১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে এগিয়ে নিতে হবে

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে এগিয়ে নিতে হবে - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশেও এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয় এবং আচরণেও কোনো হেরফের নেই যার শিকার অগণিত নিরীহ মানুষ। তাদের এ ধরনের স্বভাব দেখে এটাই মনে হয় দেশটা যেন তাদের ইজারায় রয়েছে, এর রূপরস সুষমা স্বাদ গ্রহণের এখতিয়ার একচ্ছত্রভাবে তাদের। এ কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু স্থানে মানুষের জীবন কাটে এসব ব্যক্তির কর্তৃত্বজনিত নানা ভোগান্তির মধ্যে।

প্রতিকারহীন এমন দুর্ভোগে বহু মানুষের পক্ষে নিজের মতো করে বাঁচা, নিজস্ব চিন্তাচেতনার প্রকাশ করা এতটাই নিরাপত্তাহীন। সে জন্য মূক আর বধির হয়েই থাকতে হয় তাদের। এসব ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ বা দ্বিমত করা হলে নানা হুমকির মুখে পড়তে হয়।
বিপুল আয়তনের এই বিশ্ব তখন যেন নিগ্রহের শিকার মানুষের জন্য এতটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে যে, যেখানে সেখানে তাদের বিচরণে নানা বাধা আর বিপত্তি। অথচ একজন বিশ্বাসী মানুষ স্রষ্টার সৃষ্টি এই বিশ্বকে দেখে আনন্দ উৎফুল্লচিত্তে ভ্রমণ করা এবং তাঁর সৃষ্টিতে যত বৈচিত্র্য বিস্ময় রহস্য আর সৌন্দর্য অবলোকন করার কথা তিনি বলেছেন যাতে তাঁর সৃষ্টি নৈপুণ্য দেখে মানুষের তাঁর প্রতি বিশ্বাস হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত, চিত্ত বিগলিত হয়। স্রষ্টা বিশ্বের বিশ্বাসী এবং বিনীত মানুষ ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবাইকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।
অপর দিকে অবস্থাসম্পন্ন মানুষ বিশ্বের বঞ্চিত মানুষকে বৈষম্য, নিপীড়ন করায় তাদের বিষবাষ্পের মধ্যে বাঁচতে হচ্ছে।

এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সহায়তাও তাদের জন্য দুর্লভ। বিশ্বের এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে জাতিসঙ্ঘ গা বাঁচাতে অতি সম্প্রতি পৃথিবীর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির মানবাধিকার বিষয়ক কাউন্সিলের প্রধান বলেছেন, বিশ্বের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। এর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি চীন, রাশিয়া, ইরিত্রিয়ার উদাহরণ টেনেছেন। তার বক্তব্যে ছিল, বিশ্বের বহু স্থানে চরম দরিদ্রতা, বৈষম্য, বিচারহীনতার ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। সঙ্কুচিত হয়ে আসছে গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারের পরিসর।’

বিশ্ব সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের সরকার মুখে এবং তাদের সরকারি দলিলপত্রে মানবসত্তার অধিকার নিয়ে বহু নীতিবাক্য সংযোজিত করে রেখেছে। কাগুজে এসব আশ্বাস বাস্তবে কার্যকর হতে দেখা যায় না। সেজন্য অসংখ্য মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার শিকায় উঠে আছে। জাতিসঙ্ঘের সনদে এবং বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত বহু অনুচ্ছেদ রয়েছে। সেসব নীতিকথা আর বাস্তব পরিস্থিতির কত যে ব্যবধান তা সবাই উপলব্ধি করে আর হতাশায় নিমজ্জিত হতে হয়।
বিশ্বের প্রতিটি মানবসন্তান এই ধরায় আসে বেঁধে দেয়া একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এটাই বিধাতার নিয়ম তথা বিধান। যেকোনো শিশু পৃথিবীতে আসার সাথে যে দেশের যে প্রান্তেই সে জন্মগ্রহণ করুক না কেন, স্বতঃসিদ্ধভাবে কিছু মৌলিক অধিকারের হকদার হয়ে যায় সেই নবজাতক বা জাতিকা যা আন্তর্জাতিকভাবে স্থিরীকৃত। পৃথিবীর দুই শতাধিক রাষ্ট্রের সবারই দেশ পরিচালনার জন্য নানা বিধিবিধানসহ রয়েছে সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ, যা শাসনতন্ত্র বা সংবিধান হিসেবে অভিহিত। সেখানে জনগণের অধিকার সংক্রান্ত বহুধারা বা অনুচ্ছেদ সংযুক্ত রয়েছে। জাতিসঙ্ঘেরও সর্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত একটি ঘোষণাও বিদ্যমান রয়েছে, যা ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর অনুমোদন লাভ করে। তার ভিত্তিতে ১৯৫০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার দিবস পালিত হয়। পৃথিবীর দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে তাদের শাসনতন্ত্র গ্রহণ করেছে। নানা নীতিবাক্য তাতে সংযুক্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান গৃহীত হয়।

আগেই উল্লেখ করেছি প্রতিটি দেশের সংবিধান সে দেশের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ। তা রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করার কথা। তবে বাস্তবে কোথায় তার কতটুকু কিভাবে অনুশীলন হয় সেটা জানা মুশকিল। বাংলাদেশেও সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইনের মর্যাদায় অভিষিক্ত। তাতে বলা আছে, এই আইনের পরিপন্থী কোনো আইন করা যাবে না। যদি কোনোক্রমে তেমন কোনো আইন প্রণীত হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে, সেই আইনের যতটুকু সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হবে ততটুকু বাতিল বলে গণ্য হবে। সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত যেসব অনুচ্ছেদ রয়েছে, সে ক্ষেত্রেও এই গ্যারান্টি ক্লজ কার্যকর। মৌলিক মানবাধিকারের গুরুত্ব এভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে সংবিধানে। দেশে মানবাধিকার সংক্রান্ত বিধিবিধানের অস্তিত্ব এবং তা কতটা বাস্তব রূপ নিতে পেরেছে বা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে জনগণের অধিকার কতটা রক্ষা পাচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

আমাদের সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে কথা বলার আগে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সম্পর্কিত যে ঘোষণা তার সূচনা বক্তব্য থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি। এর লক্ষ্য পাঠকের জ্ঞান ও জানার যে পরিধি, তার সহযোগী হওয়া। তবে জাতিসঙ্ঘের সেই ঘোষণার মধ্য দিয়েই যেন তার দায়িত্বের পরিসমাপ্তি ঘটেছে বলে এমন ধারণা বদ্ধমূল। কেননা বিশ্বে মানবতার সঙ্কট নিয়ে কত মানুষ বিপন্ন আর লাঞ্ছনার শিকার তা বলে শেষ করা যাবে না। মানবিক মূল্যবোধের প্রতি সীমাহীন অবহেলা। সেটা বিশ্ব সংস্থার চেতনাকে অর্থহীন করে তুলেছে।

যা হোক, মানবাধিকার সংক্রান্ত জাতিসঙ্ঘের যে দীর্ঘ ঘোষণা তার খণ্ডাংশ এখানে উদ্ধৃতি করছি। কেননা ঘোষণার পরিধি এত দীর্ঘ, তাতে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতির কারণ হতে পারে। সেই ঘোষণায় সন্নিবেশিত রয়েছে, ‘যেহেতু মানব পরিবারের সকল সদস্যের সহজাত মর্যাদা ও সম-অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহের স্বীকৃতি বিশ্বে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির ভিত্তি, যেহেতু মানবিক অধিকারসমূহের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা মানবজাতির বিবেকের পক্ষে অপমানজনক বর্বরোচিত কার্যকলাপে পরিণতি লাভ করেছে এবং সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে এমন একটি পৃথিবীর সূচনা ঘোষিত হয়েছে যেখানে মানুষ বাক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং ভয় অভাব থেকে নিষ্কৃতি ভোগ করবে, ...যেহেতু অধিকারসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়তা করা আবশ্যক; যেহেতু জাতিসঙ্ঘভুক্ত জনগণের সনদের মাধ্যমে মৌল মানবিক অধিকারসমূহ মানুষের মর্যাদা ও মূল্য এবং নারী ও পুরুষের সম-অধিকারের প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং সামাজিক অগ্রগতি ও ব্যাপক স্বাধীনতা উচ্চতর জীবন মান প্রতিষ্ঠাকল্পে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ বিজ্ঞ পাঠক বুঝে নিন, এই বক্তব্যের সাথে বিশ্বের বিদ্যমান বাস্তবতার কত পার্থক্য।
সনদে বর্ণিত হয়েছে, ‘মানব পরিবারের সকল সদস্যের’, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বের সব মানুষ কি সবাইকে এক পরিবারের সদস্য বলে স্বীকার করা হয়েছে? শ্বেতাঙ্গরা অশ্বেতাঙ্গদের তথা কৃষ্ণাঙ্গ পীত বর্ণের জনগোষ্ঠীকে কি তাদের এক পরিবারের সদস্য বা সহযোগী বলে স্বীকার করে? মাত্র কিছুকাল আগে পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের মানবিক মর্যাদা দিতে পর্যন্ত নারাজ ছিল।
জাতিসঙ্ঘের প্রভাবশালী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে মানবাধিকারে আস্থা ভালো নয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো স্বয়ং একজন ভয়ঙ্কর বর্ণবাদী ছিলেন। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে কোনো রাখঢাক ছাড়াই বর্ণবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং সময়ে সময়ে বর্ণবাদীদের উসকে দিতেন। এমন এক বর্ণবাদী ব্যক্তিকে যারা সে দেশে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত করেছিল তারা কি বর্ণবাদের আদর্শে দীক্ষিত নয়?

জাতিসঙ্ঘের সদর দফতর যে দেশে, সেই যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গরা ভীষণ বর্ণবাদী। তারা কৃষ্ণাঙ্গদের শুধু ঘৃণাই করে না, নিগৃহীত করে। মাত্র কিছু দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের এক শহরে জনৈক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ সদস্য রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মম নির্যাতন করে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে শ্বাসরুদ্ধ করে খুন করেছে। গোটা বিশ্ব তা দেখেছে। তা ছাড়া কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য বর্ণের মানুষের ওপর হরহামেশাই চলে নানা নিগ্রহ। অথচ জাতিসঙ্ঘের সনদে, সব সদস্যের ‘সহজাত মর্যাদা ও সম-অবিচ্ছেদ্য অধিকার’সমূহের স্বীকৃতির কথা জোরালোভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘মানবাধিকারসমূহের অবজ্ঞা আর ঘৃণা মানবজাতির বিবেকের পক্ষে অপমানজনক বর্বরোচিত কার্যকলাপে পরিণতি লাভ করেছে।’ সনদের এমন সব চেতনা নিয়ে কাজ করার তাগিদ এই প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী সদস্যদের মধ্যে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে কখনোই দেখা যায় না। মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে যে অভিযোগসমূহ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রয়েছে, তার চেয়েও আরো ভয়ানক অভিযোগ চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে রয়েছে।

আসলে বিশ্ব সংস্থা এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার নখদন্ত কিছুই নেই, যা দিয়ে সে কাউকে আঁচড় দিতে পারে। শক্তি সামর্থ্যহীন বলে এই সংস্থার পক্ষে কিছুই করার নেই। সে শুধু নীতি নৈতিকতার দোহাই দিতে পারে। সদস্যরা এর কোনো গুরুত্ব না দিলেও তার কিছুই করার থাকে না।

বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের সক্রিয় সদস্য। এই সংস্থার সভ্য হওয়ার আগে তাকেও সংস্থার সনদ ও অন্যান্য নীতিনির্দেশনার প্রতি সমর্থন, সহযোগিতা করা নিয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হয়েছে। এর অন্যথা করলে বাংলাদেশকে অন্যদের মতোই অভিযুক্ত হতে হবে। তেমন কোনো বিষয়ে অভিযোগ না থাকলেও মানবাধিকার আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে চরম গাফিলতির কথা নানাভাবে উঠে আসছে ক্রমাগতভাবে।

বিশ্বের অন্যতম এক বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত, সে দেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠদের অবিরাম অত্যাচার নির্যাতন চলে। তাদের ইবাদতের পবিত্র মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ এসব বিষয়ে কখনোই কোনো ভূমিকা রাখা দূরের কথা; এমনকি কোনো বক্তব্য বিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি। এসব বিবেচনায় নিলে বিশ্ব সংস্থার সনদের মর্যাদা গুরুত্ব থাকল কোথায়? এর পরও মুসলিম বিশ্ব কিভাবে বিশ্ব সংস্থার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আস্থা অক্ষুণœ রাখে? মুসলমানদের স্বতন্ত্র ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি রয়েছে, তাকে মুছে ফেলার শত চেষ্টা হচ্ছে ভারতে। মুসলমানদের বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংসের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশ্ব বিবেক এসব নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি।

দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement