১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হার না মানা জীবনের কালজয়ী গল্প

- ছবি- সংগৃহীত

১৯৬০ সালের কথা। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। এম.ই স্কলারশিপ পরীক্ষার জন্য রাত জেগে পড়াটা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুমের জন্য খুব অসুবিধা হচ্ছিল। তাই আমি গেলাম তখনকার দিনে নোয়াখালির মাইজদী শহরের জনপ্রিয় চিকিৎসক কেদার নাথ মজুমদারের কাছে। গিয়ে বললাম, মামা আমাকে একটু ওষুধ দেন তো। মামা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোর আবার কী হলো? বললাম ঘুমের জন্য পড়ালেখা করতে পারি না। ঘুম যেন না হয় তার জন্য একটু ওষুধ দেন। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে আমার গালে এক চড় মেরে বললেন, যা বেটা। মানুষ ঘুমের জন্য ওষুধ খায়, আর তুই এসছিস ঘুম তাড়ানোর ওষুধ চাইতে। এত পড়ার দরকার নেই। ঘুমের সময় ঘুমাবি, বাকি সময় পড়লেই চলবে।

আসলে ঘুম তাড়িয়ে রাত জেগে পড়ার আমার এ ধারণার পেছনে উৎস ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। প্রাইমারিতে পড়ার সময়ই আমাদের শিক্ষকের কাছে জেনেছি তিনি রাত জেগে পড়ার সময় ঘুম তাড়াতে মাথার চুলের টিকলিকে ঘরের সিলিং থেকে ঝুলানো রশির সাথে বেঁধে নিতেন যাতে ঝিমুনি এলেই চুলে টান খেয়ে আবার পড়া শুরু করতে পারেন। এ গল্পটি শুনিয়ে আমাদের শিক্ষক কৌতুক করে বলতেন, উনি তো এভাবেই বিদ্যাসাগর হয়েছেন। তোরা তো বিদ্যার ডোবাও হবি না। কথাটা মনে দাগ কেটেছিল। মনের অজান্তে বিদ্যাসাগরই হয়ে গেলেন অনুপ্রেরণা।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এক বিরল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তার প্রতিটি কাজই ছিল ব্যতিক্রমী এবং অন্যদের থেকে আলাদা। সেই ছোটবেলায় আট বছর বয়সে নিজ বাড়ি মেদিনীপুরের বীর সিংহ গ্রাম থেকে বাবার সাথে দীর্ঘপথে কলকাতায় হেঁটে আসার সময় পথের ধারের মাইল পোস্টগুলোর লেখা দেখে ইংরেজি সংখ্যা ১, ২, ৩... গণনা শিখে নিয়েছিলেন। কলকাতায় এসে বাবার সাথে থাকতেন অন্যের বাড়িতে। সেখানে পড়ার জায়গা বা বাতির ব্যবস্থা ছিল না। তাই রাতভর রাস্তার লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ালেখা করতেন সে আলোতেই। মাত্র ৯ বছর বয়সেই তার জ্ঞানের বহর দেখে কলকাতা সংস্কৃত কলেজ তাকে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে নিলো। ১২ বছর ধরে তিনি অলঙ্কার, স্মৃতি, বেদান্ত এবং ন্যায় শ্রেণীর পাঠ শেষ করে ব্যাকরণ, ভাষা, সাহিত্য ও দর্শনে উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে এখান থেকে বের হন। এখানে পড়ার সময় নজিরবিহীন অগাধ জ্ঞান লাভ করায় সংস্কৃত কলেজই তাকে ‘বিদ্যাসাগর উপাধি’ দেয়। এ সময় পাশাপাশি তিনি ল’ কমিটির পরীক্ষায় (আইন বিষয়) মাত্র ২০ বছর বয়সেই উত্তীর্ণ হলে সেখান থেকে দেয়া সার্টিফিকেটে তাকে প্রথমবারের মতো ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। তিনি নিজে কিন্তু তার নামে পারিবারিক উপাধি ‘বন্দোপাধ্যায়’ না লিখে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা লিখতেন যেন তার ব্রাহ্মণ পরিচয় ফুটে না উঠে।
সংস্কৃত কলেজ থেকে শিক্ষা শেষ করে মাত্র ২১ বছর বয়সেই তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রথমে শিক্ষক হিসেবে ও পরে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে বিভাগীয় প্রধান পদে যোগদান করেন। পাঁচ বছর পর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছেড়ে সংস্কৃত কলেজে যোগ দিলেও শিক্ষা সংস্কার নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে মতানৈক্যের কারণে আবার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে চলে যান এবং একপর্যায়ে সেখানে অধ্যক্ষ পদ লাভ করেন। কিন্তু সংস্কৃত কলেজ কাজের পুরো স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকার করে তাকে আবার ফিরিয়ে আনে। এখানেও পরে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন।

অধ্যাপনা আর প্রশাসনিক দায়িত্বের এত সব ব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিরলস অন্যান্য সৃজনশীল এবং সামাজিক কাজেও নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তার সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ‘বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক’ বলে অভিহিত করেন। আর মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র গদ্যের মধ্যেও এক মোহময় ছন্দ ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তিনি রচনা করেছেন বেতাল পঞ্চবিংশতি, ঋজু পাঠ, শকুন্তলা, ভ্রান্তি বিলাস (শেকসপিয়রের Comedy of Errors অবলম্বনে), আখ্যান মঞ্জরী, উপক্রমণিকা, বোধোদয়, বাংলার ইতিহাস, সীতার বনবাস আর শিশুদের জন্য ঈশপের গল্প, বর্ণ পরিচয় (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড) এবং আরো অনেক বই। এখানে বলে রাখা ভালো যে, বাংলা লিখনে বিরাম চিহ্নের ব্যবহার রীতিও তারই করা।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যখন আবির্ভাব তখন এ অঞ্চলে শিক্ষার ব্যবস্থা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। সুতরাং তিনি ভাবলেন শিক্ষার আলো ছড়াতে প্রয়োজন প্রচুর বিদ্যালয়। ঝাঁপিয়ে পড়লেন। একটি নয়, দুটি নয় বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি একক প্রচেষ্টায় ৫৫টি বিদ্যালয় স্থাপন করে ফেললেন-২০টি মডেল স্কুল আর ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয়। সবই অবৈতনিক। এ খবর পেয়ে ইংরেজ সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল, তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, এত স্কুল যে চালু করলেন এর বিপুল ব্যয় কে দেবে? শিক্ষকদের বেতন কোত্থেকে আসবে? সরকারের পক্ষে তো এ বিপুল ব্যয়ভার বহন সম্ভব নয়। তিনি জানতেন এমন কিছু ঘটতে পারে। তাই আগেই বিভিন্ন এলাকার বিত্তবানদের কাছ থেকে তহবিলের প্রতিশ্রæতি নিয়েছিলেন। তবে খরচের এক বড় অংশ শেষ পর্যন্ত তাকেই বহন করতে হয়েছিল। তবুও স্কুল একটিও বন্ধ হতে দেননি। শুধু শিশুশিক্ষা আর মাধ্যমিক শিক্ষাই নয়, উচ্চশিক্ষা বিস্তারেও তার অবদান অনেক। উচ্চশিক্ষার সংস্কারের জন্য তিনি নিজ উদ্যোগেই একটি বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করে সরকারের কাছে পেশ করলেন। এটি সে আমলে ‘শিক্ষা ব্যবস্থার ম্যাগনাকার্টা’ নামে পরিচিতি পেল। এ রিপোর্টটি পরে বাস্তবায়িত হয়। এরই আলোকে ভারতবর্ষে প্রথম উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ উদ্যোগের সাথে জড়িত হন তিনিও। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কমিটির ৩৯ সদস্যের মধ্যে মাত্র যে চারজন এদেশীয় অন্তর্ভুক্ত হন তার একজন ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এমনকি পরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়েরও ফেলো নির্বাচিত হন তিনি।

শিক্ষাকে সুসংগঠিত করার কাজেও তিনিই ছিলেন অগ্রণী। কারিকুলাম ভিত্তিক সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘কলকাতা স্কুল সোসাইটি’ যা পরে ‘বঙ্গীয় স্কুল সোসাইটির’ রূপ নেয়। পাক-ভারত স্বাধীনতার পর এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরতে খুদার নেতৃত্বে ‘ইস্ট পাকিস্তান স্কুল টেক্সবুক বোর্ড’ আত্মপ্রকাশ করে যা আজকের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।

এ অঞ্চলে শিক্ষার ব্যবস্থাপনাও শুরু হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই। তার আগ্রহেই ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘স্কুল ইন্সপেক্টর’ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। বিরামহীনভাবে গ্রামেগঞ্জে ছুটে বেরিয়েছেন বিদ্যালয় পরিদর্শনে। সেটিও ছিল ব্যতিক্রমী ও নিজস্ব ঢঙে। একবার এক পরিদর্শনে গিয়ে একটি বিদ্যালয়ের মাঠের গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়ার সময় কানে এলো- শিক্ষার্থীরা কিছু ভুল পড়ছে। উঠেই ক্লাসে ঢুকে একজন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলো তো দিন-রাত কিভাবে হয়’? ছাত্রের উত্তর, ‘সূর্য উঠলেই দিন, আর সূর্য ডুবে চাঁদ দেখা গেলেই রাত’। ঝটপট শিক্ষক আবার ছাত্রকে শুধরে দিয়ে বললেন, ‘সূর্য দেবতা আলো ছড়ালেই দিন হয়’। এসব শুনে বিদ্যাসাগর রাগ করলেন না। বরং ‘আহ্নিক গতি-বার্ষিক গতির’ বৈজ্ঞানিক তত্ত¡ দিয়ে দিন-রাত সৃষ্টির বিষয় বুঝিয়ে দিলেন। সেদিনই তিনি বুঝতে পারলেন শিক্ষকদেরও কিছু প্রশিক্ষণ দরকার। এরপরই তিনি শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন ‘কলকাতা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ যেটি বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ।

মানুষের বিপদে-প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্বভাবজাত গুণ। এ কারণেই তো তিনি শুধু ‘বিদ্যাসাগর’ নন, ‘দয়ার সাগর’ নামেও খ্যাত ছিলেন। তার উপার্জনের প্রায় সবটুকুই তিনি দান করে দিতেন। উপার্জনও ছিল তার ভালোই। চাকরির বেতনের পাশাপাশি তিনি বইয়ের রয়্যালটি পেতেন। আবার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রিন্টিং প্রেস এবং বইয়ের লাইব্রেরিও। প্রকাশ করতেন নিজ সম্পাদনায় সাপ্তাহিক এবং মাসিক পত্রিকাও। যেমন- সর্বশুভকরী, তত্ত্বাবোধিনী, সোমপ্রকাশ ও হিন্দু প্যাট্রিয়ট। কলকাতার বাদুর বাগানে একটি বাড়িও বানিয়েছিলেন। তবে সে বাড়িতে জায়গা দিয়েছিলেন নিজ গ্রামের বহু গরিব দুঃখী ছাত্রকে। তাদের পড়ার খরচও দিতেন। এমনকি বিখ্যাত কবি নবীনচন্দ্র সেনও ছাত্র জীবনে তার আর্থিক সাহায্যেই লেখাপড়া চালিয়েছিলেন। শেষ জীবনে আর্থিক সঙ্কটে পড়া কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের খরচও যেত বিদ্যাসাগরের কাছ থেকেই। ১৮৬৬ সালের দুর্ভিক্ষের সময় নিজ গ্রাম বীর সিংহে লঙ্গরখানা খুলে তিনি দিনের পর দিন শত শত ক্ষুধার্ত মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন। এ বিশাল আয়োজনের খরচ জোগাতে গিয়ে একপর্যায়ে তাকে নিজের প্রেসটিও বন্ধক রাখতে হয়েছিল। কিন্তু তারপরও তিনি লঙ্গরখানা বন্ধ করেননি।

সমাজ সংস্কারে তিনি ছিলেন এক সাহসী যোদ্ধা। হিন্দু সমাজে শত শত বছর ধরে বিধবা বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল। আর সেটিকেই আইনসিদ্ধ করার জন্য বিদ্যাসাগর পুরো হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে একাই লড়ে গেলেন। শেষ অবধি খবমরংষধঃরাব ঈড়সসরঃঃবব তে ‘বিধবা বিয়ে আইন’ পাস করিয়ে নেন। আইনটির খসড়াও তিনি নিজেই তৈরি করে দিয়েছিলেন। পরে নিজের অর্থব্যয়ে অনেক দরিদ্র বিধবার বিয়ের আয়োজনও করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের মাতৃভক্তির কাহিনী এ দেশের কে না জানে? মায়ের আদেশ পালন করতে গিয়ে তিনি কনকনে শীতের রাতে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় প্রমত্তা দামোদর নদীও সাঁতরে পাড়ি দিয়েছিলেন।

এ অসাধারণ মানুষটির চালচলন কিন্তু ছিল একেবারেই সাদাসিধে। সাদা ধুতি, গায়ে জড়ানো সাদা চাদর আর এক জোড়া চটি জুতা। এগুলো নিয়ে কখনো কখনো বেশ বিব্রতকর অবস্থায়ও পড়তে হতো তাকে। একবার বর্ধমানের জমিদার বাড়ির প্রহরী তাকে ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। খবর পেয়ে জমিদার স্বয়ং ছুটে এসে তাকে সসম্মানে নিয়ে গেলেন। একইভাবে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির বার্ষিক বোর্ড সভায় যোগ দিতে এসেও শুনলেন চটি নিয়ে ভেতরে ঢুকার নিয়ম নেই। সোসাইটি তার জন্য নিয়ম শিথিল করতে চাইলে তার কথা ছিল- সবার জন্য সাধারণ নিয়ম করলেই তিনি ভেতরে যাবেন। সেটি কর্তৃপক্ষ করতে পারেনি, তিনিও আর এশিয়াটিক সোসাইটির সভায় যোগ দেননি কখনো। আবার তার পোশাক কখনো কখনো অন্যদেরও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল। একবার এক স্টেশনে ট্রেন থেকে তার সাথে সাথে এক সাহেবও নামলেন। ছোট্ট একটি ব্যাগ হাতে সাহেব কুলি কুলি করে ডাকতেই পাশ থেকে তিনি এগিয়ে ব্যাগটি হাতে নিলেন। সাহেবকে বাইরে পালকি পর্যন্ত এগিয়ে দিলে সাহেব তাকে দু’আনা পয়সা দিতে চাইলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, পয়সা লাগবে না। আপনি একটি ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে খুব বড় বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন তো। তাই একটু সাহায্য করলাম। সাহেব লজ্জাই পেলেন। আর একদিন ভোরবেলা তিনি অভ্যাসমত তার বাড়ির বাগানে কাজ করছিলেন। এমন সময় চারজন ভদ্রলোক এসে তাকে বললেন, একটু ভেতর থেকে বিদ্যাসাগর বাবুকে ডেকে দাও। তিনি বললেন, একটু বসুন, হাতের কাজটা সেরে নেই। কাজ সেরে হাত-মুখ ধুয়ে একটি চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞেস করলেন, কী কাজ বলুন। এর উত্তরে তারা যখন বললেন, আমরা বিদ্যাসাগর বাবুর কাছে এসেছি, তিনি বললেন, আমিই ঈশ্বরচন্দ্র। ভদ্রলোকেরা লজ্জায় পড়ে বারবার ক্ষমা চাইলেন।

জীবনে সম্মানও কম পাননি তিনি। ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো ছিলেন, ভূষিত হয়েছিলেন সর্বোচ্চ খেতাব CIE-তে। কিন্তু এসবে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। এ কর্মবীর কর্ম দিয়েই জীবন সাজিয়েছিলেন, আর কর্মেই পরিণতি টেনেছিলেন। মা আর স্ত্রীকে হারানোর পর একাকী হয়ে পড়া ঈশ্বরচন্দ্র জীবনের শেষ দিনগুলো কাটান বিহারের কারমাটারে সাঁওতাল পল্লীতে। উদ্দেশ্য ছিল ভাগ্যবিড়ম্বিত দরিদ্র এ জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করা। কারমাটারে একখণ্ড জমি কিনে ঘর তুললেন, চারদিকে ক্ষেত আর বাগান করলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি স্কুলও। প্রতিদিন সকালে সাঁওতালদের নিয়ে ক্ষেতে কাজ করতেন। সবজি আর ফসলগুলো তাদের মধ্যেই বিলিয়ে দিতেন। বাগানের কাজ শেষে যেতেন স্কুলে। সেখানে তিনি একাই ছিলেন শিক্ষক, আর সব বয়সের সাঁওতাল শিক্ষার্থী। বিকেলে আবার তাদের নিয়েই আসর বসিয়ে সময় কাটাতেন। অসম্ভব বৈচিত্র্যময় এ মহাপুরুষটি এসব করতে করতে ১৮৯১ সালের জুলাই মাসে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কলকাতা এসে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। একদিন নিঃসঙ্গ হাসপাতাল বেডে সত্যি সত্যি ৭১ বছরের অসম্ভব ব্যস্ত এক কর্মময় জীবনের শেষ দিন এসে গেল। জানা গেল, লিভার ক্যান্সারেই তার শেষ পরিণতি।

এ মহাপ্রাণ ব্যক্তিটি ছোট্ট এক জীবনে মানুষের জন্য এত কাজ করলেন। আবার রেখেও গেলেন এক উদ্দীপনাময় কর্মমুখর জীবনাদর্শ, অনুকরণীয় সব গুণাবলি এবং শিক্ষণীয় বিষয়ের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। ২৯ জুলাই ছিল এ মহান শিক্ষকের প্রয়াণ দিবস। জানাই শ্রদ্ধা। আজকের সমাজে এত স্খলনের মধ্যে তার নীতি-আদর্শগুলো যদি কিছুটা পথ দেখায়।

লেখক : প্রাক্তন চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ


আরো সংবাদ



premium cement
অননুমোদিত জমি ভরাট কার্যক্রমের সন্ধান পেলে দ্রুত ব্যবস্থার নির্দেশ ভূমিমন্ত্রীর ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা ইসরাইলকে পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাতের ব্যাপারে সতর্ক করলো আইআরজিসি সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ১২৮তম প্রয়াণ দিবসে স্মরণ সভা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের শূন্য পদ দ্রুত পূরণের নির্দেশ ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে ঝুলন্ত নারীর লাশ উদ্ধার মধুর প্রতিশোধে সিটিকে বিদায় করে সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ রাজশাহীতে ভুয়া তিন সেনা সদস্য গ্রেফতার ডেঙ্গুতে আরো একজনের মৃত্যু, আক্রান্ত ২৩ চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণ, প্রতিদ্বন্দ্বী আ'লীগ নেতাকে ইসির শোকজ বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা

সকল