২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ক্ষয়িষ্ণু দায়িত্বশীলতা

ক্ষয়িষ্ণু দায়িত্বশীলতা - ছবি : নয়া দিগন্ত

দায়িত্ব অর্থ পরিচালন, তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ, কর্তব্য প্রভৃতি। দায়িত্ব ব্যক্তি ও বস্তু এবং জীব ও নির্জীব উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দায়িত্ব পালনকারীকে দায়িত্বশীল বলা হয়। দায়িত্বশীলের বিপরীত শব্দ হচ্ছে দায়িত্বহীন। আল্লাহপাক, সৃষ্টিকর্তা, ঈশ্বর, ভগবান যে নামে ডাকা হোক না কেন তিনি যে স্রষ্টা তা তারুণ্যের উদ্দামতায় কারো কারো মাঝে সংশয় সৃষ্টি করলেও বার্ধক্যের ক্ষয়িষ্ণুতায় রক্ত প্রবাহ শীতল হতে থাকলে স্রষ্টার অস্তিত্ব এদের অনেকের মধ্য থেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে চলে যায়। এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যাদের কাছে স্র্রষ্টার অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ, তারা কি কখনো তাদের চক্ষুকে প্রসারিত করে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করে দেখেছেন- প্রতিটি সৃষ্টি বস্তুগত বা অবস্তুগত, কঠিন বা তরল, বায়বীয় বা অবায়বীয় নিজ নিজ দায়িত্ব সৃষ্টির প্রথম থেকে অদ্যাবধি বিরামহীনভাবে কোনো ধরনের ব্যত্যয় ব্যতিরেকে সঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছে। উপরোল্লিøখিত সৃষ্টিগুলোর সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের কারণেই এ পৃথিবীতে প্রাণের আগমন ঘটেছে যার মধ্যে মানুষ নামক প্রাণীও অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের পার্থক্য হলো, মানুষের মৌলিক গুণ দু’টি, যথা- পশুত্ব ও বিচারশক্তি। অপরদিকে অন্য সব প্রাণীর মৌলিক গুণ একটি, আর তা হচ্ছে পশুত্ব।

উপরোল্লিখিত সৃষ্টিসমূহের দায়িত্ব বিষয়ে আলোকপাত করলে আমাদের ধারণা স্পষ্ট হবে। যেমন- সূর্য নামক নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আমাদের পৃথিবীসহ আরো কতিপয় গ্রহ আবর্তিত হচ্ছে। পৃথিবীর দু’টি গতি। একটি আহ্নিক গতি যার মাধ্যমে পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার আবর্তিত হচ্ছে। অপরটি বার্ষিক গতি যার কারণে পৃথিবী বছরে একবার সূর্যকে আবর্তন করছে। আহ্নিক গতির কারণে আমরা দিবা-রাত্রি পাচ্ছি। বার্ষিক গতির কারণে বছরের সূত্রপাত হচ্ছে। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ হচ্ছে চন্দ্র যা গড়ে প্রতি ৩০ দিনে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে এবং এর মাধ্যমে আমরা বছরে ১২ বার এর প্রদক্ষিণ পাচ্ছি যার ফলে একটি বছরকে ১২টি মাসে বিভক্ত করা হয়েছে। চন্দ্রের উপর সূর্য কিরণের তারতম্যের কারণে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার আবির্ভাব। আবার চন্দ্র ও পৃথিবীর আকর্ষণের কারণে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি। সূর্য, পৃথিবী ও চন্দ্র নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কখনো কোনোরূপ ব্যত্যয় ঘটিয়েছে বা অনিয়ম করেছে তা কেউ কি কখনো প্রত্যক্ষ করেছে?

অনুরূপভাবে প্রকৃতিগত কারণে মানুষেরও জীবন সমৃদ্ধ। অপরাপর সব সৃষ্টির জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য পানির তিনটি রূপ রয়েছে। যথা- তরল, কঠিন ও বায়বীয়। তরল পানি নানাবিধ ব্যবহারের কারণে দূষিত হচ্ছে। এ তরল পানি বায়বীয় আকার ধারণ করে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত হয়ে আকাশে ঘনীভূত আকারে মেঘের জন্ম দিচ্ছে। এ মেঘ থেকে বৃষ্টি নেমে একদিকে বৃক্ষরাজি তরুলতাকে সজীব করছে, অপরদিকে খাল-বিল, নদী-নালায় পানির প্রবাহ বাড়িয়ে জলজ প্রাণীর জীবন ধারণ সহজতর করছে। বায়বীয় পানি পাহাড়ের চূড়ায় শীতলতার সংস্পর্শে কঠিন আকার ধারণ করে বরফে রূপান্তরিত হয়ে রোদের তাপে ধীরে ধীরে গলে নদী-নালা, খাল-বিলের মাধ্যমে ভূ-ভাগের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পৃথিবীর সব বর্জ্য নিয়ে সাগরে ঢালছে। সাগরের পানির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এটি লবণাক্ত যে কারণে সাধারণ ব্যবহার ও সাধারণ কৃষিকাজের উপযোগী নয়।

অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন, সাগরের পানি লবণাক্ত কেন? এ প্রশ্নের উত্তর অনেকরই জানা নেই। সাগরবেষ্টিত জেলা কক্সবাজারে জেলা জজ হিসেবে আমার পদায়ন হলে যোগদানের প্রথম দিন বিকেলে কনিষ্ঠ সহকর্মীরা আমাকে বালুকা দ্বারা আবৃত সাগর তীরে নিয়ে যায়। এ কনিষ্ঠ সহকর্মীদের দু’জন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ও চাকরিতে আমার অনুজ। তারা উভয়ে মেধা ও বুদ্ধিদীপ্ততায় সাধারণ মানের চেয়ে বেশ উঁচুতে অবস্থান করছিল। আমি সাগর তীরে হাঁটাহাঁটির সময় তাদের কাছে প্রশ্ন রাখলাম- সাগরের পানি লবণাক্ত কেন? তারা কেউই দীর্ঘক্ষণ চিন্তা করে যখন প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারল না, তখন আমি তাদের বললাম- পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য নদী ও খালে বাহিত হয়ে সাগরে পতিত হওয়ার পরক্ষণেই পানির লবণাক্ততার কারণে দূষণমুক্ত হয়ে সামুদ্রিক প্রাণীর অস্তিত্বকে কোনোরূপ বিপদের মুখে ফেলে না দিয়ে ভূ-ভাগের প্রাণী ও উদ্ভিদ এবং জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন ধারণের ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে।

এ কথাটি আজ আর কারো অজানা নয় যে, মানুষসহ এ জগতের সব প্রাণীর জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে অক্সিজেন। অক্সিজেন ব্যতিরেকে ক্ষণিকের ব্যবধানে প্রাণীকুলের অস্তিত্ব বিপদের মুখে পড়বে। মানুষসহ অপরাপর প্রাণীকুল অক্সিজেন গ্রহণ করছে আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করছে। অপরদিকে বৃক্ষরাজি ও তরুলতা কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করছে আর অক্সিজেন ত্যাগ করছে। এভাবে বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য রক্ষিত হচ্ছে।

সৃষ্টিকর্তা তাঁর বস্তুগত ও অবস্তুগত, তরল ও কঠিন এবং বায়বীয় ও অবায়বীয় সৃষ্টিগুলোকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন এ দায়িত্ব নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিপূর্ণতার সাথে পালিত হওয়ার কারণেই প্রকৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষিত হচ্ছে।

সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি মানুষকেই এ ধরাতে কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য পাঠিয়েছেন। এ পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের বিচরণ ক্ষণস্থায়ী। যেকোনো রাষ্ট্রের কর্ণধার থেকে শুরু করে কারণিক পর্যন্ত সবার নির্ধারিত দায়িত্ব রয়েছে। এ নির্ধারিত দায়িত্ব যারা সফলতার সাথে পালন করেন তারা সার্থক ও নন্দিত। জনগণের হৃদয়ে তারা শ্রদ্ধাভাজন হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকেন। আর দায়িত্ব পালনে যারা বিফল তারা ব্যর্থ ও নিন্দিত-ঘৃণিত।

প্রাণিকুলের মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে নৈতিকতার মানদণ্ডে মানুষ অপরাপর প্রাণীকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। অপরাপর প্রাণীর মধ্যে কখনো এমনটি পরিলক্ষিত হয়নি যে, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণী অপ্রাপ্ত বয়স্ক প্রাণীর ওপর জৈবিক চাহিদা চরিতার্থ করার মানসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা কেন? এটা কোন ধরনের নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ?
প্রাণিকুলের ষড়রিপু- কাম, ক্রোধ, মোহ, লোভ, মদ ও মাৎসর্য মানুষের ওপর যেভাবে ক্রিয়াশীল অপরাপর প্রাণীর ওপর সেভাবে ক্রিয়াশীল না হওয়ায় মানুষ তার দায়িত্ব পালনে প্রতিনিয়ত ব্যর্থতার বেড়াজালে আবদ্ধ হচ্ছে। আর এ কারণে আজ পৃথিবীর সর্বত্র হানাহানি, অত্যাচার-নিপীড়নের প্রসার ঘটছে, সবল দুর্বলের ওপর আঘাত হানছে, ধনীরা গরিবদের শোষণ করছে, দারিদ্র্য বিমোচনের নামে প্রহসন চলছে, ঋণগ্রহীতা স্বাবলম্বী না হয়ে মাত্রাতিরিক্ত সুদের কষাঘাতে পিষ্ট হয়ে ঘরের চালা হারাচ্ছে, অন্যায় ন্যায়ের ওপর প্রাধান্য পাচ্ছে, দুর্নীতি নীতিকে গ্রাস করছে, বিলাসিতা সাধারণ জীবন মানকে ম্লান করে দিচ্ছে, ভূরিভোজন ক্ষুধার সাথে তামাশা করছে, সততা অসততার কাছে মার খাচ্ছে, চোর সাধু সেজে বড়গলায় কথা বলছে, মিথ্যা সত্যকে আড়াল করছে, পাপ পুণ্যকে অতিক্রম করছে, ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, আইন বিধিবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে, কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে, অযোগ্য যোগ্যের অগ্রে স্থান পাচ্ছে, ব্যক্তিস্বার্থকে অবদমিত করছে, বিবেকহীন বিবেকবানের ওপর ঠাঁই করে নিচ্ছে, মানবিক মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, মানসিক যাতনাকে উপহাস করা হচ্ছে, বিপর্যয় আনন্দের খোরাক হচ্ছে, নির্লজ্জ ও বেহায়া ভদ্র ও সম্ভ্রান্তের চলার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করছে, কলঙ্কের কালিমা খ্যাতির ব্যাঘাত না করে আনন্দের কারণ হচ্ছে, অপরের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে নিজেকে ওই সাফল্যের জন্য যৌক্তিক ভাবছে, পদধারীদের বিভিন্নমুখী অন্যায় ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে বঞ্চিত করছে, ধোঁকাবাজ দ্বারা সহজ-সরল মানুষ প্রতারিত হচ্ছে, অন্যায়ভাবে উপরের সিঁড়িতে আরোহণে বিবেক বাধা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে না, ঘুষখোরের দৌরাত্ম্যে ন্যায়নিষ্ঠ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, মঙ্গল অমঙ্গলের কাছে পরাভূত হচ্ছে, কল্যাণ অকল্যাণের কাছে হার মানছে, ভুখানাঙ্গা ও নিরন্নের হাহাকার প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত হচ্ছে এবং ডুবন্ত নৈতিকতা খড়কুটোকে অবলম্বন করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। তারপরও বলতে দ্বিধা নেই, ক্ষয়িষ্ণু দায়িত্বশীলতা এতসব প্রতিকূলতার মধ্যে নিভু নিভু প্রদীপ থেকে দ্যুতি ছড়িয়ে নিজ অবস্থানে অটুট থাকার সংগ্রামে অবিচল রয়েছে। আর এই দায়িত্বশীল ও দায়িত্বহীনের দ্বান্দ্বিকতার মধ্য থেকেই আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক নেতৃত্বকে খুঁজে বের করে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনে ব্রতী হতে হবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
‘প্রত্যেককে কোরআনের অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে’ মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩

সকল