২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কবি শামসুর রাহমান, কিছু কথা

কবি শামসুর রাহমান, কিছু কথা - ছবি : সংগৃহীত

কবি শামসুর রাহমান। বাংলা সাহিত্যে এক উজ্জ্বল নাম। পনেরো বছর আগে ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। মৃত্যুর এই দিনে তার স্মৃতির প্রতি জানাই অজস্র শ্রদ্ধা। একই সাথে অমায়িক এই সৃষ্টিশীল মানুষটি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে।

দৈনিক বাংলায় রাহমান ভাই আমার প্রথম সম্পাদক। তার স্বাক্ষর করা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টারের নিয়োগপত্র নিয়েই ১৯৮২ সালে দৈনিক বাংলায় প্রবেশ। সে দিনের স্মৃতি এখনো চোখে ভাসছে। অমায়িক হাসিতে তিনি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিয়োগপত্রটি। পাশে ছিলেন দৈনিক বাংলার তৎকালীন চিফ রিপোর্টার মনজুর আহমদ ভাই। সালাম জানিয়ে সম্পাদকের কক্ষ থেকে বের হয়ে নিয়োগপত্র খুলতেই আমার চোখ আটকে যায় তার স্বাক্ষরটির ওপর। কী সুন্দর স্বাক্ষর! আমার এতটাই ভালো লেগেছিল যে, ওই স্বাক্ষরের আদলে নিজের স্বাক্ষরও তৈরি করি।

তিনি যতদিন দৈনিক বাংলায় ছিলেন, তার স্নেহ থেকে কখনো বঞ্চিত হইনি। আমাকে কাছে পেলেই তার কাছের বন্ধু অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী কেমন আছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কেমন চালাচ্ছেন জানতে চাইতেন। কখনো কখনো ব্যক্তিগত কোনো সংবাদও আমার মাধ্যমে পাঠাতেন। সিদ্দিকী স্যার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। তিনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন রাহমান ভাইয়ের কাছে। সাথে একটি চিঠিও লিখে দেন। এতে আমাকে দৈনিক বাংলায় নেয়ার অনুরোধ ছিল। সে দিনই আমার ভবিষ্যৎ পেশা ঠিক হয়ে যায়। রসায়নের ছাত্র হয়েও পরে সাংবাদিকতা বেছে নিই। আজ ভাবতে ভালো লাগছে শামসুর রাহমানের সহকর্মী ছিলাম।

তার প্রিয় শহর ছিল ঢাকা। দৈনিক জনকণ্ঠের সাময়িকী পাতায় ‘বুড়িগঙ্গা তীরের রহস্যনগরী’ শিরোনামে আমার একটি ধারাবাহিক লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এ সময় রাহমান ভাইয়ের ‘কালের ধুলোয় লেখা’ শিরোনামে আত্মজীবনী ছাপা শুরু হয়। ঢাকার ওপর আমার লেখাটি দেখে তিনি খুশি হন। ফোন করে উৎসাহ দেন। আমি এই সুযোগে রাহমান ভাইকে তার স্মৃতির শহর ঢাকা নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার চাইলে সানন্দে রাজি হন। সেই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ‘কান পাতলে এখনো শুনতে পাই সর্দার আলীজান বেপারীর পাম্প স্যুর শব্দ’ ওই ধারাবাহিক লেখায় সংযোজিত হয়।

কবি শামসুর রাহমানের আরেকটি সাক্ষাৎকার নিতে তার শ্যামলীর বাসায় গিয়েছিলাম ২০০৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। তার স্নেহধন্য দৈনিক বাংলায় আমার অগ্রজ কবি হাসান হাফিজ সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাহমান ভাইয়ের শরীরটা সে দিন ভালো ছিল না। ঢাকার ওপর আমার বইতে ব্যবহারের জন্য এ সাক্ষাৎকার প্রয়োজন ছিল। তিনি পরে সাক্ষাৎকারটি দেবেন বলে জানান। তবে ওই দিনও আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। তার ১০০টি সেরা কবিতার সঙ্কলন বইটি আমার ছেলেকে উপহার দিয়ে লিখে দেন, ‘প্রিয় দীপ্য, জীবনে অনেক বড় হও, বাবাকে ছাড়িয়ে যাও সুন্দরভাবে।’ আর মেয়ের জন্য দিয়েছিলেন ‘সেরা শামসুর রাহমান’ বইটি। স্বাক্ষর করে লিখে দেন- ‘জীবনে আলো ছড়াও, প্রিয় শামার জন্য শুভেচ্ছা।’

কবিতা লেখাতেই আমার আনন্দ
আমার সৌভাগ্য একজন বড় কবিকে শুধু দেখিইনি, তার সাথে কাজ করেছি। অর্থাৎ তিনি দেশবরেণ্য কবি শামসুর রাহমান। তিনি ছিলেন একজন নিরহঙ্কার ও কোমল হৃদয়ের মানুষ। তার মনটা ছিল অনেকটা শিশুর মতো। মূলত একজন কবি ছিলেন তিনি। তবে কবিতা তো বটেই, অনুপম রচনার অজস্র ধারায় বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করে গেছেন। সাহিত্যের সব শাখায় ছিল তার বিচরণ। কথা-সাহিত্য, প্রবন্ধ-গদ্য, অনুবাদ, স্মৃতিচারণ আর শিশুতোষ রচনায় তার উপস্থিতি ছিল প্রজ্বল। সহকর্মী হওয়ার সুবাদে তার প্রিয় বিষয়-আশয়গুলোও জানার সুযোগ হয়েছে। যেমন কিসে আনন্দ হয়? শামসুর রাহমান নিজেই লিখেছেন, কবিতা লেখাতেই তার আনন্দ। যৌবনের ঊষালগ্নে কবিতা লেখায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বলে বাংলা ভাষা আয়ত্ত করেন। তাই বাংলা ভাষা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়।

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার পর ঢাকার এবাড়ি-ওবাড়িতে পালিয়ে থাকার কিছু দিন পর শামসুর রাহমান চলে গিয়েছিলেন পৈতৃক বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রামে। সেখানে তিনি লিখেন তার বিখ্যাত দু’টি কবিতা। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘এপ্রিল মাসের সাত অথবা আট তারিখ দুপুরের কিছুক্ষণ আগে বসেছিলাম আমাদের পুকুরের কিনারে গাছতলায়। বাতাস আদর বুলিয়ে দিচ্ছিল আমার শরীরে। পুকুরে ছোট ছোট, কিশোর কিশোরীও ছিল ক’জন সাঁতার কাটছিল মহানন্দে। হঠাৎ আমার মনে কী যেন বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো খেলে গেল। সম্ভবত একেই বলে প্রেরণা। কবিতা আমাকে জড়িয়ে ধরল। চটজলদি বাড়ির ভেতরে গিয়ে চতুর্থ শ্রেণীর চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে একটা কাঠপেন্সিল ও রুলটানা খাতা নিয়ে তাড়াতাড়ি পুকুরের দিকে ছুটলাম। গাছতলায় বসে খাতায় কাঠপেন্সিল দিয়ে শব্দের চাষ শুরু করলাম। প্রায় আধ ঘণ্টা কিংবা কিছু বেশি সময়ে পরপর লিখে ফেললাম দু’টি কবিতা- ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা।’

কবি এবং কবিতাই শাসমুর রাহমানের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি লিখে গেছেন। ‘কালের ধুলোয় লেখা’ আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ব্যক্তিজীবনের নানা উত্থান-পতনের মধ্যে কবিতাই ছিল আমার নিত্যসঙ্গী।’ তার শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ষাট।

সাংবাদিকতা পেশার সুবাদে শামসুর রাহমানের কবিতায় রয়েছে বিস্তর সাংবাদিকতারও উপাদান।

পশ্চিমা চিত্রকর মার্ক শাগাল, ভ্যানগগ এবং গঁগা কবিতায় তাকে প্রভাবিত করেছে। পশ্চিমা কবিদের মধ্যে ডব্লিউ বি ইয়েটস, এলিয়ট, বোদলেয়ার, এজরা পাউণ্ড, ডিলান টমাসের প্রভাবও আছে। পশ্চিমা কবিদের কবিতার ঢং তিনি গ্রহণ করেছেন। তেমনি মির্জা গালীবের পঙ্ক্তি তাকে প্রভাবিত করেছে। বাঙালি কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসুরও প্রভাব আছে। শামসুর রাহমান লেখেন, বুদ্ধদেব বসুর গদ্য আমাকে বেশ আলোড়িত করেছে। ‘পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ’ কবিতাটি ডিলান টমাসের কবিতা থেকেই জন্ম নিয়েছে। তেমনি তার ‘দুঃখ’ কবিতা এলুয়ারের স্বাধীনতাবিষয়ক কবিতার প্রভাবে রচিত। কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতি বেশি অনুরক্ত উল্লেখ করে শামসুর রাহমান লিখে গেছেন, ‘তার যে জগৎ, সে প্রকৃতি ছোট কিংবা আধুনিক চৈতন্যের হোক আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। তার শব্দসৃষ্টি, শব্দ চেতনা আমাকে আকর্ষণ করে। বনলতা সেন, আট বছর আগের একটি দিন, বিশেষ করে সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা আমার খুবই প্রিয়।’ বনলতা সেন আবৃত্তি করে একবার তিনি পুরস্কারও পান। শামসুর রাহমানের দৃষ্টিতে বৃদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর সবচেয়ে উজ্জ্বল সাহিত্যিক।

আঠারো বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখেন শামসুর রাহমান। প্রথম কবিতা উনিশ’শ ঊনপঞ্চাশ নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত সোনার বাংলায় ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। ‘রূপালি স্নান’ প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব গুহ সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায়। এটিই ছিল শামসুর রাহমানের আগমনী কবিতা। ১৯৬০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের ক্ষমতা গ্রহণের বিরুদ্ধে বিদ্রুপ করে লেখেন, ‘হাতির শুঁড়’ কবিতাটি। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানের সব ভাষায় রোমান হরফ চালুর প্রস্তাব করলে ৪১ বিশিষ্টজনের প্রতিবাদ বিবৃতিতে তিনিও স্বাক্ষর করেন এবং এর প্রতিবাদে লেখেন তার বিখ্যাত কবিতা- ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। তেমিন ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, পুলিশ রিপোর্ট, হরতাল, এ লাশ আমরা রাখব কোথায় ইত্যাদি কবিতাগুলো বিক্ষুব্ধ সময়েরই ছাপ।

শামসুর রাহমানের ঢাকা
ঢাকা শামসুর রাহমানের অসম্ভব ভালোবাসার শহর। তিনি লেখেন, ‘এ শহর ছেড়ে পৃথিবীর অন্য কোনো শহরে বেশি দিন থাকতে পারিনি। এটা আমার জন্মশহর, স্মৃতির শহর। পুরোনো ঢাকার মাহুতটুলীর এক সরু গলির ভিতর, আমার নানার কোঠাবাড়িতে ১৯২৯ সালে আমি সর্বপ্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম। আমাদের পরিবারে সঙ্গীত ও চিত্রকলা সম্পর্কে কারো কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে ছেলেবেলায় ঢাকাই সংস্কৃতির কিছু ছোঁয়া পেয়েছি। কাওয়ালি ও মেরাসীনের গান শুনেছি। এই মেয়েলি গীত বিয়ে-শাদি কিংবা মহিলার ছটি ঘরে চল্লিশ দিন কাটানোর পর উৎসব করে ঢোল বাজিয়ে গাওয়া হতো।’ নানীর কাছে ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর গল্প শুনেছেন শামসুর রাহমান। একদিন নিজেই ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীকে গল্প শোনাবেন ঠিক করলেন। আর সেটি তার শহরকে নিয়ে। সেই গল্পই ‘স্মৃতির শহর’ নামে ঢাকার ওপর তার অনুপম গ্রন্থ। ঢাকা মানে শামসুর রাহমানের কাছে দালানকোঠা বা ঘটনা ঘনঘটা নয়। ঢাকা মানে হরেক রঙের মানুষ, যাদের রঙে শহরটা রঙিন ছিল ভীষণ। সেই নৌকো নদীনালা, মেঘমেঘালী, পাখপাখালির ছবি আঁকিয়ে নঈম মিয়া, সেই নাম না জানা ভিস্তি যারা ঢাকাবাসীর পানির বন্দোবস্ত করত মশকে করে পানি সরবরাহ করে। ঘোড়ার গাড়ি, বাকরখানি, বুড়িগঙ্গার বুকে নবাব সিরাজউদ্দোলার পরিবারের সলিল সমাধি, পরীবিবির স্মৃতিবাহী লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিলের নবাবী খুশব, রামমোহন রায় লাইব্রেরি, বড়কাটরা, ছোটকাটরা, ভিক্টোরিয়া পার্ক ইত্যাদি আরো কত চরিত্র। ঢাকাইয়া ভাষায় তিনি লেখেন অসাধারণ কবিতা, ‘এই মাতোয়ালা রাইত’।

শামসুর রাহমান তার বই পড়ার কথা জানিয়ে লেখেন, ছেলেবেলায় যেসব বই পড়া উচিত ছিল সেগুলো পড়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত ছিলাম। শুধু মনে পড়ে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘হাসিখুশি’ নামে চমৎকার বইটির কথা। এটাই আমার শৈশবের প্রিয় অংশ হয়ে আছে। তেড়ে আসা অজগর এবং পাকা আমের স্মৃতি সজীব হয়ে আছে। সুকুমার রায়ের আবোলতাবোল, খাই খাই, হযবরল, নোলক, রাজকাহিনী ইত্যাদি সংগ্রহ করে এনে পড়েছি। পাটুয়াটুলির রামমোহন লাইব্রেরিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গেও পরিচয় হয় তাদের বইয়ের মাধ্যমে। রামমোহন লাইব্রেরিসংলগ্ন দালানেই জীবনানন্দ দাশের বিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। রামমোহন লাইব্রেরিতেই ‘গল্পগুচ্ছ’ আমার পড়ার ক্ষুধা বাড়িয়ে দিলো। মন বলে উঠল ‘আরো বই চাই, রবীন্দ্রনাথের বই।’ মনে পড়ে নূরপুর ভিলায় প্রায় ভুতুড়ে ঘরটিতে প্রথম পড়েছিলাম শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’। পড়েই খাঁখাঁ দুপুরে ছায়া-ছায়া ঘরে এক তরুণের চোখ হয়েছিল অশ্রুনদী।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক


আরো সংবাদ



premium cement

সকল