১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সার্কভুক্ত দেশগুলোতে আঞ্চলিক যোগাযোগের গুরুত্ব

সার্কভুক্ত দেশগুলোতে আঞ্চলিক যোগাযোগের গুরুত্ব - প্রতীকী ছবি

ব্রিটিশরা ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দোলাকে পরাজিত করে বাংলার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে শাসনের সূচনা করলেও সমগ্র ভারতবর্ষ দখলে নিতে শত বছর সময় লেগে যায়। ব্রিটিশ শাসনাধীন থাকাবস্থায় অখণ্ড ভারতবর্ষের নাগরিকরা কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই উপমহাদেশের এক জায়গা থেকে অপর অঞ্চলে যেতে পারত। ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আগমনের আগে সুদীর্ঘকাল আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে অঞ্চলটি মুসলিম শাসকরা শাসন করেন। মুসলিম এসব শাসক ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছিলেন। ভারতবর্ষ মুসলিমদের শাসনাধীন থাকাকালে এ অঞ্চলের মানুষের এক স্থান থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারেও কোনো বাধানিষেধ ছিল না। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ও মুসলিমদের শাসনের আগে এ অঞ্চল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজারা শাসন করেন; তবে তাদের শাসনামলে এককভাবে কোনো রাজা সমগ্র ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হননি।

ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশদের ত্যাগের কিছুকাল পর হতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদের অপর স্বাধীন রাষ্ট্রে ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। এ বিধিনিষেধের ফলে এ অঞ্চলের একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের অপর রাষ্ট্র ভ্রমণে ভিসা গ্রহণের আবশ্যকতা দেখা দেয়, যা এখনো অব্যাহত আছে।

১৯৮৫ সালে সার্কের আনুষ্ঠানিক যাত্রাকালে ভারত উপমহাদেশের সাতটি রাষ্ট্র যথা ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে ২০০৭ সালে আফগানিস্তান সার্কের অন্তর্ভ্ক্তু হয়। সার্কভুক্ত আটটি রাষ্ট্রের মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ দ্বীপরাষ্ট্র। অপর দিকে নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তান স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র।

সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কিন্তু তার জীবদ্দশায় সার্কের প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান দূরদর্শী ছিলেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়িয়ে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল যে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে আমাদের এ অঞ্চলেরও সমরূপ উন্নয়ন সম্ভব যদি এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়িয়ে কাক্সিক্ষত স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়।

আঞ্চলিক জোটের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বর্তমানে বিশ্বের যেসব অঞ্চল সমৃদ্ধি অর্জন করেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ইইইউ, আসিয়ান, জিসিসি প্রভৃতি। এ তিনটি আঞ্চলিক জোটভুক্ত রাষ্ট্রের নাগরিকরা জোটের অন্তর্ভুক্ত এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে চাইলে কোনো ধরনের ভিসা গ্রহণ আবশ্যক হয় না। এসব অঞ্চলের নাগরিকরা নিজ নিজ অঞ্চলে বাধাহীনভাবে সড়ক, রেল, নৌ বা আকাশপথে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে পারেন। এমনকি এসব অঞ্চলের নাগরিক ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে এক দেশ থেকে অপর দেশ ভ্রমণ করতে পারেন। এসব অঞ্চলভিত্তিক জোটগুলো নিজ নিজ অঞ্চলের উন্নয়নে আঞ্চলিক বাণিজ্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে এসব অঞ্চলের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে।

সার্ক প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়িয়ে এ অঞ্চলকে পৃথিবীর অন্যতম একটি সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত করা। কিন্তু সার্ক প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ৩০ বছর অতিবাহিত হতে চললেও পরিলক্ষিত হয় যে এখনো সে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অনেক পথ পাড়ি দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

সার্কের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারত আয়তন ও লোকসংখ্যার দিক থেকে সর্ববৃহৎ। দ্বিতীয় অবস্থান পাকিস্তানের। সার্ক প্রতিষ্ঠার আগে ভারত ও পাকিস্তান তিনটি সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৭১ সালে সর্বশেষ যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল এর পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম।

সার্ক অঞ্চলে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বেশি বসবাস করে। জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় এ অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল। সাম্প্রতিক সময়ে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো কৃষিতে বেশ উন্নতি করেছে। এ অঞ্চলের শিল্পয়োন্নয়ন আশাব্যঞ্জক হলেও এ পথে আরো উন্নয়নের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সার্ক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিধি এখনো সীমিত। এ পরিধি বিস্তৃত করা গেলে সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলো নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে থেকেই অভূতপূর্ব উন্নয়নে সক্ষম হবে।

সার্ক প্রতিষ্ঠার পর যদিও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল যে, এক দেশের নাগরিক বিনা ভিসায় অন্য দেশ ভ্রমণ করতে পারবে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়াসহ একটি দেশ অপর দেশকে প্রয়োজন অনুযায়ী ট্রানজিট সুবিধা প্রদান করবে; কিন্তু সে লক্ষ্য এখনো অর্জন করা যায়নি। আর নিকটভবিষ্যতে যে অর্জন করা যাবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করার সম্ভাবনাও খুব একটা উজ্জ্বল নয়।

সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নেপাল ও ভুটান পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে ভারতবেষ্টিত। এ দু’টি রাষ্ট্র উত্তর দিক থেকে চীন পরিবেষ্টিত হলেও সে দিকের সম্পূর্ণ সীমানা দুর্গম পাহাড়ি। তাই সে দিক দিয়ে যোগাযোগ বলতে গেলে অনেকটা দুর্ভেদ্য। নেপাল ও ভুটান এই দু’টি দেশ বৈদেশিক বাণিজ্যের বিষয়ে সম্পূর্ণ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এ দু’টি দেশ দীর্ঘ দিন ধরে সার্কের আঞ্চলিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা এ দু’টি সামুদ্রিক বন্দর দিয়ে ভারত হয়ে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার দাবি করে এলেও তা বাস্তবায়নে ধীরগতি সার্কের চেতনাকে মলিন করে দিচ্ছে।

ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়। এ সাতটি রাজ্য চতুর্দিক অপর রাষ্ট্রের স্থভাগ দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় চিকেন নেক করিডোর নামের একটি সরুপথ দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সাতটি রাজ্য যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এ পথ দিয়ে যোগাযোগ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এ সাত রাজ্যের সাথে সড়ক, রেল ও নৌপথে ট্রানজিট স্থাপনে আগ্রহী। নৌপথে ট্রানজিটটি চালু থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় নদীর নাব্যতা কম থাকায় তা বছরব্যাপী ফলদায়ক নয়। অপর দিকে সড়ক ও রেলপথে ট্রানজিট দিতে গেলে যে অবকাঠামোর প্রয়োজন তা বাংলাদেশ এখনো গড়ে তুলতে পারেনি।

ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ৫৪টি অভিন্ন নদী বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এ নদীগুলোর অধিকাংশ থেকে একতরফাভাবে উজানে ভারত পানি প্রত্যাহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও কৃষিতে সেচের কাজসহ অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর নাব্যতা রক্ষায় কাজে লাগাচ্ছে। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে এবং সার্কের চেতনা কখনো এক প্রতিবেশী রাষ্ট্র কর্তৃক অপর প্রতিবেশীর জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি অনুমোদন করে না।

ভারতের তুলনায় সার্কভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্র ক্ষুদ্র হওয়ায় সার্কের চেতনাকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষাপূর্বক ইন্ডিয়া সবসময় সার্কভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি বড় ভাইসুলভ আচরণ দেখিয়ে আসছে। ইন্ডিয়ার এ আচরণের কারণে সার্ক এক দিকে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হচ্ছে অপর দিকে সার্কভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিপন্ন হচ্ছে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাথে ইন্ডিয়ার সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ থাকলেও ট্রানজিট সুবিধা না থাকায় ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। এ তিনটি দেশের নাগরিকদের যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ভিসার আবশ্যকতা থাকায় যোগাযোগ খুব একটা সহজসাধ্য নয়। একজন ভারতীয় নাগরিকের জন্য বাংলদেশ ও পাকিস্তানের ভিসা গ্রহণপূর্বক এ দু’টি দেশ ভ্রমণ যতটুকু সহজসাধ্য; এ দু’টি দেশের নাগরিকদের জন্য ইন্ডিয়ার ভিসা গ্রহণপূর্বক সে দেশ ভ্রমণ ততটুকু সহজসাধ্য নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে নেপাল ও ভুটানের যে বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে ট্রানজিটের অনুপস্থিতিতে তা ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে সমাধা করা হচ্ছে। এতে করে উভয় রাষ্ট্রের আমদানি ও রফতানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

বর্তমানে আঞ্চলিক যোগাযোগের মধ্যে শুধু সড়ক, রেল, নৌ ও বিমান যোগাযোগ অন্তর্ভ্ক্তু নয়। এর বাইরে এক দেশের মধ্য দিয়ে অপর দেশে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও তেল সরবরাহ করা হচ্ছে, এক দেশের মুদ্রা অপর দেশে বিনিময়যোগ্য অথবা জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং একই সিম কার্ড ব্যবহার করে স্বল্প খরচে জোটভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকরা অতি সহজে অন্য দেশের নাগরিকদের সাথে কথা বলতে পারেন।

ভারতের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশমান। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের অর্থনীতিও বিকাশমান।

আঞ্চলিক সহযোগিতার পরিধির আওতায় যদি সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ট্রানজিট সুবিধা উন্মুক্ত করে দেয়া যায়, ভিসা প্রথার বিলোপ করা যায়, এক দেশের মুদ্রা অপর দেশে সহজে বিনিময়যোগ্য করা যায় অথবা অভিন্ন মুদ্রা চালু করা যায়, ব্যক্তিগত গাড়িতে এক দেশ থেকে অপর দেশ ভ্রমণের সুবিধা চালু করা যায়, এক দেশ থেকে অপর দেশে বিদ্যুৎ, গ্যাস, তেল ও পানির প্রবাহ সহজলভ্য করা যায়, একই সিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে সহজে ও স্বল্প খরচে কথা বলা যায় এবং বাণিজ্যের পরিধি সর্বোচ্চ মাত্রায় উন্নীত করা যায়; তবেই আঞ্চলিক জোট হিসেবে সার্ক পৃথিবীর অপরাপর আঞ্চলিক জোটের মতো সমৃদ্ধ জোটে রূপ নিতে পারবে। এর জন্য প্রয়োজন সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সর্বোচ্চমাত্রা প্রদর্শন এবং সুযোগ ও সহযোগিতার সর্বোত্তম ব্যবহার।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement