২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সেনা প্রত্যাহার ভুল- বুশের বিলাপ

-

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ গত ১৪ জুলাই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সমালোচনা করেছেন। আমেরিকা ও ন্যাটো সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত জর্জ ডব্লিউ বুশ ‘ডয়চে ভেলে’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বাইডেন প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তকে ‘ভুল’ আখ্যা দিয়েছেন।

টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে সেনা পাঠায় বুশ প্রশাসন। আজ দুই দশক পর সেখান থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। একে ভুল হিসেবে অভিহিত করে বুশ বলেন, ‘আফগান নারী ও মেয়েরা যে অবর্ণনীয় ক্ষতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, তাতে আমি ভীত।’ তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিদেশী সেনাদের সাথে কাজ করা আফগান অনুবাদকদের নিয়ে। ‘তাদেরকে এসব নিষ্ঠুর তালেবানদের হাতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যা আমার হৃদয়কে ভেঙে দিচ্ছে।’ এটিও সত্যি যে, সোহেইল পারদিস নামে এক আফগানকে মার্কিন সেনাবাহিনীর পক্ষে দোভাষীর কাজ করায় বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনে কিছু দিন আগে তালেবানরা শিরচ্ছেদ করেছে।

বুশের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কাবুলভিত্তিক ডয়চে ভেলের সাংবাদিক আলী লতিফি বলেন, ‘এটি খুবই কৌত‚হলোদ্দীপক ব্যাপার যে, তিনি হঠাৎ আফগান নারী ও শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, যেখানে তার লাগিয়ে দেয়া যুদ্ধ অনেককে বিধবা ও অনেক শিশুকে এতিমে পরিণত করেছে।’
রিপাবলিকান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০১ সালের শরতে আফগানিস্তানে সেনাবহর পাঠানোর সময় দম্ভ করে বলেছিলেন, শত্রুদের নিঃশেষ করা এক সপ্তাহের কাজ। ২০ বছর পর তিনিই বলছেন, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি। ফক্স নিউজ বলেছে, ‘বুশ এখন বিলাপ করছেন’।

জো বাইডেনের সেনা প্রত্যাহার ঘোষণায় এরই মধ্যে ৯৫ শতাংশ মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ছেড়েছে। তিনি এক দশক আগ থেকেই আফগান যুদ্ধকে আমেরিকার জন্য ‘বোঝা’ মনে করতেন। তিনি ক’দিন আগে বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের ভাগ্যনির্ধারণ আফগানদের হাতেই।’ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তা হলে কেন এই দুই দশকের দখলদারিত্ব? এখন আফগান সরকারি সেনারা দেশ রক্ষার কাজে আর তালেবানরা তাদের প্রতিপক্ষ। একধরনের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে আফগানিস্তানে; কিছুটা ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন, লিবিয়া, মালি, সুদান বা সিরিয়ার মতো। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর ৩০ বছরের যুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে এ গৃহযুদ্ধ।

আফগানিস্তানের সাধারণ লোকজন দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন পাকিস্তান, ইরান, তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তান সীমান্তের দিকে। অনেক দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারের পক্ষে কাজ করেছে এমন ৫০ হাজার আফগান প্রাণের ভয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আবেদন করেছে। দেশের ভেতর ও বাইরে হাজার হাজার উদ্বাস্তু, যারা অনেকেই কোভিড-১৯ অতিমারীর টিকা পায়নি। ক্ষুধা, পানীয় জল, রোগবালাই নিয়ে লাখ লাখ আফগান দুর্বোধ্য ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের এই নরক যন্ত্রণায় ছুড়ে ফেলার জন্য কারা দায়ী?

বুশের আফগান নারীদের অসহায়ত্বের বিষয়টি ফার্স্ট লেডি লরা বুশও সমর্থন করেছিলেন। রেডিও ভাষণে তিনি বলেন, ‘নখে পলিশ নাগানোর কারণে নখ উপড়ে ফেলার কাজ শুধু টেররিস্ট ও তালেবানরাই করতে পারে।’ তবে এ তথ্যের সত্যতা নিয়ে তখন ব্যাপক কথাবার্তা হয়েছে। লরা বুশের সাথে চেরি ব্লেয়ার, তৎকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের স্ত্রী, আফগান মহিলাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের সুখ-দুঃখ ব্রিটিশ পত্রিকায় তুলে ধরবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। আফগান মহিলাদের প্রতি হঠাৎ করে বুশ প্রশাসনের এমন মনোভাবের বিষয়ে আমেরিকার পত্রপত্রিকা ব্যাপক প্রতিবেদন ছাপায়। যেমন- ‘বুশের নারী জাগরণ ফাঁকা বুলি’ নিউ ইয়র্ক টাইমস। সেখানে প্রশ্ন করা হয়, এসব জাগরণ তেলসমৃদ্ধ দেশের নারীদের বেলায় নয় কেন? অভিযোগ আছে, বুশ ক্ষমতায় থাকাকালে তেলের ব্যবসায় সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং সাদ্দামকে কম দামে তেল সরবরাহের জন্য চাপ দেন। সমালোচকরা আরো বলেন, সৌদি নারীরা ড্রাইভিং করলে কী দোষ? আমেরিকার নারীরা তো হরদম গাড়ি চালাচ্ছে। বুশ প্রশাসন কেন শুধু আফগানিস্তানে নজর দিচ্ছে বোরকা ও নেলপলিশ ইস্যু নিয়ে?

তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি, সেক্রেটারি অব ডিফেন্স রামসফেল্ডসহ সবাই আফগান মহিলাদের নিয়ে কথা বলতে থাকেন। তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট কলিন পাওয়েল বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তানকে রক্ষা করা মানে, আফগান মহিলাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া।’ লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকার মেরি ম্যাকনামারা প্রশ্ন তোলেন, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মহিলাদের অধিকার কেন আসবে?’ তালেবানদের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আমেরিকার দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহু আফগান মহিলা সোচ্চার ছিল যে, তারা দুই দশক ধরে পশ্চিমাদের হাতে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়েছে।’ মনে হয়, ধর্মীয় মনোভাবসম্পন্ন মহিলা সমাজকে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্কৃতিতে দীক্ষিত করতে চেয়েছে পশ্চিমা জোট।

আমেরিকার মুসলিম নারী নেতৃত্ব ও স্কলাররা পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করছেন। মুসলিম নারী লিগের লায়লা আল মারিয়াতি ও সিমিন ঈসা বলেন, ‘আফগান মহিলাদের বোরকা ও হিজাব নিয়ে টানাটানি বড় বিষয় নয়। তাদের মৌলিক আরো সমস্যা আছে; যেমন- সন্তানদের দুবেলা খাবার, লেখাপড়া করে শিক্ষিত হওয়া, দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে মুক্ত রাখা; এসব নিয়ে কেন কেউ কথা বলছে না?’ শিক্ষিত আফগান মহিলা জোহরা ইউসুফ দাউদ, যিনি ১৯৭৩ সালে ‘মিস আফগানিস্তান’, নিউ ইয়র্কের কনফারেন্সে দাবি করেন, ‘তোমাদের বিকিনি নয়, আমরা তোমাদের গণতন্ত্র চাই।’ ইউএসএ টুডে পত্রিকায় বিশ্লেষণ করা হয় যে, আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত কাবুল প্রশাসন মহিলাদের অশিক্ষা ও বেকারত্ব দূর করতে কিছুই করতে পারছে না। আফগান নারীবিষয়ক মন্ত্রী সীমা সামার বলেন, ‘মনে হচ্ছে মহিলাদের সব দোষ যেন বোরকা।’

দুই দশকের যুদ্ধে আফগান মহিলারা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়েছে, স্বাস্থ্য চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিশ্বে শিশুমৃত্যুর হার ও মাতৃমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি আফগানিস্তানে। পশ্চিমা এক হিসাবে জানা যায়, ২০ হাজার সার্ভিসম্যান যুদ্ধে আহত হয়েছে, ৪০ হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। হাজার হাজার আফগান মহিলা প্রতি বছর প্রসবজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করছে, অথচ সাধারণ চিকিৎসায় তারা বাঁচতে পারত। ২০১৬-২০ সময়ে এক হাজার শিশু সে দেশে বোমাবর্ষণে মারা গেছে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০ শতাংশ মহিলা, ক্যান্সারে ৯ শতাংশ, ডায়াবেটিসে ৩ শতাংশ মহিলা মৃত্যুবরণ করছে। এই হলো নারী ও শিশুদের জন্য হাহাকার করার নমুনা। আরেক হিসাবে দেখা যায়, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যাপক খরচের হাত। যেমন- ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন এক লাখ ৭২ হাজার ৩৯০ জন। যুদ্ধে আফগানিস্তানের সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর প্রায় ৬৬ হাজার সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন, সাধারণ নাগরিক মরেছে ৪৭ হাজার ২৪৫ জন, তালেবান ও অন্যান্য বিরোধী যোদ্ধা মারা গেছেন ৫১ হাজার ১৯১ জন। যুদ্ধে ত্রাণকর্মী ৪৪৪ জন ও সাংবাদিক ৭২ জন মারা গেছেন।

যুদ্ধ করতে ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় এটি প্রায় ১৬৯ লাখ ৫৪ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। যুদ্ধে খরচের জন্য দুই ট্রিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে যে ঋণ নেয়া হয়েছে তার সুদ হিসেবে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯২৫ বিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছে। ২০৩০ সালে এ সুদের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে দুই ট্রিলিয়ন ডলারে, যা যুদ্ধের খরচের সমপরিমাণ। খরচ সেখানেই শেষ হচ্ছে না। ২০৫০ সাল নাগাদ সুদের পরিমাণ হতে পারে সাড়ে ছয় ট্রিলিয়ন ডলার। যুদ্ধ শেষ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের খরচ শেষ হচ্ছে না। যুদ্ধে অংশ নেয়া প্রায় ৪০ লাখ সেনাকে আজীবন দেখভাল করতে হবে, এতে প্রায় ১.৬ থেকে ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে বলে জানিয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা।

প্রসঙ্গত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ২০০৩ সালে ইরাকে আক্রমণ চালিয়ে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেন। ১৩ বছর পর ২০১৬ সালে ব্লেয়ার সিএনএনকে এক সাক্ষাৎকারে দুঃখ প্রকাশ করেন। বলেন, ভুল হয়ে গেছে। আমাদের ভুলের জন্য কিছু লোক (লাখ লাখ) অযথাই মারা গেছে। স্যার জন চিলকোটের নেতৃত্বে ইরাক যুদ্ধের তদন্ত হয়, তাও সাত বছর লাগে। কমিশন ব্লেয়ারকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। কমিশন ঘোষণা দেয়, সাদ্দামের কাছে কোনো জীবাণু অস্ত্র বা ব্যাপক জীবন বিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। চিলকোট কমিশন বুশ ও ব্লেয়ার দু’জনকেই যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা দেয় এবং বিচারের সম্মুখীন করার পক্ষে মতপ্রকাশ করে। বুশ কোনো মন্তব্য না করে চুপ থাকেন; ব্লেয়ার প্রকাশ্যে ক্ষমা চান। এতে কি কোনো অপরাধ মওকুফ হয়ে যাবে? কলিন পাওয়েলের চিঠি ফাঁস হওয়ায় জানা যায়, ২০০২ সালেই বুশ-ব্লেয়ার টেক্সাসে ইরাক আক্রমণের চূড়ান্ত রূপরেখা টানেন; অর্থাৎ আফগানিস্তান ও ইরাকে আক্রমণ কোনো হুজুগ ছিল না। বিচারের কথা বলা হলেও তাদের কোনো বিচারের সম্ভাবনা নেই। বুশের মতে, ইরাক আক্রমণ করা হয় গণবিধ্বংসী অস্ত্র বিনাশের জন্য আর আফগানিস্তানে তালেবানদের হাত থেকে মহিলাদের অধিকার রক্ষার জন্য; দুটো বিষয়ই কি ছেলেখেলার মতো নয়? দুটো দেশ ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধবিধস্ত, দুটো দেশেই চলছে গৃহযুদ্ধ। কখন সব কিছু শেষ হয়ে দুটো দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পল ক্রেগ রবার্ট তার এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, “কোনো পাগল বিশ্বাস করবে যে, যুক্তরাষ্ট্র নিজ জনগণের তোয়াক্কা করছে না। সে অর্ধ বিশ্ব দূরে আফগানিস্তানের ভালোর জন্য রক্ত ও অর্থ ব্যয় করে ‘উন্নয়ন’ ও ‘নারী স্বাধীনতা’র জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।”
আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো জানায়, তালেবানদের সময় কোনো মহিলার সামান্য শরীরের অংশ দেখা গেলেও শাসনের চাবুক এসে পড়ত; তা সত্তে¡ও মহিলারা বোরকা পরে বাজার ঘাটে নিরাপদে যেতে পারত; কেউ উত্ত্যক্ত করার সাহস পেত না। কিন্তু পরে সেসব মহিলা দিনেও বাড়ির বের হলে ধর্ষণের শিকার হতো। তালেবান আমলে নারীরা বেশি নিরাপদ ছিল। বিদেশী সাহায্য কর্মীরা স্বীকার করেন, তালেবান আমলে নারীদের কোনো প্রকার নিপীড়ন করা অসম্ভব ছিল। তা ছাড়া যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে নারী ছাড়াও শিশুদের নিপীড়নের অজস্র উদাহরণ রয়েছে। গা শিউরে ওঠার মতো সেসব ভীতিকর কাহিনী এ লেখার কলেবর বৃদ্ধি করবে।
১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে চারটি বিমান হাইজ্যাক করে নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে হামলার দায়ভার আলকায়েদার ওপর পড়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী পাল্টা আঘাতের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আলকায়েদা আর ওসামা বিন লাদেনকে টার্গেট করার পরিবর্তে বুশ আফগানিস্তান দখল করে ‘নারী জাগরণবান্ধব’ হিসেবে আফগানিস্তানকে গড়তে চেয়েছেন। আক্রমণ শুরু হলে বিন লাদেন ও আলকায়েদা নেতারা দুর্গম তোরাবোরায় আশ্রয় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান।

২০০২ সালের শুরুতে স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে বুশ আমেরিকানদের প্রচণ্ড ভীতিকর ও বোমা ফাটানো ‘বোগাস’ সংবাদ পরিবেশন করেন। তিনি বলেন, ‘আলকায়েদা যেসব গুহা ব্যবহার করে সেখানে আমাদের সেনারা পরমাণু প্লান্ট ও পরিষ্কার পানির জলাশয় আবিষ্কার করেছে। সিনিয়র সিআইএ ও এফবিআই কর্তারা মিডিয়ায় বিশদভাবে এগুলো ব্যাখ্যা করেন এবং আলকায়েদা কিভাবে আমেরিকার পরমাণু স্থাপনা ও নিরাপত্তার জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে তার বর্ণনা দেন। দুই বছর পর বুশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে, প্রেসিডেন্টের ওই বক্তব্য পুরোপুরি মিথ্যা, আফগানিস্তানে কোনো পরমাণু প্লান্টের ডায়াগ্রাম পাওয়া যায়নি। নিউক্লিয়ার রেগুলেটরি কমিশনার এডওয়ার্ড ম্যাকগাফিগ্যান বলেন, আসলে বুশের স্পিচ রাইটারের কোনো যোগ্যতা নেই। মানে দোষটা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য লেখকের। আফগানিস্তানের পরমাণু ভীতির বোগাস সংবাদটি ২০০৩ সালে ইরাকে সাদ্দামের জীবাণু অস্ত্র ও গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ধুয়া তুলতে কাজ করেছে!

ওবামার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রূপে অভিষেকের আগে যুক্তরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকাগুলো বুশের চরম ব্যর্থতা আর অপকীর্তির ফিরিস্তি দিয়ে নিন্দার তীর ছুড়ে দেয়। ইরাক-আফগানিস্তানে যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, উদ্বৃত্ত বাজেট থেকে দেশকে ঘাটতিতে নামানো, ঋণের বোঝা চাপানো, ভুল পরিবেশ নীতি আর বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, গুয়ানতানামো বে ও আবু গারিবে মানবাধিকার লঙ্ঘন- এসব তালিকায় শীর্ষে রেখেই বুশের ফিরিস্তি লিখেছে পত্রিকাগুলো। তবে সব ইসরাইলি পত্রিকা বুশের একচ্ছত্র প্রশংসার শ্লোক লিখেছে। জেরুসালেম পোস্ট লিখেছে, গত ৬০ বছরে সব মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যে ইসরাইলের জন্য বুশের চেয়ে বড় বন্ধু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

ব্রিটেনের সানডে টাইমস লিখেছে, একটি দেশ আর একটি অর্থনীতিকে ছোবড়া বানিয়ে রেখে গেছেন বুশ। ডেইলি মেইল জানায়, বুশ যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন আমেরিকার বাজেট উদ্বৃত্ত ছিল ১২৮ বিলিয়ন ডলার, তিনি যখন বিদায় নিচ্ছেন তখন ঘাটতি ছিল ৪৮২ বিলিয়ন ডলার! যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকালের সবচেয়ে নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা, বিশ্বকে মহামন্দা-পরবর্তী সবচেয়ে বড় সঙ্কট আর মধ্যপ্রাচ্যকে আগুনের গোলার মধ্যে ফেলে গেছেন তিনি। মুক্ত বাণিজ্য, অভিবাসন সংস্কার ও চীন ইস্যুতে দ্য ইকোনমিস্ট প্রশংসা করলেও সার্বিক মূল্যায়ন ছিল নেতিবাচক। পত্রিকার মতে, সবচেয়ে কম জনপ্রিয় আর জাতিকে সবচেয়ে বেশি বিভক্তকারী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বিদায় নিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার ভাবমর্যাদায় সবচেয়ে বিপর্যয়কর অবস্থায় ফেলেন তিনি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement