২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্য সরবরাহ এবং ড. ইউয়ান লঙপিং

- ফাইল ছবি

(আগের অংশের পর)
আশাবাদী ড. ইউয়ান লঙপিং
পরিস্থিতির গুরুত্ব ও পর্যালোচনায় ইরি কর্তৃক উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন সত্তে¡ও ধানের উৎপাদনশীলতা আরো বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় ছিল না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নতি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও নগরায়নের সাথে তালমিলিয়ে ধানের চাহিদা বাড়তে থাকে। ইরি কর্তৃক নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষাবাদ সত্তে¡ও খাদ্যভাবের সঙ্কট বাড়তে থাকে। ১৯৬০ এর দশকে একদিকে এশিয়ায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল (এখন হ্রাস পাচ্ছে), অন্য দিকে অধিকাংশ দেশেই নগরায়নের গতি বেড়ে যায়। মানুষ জীবনমান উন্নয়নে ও জীবিকা নির্বাহের জন্য গ্রামাঞ্চল থেকে শহরমুখী হয়ে ওঠে। শহরের জনগণ চাল সরবরাহের জন্য পুরোপুরি গ্রামীণ অঞ্চলের দারিদ্র্য ও ছোট ছোট ধান উৎপাদনকারীর ওপর নির্ভরশীল। নগরের জনসংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। আগেই বলেছি, সেই সময়কালে বিশ্বের অধিকাংশ ধান গবেষক মনে করতেন যে, প্রজননের মাধ্যমে (Cross Breeding) দোআঁশলা বা হাইব্রিড জাতের ধান উদ্ভাবন সম্ভব নয়। অথচ হাইব্রিড করার মাধ্যমেই কেবল উৎপাদনশীলতা আরো বাড়ানো সম্ভব। সৌভাগ্যক্রমে সে সময়ই আবির্ভাব ঘটে এক আদর্শবান ও প্রচণ্ড আশাবাদী ধান গবেষকের। তিনি চায়নার বিখ্যাত ধান গবেষক ড. ইউয়ান লঙপিং।

১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের প্রত্যন্ত এক ছোট শহর চাংশায় তার জন্ম। বাবা ছিলেন একজন রেল কর্মকর্তা। সেই সুবাদে এবং চীন ও জাপানের মধ্যকার যুদ্ধের কারণে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে চীনের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। তিনি চুংকিং শহরে কৃষিবিদ্যায় পড়াশোনা এবং ১৯৫৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি চাংশার একটি কৃষি কলেজে অধ্যাপনার সাথে সাথে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেন। প্রথম দিকে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল দৃষ্টি ছিল মিষ্টি আলুর দিকে। পরে তিনি ধানের উন্নয়নে দৃষ্টি ফেরান। তার মূল লক্ষ্য ছিল প্রজননের মাধ্যমে হাইব্রিড বা শংকর ধানের জাত উদ্ভাবন। ধান নিজে নিজে পরাগায়িত (self pollinated) ফসল বিধায়, এই ফসলকে এক জাতের সাথে অন্য জাতের সংমিশ্রিত (প্রজনন) করে সংকরায়ন করা খুবই কষ্টসাধ্য।

১৯৬০ সালের শেষের দিকে চায়নাতে ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ আন্দোলন ও দুর্ভিক্ষ, ড. ইউয়ানের ধান গবেষণাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। প্রচলিত আছে, ওই সময় ‘চীনে সোনার চেয়ে শস্য ছিল বেশি মূল্যবান’। বাস্তবে একই চিত্র এশিয়ার অনেক দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। ২০১১ সালে চীনের একটি দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউয়ান বলেছিলেন, ‘সেই দুর্ভিক্ষের সময় আমি কখনোই পেটভরে খেতে পারিনি। সেই তিক্ত স্মৃতি কখনোই ভোলার নয়।’ আত্মজীবনীতেও তিনি স্মরণ করেছিলেন সেই দুর্ভিক্ষের কথা। তিনি বলেছেন, নিজ চোখে দেখেছিলাম, ‘ক্ষুধার জ্বালায় সে সময় বহু মানুষ ঘাসের শিকড় এবং গাছের ছাল খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিল।’ ওই দুর্ভিক্ষের পরে চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়। তার কার্যক্রমে তাকে বুদ্ধিজীবী হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ড. ইউয়ানের চিন্তাধারা ও কার্যকলাপের মূল্য বিবেচনা করে এবং তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সাহায্য করেছিলেন। উচ্চফলনশীল গমের জাত উদ্ভাবক ও মার্কিন বিজ্ঞানী ড. নরমান বোরলাউগের মতো ড. ইউয়ানও ছিলেন খুবই বিনম্র। কখনোই খ্যাতি বা প্রশংসার পেছনে ছোটেননি। যারা তার সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন তাদের ভাষ্য মতে, ‘ড. ইউয়ানকে ক্ষেতখামারে দেখলে মনে হবে যেন তিনি নম্র গ্রামীণ কৃষকদের সাথে দেখা করছেন বা কথাবার্তা বলছেন।’ তার স্বপ্ন ছিল আকাশচুম্বী। দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী। নিজ স্বপ্নের বাস্তবায়নে ছিলেন অটল সঙ্কল্পবদ্ধ। শত কষ্ট সত্তে¡ও তিনি অদম্য সঙ্কল্প নিয়ে নিরলসভাবে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে গেছেন। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য ধান গবেষকরা বিশ্বাস করতেন যে, ‘ধানের ক্রসব্রিড বা শঙ্করায়ন সম্ভব নয়’, ড. ইউয়ান কখনোই তার লক্ষ্য অর্জনে স্বপ্নকে অনুসরণ করা থামিয়ে দেননি; যদিও স্পষ্টভাবেই এই কাজ ছিল কষ্টসাধ্য। স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার মতো।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬০ এর দশকে চীনের বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে শত শত ধানক্ষেতে হেঁটে বেড়াতে হযেছে। এভাবে ধানক্ষেত ঘুরে ঘুরে, অন্তত ১৪ হাজার ধানের গোছা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর, ১৯৭০ সালে হাইনান দ্বীপে ছয়টি ‘প্রাকৃতিক পুরুষ গাছ’ চিহ্নিত করতে সক্ষম হই।’ পুরুষ গাছ শনাক্ত করা ছিল মাত্র প্রাথমিক সফলতা। তবে এই পুরুষ ধানের গাছ থেকে আরেকটি ধান গাছের মধ্যে জিনগত উপকরণ স্থানান্তরের কৌশল খুঁজে বের করা ছিল আরো কঠিন। পুরুষ ধান গাছ শনাক্ত করার পর তিন বছর চেষ্টা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ সালে সংমিশ্রিত প্রজনন (Cross Breeding) এর মাধ্যমে শঙ্কর (হাইব্রিড) জাতের ধান উদ্ভাবনে তিনি সফলতা অর্জন করেন।

মাঠের সাফল্য
হাইব্রিড জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বড় আকারে এই জাতের আবাদ সম্ভব হয়নি। কারণ হাইব্রিড ধান উৎপাদনে প্রয়োজন হাইব্রিড বীজ। এর উৎপাদন ছিল আরো কঠিন। প্রথমে হাইব্রিড ধান তিন লাইনের সংমিশ্রণে উদ্ভাবন করা হয়েছে। এই তিন লাইনের একটি হলো বন্ধ্যা পুরুষ লাইন; একটি হলো নিরবচ্ছিন্ন পুনরুদ্ধার লাইন; আর তৃতীয়টি হলো প্রতিপালক লাইন। তাই কৃষকদের কাছে বাণিজ্যিকভাবে হাইব্রিড ধানের বীজ পাওয়া সহজলভ্য করার জন্য অতিরিক্ত তিন বছর গবেষণা চালিয়ে গেছেন।

অবশেষে ১৯৯০ সালের শেষের দিকে ড. ইউয়ান দুই লাইন জাতের উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধান উদ্ভাবন করেন। এই দুই লাইন কৌশলের অর্থ হলো- হাইব্রিড ধানের চাষ করা হবে শুধু চিহ্নিত পুরুষ গাছ ও পুনরুদ্ধারকারী লাইনের সংমিশ্রণে। এতে করে খামারে হাইব্রিড ধান উৎপাদনে মাতা-পিতার বংশকে ধরে রেখে, মূল বীজ উৎপাদন করা যেমন মোটামুটি সহজ, তেমনি ব্যয়বহুল নয়। দুই লাইনের হাইব্রিড জাত, তিন লাইনের হাইব্রিড জাত থেকে বেশি ফলনশীল। তা ছাড়া দুই লাইনের হাইব্রিড ধান উৎপাদনে চাষিরা অন্যান্য উপকরণ ও উপাদানগুলোকে আরো দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পারেন। সাথে সাথে উৎপাদনশীলতা ৮ থেকে ১১ টনে উন্নীত হয়েছে।

ড. ইউয়ান জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো নিয়ে গবেষণা করে গেছেন। তার প্রচেষ্টা ও গবেষণার ফলে ২০০৪ সাল নাগাদ হাইব্রিড ধানের ফলন হেক্টরপ্রতি ১২ টন, ২০১১ সালে ১৩.৫ টন ও ২০১৫ সালে ১৫ টনে উন্নীত হয়। মারা যাওয়ার পূর্বে তার স্বপ্ন ছিল হেক্টরপ্রতি ফলন ২০ টনে (সুপারহাইব্রিড) উন্নীত করা। উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সাথে সাথে ধানের বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনের দিকেও মনোনিবেশ করেন। যেমন- লবণাক্ততা ও খরা সহিষ্ণু জাতের ধান। অর্থাৎ যে জাতের ধান লবণাক্ত পানিতেও চাষ করা যাবে বা কম পানিতে অথবা অতিরিক্ত গরমেও চাষ করা যাবে। ২০২১ সালের ২২ মে (৯০ বছর বয়সে) এই আশাবাদী ও মনুষ্যত্বপূর্ণ মানুষটি তার জন্মস্থান চাংশার একটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি স্বপ্নপূরণে হাল ছেড়ে দেন নাই। হাসপাতালের বিছানা থেকেও তিনি মাঠের আবহাওয়া এবং ফসলের পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজ নিয়েছেন।

মনুষ্যোচিত চরিত্র
১৯৭০ এর দশকে ইরি উদ্ভাবিত যেকোনো উৎপাদনশীল জাতের তুলনায় ড. ইউয়ানের উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাতের ধানের ফলন অন্তত ২০ শতাংশ বেশি ছিল। তার উদ্ভাবন চীনের কৃষি ব্যবস্থাতে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তার কর্মের ফলাফলের মাধ্যমে ১০ হাজার বছর আগে ধান চাষ শুরু করার পর, বহু দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য ঘাটতি পেরিয়ে, চীন এখন বছরে ২০ কোটি টন ধান উৎপন্ন করে যা বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি এবং দেশটি খাদ্যে উদ্বৃত্ত। মাত্র ৯ শতাংশ আবাদযোগ্য জমি দিয়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্যের জোগান দিচ্ছে।

মহান এই বিজ্ঞানী ও মনুষ্যোচিত জ্ঞানপূর্ণ মানুষটি সারা জীবন খাদ্য সরবরাহ বাড়িয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মুখে খাবার তুলে দেয়া এবং দারিদ্র্যবিমোচনের কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। একই সাথে গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছেন। বলা যায়, দরিদ্রদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি, দারিদ্র্যবিমোচন করাও তার লক্ষ্য ছিল। এই অবদান ভুলে যাওয়ার নয়। তাকে সম্মান জানাতে বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন ২০২১ সালের ২৬ জুন এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। যেসব দেশে মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত, তারা সবাই এই মহান চীনা বিজ্ঞানীর কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে। মানবসমাজের জন্য, বিশেষ করে যেসব দেশের প্রধান খাদ্য ভাত, সেসব দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার কর্মফলই তাকে অবিস্মরণীয় করে রাখবে বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।

মহান এই কৃষি বিজ্ঞানী কেবল চীনের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করেননি, একই সাথে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। বিশ্ব খাদ্য সুরক্ষায়ও ইউয়ানের অবদান অপরিসীম। তার উদ্ভাবিত হাইব্রিড ধানের প্রযুক্তি ও চাষ কৌশল, কেবল চীনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ না রেখে, বিশ্বকে শরিকদার বানাতে বরাবরই চীন সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে তিনি জাতিসঙ্ঘের অংশীদার হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ইরিকে হাইব্রিড ধান উদ্ভাবনে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। পাশাপাশি হাইব্রিড ধানের চাষাবাদ বাড়াতে বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনামসহ এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশের কৃষকদের উৎসাহিত ও শিক্ষা দিয়েছেন। আফ্রিকার দেশগুলোতে হাইব্রিড ধানের উৎপাদন বাড়াতে ড. ইউয়ান তার জীবনের অনেক সময় সেখানে অতিবাহিত করেছেন।

ইরির মহাপরিচালক জিন বালি বলেন, ‘হাইব্রিড ধান চাষের সুবিধা হলো, এর মাধ্যমে অল্পপুঁজি দিয়েই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটানো সম্ভব। হাইব্রিড ধান নিয়ে নিরলস গবেষণার জন্য আমরা ড. ইউয়ানের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। কারণ তার গবেষণার মাধ্যমেই উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবনের পথ প্রশস্ত হয়েছে। হাইব্রিড প্রযুক্তি, ধাননির্ভর দেশগুলোকে এই শস্যে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।’
ইরি-এর হাইব্রিড ধান গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. জওহর আলী বলেন, ‘ড. ইউয়ান যতটা সম্ভব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন, যাতে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সমস্যা সমাধান করা যায়। এই হাইব্রিড জাত আজ শস্যটির বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় ১৫ শতাংশ। আমাদেরকে এর কৃতিত্ব ড. ইউয়ানকে দিতেই হবে। কারণ তিনি না থাকলে চীন অনাহারে থাকত।’

হাইব্রিড ধানের জনক-পুরস্কার ও স্বীকৃতি
দুঃখজনক হলেও সত্যি, ড. ইউয়ান নোবেল পুরস্কার পাননি। খাদ্যশস্যে নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেছেন উচ্চফলনশীল গমের জাত উদ্ভাবক মার্কিন বিজ্ঞানী ড. নরমান বোরলাউগ। এতদসত্ত্বেও, ড. ইউয়ানকেই ‘সবুজ বিপ্লবের নেতা’ হিসেবে উলে­খ করা হয়। কারণ উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন ও চাষের বিকাশে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি অনন্য প্রভাব রেখে গেছেন। সে জন্য বিশ্বের কাছে তিনি ‘হাইব্রিড ধানের জনক’ হিসেবে পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেছেন।

নোবেল প্রাইজ না পেলেও কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় অবদানের জন্য ড. ইউয়ান অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন; যার মধ্যে ২০০৪ সালে (আফ্রিকান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ড. মন্টি জোনসের সাথে যুগ্মভাবে) তিনি মর্যাদাপূর্ণ ‘বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার’ লাভ করেন। এ পুরস্কার এমন ব্যক্তিত্বরাই পান, যারা বিশ্বে খাদ্যের গুণমান, উৎপাদন ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে অবদান রাখেন।

২০০১ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চীনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভ করেছেন; ১৯৯৩ সালে আমেরিকান ফেইনস্টাইন ফাউন্ডেশন তাকে ‘হাঙ্গার রিলিফ’ পুরস্কারে ভূষিত করে; ১৯৮৭ সালে লাভ করেন ইউনেস্কোর ‘সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড’; ১৯৯৫ সালে জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘শস্য সুরক্ষা পুরস্কার।’ এ ছাড়া ১৯৮৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন থেকে ‘আবিষ্কার ও সৃজনশীলতা’ বিষয়ে পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মাননা লাভ করেছেন।

88

বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের চাষাবাদ
১৯৭০ এর দশকে চীনে প্রথম হাইব্রিড ধানের চাষ শুরু হয়। বর্তমানে দেশটিতে ধান আবাদের ৭০ শতাংশ হলো উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধান। বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের চাষ শুরু হয় ২০০১ সালে।

বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের চাষ (তিন মৌসুমে আউশ আমন বোরো) ২০১৯-২০২০
২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট ২,৯০,৭৯,২৯৭ একর জমিতে ধান চাষ করা হয়। তন্মধ্যে আউশ মৌসুমে ৩.৯৯ শতাংশ, আমনে ৩.৩২ শতাংশ এবং বোরো মৌসুমে ১৯.০২ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান উৎপাদন করা হয়েছে। গড়ে তিন মৌসুমে হাইব্রিড ধান চাষ করা হয় ৯.৭২ শতাংশ জমিতে। হাইব্রিড ধানের ফলন প্রতি একরে ১.৮৮৫ টন (তিন মৌসুমের গড়)। অন্যান্য উচ্চফলনশীল জাতের ধানের ফলন একরপ্রতি ১.২৭০ টন। অর্থাৎ গড়ে প্রতি একরে ৬৫০ কেজি বেশি। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট জমির ৯.৭২ শতাংশ অংশ জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ করা হলেও, ফলন হয়েছে মোট ধান উৎপাদনের ১৩.৭৮ শতাংশ ।

হাইব্রিড ধানের চাষ প্রতি বছর বাড়ছে। সেই সাথে একরপ্রতি ফলনও বাড়ছে। এত দিন পর্যন্ত আউশ ও আমনের জন্য তেমন উপযুক্ত জাত পাওয়া যায়নি। এখন অনেক হাইব্রিড জাত আসছে যেগুলো আউশ-আমনের জন্য উপযুক্ত। অতএব, ধারণা করা যায়, ক্রমাগতভাবে প্রতি বছর হাইব্রিড ধানের চাষ বাড়বে এবং ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৫০ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ হবে। ওই সময় পর্যন্ত, একরপ্রতি ফলন হয়তোবা ড. ইউয়ানের স্বপ্ন অনুযায়ী আট টনে উন্নীত হবে, যা বর্তমানে পাঁচ থেকে ছয় টন। তাতে চাহিদানুযায়ী ধান চাষে জমি লাগবে কম। উদ্বৃত্ত জমিতে অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদন করা যাবে। যদি তাই হয়- খাদ্যের জোগান, খাদ্যের নিরাপত্তা ও পুষ্টির নিরাপত্তায় এটা হবে বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট মাইলফলক।

এখন ধান উৎপাদনকারী প্রতিটি দেশ হাইব্রিড ধানের চাষাবাদ আত্মস্থ করে নিয়েছে। রাইস টুডে ম্যাগাজিনে ড. ইউয়ান এক মন্তব্যে বলেছেন, ‘যদি বিশ্বে ধান উৎপাদনে ব্যবহৃত জমির অর্ধেকেও হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করা হয়, তাহলে প্রতি হেক্টরে দুই টন বা প্রতি বিঘায় ২৭০ কেজি (৭.৭৩ মণ) ফলন বেশি পাওয়া সম্ভব। এমনটা হলে ধারণা করা যায় যে, বিশ্বে প্রতি বছর ধানের উৎপাদন ১৫০ মিলিয়ন টন বাড়বে। সেই অতিরিক্ত ফলন দ্বারা প্রতি বছর ৪০ থেকে ৫০ কোটি মানুষের খাবারের জোগান দেয়া সম্ভব হবে।’

উচ্চফলনশীল জাতের মতোই হাইব্রিড জাত চাষে জমি ও সেচের উত্তম ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। তেমনি প্রয়োজন রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক। চীন, ইরি, বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীরাই এখন বিভিন্ন ধরনের হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবনে গবেষণা করে যাচ্ছেন। যেগুলোর উৎপাদনে পানি, রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক লাগবে কম এবং যা ভোক্তাদের নিকট হবে স্বাদে-গন্ধে পছন্দসই। এ ছাড়াও এমন জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে যেসব জাত লবণাক্ত পানিতেও এবং খরা হলেও উৎপাদন করা যাবে।

দেশে খাদ্যের ধরন, ব্যবহার ও চাহিদা অনেক কারণে প্রভাবিত হয়। এসবের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়াও জনসংখ্যার জনতাত্তি¡ক ও উপাত্তগত মিশ্রণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের উচ্চতা, মাথাপিছু আয় ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে ভোক্তাদের স্বাদ ও পছন্দ, নগরায়নের মাত্রা ও নগরবাসীর খাদ্য গ্রহণের ধরন এবং সরকারি নীতি যা পণ্যের দাম ও প্রাপ্যতাকে প্রভাবিত করে ইত্যাদি গুরুত্ববহ। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্য গ্রহণের ধরন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির মাত্রার ভিন্নতা রয়েছে। বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এক শতাংশের কম। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তা ২.৫ শতাংশের কাছাকাছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলে গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং শিশু মৃত্যুর হার কমার কারণে জনসংখ্যার এই ঊর্ধ্বগতি।

অর্থনীতিবিদ ইস্টার বোসরুপ (ডেনমার্ক-১৯৬৫) ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন; ‘খাদ্য সরবরাহ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি হুমকি হয়ে উঠবে এ কথা সত্য নয়।’ বোসরুপ তার ‘দ্য কন্ডিশনস অব এগ্রিকালচারাল গ্রোথ’ বইতে উলে­খ করেছেন; ‘খাদ্য সরবরাহ বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধি বাধা হওয়ার চেয়ে বরং অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য খাদ্য সরবরাহের চাপ, কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে অনুঘটক হিসাবে কাজ করে।’ বোসরুপ অনুমান করেছেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য চাহিদার চাপ সামাল দিতে এবং প্রয়োজনীয় উৎপাদন অব্যাহত রাখতে জমির উৎপাদনশীল ক্ষমতার ওপর চাপ পড়বে, এটা ঠিক। তবে উৎপাদনশীলতার ওপর এই চাপ কৃষি বিজ্ঞানীদের নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে উদ্দীপ্ত করে।’

তিনি বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি অনিবার্যভাবে সমাজকে খাদ্য ঘাটতির দিকে নিয়ে যায়, যা আমাদেরকে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এই অনুঘটকের জন্য নীতি ব্যবস্থাপনা অনুক‚ল হতে হবে। বোসরুপের তত্ত¡ হলো, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত না খাদ্য দুর্লভ হয়ে ওঠে এবং তার দাম বেড়ে যায়, ততক্ষণ বিজ্ঞানীরা উৎপাদন বাড়াতে প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এগিয়ে আসেন না বা কৃষকরাও অধিক উৎপাদনে উৎসাহী হন না। এসব শর্ত যেমন উদ্ভাবনের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করে, তেমনি কৃষকদেরও উৎসাহিত করে ফসলের নতুন জাত, সরঞ্জাম ও প্রযুক্তিকে গ্রহণ বা ব্যবহার করতে।’ তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং খাদ্য সরবরাহের মধ্যে যে জটিল সম্পর্ক বিদ্যমান, ম্যালথাস সম্ভবত এ জাতীয় জটিল সম্পর্কগুলো ধর্তব্যে আনেননি।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং খাদ্য সরবরাহের মধ্যে এই জটিল সম্পর্ক হয়তো ড. ইউয়ান অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সে জন্যই হয়তো তিনি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে শুধু বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেননি, তিনি কাজ করেছেন মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সাথেও। তার কাজ শুধু চীনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, একইভাবে তিনি কাজ করেছেন এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও। এ ছাড়াও তিনি নীতিনির্ধারকদের সাথে যেমন নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন নীতি পরিবেশ তৈরিতে, তেমনি কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেছেন নতুন জাত, সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে ধানের উৎপাদন বাড়াতে। ড. ইউয়ান বেঁচে না থাকলেও তার সৃজনশীলতা, দৃষ্টিভঙ্গি, সঙ্কল্প ও অর্জন, মানুষের সামনে খুলে দিয়েছে এক নতুন দুয়ার। তার কাজগুলো আরো এগিয়ে নিলে হয়তোবা ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে ক্ষুধামুক্ত। (সমাপ্ত)

লেখক : এমএসসি, কৃষি অর্থনীতিবিদ। প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন। সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই


আরো সংবাদ



premium cement