২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উজবেকিস্তানের আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

উজবেকিস্তানের আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব - ছবি : নয়া দিগন্ত

উজবেকিস্তানের শহর সমরকন্দে রাসূল সা:-এর সাহাবি কুসাম ইবনে আব্বাস রা:-এর মাজার রয়েছে। আশপাশে আছে আরো অনেক মাজার। হজরত কুসাম রা: এ অঞ্চলে ‘শাহেজিন্দা’ বা ‘জীবিত বাদশাহ’ নামে প্রসিদ্ধ। তিনি আমাদের প্রিয় নবী করিম সা:-এর চাচা আব্বাস রা:-এর ছেলে। কুসাম ইবনে আব্বাস রা: যৌবনকালেই সমরকন্দে আসেন এবং ইসলামের শিক্ষা প্রচার করেন। ইসলামের শত্রুরা নামাজরত অবস্থায় তাকে শহীদ করেছিল। বর্ণিত আছে, শাহাদতের পর তার দেহ গায়েব হয়ে যায়, এরপর লোকেরা তাকে ‘শাহেজিন্দা’ নামে ডাকেন।

উজবেকিস্তানে ইমাম বুখারি রহ., ইমাম তিরমিজি রহ. ও নকশবন্দ সিলসিলার প্রতিষ্ঠাতা বাহাউদ্দিন নকশবন্দীর মাজার রয়েছে। ১৪ শতকের সুফি নেতা নকশবন্দের বিশ্বজুড়ে ১০ কোটির বেশি অনুসারী। আমির তৈমুরকে নিয়েও উজবেকরা গর্ব করে থাকেন। ভারতের সম্রাট বাবর মূলত তৈমুরের বংশধর ছিলেন, আসলে কোনো মোগল নন।

উজবেকিস্তানে মাজারের সংখ্যা দুই হাজারের কম নয়। সমরকন্দ ও বুখারা শহরে এসব মসজিদ ও মাজারের বেশির ভাগ অবস্থিত। সমরকন্দ শহরে সমাধি রয়েছে সম্রাট তৈমুর লং, জ্যোতির্বিদ উলুগবেক ও কুসাম ইবনে আব্বাস রা:-এর। সপ্তম শতকে এ অঞ্চলে কুসাম ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছেন। উজবেকিস্তান এখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মুসলিমদের জন্য একটি কেন্দ্রবিন্দু হতে চায়। মুসলিমদের আকর্ষণ করার মাধ্যমে ‘দ্বিতীয় মক্কা’ হিসেবে পরিচিতি পেতে চায় দেশটি। পর্যটন খাতকে লাভজনক করার জন্য উজবেকিস্তানের ভিসা প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে।
১৯৯১ সালের ৩১ আগস্ট উজবেকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পরলোকগত ইসলাম করিমভ প্রেসিডেন্ট হন। প্রায় ২৬ বছর তিনি একনায়কতন্ত্র কায়েম করে রেখেছিলেন এবং ইসলামপন্থীদের ওপর দমন-পীড়ন করায় কয়েকবার হত্যা প্রচেষ্টার শিকার হন। তখন রাজনৈতিক দল হিজবুত তাহরিরকে নিষিদ্ধ করা হয়।

পাকিস্তানি কর্মকর্তারা জানান, উজবেক যোদ্ধারা পাকিস্তানের সোয়াত ভ্যালিতে প্রবেশ করে আক্রমণ চালায়। স্থানীয় তালেবান দলে প্রায় চার হাজার বিদেশী যোদ্ধা আছে। এরা অনেকেই আইএমইউ বা ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তানের সদস্য। এই দল সোভিয়েত সময়কাল থেকেই ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে আসছিল। পাকিস্তানের মালাকান্দ, কোহিস্তানসহ চীন-পাকিস্তান সীমান্ত ও তাজিকিস্তানের দুর্গম পবর্তমালায় ঘাঁটি গড়ে এরা প্রভাব বিস্তার করছে, ইসলামী আন্দোলনে পুরো মধ্য এশিয়া তাদের লক্ষ্য। দলটি তাই একই সাথে রাশিয়া, চীন ও আমেরিকাবিরোধী শত্রু। চীন আইএমইউ যোদ্ধাদের উত্থানে চিন্তিত। পাকিস্তানকে চীন পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট সদস্যদেরও নির্মূল ও বিতাড়ন করার পরামর্শ দিয়েছে। চীন দাবি করে, উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে উজবেকিস্তানের ইসলামী মুভমেন্টে দলের গলায় গলায় ভাব। আফগানিস্তানের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা ও রাশিয়ানরা বেতার মাধ্যমে এমন সব ভাষা শুনেছেন যেগুলো আফগান ভাষা নয়। পরে রাশিয়ার সাথে তথ্যবিনিময়ে জানা যায়, ওরা চেচেন ও উজবেক যোদ্ধা। তারা অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে আফগানিস্তানে যৌথবাহিনীর ওপর দুর্দান্ত হামলা চালাত। অভিযোগ, মধ্য এশিয়ায় বিভিন্ন রুটে যারা আফিম চোরাচালান করে অর্থ উর্পাজন করে, এই উজবেক যোদ্ধাদের ভাগ না দিয়ে তাদের কারো পার পাওয়া সম্ভব নয়।
উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভ, সন্দেহভাজনদের দাড়ি কাটা, পাগড়ি পরিধান-এসব বন্ধ করেন, জেলে ঢুকান, বন্দিশিবির বানালেন; তবু তাদের দমাতে পারেননি। উজবেক এসব যোদ্ধা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানি তালেবানদের বিভিন্ন কাজে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে অদ্যাবধি।

আফগান যুদ্ধে খাইবার পাসের পর ন্যাটো বাহিনীর রসদপত্র সরবরাহের বিকল্প পথ হলো উজবেকিস্তান। দেশটি নিজেই উজবেক ইসলামী যোদ্ধাদের বিরাট ঘাঁটি। আফগান যুদ্ধে উজবেক যোদ্ধাদের নেতা জুমা নামান গনি ন্যাটো বাহিনীর হাতে মারা যান। সোভিয়েত আমলে কৃষিজমি কমিউনের নেতৃত্বে যাওয়ায় অনেক চাষির স্বাধীনতা হরণ করা হয় এবং চাষের প্রতি আগ্রহ হারায়। অনেক উজবেক চাকরির জন্য কাজাখিস্তান ও রাশিয়ায় চলে যান। তখন কৃষিপ্রধান ফারগান এলাকায় ইসলামপন্থীরা জড়ো হয়ে ভবিষ্যতের রূপরেখা চিহ্নিত করতে থাকেন।
মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিধায় পরাশক্তিগুলো তার সাথে সম্পর্ক করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। উজবেক প্রশাসনও আমেরিকা, চীন ও রাশিয়ার সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার চেষ্টা করছে। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় মধ্য এশিয়া হঠাৎ করে অতি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় অন্যান্য দেশও বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক রক্ষার জন্য উজবেকিস্তানের অভিজ্ঞতাকে রপ্ত করে এগিয়ে যেতে চায়। উজবেক সরকার বা তাসখন্দ কিছু দিন আগে ওয়াশিংটনের কৌশলগত সংগঠনে যুক্ত হয়েছে, যেখানে ইসলামাবাদ ও কাবুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আবার মস্কো ও বেইজিংয়ের সাথেও তাসখন্দ ‘ভালো বাণিজ্যিক অংশীদার’ হিসেবে কাজ করছে।

উজবেকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে আবার রাশিয়ার সাথেও সামরিক সম্পর্ক রেখেছে। একই সাথে চীনের বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) অংশ নিয়েছে। এসবই সম্ভব হয়েছে উজবেকিস্তানের বিশেষ ভূকৌশলগত কারণে। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে, যেগুলো উজবেকিস্তানকে এ অবস্থায় আনতে সহায়তা করেছে। প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজাইয়েভ নিজের দেশকে বাইরের বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করতে চান, যা আগের প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভ করেননি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট পাশের কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তানের সাথে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়েছেন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বাণিজ্য প্রসারের জন্য। উজবেকিস্তানের সেনাবাহিনীকে আঞ্চলিক শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চীনের এক গুরুত্বপূর্ণ এনার্জি পার্টনার হিসেবেও উজবেকিস্তান পরিচিত। তুর্কমেনিস্তান-চীন পাইপলাইনে উজবেকিস্তান ট্রানজিট হিসেবে কাজ করে। চীন সম্প্রতি বড় বিনিয়োগ করছে বিদ্যুৎ খাতে, যাতে উজবেকিস্তান আঞ্চলিক বিদ্যুৎ হাবে পরিণত হতে পারে। বেকারত্ব দূরীকরণ, দেশের বাইরে না যাওয়া এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে যোগ না দেয়ার জন্য রাশিয়া ও চীন প্রচুর বিনিয়োগ করছে, যাতে অধিক হারে চাকরির বাজার সৃষ্টি হয়।

যুক্তরাষ্ট্রও উজবেকিস্তানকে গুরুত্ব দিয়েছে। একজন দক্ষ ও পুরনো কূটনীতিক হিসেবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এর গুরুত্ব বোঝেন; তাই তিনি দেশটির সাথে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। ইতঃপূর্বে অবশ্য ২০০৫ সালে আন্দিজানে করিমভবিরোধী বিক্ষোভকারীদের অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ ছিল এবং এ কারণে ওয়াশিংটনের সেনাবাহিনীকে তাসখন্দ ছাড়তে হয়েছিল। জো বাইডেন এসব কিছুকে দক্ষতার সাথে সামাল দিয়ে পাকিস্তান-আফগানিস্তানসহ উজবেকিস্তানের সাথে আরো একটি কোয়াড গঠন করে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন। এই কোয়াড এবং রাশিয়া ও চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য অনেক কিছু সূচিতে রেখেছে। তিনি রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ আগেভাগে করতে চান; কেননা আঞ্চলিক সংযোগ বা কানেক্টিভিটি শক্তিশালী করা না গেলে চীন ও রাশিয়ার সাথে পাল্লা দেয়া সহজ হবে না।
নতুন কোয়াড ও চীনের বিআরআই-এ দু’টি বিষয় পাকিস্তানে এসে যেন মিলিত হয়ে গেছে।

এখানে উজবেকিস্তান ও পাকিস্তানের দূরদর্শিতা ও সমীকরণ লক্ষণীয়। দু’টি দেশের মধ্যে আবার ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্কও রয়েছে। এসব নজরে থাকা সত্ত্বেও ওয়াশিংটন ইসলামাবাদকে নতুন কোয়াডে নিয়েছে। ভারত না কোয়াডের সদস্য হতে পেরেছে, না কোয়াড গঠনে বাধা দিতে পেরেছে। রাশিয়াও ইউরেশিয়া পার্টনারশিপকে আরো সম্প্রসারিত করতে পাকিস্তানের সাথে কাজ করতে চায়, যা চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের সাথে মিলে যাবে এবং আফগানিস্তানকে সংযুক্ত করবে। অনেকেই এ পদক্ষেপকে নামকরণ করেছে ‘সিইপিসি+’ হিসেবে।

এসব পদক্ষেপ প্রমাণ করে পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান আঞ্চলিক ভূ-অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিমাপের কৌশলী নীতি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি উভয় দেশ কৌশলগত পার্টনারশিপকে আরো শক্তিশালী করতে একমত হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এই কৌশল মধ্য এশিয়ার অন্য সব দেশেও ছড়িয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া একসাথে একটি অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করা বিশ্বের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংযোগসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশ নিয়েছে। বৈঠকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়, বাংলাদেশ ও উজবেকিস্তানের মধ্যে বহুমুখী সহযোগিতার ক্ষেত্র আরো সম্প্রসারণ এবং এর সম্ভাবনার বিষয়ে বাংলাদেশ-উজবেকিস্তান আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা গভীরতর করার বিষয়গুলোও আলোচনায় স্থান পেয়েছে। তাসখন্দ-ঢাকা বিমান চলাচল ও ঢাকায় উজবেকিস্তানের দূতাবাস চালুর কথাবার্তা চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক সংযোগ শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়ায় বাংলাদেশ উজবেক প্রেসিডেন্টের প্রশংসা করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটি একটি সফল সফর। গত বছর ২৫০ জন বাংলাদেশী দক্ষ শ্রমিক উজবেকিস্তান সরকার নিয়েছে। তারা প্রতি মাসে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারবেন। কোভিডের কারণে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া ও মালদ্বীপসহ কয়েকটি দেশের শ্রমবাজার এখনো বন্ধ হয়ে আছে। তাই উজবেক সরকারের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়।

উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, অতিসম্প্রতি গঠিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান-আফগানিস্তান-উজবেকিস্তান ফ্রেমওয়ার্ক। এটি গঠনে পাকিস্তান রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে এবং মধ্য এশিয়ায় তার অবস্থান সংহত করে সম্প্রীতি ও বাণিজ্য প্রসারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই ফ্রেমওয়ার্কে ভারতের পরিবর্তে পাকিস্তান বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছে। চীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে এই জোটের সম্মিলিত উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়াও এই জোট ২০১৬ সালে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান ও চীন যে জোট করেছিল, তা থেকেও অনুপ্রাণিত হয়েছে। এখন ২০১৬ সালের ‘মেকানিজমে’ রাশিয়াও সংযুক্ত হওয়ার জন্য তোড়জোড় করছে। যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে আলাপানুসারে সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তান-আফগানিস্তান-উজবেকিস্তান রেলওয়ে ব্যবহার করতে চায়। অন্য দিকে রাশিয়া শতাব্দী পুরনো লক্ষ্যে ভারত মহাসাগর উপকূলীয় দেশের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে উদগ্রীব। গত জুন মাসের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আলাপে উঠে আসে যে, আফগান কূটনীতিকরা বিআরআইয়ের সাথে সংযুক্ত হতে চান, বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর ও গোয়াদর বন্দরে সংযুক্তি কাবুলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই কূটনৈতিক বোঝাপড়া প্রমাণ করে পাকিস্তানের নতুন কৌশল যথেষ্ট কাজ দিয়েছে। গত মার্চে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতারা ইসলামাবাদে যে ‘নিরাপত্তা ডায়লগ’ উন্মোচন করেছিলেন, তারই ফলাফল এটিকে মনে করছেন অনেকে। এভাবে সব স্টেকহোল্ডারের সাথে পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান ‘উইন-উইন’ অবস্থানে রয়েছে।

ভারতের জন্য অবশ্যই বিষয়গুলো সুখবর নয়। ভূরাজনৈতিক কৌশলে পাকিস্তান কয়েক মাসে যে উন্নতি করেছে, ভারত গত এক দশকেও তা অর্জন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র এক স্টেকহোল্ডার হিসেবে অনেক আঞ্চলিক বিষয়ে পাকিস্তানে প্রভাব ফেলবে এতে কোনো সন্দেহ নেই, যদিও দিল্লি সেটি অস্বীকার করে আসছে। তা ছাড়া আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ফোকাস ভারত থেকে পাকিস্তানের দিকে সরে যেতে পারে, যা ভারতের জন্য সুখের নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করেও একটি গ্রহণযোগ্য বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা পাকিস্তানের সাথে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে আসছিলেন; বাইডেন গুরুত্বপূর্ণ এ পলিসিকে কাজে লাগিয়েছেন। ভারতের সাথে বিশেষ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আমেরিকা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে চায়। কেননা আফগানিস্তানে শান্তির জন্য পাকিস্তান একটি মৌলিক ফ্যাক্টর। যুক্তরাষ্ট্রের আরো একটি উদ্দেশ্য নিহিত আছে। তা হলো পাকিস্তান যেন পুরোপুরি চীনের কক্ষপথে ঢুকে না যায়। চীনের বিপক্ষ সামরিক শক্তি হিসেবে ভারতকেও বড় প্রয়োজন ওয়াশিংটনের। বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়ার সাথে ভারতের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে পারে। ‘ক্লাডিভস্টক-চেন্নাই মেরিটাইম করিডোর’ ও ‘নর্থ সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোরে’ উভয় দেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। রাশিয়া পরিচালিত ইউরেশিয়া ইকোনমিক ইউনিয়নেও ভারত রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য চুক্তি করতে পারে। তবে অতিসম্প্রতি কাশ্মির প্রশ্নে রাশিয়া ভারতকে সমর্থন দেয়নি।

ইউরেশিয়ান বাণিজ্যের কারণে চলতি বছর চীনের জন্য শুভ না হলেও উজবেকিস্তানের সাথে বাণিজ্য বেশ ভালোভাবেই চলছে। সদ্যসমাপ্ত আর্থিক বছরে এ ক্ষেত্রে ট্রেড ভলিউম ছিল ৬.৪ বিলিয়ন ডলার। চীনের রফতানি ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ও উজবেকিস্তান থেকে আমদানি ১.৯ বিলিয়ন ডলার। পাশের কাজাখিস্তানের সাথেও চীনের বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য। ২০১৫ সাল থেকে চীন উজবেকিস্তানের ট্রেডিং পার্টনার। গেল বছর উজবেকিস্তানের এক হাজার ৬৫০ প্রতিষ্ঠান বেইজিংয়ে বসে কারবার শুরু করে। উজবেকিস্তান ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নে পর্যবেক্ষকের পদমর্যাদা পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে সদস্য পদের জন্য উজবেকিস্তান চেষ্টা করছে। রাশিয়ার এ সুযোগ প্রদান কাজে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

উজবেকিস্তানের সেনা বহর, সাথে তাজিকিস্তান ও রাশিয়ার কমান্ডো সেনারা, তাজিক-আফগান সীমান্ত পাহারা দেয়ার জন্য অগ্রসর হয়েছে। রাশিয়া-উজবেকিস্তান যৌথ মহড়া ১-১০ আগস্ট খাতলুন প্রদেশের তারমিজ প্রশিক্ষণ এলাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তারমিজ আফগান সীমান্ত থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে, সেখানে কমপক্ষে দুই হাজার সেনা জমায়েত হচ্ছে। ২০০ ইউনিট মিলিটারি হার্ডওয়্যার ড্রিলে থাকছে। মহড়া আফগান সীমান্ত ঘেঁষে চালানো হবে বলে জানানো হয়েছে। এটি তিন দেশের প্রথম সামরিক মহড়া। রাশিয়া জানায়, এই ড্রিল মধ্য এশিয়ার টেরিটরিয়াল ইন্টিগ্রিটিকে আরো শক্তিশালী করবে। তাজিক সেনাবাহিনীও শেষের পাঁচ দিন অংশ নেবে। উজবেকিস্তানের সাথে রাশিয়া ও চীনের যে বাণিজ্য তরী ভাসানো হয়েছে, সেখানে প্রতিযোগিতা থাকলেও কোনো বিরোধ নেই।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব


আরো সংবাদ



premium cement