১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দ্বিচারিতা আর মূল্যবোধ সাংঘর্ষিক

দ্বিচারিতা আর মূল্যবোধ সাংঘর্ষিক - ছবি : নয়া দিগন্ত

বিশ্বে ‘রাষ্ট্র’ নামক প্রতিষ্ঠানে একটা কার্যকর কর্তৃপক্ষ থাকা অপরিহার্য শর্ত যে কর্তৃপক্ষের অধীনে প্রশাসন দায়িত্ব পালন করে। সেই কর্তৃপক্ষ হচ্ছে ‘সরকার’। সে দেশে সরকার সুশাসন বা অপশাসন যাই প্রতিষ্ঠা করুক। তা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু এমন একটি কর্তৃপক্ষ তথা সরকার না থাকলে- রাষ্ট্রের যে সাধারণ সংজ্ঞা তা অপূর্ণই থাকবে। সেই সাথে সেই জনপদে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করবে। কোনো কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতিতে সে অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা এবং মানুষে মানুষে হানাহানি সংঘর্ষ সঙ্ঘাত সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে এক নারকীয় অবস্থা বিরাজ করবে। ওই জনপদকে যে পরিচিতি দেয়া হোক বা যেভাবে অভিহিত হোক, তা ভিন্ন আলোচনা।

আজ বিশ্বে দুই শতাধিক রাষ্ট্র রয়েছে। সেসব দেশে কোনো-না-কোনো প্রকৃতির একটা শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সেই ব্যবস্থা যদি ভেঙে পড়ে বা অকার্যকর হয়ে যায়, তবে তাকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে ধরে নিতে হবে। ওপরে যে পরিস্থিতির উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে তা-ই ঘটবে। সভ্যতার অগ্রযাত্রার সাথে সাথে ধীরে ধীরে সর্বত্রই একটা শাসনকাঠামো গড়ে উঠেছে। তবে এটাও ঠিক যে, পৃথিবীর নিভৃত কোনো জনপদে এখনো প্রকৃত অর্থে কোনো শাসনকাঠামো রূপলাভ হয়তো করেনি তবে দূর অতীতে যেখানে সভ্যতার ঊষার উন্মেষ ঘটেছিল। তখন সেখানে ব্যক্তিতন্ত্র তথা ব্যক্তিবিশেষকে ঘিরেই যাবতীয় ব্যবস্থা আবর্তিত হতো। ব্যক্তির অভিপ্রায় ও বিবেচনাই ছিল আইন। সে অনুসারেই সব কিছু সমাধা হতো। সাধারণের কোনো ভূমিকা থাকত না।

মানবসমাজে বহু পরিবর্তন বিবর্তন আর অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রসর বহু রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন অনেক অত্যাশ্চর্য বিষয় সংযোজিত হয়েছে। বিশেষ করে অধুনা তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতিতে বহু ক্ষেত্রেই একটা বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। মানুষ ঘরে বসেই জানতে পারছে বিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ের সর্বশেষ অগ্রগতি। জনগণ জানতে পারছে রাষ্ট্রের কাছে তার প্রাপ্তি অথবা বঞ্চিত হওয়ার বিষয়গুলোর যত খতিয়ান। এখনো বিশেষজ্ঞরা বসে নেই- আরো অগ্রগতির জন্য চলছে লাগাতার গবেষণা। তবে এর সুফল বিশ্বের সব মানুষের দুয়ারে পৌঁছেনি। বিশ্বের পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর নাগরিকের কাছে তা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তবে উন্নত দেশের প্রশাসন তথা কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে রাজনীতি করে। রাজনৈতিক কারণে তারা নানা কৌশল চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে থাকে। এই প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষ ‘হাইড অ্যান্ড সিক’-এর পথ অনুসরণ করে। সে জন্য সব তথ্য জনগণকে জানতে দিতে চায় না। প্রযুক্তিগত কৌশল অবলম্বন করে। আসলে বিশ্বে জনগণের জন্য সব কিছু খোলামেলা নয়।

আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আজকে মানুষের বোধ আর বিবেচনার নতুন দুয়ার উন্মুক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার সুফল হিসেবে জনগণের অধিকার ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের আধুনিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে; মুক্ত মতপ্রকাশের অবাধ ও অবারিত পথ খুলে গেছে; তাতে মানুষ তথ্য ও তত্ত্বে নিজেকে সজ্জিত করতে সক্ষম। মানুষ তার নিজস্ব অভিপ্রায় অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বশীলদের বেছে নেয়ার স্বচ্ছ অবাধ আর ভয়ভীতিহীন ব্যবস্থার অনুশীলন করছে, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে কোনো বঞ্চনা বা বৈষম্য দূর করার চেষ্টা হচ্ছে, রাজপথে শৃঙ্খলার আওতায় বাদ-প্রতিবাদের অধিকার অক্ষুণ্ন রয়েছে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ক্ষোভ উষ্মা আর সমালোচনার অবাধ অধিকার নিশ্চিত রয়েছে, সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও যে বহু মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে সে ধারণাও এখন স্বীকৃত, জনগণের মৌলিক অধিকার নির্ণীত হয়েছে এবং তা সুপ্রতিষ্ঠিত। মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার যে চাহিদা তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুরক্ষা এবং কর্মের সংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। আর কোথাও বা তা বাস্তবায়নের নিরন্তর চেষ্টা জারি রয়েছে। এসব সম্ভব হয়েছে মানুষের দ্বারাই, সেসব মানুষের হৃদয়ে দায়িত্বানুভূতি, মানুষের প্রতি রয়েছে মমতা আর ভালোবাসা। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের যত বিধি-বিধান, তার সব অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করা হয়।

এসব দেশের নাগরিকদের দেশের প্রতি রয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা। রাষ্ট্রের বিধিবিধান জ্ঞাতসারে তারা ভঙ্গ করে না। এমন শিক্ষা শিষ্টাচার অবশ্য তাদের একদিন হঠাৎ করে উদিত হয়নি, সমাজপতির নীতি, নৈতিকতা, চারিত্রিক মাধুর্য্য, পারিবারিক পরিমণ্ডলে ঐতিহ্যের লালন, শিক্ষাঙ্গনে পরিশীলিত মানুষ হওয়ার শিক্ষা ও চর্চা। সবমিলিয়েই এমন পরিশীলিত সুনাগরিক হওয়ার দীক্ষা তাদের মন-মানসে গ্রথিত হয়েছে।

আমাদের দেশের কর্তৃপক্ষ কি জনগণকে তাদের প্রাপ্তি বুঝিয়ে দিতে পেরেছে? তেমন আচরণ বোধ বিবেচনা কি এ দেশের নাগরিকদের কাছ থেকে পাওয়া আদৌ সম্ভব! আমাদের কর্তৃপক্ষের মাঝে এমন চিন্তাভাবনা ধ্যান ধারণায় রয়ে গেছে। তেঁতুলের গাছ রোপণ করে সেখান থেকে সুমিষ্ট ফল আশা কি করা সম্ভব? জনগণের সমর্থন নিয়ে কোনো সরকার দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করা অনৈতিক বা কোনো সমস্যা নয়। তবে তাদের দায়িত্ব পালন নিয়ে জনগণের মূল্যায়ন এবং নির্বাচনের সময় তার অবাধ প্রতিফলনের অধিকার নিশ্চিত থাকতে হবে। তাতে সংশয় সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর এসব পরিচর্যা আর দেখভাল করা সাংবিধানিক দায়িত্ব তারা তো অমাবস্যার চাঁদ হিসেবে মানুষের কাছে পরিগণিত। তারা অন্ধকারকে তাদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ বলে মনে করে। রাতেই তাদের যত জাদুকরী খেলা। অথচ অন্ধকার হচ্ছে যত অপকর্মের সূতিকাগার। পরিশুদ্ধ মানুষ তো অন্ধকারকে এড়িয়ে চলে। কারণ, অন্ধকার কুলক্ষণের প্রতীক।

অথচ অত্যাদ্ভূত ব্যাপার, উল্লিখিত জীবনব্যবস্থার যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো, তার পাশাপাশি আজকের দিন পর্যন্ত বিশ্বের বহু জনপদে ব্যক্তিতন্ত্রকে যা বহু আগে গণতান্ত্রিক সমাজের মানুষ ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, বিস্ময়ের ব্যাপার, সেই ব্যক্তিতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারজনিত নির্মম কুৎসিত শাসনব্যবস্থা এখনো বেশ কিছু দেশে বহাল রয়েছে। সেখানে এমন এক গুমোট শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ যে পরিস্থিতিতে জনগণ প্রহসনমূলক জীবনযাপন করছে। সেখানকার অবস্থাটা অনেকটা যেন এমন : কেউ পানিতে পড়ে গেলে নিমজ্জমান ব্যক্তিটি যখন নাক ভাসিয়ে রেখে কোনোভাবে বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টা করে থাকে; অথচ ব্যক্তিতন্ত্রের সব নাটের গুরু তখন সুদৃশ্য লেবাস আর কৃত্রিম হাসি-তামাশার অন্তরালে এমন এক আদিম জিঘাংসা ও ভয়ঙ্কর মন-মানস লালন করে, যা কল্পনাকেও অতিক্রম করে যায়। তাদের সেই কুৎসিত কদাকার অপশাসনকে নানা বর্ণে প্রলেপ দিয়ে বিশ্বকে জানান দিতে চায়। তাদের রাজ্য বস্তুত ‘স্বর্গরাজ্য’, সেখানে কত সুখ আনন্দ আর অপরিসীম শান্তিতেই না মানুষ জীবনযাপন করছে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়, বিশ্বের বৃহৎ কিছু রাষ্ট্র যারা নিজেদের গণতন্ত্র ও মানবতার মানসপুত্র পরিচয় দিয়ে মানবাধিকারের প্রবক্তা হিসেবে চাম্পিয়ন হতে চায়। তারা নিছক রাজনৈতিক স্বার্থ অর্জন ও অস্ত্র বাণিজ্যের স্বার্থে এসব ব্যক্তিতন্ত্রের নির্মমতাকে নির্লজ্জভাবে সাহায্য সমর্থন করে যাচ্ছে। এতেই স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রগুলো আশকারা পায়। গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের প্রতি সেসব রাষ্ট্রে দ্বিচারিতা শুধু দুর্ভাগ্যজনকই নয়। পশ্চিমারা যে মূল্যবোধ নিয়ে বড়াই করে তা যে কতটা কৃত্রিম, তা এ থেকেই প্রমাণিত। যারা বিশ্বে মানবসত্তাকে পদদলিত করছে তাদের মদদেই এসব তথাকথিত রাষ্ট্র বহাল তবিয়তে রয়েছে বিশ্বব্যবস্থাকে তুড়ি মেরে।

কিছু আগে আমাদের এই কলামে জাতিসঙ্ঘের এক বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম যে, বিশ্বে এখন কয়েক দশকের চেয়ে মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। সেই ব্যক্তিতান্ত্রিক দেশগুলোসহ অনেকে গণতন্ত্রের পোশাকপরিচ্ছদে আচ্ছাদিত। দেশগুলোতে মানবাধিকার পরিস্থিতি যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে আছে, তার সামান্য আভাষই বস্তুত জাতিসঙ্ঘের সে বিবৃতিতে প্রকাশ পেয়েছে। পৃথিবীর প্রকৃত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষসহ সংবেদনশীল মানুষ আর মানবতাবাদীরা এখন বেদনায় আপ্লুত। পত্রপত্রিকাসহ নানা মিডিয়ায় এসব প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু বেদনার বিষয়, যারা বা যেসব রাষ্ট্র এর কিছুটা অন্তত প্রতিকার করতে পারে তারা নিথর নীরব। এখানে নারীসমাজের লাঞ্ছনা এবং তাদের যে পণ্যের মতো ব্যবহার করছে, তারও কোনো প্রতিকার প্রতিবিধানের প্রচেষ্টা নেই। নারীর সম্মান সম্ভ্রম সুরক্ষার জন্য যেসব নারী সংগঠন রয়েছে তাদের আরো সক্রিয় হওয়া উচিত। তা ছাড়া নারীরা যে সবার কাছেই মা বধূ ও কন্যার মর্যাদা পাওয়া উচিত তা যেন সবাই ভুলতে বসেছে।

বিশ্বের কোথাও নীতিনৈতিকতা, মানবিকতা, মানবাধিকার ও মূল্যবোধকে সযতেœ লালন করা হচ্ছে; আর কোথাও এসব গহিন জঙ্গলে নির্বাসন দেয়া হয়েছে। অথবা মাটির শত ফুট নিচে প্রোথিত করে রাখা হয়েছে। এমন বিচিত্র বিশ্বে আমরা বসবাস করছি। আমাদের মূল বক্তব্য, পৃথিবীর তাবৎ শাসনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করব কিভাবে? আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা গবেষকও নই। এই উপমহাদেশের মানুষ সংসদীয় ব্যবস্থার সাথে দীর্ঘ দিন থেকে পরিচিত এবং অবহিত। আমরাও সে খবর কিঞ্চিৎ রাখি। এসব দেখে-শুনেই আমাদের যৎসামান্য বোধ সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্বের বহু দেশেই সংসদীয় ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চলছে। সংসদীয় গণতন্ত্র এমন এক রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা, যেখানে সর্বময় ক্ষমতা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংসদের ওপর ন্যস্ত থাকে। এই ব্যবস্থায় সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য নয়, বলতে গেলে এটা অনেকটা আলঙ্কারিক পদ। যুক্তরাজ্য ভারত এবং বিশ্বের আরো অনেক দেশেই বর্তমানে সুষ্ঠুভাবে এই শাসনব্যবস্থা চালু আছে। এ কথা উল্লেখ করা জরুরি যে, পরিশুদ্ধ সংসদীয় ব্যবস্থা তখনই সত্যিকারভাবে প্রতিভাত হয়ে উঠে, যখন সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হয়। যাই হোক, সরকারব্যবস্থা হিসেবে সংসদীয় ব্যবস্থাকে জনগণের পার্টিসিপেশনমূলক শাসনব্যবস্থা বলে মনে করা হয়। তাই নিষ্কলুষ ও সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকা নির্বাচন এই শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান চেতনা।

বাংলাদেশ তাত্ত্বিকভাবে এবং দেশের সংবিধানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং সেখানে শাসনব্যবস্থার যে ধারণা পরিস্ফুট তা বহুলাংশেই বা পুরোপুরিভাবেই সংসদীয় ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সে ব্যবস্থার অনুশীলন ও চর্চা কতটা সার্থকতার সাথে এবং এই শাসনব্যবস্থার ব্যাকরণ তথা রীতি পদ্ধতি কতটা তার মাপকাঠি অনুসারে চলছে? এই শাসনব্যবস্থা কতটা সার্থকতা লাভ করেছে, তার সৌন্দর্য কতটা বিকশিত হতে পেরেছে, প্রতিষ্ঠানটি জনগণের আশা আকাক্সক্ষা পূরণ এবং আস্থা সৃষ্টি করতে পেরেছে, সেই সাথে এই শাসনব্যবস্থা সার্থক করার ক্ষেত্রে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের প্রক্রিয়া তথা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে, গণতান্ত্রিক চেতনাকে কতটা অর্থপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা ও পরিচর্চা হচ্ছে? এসব বিষয় নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন সংশয় আর সংক্ষুব্ধতা দেশে রয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে ঢের আলোচনা হয়েছে। বক্তব্য তখনই পেশ করা উচিত বা প্রবৃত্তি জাগে যখন পরিশুদ্ধতা অর্জনের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। আমাদের সংবিধানে সংসদীয় ব্যবস্থার যে রূপ সৌন্দর্য রয়েছে আমাদের জানা মতে, তা তুলে ধরার চেষ্টা করব।

একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে পরিশুদ্ধ এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন বলে দেশের সংবিধানে সংসদীয় ব্যবস্থাকে সন্নিবেশিত করে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারেনি নানা কারণে। সে বিষয়ে সামান্য আলোচনা হতে পারে। সংসদীয় ব্যবস্থা তখনই ফলপ্রসূ হতে পারে যখন রাজনীতিকরা এই শাসনব্যবস্থার প্রতি প্রতিশ্রুত এবং সংসদের যে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো রয়েছে তা সদস্যদের রপ্ত করা অপরিহার্য। সেই সাথে এ ব্যাপারে সবার কমিটমেন্ট থাকা অপরিহার্য যে, সংসদই হবে দেশের রাজনীতির মূলকেন্দ্র এবং জাতীয় সব সঙ্কট সমস্যা সেখানেই সমাধান করা হবে।

এসবের ঘাটতির পাশাপাশি এটা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, এ দেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ধারাবাহিকভাবে চলতে দেয়া হয়নি। এটাও এই শাসনব্যবস্থা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। সেই সাথে সংসদ সদস্যরা কর্তৃক সংসদীয় ব্যবস্থার যে টেকনিক্যাল বিষয়ে কথা বলা হয়েছে, তা অর্জিত না হওয়ায় এখন পর্যন্ত সংসদ প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারেনি। সংসদীয় ব্যবস্থা এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে যে বাধার কথা বলা হয়েছে- তার সামান্য কিছু বিষয় উল্লেখ করছি।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। এ সময়কালে অধিবেশনে বসা ১০টি সংসদের মধ্যে সপ্তম সংসদ বাদে প্রতিটি সংসদেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। অন্যান্য সংশোধনী নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই। নিবন্ধের জন্য তা প্রয়োজনীয় নয়। আমরা সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর কথাই প্রথমে উল্লেখ করতে চাই। এ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার বিরাট পরিবর্তন ঘটানো হয়। তথা সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন করা হয়। এই সংশোধনীর এটাই মূলকথা। এই সংশোধনী সংসদীয় ব্যবস্থার ওপর চরম আঘাতস্বরূপ এবং এর দ্বারা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ইতি ঘটানো হয়েছে এটাই বলতে হয়।

রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা দীর্ঘকাল দেশে বহাল থাকায় সংসদীয় ব্যবস্থার বিকাশের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হতে পারেনি। এ সময় সংসদীয় ব্যবস্থা রহিত করা হয়। এই শাসনব্যবস্থার যে জবাবদিহিমূলক শাসননীতি তারও অন্তর্ধান ঘটে। ফলে এই শাসনব্যবস্থার যে কারিগরি কৌশল শিষ্টাচার তার কোনোটাই সদস্যদের পক্ষে রপ্ত করা সম্ভব হয়নি। দেশে সুশাসন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রশাসনে জবাবদিহিতা একটা বড় বিষয়। সংসদীয় ব্যবস্থায় তা ষোলআনা কার্যকর হয়।

সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী গৃহীত হয় ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট বিএনপি সরকারের ক্ষমতাসীন থাকাকালে। এই সংশোধনীর ফলে দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকারব্যবস্থা কায়েম হয়। তবে প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই ব্যবস্থা কায়েম হলেও এর কার্যক্রম অ্যাক্টিভিটি, এসেন্স ও শৈলী কোনোটাই আসলে এখনো মূর্ত হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থা মূলত যুক্তরাজ্যের সংসদীয় ব্যবস্থার আদলে বা বাহ্যত গ্রহণ করা হলেও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যতটা অ্যাকটিভ এবং সর্বব্যাপী দৃষ্টি তা আমাদের দেশে কখনই প্রতিষ্ঠা পায়নি এবং জনগণ সংসদ থেকে ঈপ্সিত সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত এবং তারা আস্থাও হারিয়েছে।

আমরা আগে উল্লেখ করেছি যে, আমাদের সংসদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে অভিন্ন। তাই সংবিধানে এ সম্পর্কিত যে অনুচ্ছেদগুলো রয়েছে- তার কয়েকটি অনুচ্ছেদ এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমাদের সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ‘বাংলাদেশের একটি সংসদ থাকিবে এবং এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত হইবে;’ সংসদের আইনের ক্ষমতাসহ তা সংশোধন, পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজনের ক্ষমতাও সংসদের রয়েছে। এমনকি সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতাও সংসদের রয়েছে।

এর দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, সংসদ অমিত ক্ষমতার অধিকারী। সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে এবং প্রধানমন্ত্রীও সময়ে সময়ে তিনি যেরূপ স্থির করিবেন, সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী লইয়া এই মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে।’ এই ধারা স্পষ্ট করে যে, প্রধানমন্ত্রী দেশের সরকারপ্রধান, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীই সরকারপ্রধান হিসেবে পরিগণিত। ৫৫(৩) রয়েছে ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন।’ সংসদীয় ব্যবস্থা যে জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত, আমাদের সংবিধানের এই ধারাটি তারই প্রতীক। সংসদীয় ব্যবস্থায় মন্ত্রীদের কার্যকাল প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের ওপর নির্ভর করে। আমাদের সংবিধানে তেমনি ধারা সংযুক্ত রয়েছে, ৫৮(২) অনুচ্ছেদে রয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময় কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিতে পারিবেন...’

সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির পদটি প্রকৃতপক্ষে আলঙ্কারিক। তার তেমন কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব বা ক্ষমতা থাকে না। আমাদের সংবিধানে সেই ব্যবস্থাই বলবৎ রয়েছে।

ndigantababor@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement