান দখলে এসে ২০ বছর কাটিয়ে গেল।

আমেরিকার এক পপুলার মিডিয়া হলো ‘এনপিআর’ রেডিও। এরই ওয়েবসাইট লিখছে, আমেরিকা নাকি ‘আফগানিস্তানে গণতন্ত্র এনে দিতে গিয়েছিল। তবে এটা করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত আমেরিকাতেই গণতন্ত্রের অভাব ঘটিয়ে ফেলেছিল, অজনপ্রিয় যুদ্ধ যেমনটা ঘটিয়ে থাকে।’ এ দেখি বিরাট এক আঁতলামো! ইদানীং আমেরিকান মিডিয়ার এমন লেখা দেখে মনে হয় তাদের দিন ফুরিয়ে আসছে, তাই কথার আর ওজন থাকে না। কখন কী বলে ঠিক থাকছে না।

এ ছাড়া এ কথাটাও সত্য নয়। যেমন, বুশ দুই টার্মে ক্ষমতায় ছিলেন। প্রথম টার্মে যদি ধরে নেই পাবলিক জোশে তিনি আফগানদের কড়া শাস্তি দেয়ার জন্য বোমা ফেলতে গিয়েছিলেন, মানে নাইন-ইলেভেনে টুইনটাওয়ারে হামলার শাস্তি দিচ্ছিলেন। প্রশ্ন উঠবে, তাহলে এর পরও যুদ্ধ চালু রাখতে ভোটাররা তাকে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত করলেন কেন? এর দায় তো তখন অবশ্যই (লোভী) ভোটারদেরও নয় কি? যারা দায়িত্ব নিতে চায়নি, বুশ কী করে দেশে টাকা আনছেন? আর বুশের পদক্ষেপ তাদের পক্ষে যাচ্ছে বলে তারা মেপেছিলেন ও আর উৎসাহ দিতে বুশকে আবার নির্বাচিত করে দিয়েছিলেন তাদের ওসব বৈষয়িক লাভ দিয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে। তাদের বিচারে আমেরিকান সমাজে ‘কাজ-কাম’ আর ‘মানি সার্কুলেশন’ বেড়েছিল দেখেই তো তারা সিদ্ধান্তে গিয়েছিলেন... ‘কাজেই বুশকেই আবার জিতিয়ে দাও’। তাই তারা জিতিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো যুদ্ধে আমেরিকান জনগোষ্ঠী ও অর্থনীতিকে জড়ানোর কারণে এই মানি সার্কুলেশন বৃদ্ধি পেয়েছিল- যেটা ছিল এক জবরদস্তি বৃদ্ধি। আর যুদ্ধ তো ঠিক কোনো ব্যবসা বা বাণিজ্য নয়। তাই যুদ্ধ শেষে কিছু রিটার্ন এলে আসতেও পারে, যার ওপর কেউ ভরসা করে থাকে না; তবু এলে সেটা বাড়তি লাভ বলে হাত পেতে চুপচাপ নিয়ে নেয়।

যুদ্ধ দেশকে বিশেষ কোনো সুবিধা (অ-মানিটারি সুবিধা) কখনো কখনো এনে দিতে পারে। যেমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আমেরিকাকে গ্লোবাল নেতা বানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সবার উপরে সাবধান থাকতে হয়, কোনো যুদ্ধের খরচ যেন দেশের বইবার সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি দাবি না করে বসে। সে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা যুদ্ধ করেও টিকে গিয়েছিল। আমেরিকা ইউরোপ (এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নসহ) ও
এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার ওপর একই গ্লোবাল কর্তৃত্ব সুযোগ এনে দিয়েছিল। কিন্তু আফগানিস্তান-ইরাকের যুদ্ধের ব্যয় ছিল লাগামছাড়া আর বিপুল খরচের তুলনায় রিটার্ন এমন বড় কিছু নয়। ইতোমধ্যেই যুদ্ধের সাত বছর পেরোতেই বেহিসাবি খরচের ভারে শুধু ‘আমেরিকান ইকোনমি’ নয় এর নেতৃত্বে ও সাথে থাকা ইউরোপসহ সারা গ্লোবাল ইকোনমিও মহামন্দার (২০০৮) কবলে পড়ে যায়। এভাবে আমেরিকান ব্যবসাদার ও ভোটার সবপক্ষেরই যুদ্ধের শখ মিটিয়ে দিয়েছিল। কারণ, গ্লোবাল মন্দার মধ্যে আর আফগান-ইরাক যুদ্ধও তো এক সাথে দুনিয়াতে কখনো চলতে পারেনি।

এর পরের ওবামা দু-টার্ম বা পরে ট্রাম্প- দু’জনেই তাদের কালের যুদ্ধের উল্টা- যুদ্ধের খরচ কমানোর নায়ক সাজতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সুখকর খুব কিছু হয়নি। আর বিবেচনাহীনভাবে যুদ্ধের দায় ফেলে পালিয়ে যাবেন- এই সস্তা শর্টকাট বেকুবির পথ নিয়েছিলেন ট্রাম্প। এমনকি চুক্তিও সম্পন্ন করেছিলেন একা ট্রাম্প নিজেই। ফলে তালেবান-চুক্তি করার মূল দায়ভার এককভাবে ট্রাম্পের। কিন্তু বাইডেন তা বাস্তবায়নে গেছেন বলে সব দায় এখন তিনি বাইডেনের ওপর চাপাচ্ছেন। এটাই বড় তামাশার।

আবার বাইডেন তালেবানদের ক্ষমতায় এনে নিজের প্রত্যাহার নিশ্চিত করবেন এমন বাস্তবায়ক প্রেসিডেন্ট হতে দায় নেয়া যে খুবই রিস্কি তা তারও অজানা ছিল না। কিন্তু তবু তিনি রাজি হয়েছিলেন; কারণ সেনা প্রত্যাহার তার সরকারের পরিচালনা খরচ কমাবে। কারণ, এখনকার আমেরিকা মানে অর্থনৈতিক সক্ষমতার অভাব, সেই প্রাচুর্যের আমেরিকা আজ আর নেই। কিন্তু তার অর্থ দরকার। কারণ, এ দিকে সোর্সের খবর না রেখে তিনি সারা ইউরোপ আর জাপানের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, চীনের পাল্টা ব্যাপক বিনিয়োগ সক্ষমতা, পাল্টা বেল্ট-রোড খাড়া করার সক্ষমতা হাজির করবেনই। এখন আফগান ফ্রন্ট থেকে সেনা প্রত্যাহার যদি বাইডেনকে কিছু বিনিয়োগ সক্ষমতার উৎস দেখায় যদিও শেষে এসবই গল্প হয়ে থেকে যাবে!

কিন্তু এর আগেই ট্রাম্প দান মারার চেষ্টা করেছেন। তিনিও আগামী নির্বাচনের হিসাব মোতাবেক এখন উল্টা বাইডেনের ওপর নিজেরই সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের দায় চাপিয়ে নিজে হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছেন। তাই বলা যায়, সাবেক প্রেসিডেন্টরা মাত্রই আসলে দায়দায়িত্ব নিতে না চাওয়া অপরচুনিস্ট। আর বাইডেন ইতোমধ্যেই তালেবান ক্ষমতা দখল নিয়ে নেয়ায় নৈতিক দিক থেকে ঘায়েল হয়ে গেছেন; আমেরিকান মানসিক-নৈতিক দিক দুর্বল করে ফেলেছেন।

এ দিকে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের একগুঁয়ে নীতি বাইডেন চুপে অনুসরণ করে যেতে চেয়েছিলেন। চীনা পণ্যের আমেরিকায় আমদানিতে ট্রাম্পের বাড়তি ট্যাক্স আরোপ করেছিলেন ২৫ শতাংশ। সেটা চালু রেখেছিলেন বাইডেন। সেটা এখন বাইডেনের ওপরই শাস্তি হিসেবে আসা শুরু করেছে। যেটা বাইডেন আগে বদল করতে যাননি, ‘কম দেশপ্রেমী’ হতে চাননি বলে হয়তো। কিন্তু সেটাই বাইডেনকে আমেরিকার আগামী মিডটার্ম নির্বাচনে পরাজয়ের স্বাদ দিতে উদ্যত হচ্ছে বলে খবর চাউর হচ্ছে। এটাও ট্রাম্পের এক ফায়দা।

ওদিকে বাইডেনের তালেবান উত্থান পলিসি ভারতের জন্য একেবারেই অসহ্য হয়ে উঠেছে। মূল কারণ, পাকিস্তানের কাছে ভারতের নৈতিক পরাজয়। পাকিস্তানকে আর ‘জঙ্গি দেশ’ দেখাতে পারছে না। গত ২০ বছর ধরে প্রপাগান্ডায়- যেন পাকিস্তানই আফগানিস্তানের মা-বাপ; সব ইসলামী রাজনীতিক বা সশস্ত্র ধারার উৎস। গত ২০ বছর আমেরিকার যুদ্ধ যেন আফগানিস্তানের তালেবানসহ অন্যান্য সশস্ত্র গ্রæপের বিরুদ্ধে ছিল না, যেন আমেরিকার যুদ্ধ চলছিল (জঙ্গি) পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমেরিকা যেন ভারতকে পাকিস্তানি ইসলামী জঙ্গি থেকে মুক্ত করতে লড়ছিল। বিশেষ করে এত দিনের আফগানিস্তান যেন ছিল নারীমুক্তির ঘাঁটি- এমন এক বিরাট কারখানা। আর এখন তালেবানদের আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল নয়- ‘পাকিস্তানের কারণে’ এই নারীমুক্তি কারখানা এখন যেন বন্ধ হয়ে যাবে। আফগান নারীরা বিভিন্ন দেশে আমেরিকান স্কলারশিপে যে পড়তে গিয়েছিল তা তালেবানদের দ্বারা নয়, পাকিস্তানের কারণে যেন বন্ধ হয়ে যাবে। এই ক্যাম্পেইন এতদিন কানে কানে বলার মতো করে চালিয়েছিল ভারত। বিশেষ করে ইউরোপের স্কানডিনেভিয়ান দেশগুলোর কথা বেশি এসেছে।

আর ভারত এ কাজ হাতে নিয়েছিল আরেক কারণে। রাশিয়া, চীন ও আমেরিকাকে সাথে নিয়ে তালেবানের ওপর শক্ত গ্লোবাল রাজনৈতিক সিস্টেমের মধ্যে তাদেরকে আসতে বাধ্য করার জন্য ত্রয়কা গঠন করেছিল যাতে এই তিন দেশের বিরল কমন ও শক্ত অবস্থান তালেবানদের দেখানো এবং মানতে চাপ দেয়া যে তাদের কমন অবস্থান ও বক্তব্য আবার নিরাপত্তা পরিষদেরই প্রস্তাব। এর বাইরের কারো বা কোনো প্রস্তাব নয়। আর এ কাজ বাস্তবায়ন করতেই তারা পাকিস্তানকে ত্রয়কার ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল, যার নয়া নাম দিয়েছিল ‘ত্রয়কা প্লাস’। আর এতেই ভারতের সব পাকিস্তানবিরোধী প্রপাগান্ডা পানি হয়ে গিয়েছিল। এসবেরই প্রতিশোধ হিসেবে ভারত পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আফগান নারীদের মধ্যে প্রপাগান্ডা চালিয়েছে যে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ পাকিস্তান। পাকিস্তানই তালেবানদের পরিচালক। অতঃএব আফগান নারীরা যেন পাকিস্তানের ওপর অবরোধ আরোপের জন্য জাতিসঙ্ঘে পিটিশন লিখে আবেদন জানায়। অথচ বাস্তবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুনিয়ার কোনো সরকারের এমন কোনো অভিযোগই নেই। জাতিসঙ্ঘসহ কোনো ফোরামেই এমন কিছু নেই। কিন্তু ভারত ইউরোপের ক্যাম্পাসগুলোতে আফগান বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন পিটিশন স্বাক্ষর ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছেই।

গতকালের আনন্দবাজার পত্রিকা এক মজার খবর দিয়েছে, ভারতীয় অ্যাম্বাসির সর্বশেষ দেড় শ’ জনের যে দলটা কাবুল থেকে ফেরত এসেছেন তারা ফিরে এসেছেন তালেবানের নিরাপত্তা সহায়তায়। তারা দেশে নিরাপদে ফিরতে চান বলে স্থানীয় তালেবান কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করলে কমান্ডার ভারতীয় অ্যাম্বাসির ২২টি গাড়ির কনভয়-বহর পাহারা দিয়ে এয়ারপোর্টে নিরাপদে পৌঁছে দেন।

‘কাউন্টার হিরো’ ব্রহ্ম চেলানি
ভারতীয় ব্রহ্ম চেলানি তিনি অনেক বাংলাদেশীর মতোই আমেরিকান থিংকট্যাংক ফেলো। তিনি দিল্লিতে বসে আমেরিকান ফান্ডে এক এনজিও বা থিংকট্যাংক চালান, নাম সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ। তিনি প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে কলাম লেখেন আর সে লেখা বাংলাদেশের ‘প্রো-আমেরিকান’ পত্রিকাগুলো ছাপে। কিন্তু তিনি বাইডেনের তালেবানদের সাথে ডিল করা এবং পরে নিজ মুরোদে তালেবানরা ক্ষমতা দখল করলে এরপর একেবারে ক্ষেপে আগুন হয়ে যান। এমনই হতাশ আর ক্ষুব্ধ হয়ে গেছেন, যাকে বলে ‘রাগে অন্ধ’। তার এবারের লেখার শিরোনাম- ‘কাবুলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বনেতৃত্বের অবসান হলো’। এটাই এর প্রমাণ। এই লেখার শুরুতে তার কথা মনে করেই লিখছিলাম।

তার লেখা পড়ে মনে হবে, তিনি ট্রাম্পের অবস্থান নিয়ে বাইডেনকে বকাবকি বা চরম গালাগালি করছেন। আবার অনেক সময় মনে হবে, তিনি বোধহয় এক পাঁড় কমিউনিস্ট যারা সাধারণভাবে আমেরিকাকে এমন খারাপ বলে অভিযুক্ত করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি এখনো তার আয়, ডিগ্রি, চাকরি, ওঠাবসা, ভাব-বিনিময় সবই ডিপ আমেরিকান সম্পর্কিত হয়েই করে চলেছেন।

মূলত আফগানিস্তানে তালেবানদের বিজয় ও ক্ষমতার উত্থান দেখে চেলানি একেবারে ভেঙে পড়েছেন। পরে সিরিয়াসলি কিছু কঠিন কথা লিখেছেন। যে কথাগুলো গত ২০১৪ সাল থেকে লিখে আসছি। সে কথাগুলোই একজন প্রো-আমেরিকান একাডেমিক বলে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে, তার আনুষ্ঠানিক মরণ-মুহূর্ত হিসেবে তালেবানের এ ক্ষমতারোহণকে ভবিষ্যতে স্মরণ করা হবে। এর মধ্য দিয়েই পশ্চিমাদের সুদীর্ঘকালের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের যবনিকাপাত হলো।’ ... ‘আফগান জনগণকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের চলে যাওয়া তার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থার ওপর বড় আঘাত হানল। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের কাছে এ বার্তা গেল, যুক্তরাষ্ট্র শুধু তার নিজের বিপদের সময়ই মিত্রদের গণনার মধ্যে ধরে। বিপদ কেটে গেলে সে মিত্রদের বিপদের মধ্যে ফেলে পালিয়ে যায়।’ এ ধরনের ভাষ্য এতদিন আমরা কমিউনিস্ট প্রপাগান্ডা বলেই শুনেছি। চেলানি আমেরিকাকে সরাসরি ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলছেন। বলেছেন, ‘আফগান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং তার পরপরই সরকারের পতনের ঘটনার সাথে নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতার যোগসাজশ রয়েছে।’ এর পরের বক্তব্যগুলো একেবারেই কমিউনিস্ট অভিযোগ ধরনের। বলছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আফগান সেনাদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে, যাতে তারা স্বনির্ভর হতে না পারে এবং সব সময় যাতে তাদের মার্কিন বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।’... ‘সুবিধাবাদী চীন এখন খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ আফগানিস্তানে আধিপত্য বিস্তার করবে এবং ধীরে ধীরে পাকিস্তান, ইরান ও মধ্য এশিয়ায় নিজের কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করবে। চীন ক‚টনৈতিক স্বীকৃতি এবং অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা দেয়ার বিনিময়ে তালেবানকে বলা যায়, কিনে নিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে মধ্যযুগীয় উগ্র জিহাদী সন্ত্রাসীদের পুনর্বাসন করে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অবিশ্বস্ততার স্মারক প্রতিমূর্তি স্থাপন করা হবে। কাবুলে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকে চিনুক ও ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারে করে ভীতসন্ত্রস্ত আমেরিকানদের সরিয়ে নেয়ার ছবি ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের সায়গনের মার্কিন দূতাবাস থেকে তাদের নাগরিকদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। এসব ছবি আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হওয়ার প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।’

এটুকু অন্তত বলা যায়, চেলানি আমেরিকার ওপর সব ধরনের আস্থা হারিয়েছেন যা থেকে ভারতের সরকারি অবস্থান বা দিশেহারা অবস্থার কিছু আন্দাজ করা যায় বোধহয়। ভারতের দুরবস্থা এতই নিচে যে, সেই আমেরিকার ওপরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ভরসা করা ছাড়া বিকল্প নেই। তাই আমেরিকার মুখ চেয়ে থাকতে সপ্তাহজুড়ে তিনি আমেরিকায়। এ দিকে কাবুলে ভারতের বছরে দেড় বিলিয়নের রফতানির বাজারটাও হাতছাড়া হয়ে গেছে, তালেবান আপত্তিতে। ওদিকে, তালেবানের সাথে কথা বলবে না মানে স্বীকৃতি দেবে না-নেবে না বলে গোঁ ধরে বসে আছে ভারত। কিন্তু কতক্ষণ টিকতে পারবে?

কাবুলের অনেক পরিবর্তনের মাঝে তারা অন্তত একটা জিনিস সারা দুনিয়ার মানুষকে দেখিয়েছে, শিখিয়েছে। কিন্তু এটা যারা শিখতে চায় কেবল তারাই এটা দেখতে পারে। তা হলো, এটা একটা গ্লোবাল বাণিজ্যের দুনিয়া মানে গ্লোবাল আন্তঃনির্ভরশীলতার দুনিয়া হয়ে উঠেছে। আপনি কাউকে পছন্দ করুন আর নাই করুন আপনার বেলাতেও একই নিয়ম- এটা আন্তনির্ভরশীলতার দুনিয়া। এখন কেবল আরেকটা সম্ভাবনা আছে। যারা গ্লোবাল নেতা মানে যিনি বা যারা মিলে গ্লোবাল রাজনৈতিক সিস্টেম (তাতে এত ত্রুটি, যতই থাক) বলে একটা কাঠামো নিয়ে তারা হাঁটে তাদের ভ‚মিকা বিষয়ক। এই ভ‚মিকাটা হলো, এরা চাইলে ওই কাঠামোতে ফিট হচ্ছেন না বলে শাসক হিসেবে আপনার ধরনটাকে উপড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে পারার ক্ষমতা রাখে।

এ সপ্তাহে তালেবানরা আরো অনেকটা নিজেদের খুলে ধরেছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রয়টারসের এক্সক্লুসিভ নিউজে দেখা যাচ্ছে তাদেরই একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়াহিদুল্লাহ হাসেমি- ‘ক্ষমতাকাঠামো’ নিয়ে কথা তুলেছেন। সুপ্রিম নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার নাম প্রকাশ্যে এনেছেন। তিনি অপ্রকাশ্যে থেকেই ডেপুটি তিনজনের কেউ একজন দিয়ে শাসন করতে পারেন এমন ধারণা দিয়েছেন। দোহা পলিটিক্যাল অফিসের কথা বলেছেন। বলেছেন, তালেবানরা কিভাবে দেশ চালাবে তা নিয়ে অনেক কিছুই আমরা এখনো ফাইনাল করিনি। কিন্তু আফগানিস্তানে গণতন্ত্র হবে না (উড নট বি অ্যা ডেমোক্র্যাসি)। এ ছাড়া ঠিক এমনকি আরেকটা বাক্য আছে তার কথায়। আর বলছেন, ‘আফগানিস্তানে কী ধরনের পলিটিক্যাল ব্যবস্থা চালু হবে- সেটা পরিষ্কার। আর তা হলো শরিয়া ল’।

কিন্তু এই দুটি বাক্যই তালেবানদের একেবারেই বিরুদ্ধে যাবে। সেটা এ জন্য নয় যে, তালেবানরা যা বোঝাতে চায় আর পশ্চিম বা গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেমে বোঝাবুঝি চলে যেভাবে, এটা সেখানে ঠিকঠাক মতো হয়েছে তাই। না, এটা তা নয় বরং উল্টোটা। এটা বরং যারা তালেবানদের উপড়ে ছুড়ে ফেলতে উদগ্রীব তারা যেভাবে শুনতে পছন্দ করবে, সে মোতাবেক বলা হয়েছে। বরং কিভাবে বললে তালেবানদের প্রতি প্রশ্নের ঠিক জবাব দেয়া হবে, আবার পশ্চিমের কৌত‚হলও মিটবে তা এখানে ঘটেইনি।

এর একটা সহজ উপায় হতে পারে তালেবানদের আগে উল্টা জেনে নেয়া যে, তারা ঠিক যা বলতে চায় তা পশ্চিমের ভাষায় কী করে বলতে হয়। তা না জেনে আগাম পশ্চিমের ভাষা নকল করে সেই শব্দ ব্যবহার করে বলতে গেলে ফল জাস্ট এর উল্টো হবে।

যেমন ‘গণতন্ত্র’ তালেবানদের ধারণা বা পরিভাষা নয়। তাহলে তালেবানরা ‘গণতন্ত্র’ মানবে বা মানে না- এ কথা তালেবানদের বলার তো দরকার নেই। এ ছাড়া এভাবে বললে কথাটা তালেবানদের একেবারেই বিরুদ্ধে যাবে।

দ্বিতীয়ত, কথাটা সেকালের সোভিয়েতদের অযোগ্য বা আনফিট দেখানোর জন্য আমেরিকান ভাষ্যের ট্রাপ ছিল। রাষ্ট্র বিষয়ে ক্লাসিক্যালি যা বলা হয়েছিল এটা সেই শব্দ নয় যে বিষয়টা একালের পশ্চিমও ভুলেই গেছে।
তালেবান-১-এর আমলে আফগানিস্তান রাষ্ট্রের নাম তারা দিয়েছিল ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’। গত ২০২০ সালে এই নামের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব আছে। বলেছিল যে, তারা এই নাম সমর্থন করবে না। আর ওই প্রস্তাবটাই পরে ত্রয়কার মিটিংয়ে উঠিয়ে এনে তাদেরও একই আপত্তি রুজু করেছিল তারা তালেবানদের কাছে।

কোনো দেশ যদি নিজের নামের মধ্যে ‘আমিরাত’ বলে শব্দ রাখে তবে জাতিসঙ্ঘ বা মডার্ন দুনিয়া এর অর্থ করবে যে, ওটা একটা রাজতন্ত্র। যেমন দুবাই (ইউএই)। এখন একটা লক্ষ করার বিষয়, ১৯৪৫ সালের পরে দুনিয়াতে কোনো নতুন রাজতান্ত্রিক দেশ জন্ম নেয়নি। কেন? কারণ জাতিসঙ্ঘ ম্যান্ডেট তা সমর্থন করে না। তবে আপাতত সৌদি, দুবাই, কাতার এরা জাতিসঙ্ঘের সদস্য অবশ্যই। এটা ছাড় দেয়া আছে। কিন্তু সেই ছাড় শেষ হয়ে যাবে যদি এমন কোনো দেশের বাসিন্দারা মিছিল আন্দোলন আপত্তি শুরু করে যে, তারা রাজতন্ত্র চায় না। আর সে ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ ওই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে বাদশাহকে চিঠি দেবে গণভোট ডেকে ফায়সালার জন্য।

এখন আমাদের প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, তালেবানরা কি আফগানিস্তানকে দুবাইয়ের মতো এক আমিরাত বানাতে চাচ্ছে? তাদের মধ্যে কেউ কি অলরেডি আমির (রাজা, বাদশাহ, সুলতান) আছেন বা হয়ে আছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর যথেষ্ট ভেবেচিন্তে, দায়িত্ব নিয়ে দিতে হবে। ঠিক যাই তারা বোঝাতে চায় তাই যেন বলে। তা না করে আগেই যদি বলে দেয়া হয়, আফগানিস্তানে গণতন্ত্র হবে না এটা নিজেকেই অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। নিজের বিরুদ্ধে কাজ করা হবে। মূল কথা বুঝে কথা বলতে হবে। নইলে কথা নিজের বিরুদ্ধে যাবে!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement