২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমরা কোথায় আছি?

আমরা কোথায় আছি? - ফাইল ছবি

তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর যত সমস্যা তার তালিকা দীর্ঘ হওয়াই স্বাভাবিক, সেখানকার আর্থসামাজিক অবস্থার কারণেই। সেসব দেশ বা অঞ্চলের সমস্যা বিচিত্র প্রকৃতির। বাইরের জগৎ থেকে এসব জনপদের খোঁজখবর পাওয়া দুষ্কর। এসব দেশের তথ্যের অবাধ প্রবাহ নেই বললেই চলে। যতটুকু রয়েছে তাও সরকারি নিয়ন্ত্রণে, কর্তৃপক্ষের ভাষ্যই কেবল তাতে থাকে। আজকাল তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে তথ্য তত্ত্ব পৌঁছে যায় মুহূর্তেই। সে অঞ্চলে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত এবং তাতে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। তা ছাড়া তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে রয়েছে নানা রাখঢাক লুকোচুরি সেন্সরশিপ। তাই বেশির ভাগ দেশেরই সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত হওয়া কঠিন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, বিশ্ব সংস্থার পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে তাদের অনুসন্ধানভিত্তিক কিছু তথ্য প্রকাশ পায়। সেখানে স্বল্প পরিসরে যে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় তা থেকেই মূলত দেশগুলো সম্পর্কে সামান্য ধারণা পাওয়া যায়। যতটুকু খবর জানা যায় তা থেকেই সে দেশগুলো সমস্যার সাগরে আকণ্ঠ ডুবে আছে সেটি উপলব্ধি করা সহজ। এসব সমস্যা এত গভীর ব্যাপক এবং বিস্তৃত যে, তার কোনটির ওপর কোনটিকে প্রাধান্য দেয়া সঙ্গত হবে তা-ও নির্ণয় করা কঠিন। যতটুকু জানা গেছে, তার আলোকে এর ক্রমবিন্যাস করা যেতে পারে।

সংক্ষিপ্তভাবে কেবল সমস্যাগুলোর শিরোনামই উল্লেখ করা যেতে পারে। কেননা, এতগুলো দেশের দুঃখ বেদনার পাঁচালি জানা যেমন সম্ভব নয়, তা থেকে কিছু কথা বলা হলেও সেটি হয়ে উঠবে বিরাট ভলিউমের এক শোকগাথা। এখন যেসব সমস্যা মানুষকে দৈনন্দিন জীবনে শত দুর্ভোগ, দুর্দশায় ফেলে রেখেছে তার কয়েকটি শুধু উল্লেখ করছি। তবে এটাও সত্য, সব কিছুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করাও যাবে না। সমস্যাগুলো হচ্ছে- সম্পদের কৃচ্ছ্্র বা স্বল্পতা, তা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা বা উদ্যোগ নেই বললেই চলে, তার পরও যতটুকু সম্পদ রয়েছে তাও বিলিবণ্টনে আছে বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি। বর্তমানে বিশ্বে এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম উপাত্ত হচ্ছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অথচ এ ক্ষেত্রে রয়েছে যত অজ্ঞতা। নিতান্ত বেঁচে থাকার জন্য যে মৌলিক চাহিদা, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান আর ন্যূনতম চিকিৎসার সুযোগ- সেটি নেই বললেই চলে। রুজি রোজগারের জন্য শ্রম বিক্রির নেই তেমন সংস্থান। সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে চলে যত প্রহসন; মানুষের মুক্ত স্বাধীন চিন্তার পথে আছে ভয়-ভীতি ও প্রতিবন্ধকতা। গণতন্ত্রকে নির্বাসন দেয়া হয়েছে গহিন কোনো অরণ্যে। এত সব দুর্ভোগের পরও ঋণভারে জর্জরিত দেশের সাধারণ ব্যয় নির্বাহের জন্য সমস্যার ভারে ন্যুয়ে পড়া মানুষের ওপর রয়েছে উচ্চ হারে কর। ভঙ্গুর অর্থনীতির যত অভিশাপ, অদক্ষ অক্ষম প্রশাসন যারা সমস্যার কোনো সুরাহা করতে না পারলেও তাদের হম্বিতম্বি আর দুঃশাসনের কারণে জনজীবন দুর্বিষহ। এমন যাতনার প্রতিকার চাওয়ারও কোনো পথ সেখানে নেই। তাই একেই নিয়তি জ্ঞান করে বংশপরম্পরায় চলছে জীবন। এমন সব সমস্যার যাতনা থেকে দেশের মানুষ আর দেশকে উতরে নেয়া মানুষকে আশাবাদী করার সক্ষম দূরদৃষ্টির অধিকারী নেতার অভাবই প্রকৃতপক্ষের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর বলতে গেলে, প্রধান সমস্যা। যারা এখন এসব দেশের কর্তৃত্ব করছেন তারা পরিবর্তন আনতে পারেননি। সৎ, যোগ্য নেতৃত্ব বস্তুত যেকোনো দেশে সম্পদ আর আশীর্বাদস্বরূপ। এমন নেতৃত্ব তৈরির যত পদ্ধতি প্রক্রিয়া উন্নত দেশগুলোতে বিদ্যমান, তার কল্পনা করাও সেখানে সম্ভব নয়। শুধু তৃতীয় বিশ্বই নয়, এই বলয় থেকে কোনোক্রমে বেরিয়ে আসার পথে যারা রয়েছে সেখানেও এই ক্রাইসিস বিদ্যমান।

দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাভাবনার আর সঙ্কট উত্তরণের বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণে অক্ষম নেতৃত্ব ও তার যে প্রশাসন তাদের পক্ষে সমস্যার অতল গহ্বর থেকে দেশকে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করা সম্ভব নয়। যদি তেমন নেতা থাকতেন তবে হয়তো উন্মুক্ত হতে পারত, খুলত নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। কিন্তু বিপদ হচ্ছে, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি থাকলে এমন পরিস্থিতিতে কখনো কোনো ব্যক্তিবিশেষের বেরিয়ে আসার ঘটনা লক্ষ করা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে ব্যক্তিতন্ত্রেরই উদ্ভব ঘটার সম্ভাবনা ষোলোআনা। এমন হলে বরং সাধারণের দুর্ভোগ নির্যাতন বাড়ে বৈ কমে না। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে সৃষ্টি হয় এক বিশেষ সুবিধাভোগী দুরাচারী গোষ্ঠীর। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতা ও তার সহযোগীদের ভিত্তি হয়ে থাকে সর্বশ্রেণীর মানুষ। আর ব্যক্তিতন্ত্রে নেতার ক্ষমতার উৎস হয়ে থাকে সেই সুবিধাভোগী দুরাচারীরা। এরা ব্যক্তিতন্ত্রকে সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার বিনিময়েই ভোগ করে যত সুখ আনন্দ বিলাস ভূষণ। তার ফলে সাধারণের যত কষ্ট যাতনা সেই তিমিরেই থেকে যায়। এটাই হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

পক্ষান্তরে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যোগ্য আর দেশের প্রতি নিবেদিত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নির্বাচিত নেতার দায়িত্ব সহজ তো নয়ই বরং নানা চ্যালেঞ্জও তাকে মোকাবেলা করতে হয়ে প্রতিনিয়ত। তাই তাকে অনন্য সব যোগ্যতা রপ্ত করতে হয়। তাকে বহু মত, বিচিত্র মন-মানসসম্পন্ন ব্যক্তির ভিন্ন মত পোষণ ও প্রকাশের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, স্বীকৃতি দিতে হয়। শেষে সবাইকে ন্যূনতম ইস্যুতে এক কেন্দ্রে নিয়ে আসার দুরূহ কাজটি সহযোগীদের নিয়ে তাকেই করতে হয়। আর এমনও ঘটে যে, নেতার লক্ষ্য, কর্মপদ্ধতি নিয়ে সহযোগীদের মধ্যেও কখনো দ্বিমত, জিজ্ঞাসা জাগতে পারে। এমন ক্ষেত্রে বিষয়টি নেতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় বটে। কেননা, গণতান্ত্রিক প্রশাসনে সবার সম্মিলিত প্রয়াস/উদ্যোগ থাকতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে সহযোগীদের প্রশ্নের সদুত্তর ও ব্যাখ্যা দিতে হয়। যাতে প্রশ্ন উত্থাপনকারী সহযোগীরা কনভিন্সড হন তার বক্তব্য ব্যাখ্যায়। এমনটা কঠিন হলেও এখানেই গণতান্ত্রিক সমাজের শৈলী আর সৌন্দর্য। এ জন্য নেতাকে গণতান্ত্রিক চেতনার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। নিজের ভিশন তথা জাতিকে উন্নয়নের সর্বোচ্চ সোপানে এগিয়ে নেয়ার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুক্ষণ মনমস্তিষ্কে ধারণ ও লালন করতে হয়। গণতন্ত্রের এমন উদাহরণ বস্তুত সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অধিক লক্ষ করা যায়। তাই এই শাসনব্যবস্থাকে অধিকতর গণতান্ত্রিক ও প্রতিনিধিত্বশীল হিসেবেই মনে করা হয়ে থাকে।

সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ এতটাই সক্রিয় প্রাণবন্ত থাকে যে, এতে প্রশাসন তার দায়িত্ব পালন নিয়ে সদা সক্রিয় তৎপর এবং ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে থাকার চেষ্টা করে। অথচ ব্যক্তিতন্ত্রে এমন ধারণার কোনো অস্তিত্বই থাকে না, স্বীয় মত ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজ পথে চলতে চরম স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, কোনো পরামর্শও কানে তোলে না। এমন একদেশদর্শী সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জনগণের স্বার্থকে ক্ষুণœ করে; কিন্তু সে নেতার তাতে কিছুই যায় আসে না।

অপর দিকে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয় নিয়ে শেষ কথা বলার ক্ষেত্রে সামষ্টিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন অপরিহার্য। কোটি মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন অত্যাবশ্যক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতাকে ঘাটে ঘাটে তার দায়িত্ব পালন নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব ব্যাখ্যা দিতে হয়। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার ক্ষেত্রে বিরক্ত হওয়া যায় না। অর্থাৎ জবাবদিহিতার চেতনা ও মূল্যবোধকে ধারণ করতে হয়। এমন গণতান্ত্রিক চেতনাই দেশে সুশাসন, জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার পথকে উন্মুক্ত করে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হচ্ছে যোগ্য ব্যক্তিকে যথাযথ স্থানে বসিয়ে দায়িত্ব প্রদান। এখানে অনুরাগ-বিরাগের বা ব্যক্তিগত পছন্দের কোনো অবকাশ নেই। এভাবে দায়িত্ব গ্রহণকারী সব ব্যক্তির দায়িত্ব পালন নিয়ে রুটিনমাফিক মূল্যায়ন করতে হয়। তার যোগ্যতা উৎকর্ষের জন্য পুরস্কার আর অযোগ্য অদক্ষদের তিরস্কারের রেওয়াজ যথাযথভাবে পাালিত হলেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায় এবং জবাবদিহিতার রীতি অনুসৃত হয়।

দেশের নেতাকে শুধু ঘর সামলালেই চলে না। বহির্বিশ্বে রয়েছে তার অনেক দায়িত্ব। ভিন্ন দেশের কাউন্টার পার্টের সাথে কথা বলে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতবিনিময় নিয়তই তাকে করতে হয়। সে আলোচনায় কাউন্টার পার্টের মতো জ্ঞান ব্যুৎপত্তি এবং নানা বিষয়ে নিজের দেশের সমস্যা, সম্ভাবনা ও নীতি পথ যেমন তার নখদর্পণে রাখতে হয়, তেমনি বিশ্বের নানা ঘটনাপ্রবাহ, বিভিন্ন বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকতে হয় তাকে। তার জানা ও বিচার-বিবেচনার পরিধির কোনো ঘাটতি থাকতে পারবে না। কেননা, তিনি শুধু ব্যক্তি বিশেষ নন; দেশের লাখো মানুষের প্রতিনিধি। তাই তার সাথে জাতির সম্মান মর্যাদার প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজ বিশ্বের যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি সেখানে নানা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অবশ্য তেমন মানের নেতৃত্বকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ বেছে নেয়। তার দায়িত্ব পালনের সক্ষমতার পরিচয় দিতে হয় নির্দিষ্ট সময়ের পর নির্বাচনের সময়। নির্বাচনে সব কিছু চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে মানুষ। তার কাজ ও অবদান নিয়ে চলে গবেষণা আর মূল্যায়ন।

তবে এমন নেতৃত্ব ও তার সহযোগিতাকারীরা কোনো দেশেই প্রথম বা শেষ হতে পারে না। যদি তা হতো তবে সেসব দেশের অবস্থান স্বমহিমায় ধারাবাহিকভাবে সমুজ্জ্বল থাকতে পারত না। আমরা বস্তুত উন্নত ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের কথাই বলছি। নেতৃত্বের এই ধারাবাহিকতার প্রসঙ্গে একটু ভিন্ন ধরনের উদাহরণ পেশ করতে চাচ্ছি।

‘ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ’ এই পরিভাষা মূলত শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রেই বহুল প্রচলিত। এর সাধারণ অর্থ কোনো শিল্পের উৎপাদন কার্যক্রমকে সচল রাখার জন্য, প্রয়োজনীয় মালামাল তথা কাঁচামালের অব্যাহতভাবে জোগান দেয়া। শুধু শিল্পেই নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও তা ভিন্ন দ্যোতনা নিয়ে বিরাজ করে। কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা, বিপণনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যদি যোগ্য দক্ষ লোকবলের ঘাটতি দেখা দেয় আর সে শূন্যতা পূরণে যোগ্য কর্মনিষ্ঠ বুদ্ধিদীপ্ত সৎ ব্যক্তিকে নিযুক্ত না করা হয় তবে মরুপথে নদী যেভাবে হারিয়ে যায়, এমন পরিস্থিতিতে সব সচল প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যেও সেটিই ঘটবে।

যেসব প্রতিষ্ঠান উচ্চমান ধরে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে তারা কখনোই এমন শূন্যতা সৃষ্টি হতে দেয় না। শূন্যস্থান পূরণের জন্য নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দেয় এবং এই নীতি অনুসৃত হয়। সব সফল প্রতিষ্ঠানে এ ক্ষেত্রে বন্ধুস্বজনের প্রতি অনুরাগ অনুকম্পার কোনো প্রশ্রয় দেয় না। এভাবে আসলে যোগ্য সক্ষম ব্যক্তি তৈরি হয়। যারা সব প্রতিকূলতা মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন করে, একান্ত বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া নেতৃত্বের গুণাবলি নিয়ে মানুষের জন্ম হয় না।

পৃথিবীর সফল দীপ্যমান ব্যক্তি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের এন্টারপ্রেইনিউর বা কোনো রাষ্ট্রের কর্ণধার হন। তাকে অবশ্যই অধ্যয়ন প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের সমস্যার গভীরে পৌঁছার দক্ষতা থাকতে হবে। নতুন চিন্তা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা অনুশীলন, মানুষের মন-মানস মূল্যবোধ বোঝার অধিকারী হতে হবে।

কোনো দেশেই নেতা রেডি ও ‘রেডিমেড’ হয় না। নানা ঘাত-প্রতিঘাত উৎরে এসে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পরিপক্ব হয়েই নেতা হওয়া যায়। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই নেতা হওয়া ও নেতৃত্ব দেয়ার একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা আছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির যোগ্যতা ও মানুষের আস্থা সমর্থনই তার উপরে ওঠার সিঁড়িটাকে কাছে নিয়ে আসে।

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, আমেরিকার হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ও সিনেটই নেতা হওয়ার সূতিকাগার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পান কোনো দক্ষ যোগ্য সিনেটর অথবা কোনো রাজ্যের গভর্নর আর ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকেন সংসদীয় দলের নেতা যিনি বুদ্ধিদীপ্ত তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে খ্যাতির অধিকারী। উভয় দেশেই যোগ্যতা যাচাই হয় নানা বিষয়কে সম্মুখে রেখে। আজকের বিশ্বে উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে দলের সাংগঠনিক প্রশিক্ষণের বাইরেও নানা বিষয়ে জ্ঞান ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হয়। সেসব দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সর্বক্ষেত্রেই ছাত্রদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে অনন্য ভূমিকা রাখছে। রাজনীতি দর্শন বিজ্ঞান প্রযুক্তি চিকিৎসাসহ হেন বিষয় নেই যা নিয়ে সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চমানে দীক্ষা নেয়ার সুযোগের কোনো কমতি আছে। তৃতীয় বিশ্ব ও উন্নত দেশগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে সামান্য বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তাতে সচেতন পাঠকের এমন প্রশ্ন জাগ্রত হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, আসলে বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে কোন বলয়ের দেশ হিসাবে চিহ্নিত করা হবে? মুশকিল হলো যেসব ক্রাইটেরিয়া বা ইন্ডিকেটরের ভিত্তিতে কোনো দেশকে তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলে চিহ্নিত করা হয়, তা নিয়ে কিছু কথা তো বলা হয়েছে। সে ভিত্তিতে যদি বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করা হয়, তবে তৃতীয় বিশ্বের যে ‘শর্টকামিং’গুলোর কথা বলা হয়েছে, সেসব বিষয়ের কিছু কিছু বাংলাদেশে বিরাজ করছে। সেটি তো উপেক্ষা করা যায় না। তৃতীয় ও উন্নত বিশ্বের ভালোমন্দের যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হয়েছে তার ভিত্তিতেই পাঠক স্বাধীনভাবে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে নিজ সিদ্ধান্ত স্থির করে নিতে পারেন যে, আমাদের অবস্থান আসলে কোথায়? যেহেতু আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি ব্যক্তির মুক্ত স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়, সে আলোকে তো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে কেউ।

যাক, আমরা এই মুহূর্তে এই বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি বক্তব্য তুলে ধরতে চাই। সরকারি মহল থেকে সম্প্রতি বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ দরিদ্র দেশগুলোর অবস্থান থেকে উপরে উঠে এসেছে।’ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের আর যেসব দুর্বলতা রয়েছে, আমরা কি সেসব বৈশিষ্ট থেকে বেরুতে পেরেছি? তা ছাড়া দু’বছর ধরে কোভিডের মারাত্মক ছোবল দেশ ও জনগণকে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দিক থেকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। ফলে অসংখ্য মানুষ হতদরিদ্র হয়ে পড়েছে। অগণিত নারী পুরুষ বেকার জীবনযাপন করছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জীবনমান কল্পনাতীতভাবে নিচে নেমে গেছে। এসব বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের অবস্থান এখন কোথায় তা নির্ণয় করা কঠিন। আর এসব নির্ণয়ের দায়িত্ব দেশের বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের। নানা গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করে তথ্য-উপাত্ত পেশ করে তারা সঠিক মূল্যায়ন পেশ করতে পারেন। আমরা যেসব কথা বলে এসেছি, তা দেশের মানুষের বাস্তব জীবনের অবস্থা থেকে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলা আমাদের সাজে না। কেউ কেউ আবার এতে রাজনীতির ঘ্রাণ পেতে পারেন।

আমাদের আলোচনার মূল লক্ষ্য অবশ্য তৃতীয় বিশ্বের সমস্যা সঙ্কট নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তার কারণ হিসাবে যা মনে করেন, সেটিই হলো প্রকৃত সত্য। তবে আমরা হতাশ নই। দুর্বল অক্ষম মানুষই হতাশ হয়। দেশের সম্মুখের সব কিছু স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, কোটি কোটি মানুষ কোভিডের টিকা দেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। এতে আমরা সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তের আলোক শিখা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের ভরসা এবং ধৈর্য রয়েছে। সেটি সমুজ্জ্বল হয়ে উঠবে মনে করি। আমাদের রাষ্ট্রীয় ভিশন প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে এসেছে যে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি। সে পথে এগিয়ে যাওয়ার অভিযাত্রা হয়তো আমরা শিগগিরই শুরু করতে পারব। তবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছার এবং দৃঢ়তার সাথে অগ্রসর হবার কিছু শর্ত আছে। আজকের এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকেও সে সম্পর্কে ভাবনা শুরু করতে হবে। কথা শক্ত হলেও বলতে হচ্ছে- আমাদের সর্ব পর্যায়ে অনেকেই নিখুঁত নই, আমাদের অনেক দুর্বলতা রয়েছে যা ইতোমধ্যে বোঝা হয়ে গেছে। হয় পরিশুদ্ধ হওয়া, না হয় সরে যাওয়া সময়ের দাবি। যারা সমাজ রাষ্ট্রে স্মরণীয় বরণীয় তারা স্ব অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছিলেন বা পেরেছেন এভাবে আত্মসমালোচনা নিয়ে। দুর্বলতাগুলোর সন্ধান; তা থেকে পরিশুদ্ধ ও মুক্ত হবার চেষ্টা অহর্নিশ জারি রাখা জরুরি। গণতন্ত্র মানবাধিকার মুক্ত মতপ্রকাশের অধিকার সুশাসন জবাবদিহিতার মতো বিষয়গুলো পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। বিশেষ করে দেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে প্রকৃত অর্থে কার্যকর করতে হবে। শেষ করব এই কথা বলে যে, দেশের স্থপতি যে সংবিধান আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন তাতে দিকনির্দেশনার সব কিছুই রয়েছে, তাকে যথাযথভাবে অনুশীলন করতে হবে।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement