২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রশিদ ছিদ্দিকীর ইতিহাস-আশ্রয়ী সাহিত্যকর্ম

- ছবি- সংগৃহীত

বাংলা সাহিত্যচর্চায় এ অঞ্চলের মুসলমানদের পিছিয়ে থাকা মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীকে সাহিত্য সাধনায় উদ্বুদ্ধ করে। সামাজিক দায়বদ্ধতা তাকে সফলতার শীর্ষে পৌঁছাতে সাহায্য করে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাহিত্যচর্চায় নিজস্ব অর্থায়নে মাসিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছেন। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার বিচরণ ছিল অবাধ ও স্বচ্ছন্দ। ছোটগল্প, কবিতা, উপন্যাস, অনুবাদ, রম্যরচনা, সম্পাদকীয়, প্রতিবেদন তৈরি, সাহিত্য সমালোচনায় যে বৈদগ্ধের পরিচয় দিয়েছেন, তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। বাগ্মিতা ও বক্তব্য উপস্থাপনায়ও পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী তার রচনায় শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার প্রয়াস পেয়েছেন। স্বাধীনতা, ইংরেজদের শোষণ, শিক্ষার বিকাশ, ইসলামী মূল্যবোধ, জাতীয় ঐক্য, নারীর মর্যাদা, সমাজ হিতৈষণা ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ছিল তার লেখার মূল সুর। ঐতিহ্যপ্রীতি ও ইতিহাসনির্ভরতা তার সাহিত্যকর্মকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর কক্সবাজারের মুসলিম সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ও সমাজহিতৈষী মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী ১৮৯৫ সালে কক্সবাজারের চকরিয়া থানার কাকারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক পরিসরে তার পড়ালেখার হাতেখড়ি। কৈশোরে মাতৃহারা হওয়ায় নানামুখী পারিবারিক সমস্যা ও জটিলতায় পড়েন। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ, নিরন্তর জ্ঞানসাধনা, বিদগ্ধজনের সান্নিধ্য ও কঠোর অধ্যবসায়ে স্বল্প সময়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী রচিত গল্প, কবিতা, উপন্যাস, অনুবাদ ও রম্যরচনানির্ভর গ্রন্থের সংখ্যা ২৮টি। এর মধ্যে ১৬টি কলকাতা ও চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। বাকি ১২টি পাণ্ডুলিপি আকারে রয়েছে। প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে- রুস্তম-সোহরাব; যবনবধ কাব্য; চিত্তদর্পণ; কলির বাঙ্গালা; পাকিস্তান বিজয় কাব্য; বিজয় কবিতা; চিন্তার ফুল; সমাজ চিন্তা; প্রেম কুঞ্জ; বাঙ্গালা মৌলুদ শরীফ; মহা কোরআন কাব্য; সত্য সন্ধান, নুরুন্নাহার; উপেন্দ্র নন্দিনী; জেরিনা; মেহেরুন্নেছা; প্রণয় প্রদীপ; গন্ধর্ব্যদুহিতা; মহাভুল সংশোধনী; মহাযুদ্ধ ও ভারতবাসী; হিন্দু ও মুসলমান; চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব; চাটিগামী ও রোঁমাই তত্ত্ব; হযরত আমীর হামযার জীবনী; ঊষা তারা; মুক্তার ছড়া; আত্মজীবনী ও পদ্মিনী।

তিনি ১৮৯৮ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম সংবাদপত্র বের করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তার সম্পাদনায় চট্টগ্রাম ও কলকাতা থেকে পাঁচটি সাপ্তাহিক ও মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বের হয়। সে যুগে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও একক প্রচেষ্টায় সংবাদপত্র প্রকাশনা ছিল রীতিমতো দুঃসাহসী কাজ। মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীর জন্মস্থান কক্সবাজারের সাংবাদিকতার ইতিহাস খুব প্রাচীন না হলেও ঐতিহ্যমণ্ডিত। তাকে কক্সবাজারের সাংবাদিকতার জনক-পথিকৃৎ হিসেবে অভিহিত করা যায়। তার আগে কক্সবাজারের কোনো ব্যক্তি সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেননি। তার সম্পাদিত সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- মাসিক ‘সাধনা’ (১৩২৬-১৩২৯), মাসিক ‘আন নেসা’ (১৩২৮-১৩২৯), সাপ্তাহিক ‘মুসলিম জগত’ (১৩২৯-১৩৩০), সাপ্তাহিক ‘রক্তকেতু’ (১৩৩৩-১৩৩৪), সাপ্তাহিক ‘কক্সবাজার হিতৈষী’ (১৩৪৬)। (অধ্যাপক নূর আহমদ অ্যাডভোকেট, কক্সবাজারের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৩৯-১৪০)।

এসব সংবাদপত্র ঘিরে একটি লেখকগোষ্ঠী তৈরি হয়, নবীন-প্রবীণ কলমসৈনিকরা সাহিত্যচর্চার একটি প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পান। এ ছাড়াও তৎকালীন প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিকদের লেখা নিয়মিত ছাপা হতো। কবি ও লেখকদের মধ্যে ছিলেন- কাজী নজরুল ইসলাম, কুমুদ রঞ্জন মল্লিক, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, শশাঙ্ক মোহন সেন, প্রমথ নাথ বিশী, জীবেন্দ্র কুমার দত্ত, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কায়কোবাদ, গোলাম মোস্তফা, শাহাদত হোসেন, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, ডা: লুৎফর রহমান, অধ্যাপক আবুল হোসেন, মাহবুব-উল-আলম, বনফুল, ফররুখ আহমদ নেজামপুরী, বঙ্গচন্দ্র নাথ কাব্যবিনোদ, অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম, আশুতোষ চৌধুরী, দিদারুল আলম, মৌলভী তমিজুর রহমান, জিতেন্দ্রনাথ সেন, মৃণালিনী বসু, হরিপ্রসন্ন দাস প্রমুখ। কাজী নজরুল ইসলামের গীতিময় দীর্ঘ কবিতা ‘অবেলায়’ ও ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত ও বহুল পঠিত কবিতা ‘আনোয়ার’ ও ‘রণভেরী’ এবং বেগম রোকেয়ার ‘আপিল’ সর্বপ্রথম মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী সম্পাদিত মাসিক ‘সাধনা’য় প্রকাশিত হয়। (শফিউল আলম, মোহাম্মদ আবদুর রশীদ সিদ্দিকী, পৃষ্ঠা ২৫-৭)

মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী সম্পাদিত মাসিক ‘আন নেসা’ প্রথম মুসলিম মহিলা সাহিত্য পত্রিকা হলেও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মহিলার লেখা এ পত্রিকায় স্থান পেত। নারী সমাজের অধিকার, পর্দাপ্রথা, গৃহস্থালি, আদর্শ নারীদের ভূমিকা, গৃহচিকিৎসা, পারিবারিক রীতিনীতি, পতিভক্তি, পাকপ্রণালী, জ্ঞান-বিজ্ঞানে দেশ-বিদেশের বিশেষত মুসলিম মহিলাদের অগ্রগতির কথা ‘আন নেসা’তে প্রকাশিত হতো। মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রপথিক হিসেবে ‘আন নেসা’র ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য। সে সময় যারা নিয়মিত ‘আন নেসা’য় সাহিত্যচর্চা করতেন তাদের মধ্যে শামসুন নাহার মাহমুদ, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, বেগম বদরুন্নেছা ফাতেমা খাতুন, বেগম আয়েশা খাতুন, বেগম সুফিয়া খাতুন, নূরজাহান, আজিজুন্নেসা খাতুন, মাখনমতী দেবী, কুমুদিনী বসু ও হেমলতা দেবী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৯-৩০)।

এসব সংবাদপত্রে সমকালীন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। পরাধীনতার গ্লানি থেকে জাতির মুক্তি, নিপীড়িত মানবতার কল্যাণ ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জাগরণে এসব পত্রিকার ভূমিকা ছিল আপসহীন, জোরালো ও তেজোদ্দীপ্ত। ১৯২২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ও আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘মুসলিম জগত’ পত্রিকা ব্রিটিশবিরোধী ভূমিকার জন্য পাঠকপ্রিয়তা পায়। ‘সময় থাকিতে সাবধান, বুঝে চল ব্রিটিশ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধের জন্য তিনি বিটিশ সরকারের কোপানলে পড়ে কারাবরণ করেন (অধ্যাপক নূর আহমদ অ্যাডভোকেট, কক্সবাজারের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-১৪০)। চারটি পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও ছিদ্দিকী ১৯৩৮ সালে কলকাতা থেকে ‘মোসলেম জগৎ পঞ্জিকা’ নামে একটা মুসলমানি পঞ্জিকা প্রকাশ করেন। এ পঞ্জিকায় ইসলামী মাসপঞ্জি, ইসলামবিষয়ক জ্ঞাতব্য বিষয় ও তথ্যাদি, পয়গাম্বর ও চার খলিফার জীবনী, কিছু ব্যঙ্গ-কৌতুক এবং ছিদ্দিকীর একটি গল্পও স্থান পেয়েছে। ‘মোসলেম জগৎ পঞ্জিকা’ ইসলাম ধর্ম ও আরবি মাস বিষয়ে বাংলাভাষায় সম্পাদিত প্রথম পঞ্জিকা।

আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী যে যুগে সাহিত্য সাধনা করেছেন তখন পরিবেশ বেশ অনুক‚ল ছিল এমন দাবি করা যাবে না। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি সাহিত্যচর্চা করেননি, বরং অন্তরের তাগিদ থেকেই এ পথে পা বাড়ান। সামাজিক চেতনাবোধ সাহিত্য আবহ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজের সচেতন জনগোষ্ঠীর সার্বিক সহযোগিতা ব্যতিরেকে সাহিত্য পত্রিকা টিকিয়ে রাখা কঠিন। সে সময় আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে যারা সাহিত্য পত্রিকা পরিচালনা করেন, তারা নিঃসন্দেহে প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল এক নিবন্ধে বলেন- “তখন সাহিত্যসাধনা আর সাহিত্যপত্রিকা চালানোর সুযোগ-সুবিধা ছিল অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। নিজেদের অর্থসঙ্গতিও ছিল অত্যন্ত সীমিত। তবুও তারা অনেকেই সাহিত্য সাময়িকী পরিচালনার অগ্রণী হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের মরহুম আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী তেমন এক সাহিত্য উদ্যোগী মানুষ ছিলেন। তিনি তেমন উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন না- প্রথম দিকে অর্থবিত্ত তার ছিল না তেমন। তবুও প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ‘সাধনা’ আর ‘আন্নেছা’ নামে দুটো মাসিক পত্র বের করেছিলেন। শেষোক্তখানা নামেই প্রকাশ-মহিলা পত্রিকা। সম্ভবত ওই ক্ষেত্রে অর্থাৎ মহিলা সম্পর্কীয় ব্যাপারে ‘আন্নেছা’ই ছিল আদি ও প্রথম পত্রিকা। তার আগে আর কোনো মুসলমান সম্পাদিত মহিলা পত্রিকার নাম শোনা যায়নি। আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী যখন ‘সাধনা’ বের করেন সে ১৩২৬ বাংলার তখন দেশে লেখক ও সাহিত্যিকদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। মুসলমান সমাজে তার সংখ্যা এক হাতের আঙুলেই গোনা যেত। মুসলমানদের ছাপাখানা ছিল না তখন এখানে। বিজ্ঞাপনের অবস্থাও আরো নৈরাজ্যজনক। কাজেই পত্রিকা চালিয়ে, বিশেষ করে সাহিত্য পত্রিকা চালিয়ে জীবিকা অর্জন তখন কল্পনারও বাইরে। তবুও ছিদ্দিকী সাহেবরা যে এ দুরূহ দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন সে স্রেফ সমাজকল্যাণ উদ্দেশ্যেই- সমাজকে সাহিত্যসচেতন করে তোলার মতলবেই। তাদের শক্তি আর সামর্থ্য অত্যন্ত সীমিত ছিল- এ সম্বন্ধে তারা নিজেরাও যে ওয়াকিবহাল ছিলেন তা নয়, তবুও ক্ষেত্র প্রস্তুতের দায়িত্ব তারা এড়াতে চাননি। সে যুগে আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীর মতো আরো কেউ কেউ সাহিত্যের প্রেরণা ও তার জন্য অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টির তাগাদা যে বোধ করেননি, তা নয়। তাদের অনেকেরই নাম, স্মৃতি আর কৃতিত্ব আজ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেলেও নীরবে এরা যে আমাদের ভবিষ্যৎ সাহিত্য ইমারতের ভিতপত্তন করে গেছেন তাতে সন্দেহ নেই। এদের উদ্যোগ, উদ্যম, আর প্রচেষ্টার পরিচয় আর মূল্যায়ন দরকার। তা না হলে আমাদের সাংবাদিকতা আর সাহিত্যের ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যাবে” (আবুল ফজল, ‘সাধনা’- একটি সাহিত্য মাসিকী, মাহে নও, ঢাকা, ১৯৬৭)।

‘মহা কোরআন কাব্য’ হলো মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীর পবিত্র কুরআনের আমপারা খণ্ডের কাব্যানুবাদ। ১৯২৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত আমপারা খণ্ডের এ অনুবাদ ছিল কোনো মুসলিম লেখকের প্রথম সফল প্রয়াস। কাজী নজরুল ইসলাম অনূদিত কাব্যে আমপারা প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে অর্থাৎ ছিদ্দিকীর অনুবাদের পাঁচ বছর পর। ছিদ্দিকীর কাব্যানুবাদে প্রতিটি সূরার শানে নুজুল বা অবতীর্ণ হওয়ার কারণ, ঐতিহাসিক ঘটনা ও পটভূমি বিশ্লেষিত হয়। প্রতিটি সূরার রয়েছে মূল আরবির মতো, গদ্যানুবাদের পর কাব্যানুবাদ। মহা কোরআন কাব্যের ভূমিকায় মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী লিখেছেন-
‘কুরআন গদ্য পুস্তক নহে, ইহা একটা সর্বছন্দ সমন্বিত মহাকাব্য। একটু অনুধাবন করিলে ইহার পঠন প্রণালি ও অর্থ বিশ্লেষণ কাব্য সাহিত্যের সর্বপ্রকার মালমসলা এবং সর্বাধিক সম্পদ বিদ্যমানতার প্রমাণ প্রদর্শন করিবে। কুরআনের কবিতাবলি ও আমপারার উপাদেয় সঙ্গীত রত্নরাজির সহিত তুলিত হইতে পারে এমন কবিতা ও সঙ্গীত পৃথিবীর কোনো ভাষায় আছে বলিয়া আমার মনে হয় না। হাফেজগণ যখন মধুর কণ্ঠে কুরআনের আয়াতগুলো পাঠ করিতে থাকেন তখন কী স্বর্গীয় ললিত ঝঙ্কার মানুষের প্রাণে বিভুপ্রেমের কি অমৃত সুধাই না বর্ষণ করে!’ (মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী, মহা কোরআন কাব্য, কলকাতা, ১৯২৭, ভূমিকা)। সূরা আল ফাতিহার কাব্যানুবাদ সম্পর্কে গবেষক ড. মুজিবর রহমান খান মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন- ‘সঙ্গীতের ছোঁয়াচ ও ললিত ঝঙ্কার কাব্যখানিকে সত্যই সুন্দর ও সার্থক করিয়াছে’ (বাংলাভাষায় কুরআন চর্চা, ১৯৮৬)।

চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীর আগ্রহ ছিল অদম্য। প্রচুর আরবি, উর্দু ও ফারসি শব্দ চট্টগ্রামের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের ‘চট্টগ্রামী ভাষার রহস্য ভেদ’ গ্রন্থ প্রকাশের আগে এ বিষয়ে ছিদ্দিকী ‘চট্টগ্রামের ভাষাতত্ত্ব’ নামে দু’টি পুস্তক রচনা করেন। ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব’ (ব্যাকরণসংবলিত) গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেন- “আমি চট্টগ্রামী কথ্যভাষার তত্ত্ব উদ্ধারের জন্য বহুদিন হইতেই চেষ্টা করিয়া আসিতেছি। ১৩৩৬ সালে ‘চট্টগ্রামের ভাষাতত্ত্ব’ নামে আমি একখানি ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশ করিয়াছিলাম, কিন্তু ইহাতে কৃতসঙ্কল্পের পূর্ণ সাফল্য ঘটে নাই। তখন হইতেই আমি আমার এই ভাষার উৎপত্তিগত, ভাবগত ও অর্থগত তাৎপর্যের উদ্ধার কামনায় নিজের শক্তি ক্ষয় করিয়া আসিতেছি। আজও আমি সফলকাম হইয়াছি বলিতে পারি না। তত্রাচ আমি আজ পর্যন্ত চট্টগ্রামী ভাষার মূলতত্ত্ব উদঘাটন করিয়া যতটা আয়ত্তাধীন করিতে সক্ষম হইয়াছি তাহাই আজ প্রকাশ করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না। এতদ্বারা আংশিক সাফল্যকেও আমি বিরাট সাফল্য বলিয়া মনে করিব, যদি দেশবাসী ইহার ভিতর দিয়া নিজেদের বুলির সহিত কথঞ্চিৎও পরিচিত হইতে পারেন” (‘চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব’, ভূমিকা, ১৩৫৩ বঙ্গাব্দ)। আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী যে এ বিষয়ে সাফল্য অর্জন করেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। কারণ ড. মুহাম্মদ এনামুল হক তার ‘চট্টগ্রামী ভাষায় রহস্য ভেদ’ গ্রন্থে ছিদ্দিকীর গ্রন্থকে অন্যতম রেফারেন্স পুস্তক হিসেবে যেমন গ্রহণ করেন, তেমনি অনেকগুলো চট্টগ্রামি আঞ্চলিক শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে ছিদ্দিকীর মতামতকেও গ্রহণ করেন। গবেষকরা ‘চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব’ গ্রন্থটিকে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি মনে করেন। এটা চট্টগ্রামী উপভাষার ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ এবং বাংলা উপভাষা গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংযোজন (মালিক সোবহান, কক্সবাজার চরিতকোষ, পৃষ্ঠা-১৯)।
ব্যক্তিজীবনে মরহুম মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী ছিলেন নিরহঙ্কার, নির্লোভ ও বন্ধুবৎসল। জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় তিনি কলকাতার মতো নগরীতে কাটালেও নিজ গ্রামকে ভুলতে পারেননি। কলকাতায় স্থায়ীভাবে অবস্থান না করে তিনি স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন। গ্রামকে তিনি তার সমাজসেবার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বেছে নেন। জনসেবা, দেশপ্রেম ও জনকল্যাণ ছিল তার জীবনব্রত। ইসলামী অনুশাসন পালনে তিনি ছিলেন সতত যত্নশীল। বাংলাদেশের প্রথিতযশা আলিম ও সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা ছিদ্দিক আহমদের (রহ:) সাথে ছিল তার বিশেষ সখ্যতা ও সম্পর্ক; কারণ দু’জনই ছিলেন বহুমাত্রিক মেধা ও সৃজনশীল মননের অধিকারী। ১৯৫১ সালে ৫৬ বছর বয়সে এ মনীষী ইন্তেকাল করেন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement