২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

যেখানে অন্যায় সেখানেই প্রতিবাদ

যেখানে অন্যায় সেখানেই প্রতিবাদ - ছবি : নয়া দিগন্ত

ন্যায়ের বিপরীত শব্দ অন্যায়। নৈতিকতাবিরোধী, শিষ্টাচার ও মূলবোধ বিবর্জিত, ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা নিষিদ্ধ এবং দেশের প্রচলিত আইনবিরোধী যেকোনো কাজ অন্যায়। সমাজ ও দেশের আদর্শ ও বিবেকবান ব্যক্তিদের অবস্থান সবসময় ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিপক্ষে হয়ে থাকে। এরূপ ব্যক্তিরা কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। বর্তমানে আমাদের দেশ ও সমাজে অন্যায় এমনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যে আদর্শ ও বিবেকবান ব্যক্তিদের অনেকে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অবস্থান গ্রহণে সাহসী হয়ে ওঠেন না। অন্যায়ের প্রতি সরাসরি ও মৌন সমর্থনও অন্যায়। নীতিনৈতিকতা ও বিবেকের তাড়নায় একজন আদর্শ ও বিবেকবান ব্যক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া দায়িত্ব হলেও বর্তমানে এ দায়িত্বটি পালনে অনেকেই সচেষ্ট নয়।

আমাদের দেশের জনমানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ইসলাম ন্যায়কে ধারণ এবং অন্যায়কে বর্জনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বীর জন্য অন্যায়কে শক্তি দিয়ে প্রতিহত করা অপরিহার্য। আর কারো যদি শক্তি দিয়ে প্রতিহত করার সাহস বা সামর্থ্য না থাকে সে ক্ষেত্রে তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত। যারা অন্যায়ের প্রতিবাদে অক্ষম এমন ব্যক্তিদের অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেই তুষ্ট থাকতে হয়। অন্যায় বিষয়ে যাদের শেষোক্ত অবস্থান ইসলামের দৃষ্টিতে তারা দুর্বল ঈমানের অধিকারী। ঈমান হলো অন্তরে বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং সে অনুযায়ী কার্য পরিচালনা।

ইসলামী রাষ্ট্র ও মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের সর্বোচ্চ আইন হলো কুরআন, অপর দিকে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সর্বোচ্চ আইন হলো সে দেশের সংবিধান। আমাদের দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এবং আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও আমরা সাংবিধানিকভাবে ইসলামী রাষ্ট্র নই। আর এ কারণে হত্যা, ধর্ষণ ও চুরির মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে কুরআন নির্দেশিত শাস্তির সাথে আমাদের প্রচলিত দণ্ড আইনে উল্লিখিত শাস্তির পার্থক্য রয়েছে।
ইসলাম অপর ধর্মাবলম্বীদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার অনুমোদন দেয় না। কোনো ইসলাম ধর্মাবলম্বী যদি এ কাজটি করেন সে ক্ষেত্রে এটি তার জন্য অন্যায়। পৃথিবীর যেসব দেশ ধর্মীয় স্বাধীনতার নীতি অনুসরণ করে সেসব দেশে একজন নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। আমাদের দেশে কোনো ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা তাদের ধর্মীয় বিধান পালনে বাধার সম্মুখীন হওয়া যেমন অন্যায় অনুরূপ তাদের কাউকে জোরপূর্বক ইসলামের বিধান অনুসরণে বাধ্য করাও অন্যায়। আমাদের দেশে অপর কোনো ধর্মাবলম্বী এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে তিনি রাষ্ট্রের কাছে প্রতিকার প্রার্থনা করতে পারেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত হিন্দু অধ্যুষিত দেশ। ভারতে উগ্রপন্থী হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সেখানকার বিভিন্ন রাজ্যে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মাবলম্বী মুসলিমদের তাদের ধর্মীয় অনুশাসন পালনে বাধার সম্মুখীন হওয়া এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেলেও ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রতিকার পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিবাদ করার মতো অনুকূল পরিবেশ ছিল না অথবা প্রতিবাদ-পরবর্তী অনেককে নিগৃহীত ও হেনস্তার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সুতরাং অন্যায়ের প্রতিবাদ নাগরিক কর্তব্য হলেও তা প্রয়োগের জন্য চাই অনুকূল ও সহায়ক পরিবেশ।

আমাদের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে- সংবিধান ও আইন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। সংবিধান আমাদের নাগরিকদের শর্তসাপেক্ষে সংগঠনের স্বাধীনতা এবং সমাবেশের স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা এবং সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মানববন্ধন প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনায় অন্যায়ভাবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বিশেষত পুলিশ কর্তৃক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, অপর দিকে সমরূপ কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে সরকারি দল বা এর অঙ্গসংগঠন বা এর জোটভুক্ত অপর কোনো দল বা তাদের অঙ্গসংগঠন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তথা পুলিশের পৃষ্ঠপোষকতা ভোগ করছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ কেউ নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর আচরণের সম্মুখীন হচ্ছে আবার কেউ কেউ অন্যায়ভাবে কারান্তরীণ হচ্ছে আবার অনেকে প্রতিবাদ না করেও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে।

আমাদের দেশে প্রজাতন্ত্রের কর্মে যারা নিয়োজিত তাদের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধাদি জনগণ প্রদত্ত করের অর্থ থেকে নির্বাহ করা হয়। এদের সবার আবশ্যিক কর্তব্য জনগণকে নিঃস্বার্থ সেবা প্রদান। সর্বশেষ অষ্টম বেতন স্কেলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের যে হারে বেতনভাতা ও অপরাপর সুযোগ-সুবিধাদি দেয়া হচ্ছে, এদের কারো বেতনবহির্ভূত অন্যায় বা অবৈধ প্রাপ্তির সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো- এদের খুব কমসংখ্যক এ পথ থেকে বিরত। সর্বশেষ বেতন স্কেল বাস্তবায়ন-পরবর্তী অন্যায় তথা দুর্নীতিবিষয়ক অবস্থানের উত্তরণ না হওয়ায় রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে আসীন অনেককে আক্ষেপ করতে দেখা গেলেও এর প্রতিবিধানে তাদের পক্ষ থেকে কার্যকর বা ফলপ্রসূ ব্যবস্থা না নেয়ায় দেশবাসী আশাহত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্তভাবে কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ তার জন্য বিপর্যয়ের বার্তাবহ হলেও সমষ্টিগত প্রতিবাদ প্রতিকার প্রদানে সহায়ক মনে করা হলেও কায়েমি স্বার্থবাদীদের কারণে তা বাস্তবায়ন বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়ার কারণে এর অনুপস্থিতি লক্ষণীয়।

পৃথিবীর সব দেশেই বিচার বিভাগকে বলা হয় জনগণের শেষ ভরসাস্থল। পৃথিবীর সর্বত্র বিচার বিভাগ জনমানুষের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠান। কিছু বিচারকের আচরণের কারণে আমাদের দেশে তা রক্ষিত হয়নি। জনমানুষের অধিকার হরণের ক্ষেত্রেও এ প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহার হয়ে গেছে। অনেক সাধারণ মানুষ অন্যায়ের শিকার হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার পাননি। এ অবস্থায় আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তাদের।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের ক্ষেত্রে সাধারণ চাকরিজীবীদের চেয়ে অধিক বয়সে অবসরের সুবিধা ভোগ করায় দেখা গেল মুক্তিযোদ্ধা নয় এমন অনেকে অন্যায়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে বর্ধিত বয়স পর্যন্ত চাকরির সুযোগ গ্রহণ করেছেন। সরকারের সর্বোচ্চ সচিব পদে আসীন এমন কয়েকজনের সন্ধান পাওয়া গেলেও আজ অবধি তাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা অগণিত। কিন্তু যারা তালিকা চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত এদের অনেকে অন্যায় প্রাপ্তি দ্বারা বশীভূত হয়ে এ কাজ থেকে নিজেদের নিবৃত্ত রাখতে পারছে না।

দেশের জনমানুষ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে জনসমর্থন রয়েছে এমন রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হয়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। আমাদের দেশে অতীতে কখনো ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না এ বিষয়ে আমাদের দেশের বড় দু’টি দলের অবস্থান ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় এবং ক্ষমতার বাইরে থাকাবস্থায় এক ও অভিন্ন। ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে না পারলে দেশে কখনো গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। আর গণতন্ত্র বিকশিত না হলে তা অন্যায়ের বিস্তৃতির পথ প্রশস্ত করে। যেকোনো পক্ষপাতদুষ্ট ও কলুষতাপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচনী কাজের সাথে সম্পৃক্ত সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অন্যায় সুযোগ দিতে হয়। যেকোনো সরকারের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এ ধরনের অন্যায় সুযোগ প্রদান-পরবর্তী তাদের কাছ থেকে ন্যায়ের প্রত্যাশী হওয়া দুরাশা বৈ আর কিছু নয়। আর এ কারণেই দেখা যায় অবৈধ ও অন্যায়ভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে যারা ক্ষমতাসীন হয় তাদের পক্ষে কখনো সুশাসন নিশ্চিত সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেকোনো দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে তা দেশের সাধারণ মানুষের এবং বিরোধী মতাবলম্বীদের দুর্ভোগের কারণ হিসেবে দেখা দেয়।

দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন প্রতিটি সরকারের দায়িত্ব। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য চাই আইনের শাসন। আইনের শাসনের নিশ্চিতের পূর্বশর্ত হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল। রাষ্ট্রক্ষমতায় গণতান্ত্রিক পরিবেশে জনমতের প্রতিফলনে যারা অধিষ্ঠিত হন তাদের পক্ষে সুশাসন নিশ্চিত করা সহজ। সুশাসন নাগরিকদের জন্য যেকোনো অন্যায় প্রতিবিধান ও প্রতিবাদ নিশ্চিত করলেও দুঃশাসন যে এর বিপরীত তা সময় ও কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর পাথরঘাটায় বদর দিবস পালনে দেড় হাজার মানুষের ইফতারি আদমদীঘিতে ৭২ হাজার টাকার জাল নোটসহ যুবক গ্রেফতার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : মন্ত্রী গাজীপুরে গাঁজার বড় চালানসহ আটক ২ দুই ঘণ্টায় বিক্রি হয়ে গেল ২৫০০ তরমুজ

সকল