২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সত্যিকার লকডাউন যেন হয়

সত্যিকার লকডাউন যেন হয়
সত্যিকার লকডাউন যেন হয় - সংগৃহীত

লকডাউন, শাটডাউন ইত্যাকার শব্দের সাথে আমরা ইদানীং বেশ পরিচিত। এর প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগে লকডাউন এখন একরকম প্রতারণার ফাঁদে পড়ে যেন ‘ঠগডাউনে’ পরিণত হয়েছে। করোনা মহামারীর করুণায় সাম্প্রতিককালে পৃথিবীজুড়ে এসবের আমদানি। মহামারীটি যেহেতু ছোঁয়াচে তাই বিচ্ছিন্ন থাকার চিকিৎসাপত্র। এই বিচ্ছিন্নতারও সীমা-পরিসীমা আছে। কতটুকু দূরে থাকবে মানুষ, কিভাবে দূরে থাকবে তারও হিসাব-নিকাশ থাকছে। সভ্যতা শিখিয়েছে- মানুষ সামাজিক জীব। মহামারী শেখাচ্ছে- সামাজিক দূরত্বের গুরুত্ব। যন্ত্রদানবে লেখা আছে- নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। ২০ গজ দূরে থাকুন। এখন চিকিৎসাবিদরা বলছেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। আসলে এটি অসামাজিক দূরত্ব। চিন্তাবিদরা বলছেন, কথাটি হওয়া উচিত ছিল শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। আর সবকিছুর মতো ভাষার প্রয়োগ অথবা অপপ্রয়োগে বিভ্রান্ত আমরা। তবুও এটি তো সত্য যে, মানুষ মানুষের জন্য। মানুষ কাছে আসবে, পাশে থাকবে এটাই মানবিকতা। মহামারী আমাদের অনুচিত শিক্ষা দিচ্ছে। তবে এ দূরত্ব নিজের নিরাপত্তার জন্য। সবার মঙ্গল নিশ্চিত করতে। তাই বলে কি আমরা এটা ভুলে যাবো ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’।

আসলে প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের। সংযমী আচরণ। অতিমাত্রায় সাবধানতা অথবা অতি স্বার্থপরতা নিরাপদ দূরত্বের নেতিবাচক ব্যাখ্যা দিচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে ভীতির ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে, মাকে ফেলে সন্তান পালিয়ে গেছে। আক্রান্ত প্রতিবেশীর বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। এই দেড় বছরে কোভিড-১৯ এর আসা-যাওয়া উঁচুতে অথবা নিচুতে অবস্থান- মহামারীকে যেন স্বাভাবিক করে তুলেছে। গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে সব। এখন কোনো মৃত্যু যেন আমাদের কাঁদায় না। কোনো সংক্রমণ-আক্রমণ ভয় পাইয়ে দেয় না। রাস্তা-ঘাটে, শহরে-নগরে, হাট-বাজারে, যানবাহনে কিংবা ফেরিতে মানুষের যে ঢল লক্ষ করা যায় তা বিস্ময়কর। ভাবখানা এই যে- ‘কুছ পরোয়া নেহি’। অথচ পরোয়া করার এখনই সময়।

দেশে এখন করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ চলছে। দিনের মৃত্যুসীমা ১১৯-এর মতো সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। নানা রঙবেরঙের আকার-প্রকার অতিক্রম করে ভয়াবহ ডেল্টায় পৌঁছেছে। ইতোমধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আমাদের সীমান্তে আঘাত হেনেছে। তা-ও দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে। রাজধানী এখন আক্রান্ত। তাই টনক নড়েছে রাজধানীর রাজা-উজিরদের। তারা দিগি¦দিক হয়ে রাজধানীকে রক্ষার শেষ চেষ্টা করছেন। এই সেদিন দেখলাম, বলা নেই কওয়া নেই রাজধানীমুখী বাসগুলো থামিয়ে দেয়া হলো। নামিয়ে দেয়া হলো যাত্রীদের। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়ায় হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগের শিকার হলেন। অথচ গাড়িওয়ালাদের গাড়ি চলছে নির্বিঘ্নে। অদ্ভুত এদের কাণ্ডকারখানা। দেখলাম যাত্রীরা টাঙ্গাইল যাবে, নামিয়ে দিচ্ছে উত্তরায়। তাহলে তারা কি হেঁটে টাঙ্গাইল যাবেন? রাজধানীর কর্তাব্যক্তিরা এ ব্যবস্থা নেয়ার আগে যথেষ্ট প্রচার, মালিক সমিতি ও চালক সমিতিকে অবহিত করতে পারতেন। তাহলে মানুষের এই চরম দুর্ভোগ হতো না।

শাসকদের অবশ্য জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করা লাগছে না। কারণ, ক্ষমতার আসা-যাওয়ায় জনগণের কোনো ভ‚মিকা থাকছে না। তাই যখন যা ইচ্ছা তখন তাই করছেন তারা। বিস্ময়ের ব্যাপার, প্রথম থেকেই তাদের এই তুঘলকি কাণ্ডকারখানা লক্ষ করা যাচ্ছে। সবার নিশ্চয়ই মনে আছে- করোনা সংক্রমণের শুরুতে ২০২০ সালের প্রথম দিকে যখন বাংলাদেশে লকডাউনের প্রয়োজন ছিল, তখন জনগণের সুরক্ষার চেয়ে উদযাপন গুরুত্ব পেলো। নরেন্দ্র মোদির প্রতীক্ষায় দীর্ঘায়িত হলো সময়। তিনি সেই সময়ে এলেন না। করোনা সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ পেলো। প্রথমদিকের আরেকটি বিষয় মনে পড়ল। গার্মেন্টে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর কর্তাব্যক্তিদের খেয়াল হলো- ব্যবসায় লোকসান দেয়া যাবে না। ব্যবসায়বান্ধব পুঁজিপতিদের সরকার নির্দেশ দিলো, গার্মেন্ট শ্রমিকরা ফিরে এসো। অথচ ততদিনে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শ্রমিকরা অনেক কষ্ট করে কাজে ফিরে এলেন। লেট বেটার দ্যান নেভার।

গত বছরের ৮ মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণের পর ২৬ মার্চ থেকে ১৪ দিনের লকডাউন দেয়া হয়েছিল। তখন সেই লকডাউনের মধ্যেই হাজার হাজার মানুষ নগর থেকে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। তখন কচ্ছপের মুখ বন্ধ আর খোলার মতো করে ধাপে ধাপে লকডাউন বাড়িয়ে ৩০ মে পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল ঈদুল ফিতর। গণবিচ্ছিন্ন সরকার বুঝতে অক্ষম ছিল যে, ঈদুল ফিতরে মানুষের বাড়ি ফেরা আটকানো যায় না। এর ফলে যা হওয়ার তাই হলো। জুন-জুলাইয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যু চরম পর্যায়ে পৌঁছে। এ পর্যায়ে চলতি বছরের ৫ এপ্রিল থেকে সাত দিন নামেমাত্র লকডাউন দেয়া হয়। এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে তা বাড়িয়ে নেয়া হয়। এরপর বিধি-নিষেধ আর লকডাউনের খেলা চলেছে অনেকদিন। শিল্পকারখানাগুলো তো প্রথম থেকেই খোলা ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে শপিংমল, আমোদ-প্রমোদের জায়গা ও পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেয়া হলো। সবকিছু খোলামেলা। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া। তবু সরকার বলছে- লকডাউন। চলছে যেন লকডাউন আর শাটডাউনের খেলা। লকডাউন হচ্ছে বিধি-নিষেধের মধ্যে বসবাস। আর শাটডাউন হচ্ছে সর্বাত্মক অবরোধ। কারফিউয়ের মতো। একটি কার্টুনের কথা মনে পড়ছে। হাজার হাজার মানুষের বিরাট জনসভা। ব্যানারে লেখা- লকডাউন। এই হচ্ছে লকডাউনের তামাশা। কখনো বলছে- কঠিন লকডাউন। গণমাধ্যম ঢিলেঢালা নমনীয়, কমনীয় ইত্যাদি শব্দাবলির আড়ালে এই তামাশাকে ব্যাখ্যা করছে।

প্রতিবেশী ভারতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। তার প্রতিঘাত যে বাংলাদেশে আসবে তা চিন্তা করার মুরোদ কি বাংলাদেশ সরকারের ছিল না? মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে যখন সীমান্তে মৃত্যুর হানা এলো, তখনো সতর্ক হলো না সরকার। ২৯ মে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিশেষজ্ঞ কমিটি সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ভারতীয় সীমান্তের সাত জেলায় লকডাউনের সুপারিশ করে। তা গ্রাহ্য করেনি সরকার। অথচ উচিত ছিল সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারি করা। সব ধরনের যোগাযোগ পরিবহন, আমদানি-রফতানি বন্ধ করে দেয়া। সরকার সীমিতভাবে করেছে এসব। অথচ দেশের অভ্যন্তরের মতোই সে ব্যবস্থাও ছিল ঢিলেঢালা ও অকার্যকর। ফলে এখন আমরা সর্বনাশের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছি। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ঢাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু আবার বাড়তে থাকে।

রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করার অকার্যকর চেষ্টার কথা আগেই বলেছি। সাত জেলায় ২২ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে সবকিছু খোলা রয়েছে। সড়কে পরিবহন চলছে। ভয়ানক যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। অবশেষে কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হলো ২৮ জুন থেকে। একদিন পর তা পরিবর্তন করে ১ জুলাই থেকে কার্যকরের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এটি লকডাউন না শাটডাউন তা নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। মনে হচ্ছে, আজ থেকে কঠোর লকডাউন-ই হয়তো হবে। এ ঘোষণাটি দেয়া হলো অনেকটা আকস্মিকভাবে। ফলে জনসাধারণের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে যায়। ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যায়। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। বেড়ে যায় সবকিছুর দাম। আবার দীর্ঘতর ও কঠিন লকডাউনের ভয়ে ঢাকা থেকে গ্রামে চলে যাওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় মানুষ।

এ অবস্থায় কঠোর লকডাউনের মধ্য দিয়ে সরকার যে সংক্রমণ হ্রাসের চেষ্টা করছে তা বাধাগ্রস্ত হবে। কার্যকর লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। তবে লকডাউন হতে হবে গরিবের খাবার ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে। দেশের সাধারণ মানুষের খবর যারা রাখেন তারা জানেন, দেশের ছয় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান নেই। শাটডাউন দিলে বিপুলসংখ্যক মানুষ না খেয়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। সরকার সীমিতভাবে খাদ্যসাহায্যের কথা বলছে বটে, তবে তাতে ভরসা নেই সাধারণ মানুষের। কারণ এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দলনির্ভর। আর দলনির্ভর হলে দুর্নীতি তো অবশ্যই হবে। উচিত ছিল স্থানীয় সরকার, পেশাজীবী সমিতি ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক খাদ্যসহায়তা। এভাবে গরিব মানুষরা করোনায় মরবে নাকি না খেয়ে মরবে সেটিই প্রশ্ন।

বিশেষজ্ঞ মহল মনে করে, শুধু লকডাউন বা শাটডাউন ঘোষণায় সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। মানুষ আশা করে, এই শুরু হওয়া লকডাউন যেন ‘ঠগডাউনে’ পরিণত না হয়। এর আগের লকডাউনগুলো যেমন কার্যকর হয়নি, এবার যেন তেমনটি না হয়। ইতঃপূর্বের লকডাউনে দেখা গেছে, বিশেষ প্রয়োজনে পুলিশের পাস দেয়া পাইকারি হয়ে গেছে। সরকারের বড় দুর্বলতা নিজেদের ব্যাপারে শক্ত হতে না পারা। ফলে দলীয় ও প্রশাসনের পরিচয়ে সবকিছু সর্বনাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটাও মনে রাখতে হবে, এটি সরকারের একার দায়িত্ব নয়। দল-মত, ধর্ম, বর্ণ ও মতভেদ নির্বিশেষে সবার উচিত মহামারীর এই সময়ে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। প্রথম থেকেই সেই মনোভাব সরকার প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে। সে জন্য মান বা অভিমানে দেশের সর্বনাশ সাধন করা যাবে না। এটি জাতি হিসেবে আমাদের সবার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের অবশ্যই এই চ্যালেঞ্জ সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement