২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যসরবরাহ এবং ড. ইউয়ান লঙপিং

-

ম্যালথাস তত্ত্ব
১৭৯৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বজনসংখ্যা শত কোটিতে পৌঁছে ছিল। সে সময় ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ও জনতত্ত্ববিদ থমাস ম্যালথাস জনসমক্ষে এক ভীতিকর তত্ত্ব নিয়ে আসেন। তার তত্ত্ব অনুযায়ী বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে, অথচ খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে মাত্র গাণিতিক হারে। (জ্যামিতিক হার- ৩, ৯, ২৭, ৮১। অথবা ৪, ১৬, ৬৪, ২৫৬ ...। গাণিতিক হার- ১, ৩, ৫, ৭, ৯ অথবা ৫, ৮, ১১, ১৪, ১৭ ...)। এ অবস্থা চলতে থাকলে, কালক্রমে এমন একসময় আসবে যখন মানুষ আর বিশ্বের বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনমাফিক পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে পারবে না। পরিণতিতে তাদের জীবনযাপনের মান ক্রমাবনতির দিকে যাবে। এমনকি, সমাজকে টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে। ম্যালথাসের এই তত্ত্ব যেমন ছিল বহুল আলোচিত, তেমনি হয়েছে সমালোচিত। শেষ পর্যন্ত তার তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্যনিরাপত্তার মধ্যকার জটিল সম্পর্ক যেমন অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়, তেমনি উপেক্ষা করাও উচিত নয়।

আধুনিক যুগে যদি কোনো অঞ্চল জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে না পারে, তবে সহজেই অন্য অঞ্চল থেকে আমদানি করা যায়। ম্যালথাস যে সময়ে এই তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন, সেটি ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজ। তখন কোথাও খুব বেশি খাদ্য উদ্বৃৃত্ত থাকত না। পরিবহনের ব্যবস্থাও ছিল কঠিন, বলতে গেলে দূরদেশ থেকে খাদ্য আমদানি ছিল তখন অসম্ভব। সমাজের নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা থেকেই খাদ্যের জোগান দিতে হতো। অতএব খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা ও উৎপাদনের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যের জোগান ও নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জটিল সম্পর্ক হিসেবে আনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি বনাম খাদ্যের জোগান
ম্যালথাসের তত্ত্ব সঠিক প্রমাণিত না হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি লোক দুর্ভিক্ষে মারা গেছে এবং পুষ্টিহীনতায় ভুগেছে। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায় ১৭০০ শতাব্দীতে অন্তত ২৩টি, ১৮০০ শতাব্দীতে ২৫টি, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ২৫টি ও বিংশ শতাব্দীতে ৩৯টি বড় দুর্ভিক্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ভিক্ষে কোটি কোটি লোক মারা গেছে। তাছাড়া অঞ্চলভিত্তিক ছোট ছোট ও ক্ষণস্থায়ী দুর্ভিক্ষ লেগেই ছিল।

বিংশ শতাব্দীতে অনেক দেশে উচ্চহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশ্বের বহু দেশ মারাত্মক খাদ্যসঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে। ফলে ১৯৫০ সালের দিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানোর লক্ষ্যে বহু দেশ ‘পরিবার পরিকল্পনা’ কর্মসূচি হাতে নেয় এবং এর বাস্তবায়নে জোর প্রচেষ্টা চালায়। সেইসঙ্গে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানোর প্রচেষ্টায় সম্মিলিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর দুটি প্রধান প্রক্রিয়া হলো; আবাদের জমি বাড়ানো অথবা আবাদযোগ্য জমিতে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা পূরণে অনেক দেশ আবাদযোগ্য জমি সম্প্রসারণের মাধ্যমে সীমিত আকারে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে স্বল্প সময়ের জন্য সমস্যার সামাল দিয়েছে। কিন্তু নতুন প্রযুক্তির অভাবে প্রতি ইউনিট জমিতে ফসল উৎপাদন ছিল খুবই কম। জমি সীমিত বিধায় আবাদযোগ্য জমির সম্প্রসারণ খুব বেশি করা সম্ভব নয়। এছাড়া বন উজাড় বা বাস্তুসংস্থান ধ্বংস করে চাষাবাদ বাড়ানোর অর্থ, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে বাস্তুতন্ত্রে প্রভাব ফেলা।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি
একশ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল ১৯.৫ কোটি; এক হাজার খ্রিষ্টাব্দে ২৭.৫ কোটি; ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে ৪৬.১০ কোটি ও ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে ১০০ কোটিতে উন্নীত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পৃথিবীর জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৬০ কোটিতে যা ১৯৩০ সাল নাগাদ পৌঁছে যায় ২০০ কোটিতে। ১৯৬০ সালে বিশ্বজনসংখ্যা ছিল ৩০০ কোটি। চল্লিশ বছরের ব্যবধানে ২০০০ সালে বিশ্বজনসংখ্যা আরো ৩০০ কোটি বেড়ে ৬০০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বজনসংখ্যা ৮০০ কোটি ও ২০৩০ সাল নাগাদ ৮৫০ কোটিতে পৌঁছে যাবে (ওয়ার্ল্ডোমিটার, হাইড ২০১০)।

উপর্যুক্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯.৫০ কোটি থেকে জনসংখ্যা ১০০ কোটিতে পৌঁছাতে ১৭০০ বছর সময় লেগেছিল। অথচ পরবর্তী ১০০ কোটি বাড়তে সময় নিয়েছে মাত্র ১০০ বছর। আর পরবর্তী ১০০ কোটি বাড়তে সময় লেগেছে মাত্র ৩০ বছর। অর্থাৎ ২০০০ সালে মাত্র ৪০ বছরের ব্যবধানে জনসংখ্যা ৩০ কোটি থেকে দ্বিগুণ হয়ে ৬০ কোটিতে পৌঁছে যায়।

ম্যালথাসের জনসংখ্যা বৃদ্ধি তত্ত্ব বনাম খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহের আতঙ্কিত ও হতাশাপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণীর মূল নির্যাস ছিল, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে খাদ্যের জোগান কমে যাবে। তাতে মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্রমশ কমে যাবে। এমনকি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সঙ্কটে পরিণত হবে।’ অন্যভাবে বলতে গেলে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে ধরে নেয়া হয়েছিল ‘নিয়তি নির্ধারিত অনিবার্য পরিণতি’ হিসেবে।

উৎপাদনশীলতা বনাম খাদ্যসঙ্কট
সম্ভবত ম্যালথাসের অনুমানের মূল ভিত্তি ছিল; জনসংখ্যা বাড়লেও জমির পরিমাণ একই থাকবে। তবে আবাদযোগ্য জমি বাড়াতে পারলেও পরিমাণে ১০ থেকে ২০ শতাংশের বেশি বাড়ানো সম্ভব নয়। অন্যদিকে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ানো গেলেও ভূমির উর্বরতা হ্রাস পাবে। তাতে জমি ও শ্রমের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা (Marginal Productivity) কমে যাবে। জমির ও শ্রমের উৎপাদনশীলতা কমে গেলে খাদ্যের উৎপাদন কম হবে। তাতে পৃথিবীর মানুষ খাদ্যাভাবের এক অনিবার্য পরিণতির মুখোমুখি হবে। এ ক্ষেত্রে বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট খাদ্যের জোগান দিতে হলে জমির প্রতি ইউনিটে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব একমাত্র নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে। অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ম্যালথাস হয়তো খাদ্য উৎপাদনে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সম্পর্কে ধারণা করতে পারেননি। সে সময় ইউরোপীয়দের জন্য খাদ্য সরবরাহ কোনো সমস্যা ছিল না। তারা বিভিন্ন উপমহাদেশে বহু অঞ্চল দখল করে ঐ দেশগুলোকে নিজেদের উপনিবেশে পরিণত করেছিল। স্থানীয় জনগণকে দাসের মতো ব্যবহার করে ইউরোপীয় খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদন করা হতো এবং স্থানীয়দের ক্ষুধার্ত রেখে উৎপাদিত ফসল নিয়ে যেতো নিজ দেশে। এ কারণে হয়তো খাদ্য সরবরাহ নিয়ে ইউরোপীয়দের তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। অন্যদিকে এশীয়দের মূল খাদ্য ছিল ভাত। জনসংখ্যার বাড়তি ঘনত্ব, আবাদযোগ্য জমির স্বল্পতা ও জমির ইউনিট প্রতি (মাত্রানুযায়ী) উৎপাদনশীলতা কম হওয়াতে ক্ষুধার যন্ত্রণায় তাদের অসহ্য জ্বালা ভুগতে হয়েছে নিত্য-নিয়ত।

১৭৫৭ সালের জুনে পলাশী যুদ্ধে জয়ের পর ব্রিটিশরা ভারতকে উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করে। এরপর টানা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারত শাসন করে। সে সময় বিভিন্ন উপমহাদেশে অন্তত সাড়ে তিন কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছিল। ১৯৪৩ সালে বাংলার মহাদুর্ভিক্ষেই প্রাণ গিয়েছিল অন্তত ৩০ লাখ মানুষের। যার পেছনের মূল কারণ ছিল উপমহাদেশে উৎপাদিত খাদ্য সরিয়ে নেয়া হয়েছিল অন্যান্য অঞ্চলে থাকা ব্রিটিশ সৈন্য ও নাগরিকদের জন্য। সে সময়কার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল অবশ্য এর জন্য ভারতে অতিমাত্রায় জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতের লোকেরা খরগোশের মতো বাচ্চা দেয়, তাই এই দুর্ভিক্ষ।’

খাদ্য উৎপাদন ও জীবিকা নির্বাহের সঙ্কট
বিশ্বের ৬০ শতাংশ জনসংখ্যার বাস এশিয়ায় ও ১৭ শতাংশ আফ্রিকায়। সম্মিলিতভাবে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশেরই বসবাস এই দুই মহাদেশে। অধিকাংশ এশীয় মানুষের কাছে ভাতই হলো প্রধান খাদ্য। পাশাপাশি আফ্রিকার বৃহৎ জনগোষ্ঠীরও প্রধান খাদ্য হলো ভাত। সবমিলিয়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরই ভাত প্রধান খাবার হিসেবে ধরা যায়। ধান থেকে চাল ও চাল থেকে ভাত। তাই বৃষ্টিপ্রবণ এশিয়ার কৃষিক্ষেত্রে ধান চাষ আধিপত্য বিস্তার করেছে। এশিয়ার বেশির ভাগ আবাদি জমি ধান চাষে ব্যবহৃত হয়।

ম্যালথাসের পূর্বাভাসের সময় এশিয়ার জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশই গ্রামাঞ্চলে বাস করত। প্রায় সবাই ছিল ক্ষুদ্র চাষি। জনসংখ্যার তুলনায় মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল খুব কম। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমির মালিকরা নিজেদের খাদ্য সরবরাহের জন্যই ধান চাষ করত। নিজ পরিবারের খাদ্যের জোগান ছাড়াও ধান চাষ ছিল জীবিকা নির্বাহের প্রধানতম উপায়। তাছাড়া ধানের উৎপাদন শুধু পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নয়। সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা। এশিয়ার বেশির ভাগ দেশের ক্ষেত্রেই এটি ছিল বাস্তবতা।

১৯৫০ এর দশকে নগরায়ণের সাথে এই অঞ্চলে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নগরায়ণের সাথে সাথে মানুষের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দরিদ্র এশীয়দের প্রাত্যহিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হয়ে ওঠে ধান। দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালোরির ৭০ শতাংশ ও প্রোটিনের ২০ ভাগ পূরণ করা হতো ভাত থেকে। সুতরাং ধান কেবল সাধারণ জনগণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ শস্য নয়, একইভাবে ধানের উৎপাদন ছিল লাখ লাখ ক্ষুদ্র চাষি পরিবারের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের কোটি কোটি বেকার ও ভূমিহীন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকা ও জীবনধারণের জন্য আয়ের একমাত্র উৎস ছিল ধানের খামারে কাজ করা থেকে অর্জিত আয়।

অন্য কোনো শিল্পের অনুপস্থিতিতে এতদঞ্চলে অন্য কোনো ধরনের কর্মসংস্থান ছিল না। এক কথায় বলা যায়, গ্রামীণ এশিয়ায় ধানের খামারে কাজ করা ছাড়া অন্য কোনো আয়ের উৎস ছিল না। ১৯৫০ এর দিকে ব্যাপক হারে দারিদ্র্যের পাশাপাশি, খাদ্য ঘাটতি এশিয়ার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং বিশ্বজনসংখ্যার ৬০ শতাংশের প্রধানতম খাদ্য সরবরাহে অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি। ধানের উৎপাদন বাড়ানো কেবল ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীকে ক্ষুধা থেকে বাঁচাতে নয়, বরঞ্চ একই সঙ্গে পুষ্টি সুরক্ষা, কর্মসংস্থান, ভূমিহীন এমনকি ক্ষুদ্র চাষিদের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম এবং দারিদ্র্য হ্রাসের মৌলিক হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ড. নরমান বোরলাউগ ও গমের উৎপাদনশীলতা
বিশ্বে তিনটি প্রধান খাদ্য হলো; ধান, গম ও ভুট্টা। তবে বিশ্বজনসংখ্যার ৬০ শতাংশই তাদের প্রধান খাদ্য ও পুষ্টির জন্য ভাতের (ধান) উপর নির্ভরশীল। ইউরোপ এবং উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য হলো গম ও ভুট্টা। ১৯৫০ এর দশকে, তীব্র না হলেও অন্য দুই প্রধান খাদ্যের জোগানও কমতে থাকে। তাতে ধানের সাথে সাথে গম ও ভুট্টার উৎপাদন বাড়ানো জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। এ লক্ষ্য অর্জনে রকফেলার ফাউন্ডেশনের এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় মেক্সিকান সরকার একটি পাইলট প্রকল্প শুরু করে। এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ‘সিমিট’। এর প্রধান কার্যালয় ছিল মেক্সিকো সিটিতে। ওই সময় মেক্সিকো খাদ্যসঙ্কটে নিপতিত ছিল। মেক্সিকোর প্রধান খাদ্য হলো গম। প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য ছিল গম ও ভুট্টার উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। পরবর্তী সময়ে এই সংস্থাটি আন্তর্জাতিক ভুট্টা ও গম উন্নতকরণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

প্রতিষ্ঠালগ্নেই মার্কিন কৃষিবিদ ড. নরমান বোরলাউগ কৃষি গবেষক হিসেবে যোগ দেন। ড. নরমানের নেতৃত্ব ও কঠোর পরিশ্রমে গমের জিনগত উন্নতি ঘটিয়ে প্রথমবারের মতো উচ্চ ফলনশীল গমের জাত উদ্ভাবন করা সক্ষম হয়। সেই সঙ্গে উদ্ভাবন করা হয় নতুন চাষপদ্ধতি। জিনগতভাবে উন্নত গমের এই নতুন জাতগুলো রোগ এবং পোকামাকড় প্রতিরোধী ছিল। নতুন জাত এবং নতুন চাষপদ্ধতির ফলে সে সময় গমের ফলন যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। গমের উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাওয়াতে ১৯৬০ এর দশকে মেক্সিকো খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। একই পদ্ধতি অনুসরণ করে এই প্রতিষ্ঠান পরে ভুট্টার উৎপাদনশীলতাও বাড়াতে সক্ষম হয়।
মেক্সিকোতে সফলতা অর্জনের পর ড. নরমান পৃথিবীর অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে প্রথম দিকে ভারত ও পাকিস্তানে উন্নত জাতের এই গমের আবাদ শুরু করতে জোর প্রচেষ্টা চালান। তার অবিরত চেষ্টার ফলে এই দুই দেশে উন্নত জাতের অধিক উৎপাদনশীল গমের চাম প্রাধান্য পায়। ফলে ১৯৬০ এর দশকে ভারত ও পশ্চিম তৎকালীন পাকিস্তান দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পেয়েছে। পাকিস্তান ও ভারতের কিছু অংশের জনগণের প্রধান খাদ্য হলো গম। তবে ভারতের বৃহদংশ ও এশিয়ার অন্যান্য দেশে জনগণের প্রধান খাদ্য ভাতের জোগানে কোনো অবদান রাখা হয়নি। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ছাড়া এশিয়ার অন্যান্য দেশে খাদ্যের সঙ্কট দিন দিন বাড়তে থাকে। অতএব খাদ্যসঙ্কট নিরসনে ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এশিয়া মহাদেশের জন্য মূল বিবেচ্য বিষয়ও জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।

ইরি (IRRI) ও ধানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি
নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা আইআরআরআই (ইরি) ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধান কার্যালয় ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায়। সিমিট যখন গম ও ভুট্টার উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ব্যস্ত, তখন ‘ইরি’ এর প্রধান লক্ষ্য ছিল ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। যে কৌশল ও প্রযুক্তি অবলম্বনে গম ও ভুট্টার উৎপাদনশীলতা বাড়ানো হয়েছে, প্রায় একই কৌশল অবলম্বন ও অনুসরণ করা হয়েছে ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে। সে সময় অধিকাংশ কৃষি গবেষকের ধারণা ছিল; ধানকে ক্রসব্রিডিংয়ের মাধ্যমে হাইব্রিড (শংকরায়ন) ধানে রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়। তাই ইরি-এর গবেষক এবং ব্রিডাররা (প্রজননকারী) ধানের ক্ষেত্রেও গমের মতো, একই কৌশল ও চাষনীতি অনুসরণ করেছিলেন। ইরি শতকরা শতভাগ সফলতা অর্জন করেছে প্রাথমিক পর্যায়ে। কারণ গমের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনে ড. নরমান প্রবর্তিত মৌলিক কৌশল ও চাষনীতি অনুসরণ করে, ইরি অনেকগুলো উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে এশিয়াতে ধানের উৎপাদন বাড়তে থাকে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে ধান উৎপাদনের গতি বাড়াতে মোটামুটি সফলতা অর্জন করে ইরি।

উন্নত ও অধিক উৎপাদনশীল জাত উদ্ভাবনের একেবারে গোড়ার দিকে কৃষকরা ধানের এই নতুন জাতগুলো চাষ করতে তেমন আগ্রহী ছিল না। তবে ইরি-এর ধান বিশেষজ্ঞদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কালক্রমে কৃষকের কাছে উচ্চ ফলনশীল জাতগুলো সমাদৃত হতে থাকে। ১৯৬৫ সালে, আমি যখন ভিক্টোরিয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, সে সময় কুমিল্লায় ইরি থেকে নিযুক্ত একজন জাপানি ধান বিশেষজ্ঞ ছিলেন যিনি ইরি উদ্ভাবিত নতুন উচ্চ ফলনশীল ধানের জাতগুলো চাষ করতে গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের বোঝাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এরপর নতুন এই উচ্চ ফলনশীল ধানের জাতগুলো গোটা বাংলাদেশের ক্ষুদ্র কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় করতে প্রায় এক দশক লেগেছে। এখন এশিয়ায় উৎপাদিত মোট ধানের প্রায় ৬০ শতাংশই হলো আধুনিক উচ্চ ফলনশীল জাত। ধানের এই আধুনিক জাতগুলো সাধারণত জমির উন্নত ব্যবস্থাপনা, সেচের ব্যবহার এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী জাতগুলো থেকে অনেক বেশি ফলন দেয়।

সবুজ বিপ্লব
পরিবার প্রতি জমির পরিমাণ কম হলেও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে উচ্চ ফলনশীল ধান গরিব চাষিদের নিয়োজিত মূলধনের কার্যকর ব্যবহার অনেকাংশে বাড়িয়েছে। এই নতুন কৌশল (প্রযুক্তি) ব্যবহারে, উন্নত জাতের এই ধান চাষে, বড় কৃষকরা যতটুকু উৎপাদন বাড়াতে পারেন অথবা আর্থিক সুবিধা অর্জন করতে পারেন, আনুপাতিক জমির হারে ছোট খামারিরাও একই সুবিধা অর্জন করতে পারেন। অর্থাৎ এই প্রযুক্তি ‘মূলধন নিরপেক্ষ’। নতুন এই প্রযুক্তি জমিতে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশে খাদ্যনিরাপত্তা বাড়ানো, দরিদ্রদের পুষ্টির সুরক্ষা উন্নত করা, মারাত্মক দারিদ্র্য হ্রাস এবং গ্রামীণ উন্নয়নকে আরো যথার্থ করতে সাহায্য করেছে। তবে সর্বসাকুল্যে প্রধান সফলতা হলো, ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্যের জোগান বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।

উপরে বর্ণিত তথ্যগুলো কার্যক্ষেত্রে হয়তোবা এত রঙিন নয়। অনেক ক্ষেত্রেই সমালোচনা আছে। এতদসত্ত্বেও গম, ভুট্টা ও ধান; এই তিন প্রধান খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান চালক হিসেবে আজকাল সবাই এই নতুন প্রযুক্তিকে মেনে নিয়েছে। যে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে গম, ভুট্টা (সিমিট উদ্ভাবিত) ও ধানের (ইরি উদ্ভাবিত) উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে, তা মূলত ‘সবুজ বিপ্লব’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সবুজ বিপ্লবের ফলে বিশ্বে এসব শস্যের ফলন অভূতপূর্বভাবে বাড়ানো গেছে। এই উদ্ভাবনের কারণেই ১৯৭০ এর দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পূূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও এশিয়ায় দুর্ভিক্ষ এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এশিয়ার অনেক দেশে খাদ্যসঙ্কট অব্যাহত ছিল এবং এ সঙ্কট দিন দিন তীব্র হতে থাকে।

(বাকি অংশ আগামীকাল)

লেখক : এমএসসি, কৃষি অর্থনীতিবিদ
প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশন
সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই


আরো সংবাদ



premium cement