২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উপকূলের উপকথা

-

বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ উপকূল। এই সুদীর্ঘ উপকূলের জনজীবন সমতল ভূমি থেকে স্বতন্ত্র। উপকূল জীবন যেমন সমুদ্র উপকূলের কারণে আকর্ষণীয় তেমনি ঝড়ঝঞ্ঝা জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত। ১৯৭০ সালের মহাপ্লাবন দেখেছি। সে রকম মহাপ্লাবন আর ঘটেনি সত্য, কিন্তু নিত্যবছর ঝড়, প্লাবন যেন নিয়মিত ব্যাপার। সিডর, আইলায় জনজীবন বিপর্যস্ত। উপকূলের মানুষজন এর সাথে সংগ্রাম করেই বেঁচে আছে। তাই অন্য এলাকার মানুষের চেয়ে এই এলাকার মানুষ বেশি সাহসী। সংগ্রামমুখর জীবন তাদের। উত্তাল সাগর, অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপমালা এবং সমুদ্রসম্পদ দিয়েছে একে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। অফুরন্ত সম্ভাবনার হাতছানি দেয় বঙ্গোপসাগর। মৎস সম্পদের প্রাচুর্য এসব অঞ্চলকে দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন। মাছে-ভাতে বাঙালির সার্থকতা। খনিজসম্পদ আহরিত হলে তা যোগ করবে সমৃদ্ধের নতুন মাত্রা।

‘সে এক রূপকথারই দেশ- রূপের যেথা হয় না কভু শেষ’। সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের মাথিনের প্রেমকাহিনী আছে ধিরাজ ভট্টাচার্যের’ যখন আমি পুলিশ ছিলাম গ্রন্থে। চাঁটগা হয়ে আছে মালেকা বানুর দেশ। মনপুরার পাখি উপকূলের লোকদের বলে ‘সে যেন ভোলে না মোরে’ টিয়া রঙের দ্বীপটি আজো উজ্জ্বল। সারেং বউ আজো ঘোরাফেরা করে উপকূলের বিভিন্ন জনপদে। জলদাসের লোনা জলে জেলেদের জীবনগাথা আমাদের অশ্রুসিক্ত করে। নীল দরিয়া কাঁদে রইয়া রইয়া। রূপকথার শেষ এখানেই নয়।

এখনো মধ্য উপকূলে রূপজানের রূপকথা শিহরিত করে মানুষকে। পটুয়াখালীর সমুদ্র উপকূলবর্তী বড় বাইশদিয়া একটি প্রাচীন দ্বীপদেশ। সেখানে ১৯৪০-এর দশকে ঘটেছিল এক মর্মান্তিক ঘটনা। বিয়ে করা বউ দেয় না মেয়েপক্ষ। ছেলেপক্ষ ছিনতাই করে আনতে যায় বৈধ বউকে। দুর্ভাগ্যক্রমে বউ সে দিন ছিল না সেখানে। ছেলেপক্ষ অবৈধভাবে তুলে নেয় অপর নারী রূপজানকে। রূপজানকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায় মেয়েপক্ষ। গুম ও নারী অপহরণের মামলা হয়। তখন ব্রিটিশ যুগ। মামলায় এই উপকূলের ডজনখানেক সামন্ত প্রভু ফেঁসে যায়। আশঙ্কা জাগে ফাঁসির। ওদিকে পানসি নৌকায় করে অপহরণকারীরা ভেসে বেড়ায় নদীতে নদীতে, বন্দর থেকে বন্দরে। একটি রূপসী মেয়ে। অথচ কামুক পুরুষ অনেক। সুতরাং ঘটে নানা অঘটন। সে এক মর্মস্পর্শী কাহিনী। রূপজানকে বশে আনতে না পেরে সামন্তবর্গ অবশেষে খুন করে তাকে। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। সে কাহিনী আজো কাঁদায় পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি-পায়রা বন্দরের অগণিত মানুষকে।

পায়রা সমুদ্রবন্দর আশীর্বাদ না অভিশাপ! তা আজো মধ্য উপকূলের মানুষের এক বড় প্রশ্ন। ১৯৬০ সাল থেকে শ্রুত তৃতীয় সমুদ্রবন্দর অবশেষে ঠাঁই নেয় রাবনাবাদ নদের লালুয়া গ্রামে। উত্তাল পায়রা নদী থেকে অনেক দূরে হলেও পায়রা নামটি মন কেড়ে নেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাই এর নাম হয় পায়রা। সমুদ্রবন্দর হিসেবে কয়েক বছর আগে কাজ শুরু হয় পায়রার। এর অবকাঠামো তৈরির কাজ এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু ইতোমধ্যে ভূমিদস্যুদের শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে এখানে।

উল্লেখ্য যে, পায়রা বন্দর অবকাঠামো গড়ার আওতায় ইতোমধ্যে হাজার হাজার বিঘা জমি অধিগ্রহণ করেছে এই সরকার। আর বাস্তুচ্যুত হয়েছে শত শত পরিবার। ক্ষতিপূরণের মাত্রাও অনেক। কিন্তু অতীতের ভূমি রেকর্ডের ফাঁদে বঞ্চিত হচ্ছেন বর্তমান মালিকরা। দুর্নীতির সয়লাব সর্বত্র। পায়রা সমুদ্রবন্দর সংলগ্ন লালুয়া, বালিয়াতলী ও টিয়াখালী ইউনিয়নের অনেক অঞ্চল পায়রার পেটে গেলেও এখনো ক্ষুধা মেটেনি বন্দর কর্তৃপক্ষের। তারা লোলুপ দৃষ্টি দিয়েছেন অদূরবর্তী দ্বীপ ইউনিয়ন বড়বাইশদিয়া, চালিতাবুনিয়া ও মৌডুবীর দিকে। এতে অব্যাহত আতঙ্কে ভুগছেন ওই সব এলাকার অধিবাসীরা। তারা পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষকের জমির আর ক্ষতি না করতে। মিনিমাম ল্যান্ড ম্যাক্সিমাম ইউজ- নীতি অবলম্বন করলে অনেক জমি বেঁচে যায়।

সমুদ্রবন্দর কেন্দ্র করে অভাবিত উন্নয়ন ঘটবে এই উপকূলে। অবশ্য একটি ‘যদি’ আছে। যদি বন্দরটির কার্যকারিতা ও ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। পায়রাকে কেন্দ্র করে গভীর সমুদ্রবন্দরের চিন্তা ছিল। নদীতে অব্যাহত পলির বৃদ্ধি সে সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে। যে নদীর প্রবাহকে সম্বল করে পায়রার প্রতিষ্ঠা সেই রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্যতাই প্রশ্নের সম্মুখীন। ড্রেজিং করে করে যাতায়াত উপযোগী রাখা হচ্ছে। এতে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বেলজিয়ান একটি কোম্পানিকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের স্থাপনার পরিপার্শ্বই প্রমাণ করে, এটি একটি স্থায়ী লোকসানি ব্যবস্থা। মধ্য উপকূলীয় অঞ্চলে পায়রার সমুদ্রবন্দরের উপকারিতার লক্ষণ স্পষ্ট। ব্যবসাবাণিজ্য, কলকারখানা ও পর্যটনের প্রসার ঘটছে। অদূরেই কুয়াকাটার সাগরসৈকত পায়রার সৌকর্য বাড়াচ্ছে। জনগণের জীবনধারায় আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগছে। এর বিপরীতে কৃত্রিমতা, দুর্নীতি , নেশা, যৌনাচার ও অপসংস্কৃতির উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। যে কারণে কবিগুরু নগরকে ফিরিয়ে নিয়ে অরণ্য চেয়েছেন সেসব কারণ ঘটছে।

সবচেয়ে বড় বিপদ ঘটছে ভূমিদস্যুদের থেকে। হাজী সেলিমের সাইনবোর্ড দেখলাম আশপাশের এলাকায়। ছল বল কলা কৌশল করে বিজনেস হাউজগুলো কৃষকের জমি বেহাত করছে। সব মিলিয়ে পায়রাবন্দর আশীর্বাদ না অভিশাপ- এই চিন্তায় নিমগ্ন এলাকাবাসী।

তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র- আরেকটি বিপক্ষ। সারা বিশ্ব যখন কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে এসেছে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে তখন বাংলাদেশে রামপালে এবং পায়রা বন্দর এলাকায় স্থাপিত হয়েছে আরেক কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র। সাগর আর নদীবিধৌত বন-বনানী, গাছগাছালিতে পূর্ণ- এই এলাকা দূষিত হয়ে পড়বে, এই কয়লাভিত্তিক বিদুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের কারণে। শোনা যাচ্ছে, বন্দরের বিপরীতে বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নে জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা চলছে। সেখানেও আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে।

এসব নিয়ে উপকূলের মানুষ জীবন অতিবাহিত করছে। এর মধ্যে করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত পৃথিবী। বাংলাদেশ এখন কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় তরঙ্গ অতিক্রম করছে। সৌভাগ্যক্রমে দেশের সর্বত্র যে অবস্থা তা থেকে একটু ভালো এই এলাকার অবস্থা। করোনার করুণার কথা মাঝে মধ্যেই শোনা যায়। তবে আসল খবরের চেয়ে নকল খবর অনেক বেশি। অবশেষে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান শুরু হওয়ায় এই দূর উপকূলেও স্বস্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এত দিন এই উপকূলে আটকে পড়েছিলাম অনেক দিন। আশা ও আনন্দের মাঝে নিজ বাড়িঘর ছেড়ে যেতে পারছি- সেটিও ভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
গ্যাটকো মামলা : খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শুনানি ২৫ জুন বুড়িচংয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ গলাচিপায় স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে ৩টি সংগঠনের নেতৃত্বে মানববন্ধন থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা ছেলে হারা মা সাথিয়ার কান্না যেন থামছেই না বৃষ্টির জন্য নারায়ণগঞ্জে ইস্তিস্কার নামাজ আদায় প্রবাসী স্ত্রী থেকে প্রতারণার মাধ্যেমে দেড় লাখ টাকা চাঁদা আদায়, ছাত্রলীগ নেতাকে শোকজ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ভোটারের তালিকা চান হাইকোর্ট আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরো ৪৬ বিজিপি সদস্য উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুবককে কুপিয়ে হত্যা কক্সবাজারে ট্রেন লাইনচ্যুত, যোগাযোগ বন্ধ

সকল