২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবনা

উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবনা - ছবি : সংগৃহীত

আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গন বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা, সেগুলোর সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে ইতঃপূর্বে এই কলামে আমি মতামত দিয়েছি। এ প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা বলা প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষার্থী যারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাচ্ছে না তারা উচ্চশিক্ষার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিড় করছে। পশ্চিমা বিশ্বে অতি মেধাবী না হলে সাধারণত কেউ উচ্চশিক্ষার পথে পা বাড়ায় না। সেখানেও সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আরো বড় কথা ইউরোপ-আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগ বেসরকারি।

আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা বিশেষ করে পিএইচডি লেভেলে পড়াশোনা নিয়ে নানারকম ধারণা রয়েছে। যদিও এখানকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি করার সুযোগ এখনো তৈরি হয়নি। আমাদের অনেকে মনে করেন পিএইচডি করলে নিজের উন্নয়ন হবে, কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি হবে, ইত্যাদি। এটা সর্বাংশে সঠিক নয়। এখানে বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্সের পর মাস্টার্স পর্যায়ে ছাত্ররা গবেষণা করে। তাদের অনেকে পিএইচডি করতে বিদেশে যায়। মূলত বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে পড়ুয়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের আকাক্সক্ষা থাকে যে তারা গবেষণা করবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের শিক্ষার্থীরা বেশ এগিয়ে। এমন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যায়ে প্রায় সব শিক্ষার্থী থিসিস করে, সেগুলো পাবলিকেশন করে। এসব পাবলিকেশন বিদেশে স্কলারশিপ পেতে সহায়ক হয়। যারা এখান থেকে পিএইচডি করতে বিদেশে যাচ্ছে তাদের অনেকে আর দেশে ফেরে না।

আমার হিসাবে পিএইচডি করতে আমেরিকায় যাওয়া ৮০ ভাগ ছাত্র দেশে ফিরতে চায় না। এরা থেকে যাওয়ার মানসিকতা নিয়েই যায়। যারা জাপানে যায় তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টা। তাদের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ফিরে আসে। অনেকে জাপানে পিএইচডি করে পোস্ট-ডক্টরাল করতে আমেরিকায় যায় এবং সেখানে থেকে যায়। এরা দেশের জন্য তেমন প্রোডাক্টিভ হয় না। আর যারা পিএইচডি করার আগে দেশের কোনো কর্মক্ষেত্র যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা বা সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন, তারা ফিরে আসেন। যারা শিক্ষকতা থেকে ছুটি নিয়ে যান তারা হয়তো ফিরে আসেন। আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা গড়পড়তায় মেধাবী। কেউ কেউ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়েও ভালো। মেধাবীরা সাধারণত শিক্ষকতা করতে আগ্রহী হয়। এরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেলে বেসরকারিতে চলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করা শিক্ষার্থীরা কলেজ বা স্কুলেও শিক্ষকতা করতে পারে। এ পর্যায়ে তারা মৌলিক বিষয়াবলি যেমন : পদার্থ, রসায়ন, গণিত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি বা অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষকতা করতে পারে। আবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসনিক পদে যাওয়ারও সুযোগ আছে। আমার মতে, অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রত্যেক শিক্ষকের পিএইচডি করা উচিত। শুধু পদোন্নতি নয়, তার অভিজ্ঞতা ও গবেষণার সামর্থ্য বৃদ্ধি, কিভাবে গবেষণা করতে হয় তা শিক্ষার্থীদের শেখানোর জন্যও এটা দরকার।

পিএইচডি মূলত একটি ট্রেনিং। এতে একটি বিষয়ের ওপর তার গবেষণা করার দক্ষতা তৈরি হয়। তখন সে আরেকজন গবেষক তৈরি করার উপযুক্ত হয়। এটা সংশ্লিষ্ট বিষয় বোঝার জন্য তাকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চায় যে তার শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রিধারী হোক। এটা তাদের জন্য আত্মগর্বের (vanity) বিষয়ও বটে। যারা কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চান, তাদেরও পিএইচডি দরকার। যারা প্রশাসনে কাজ করবেন বা কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন তাদের জন্য এটা খুব একটা জরুরি নয়। তাদের পিএইচডি খুব কাজে লাগে না। তাই কারা পিএইচডি বা উচ্চতর গবেষণা করবে সেটা আগে বুঝতে হবে। যারা পিএইচডি করতে বিদেশে চলে যায় তাদের কথা ভিন্ন, এরা ডিগ্রি অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র বেছে নিতে পারে। কিন্তু যারা দেশে থেকে পিএইচডি করতে চায় বা পিএইচডি করে দেশে ফিরতে চায় তাদের জন্য বিষয়টি জরুরি।

বিদেশে পিএইচডি করতে বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য স্কলারশিপ পাওয়ার সুযোগ বেশি। বাণিজ্য বা সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ কম। আমেরিকায় এসব বিষয়ে গবেষণার সুযোগ কিছুটা থাকলেও অন্যান্য দেশে নেই বললেই চলে। এরা চাইলে দেশে পিএইচডি করতে পারে। বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ে পিএইচডির স্কলারশিপ পেতে অসাধারণ মেধাবী হতে হয় না। আমি দেখেছি, প্রথম শ্রেণী পাওয়া তালিকায় ১৫ বা ২০ নম্বরে আছে তারাও আমেরিকায় পিএইচডি করার সুযোগ পাচ্ছে। আমেরিকায় অনার্স-মাস্টার্স লেভেলকে বলে আন্ডার-গ্র্যাজুয়েশন। আমরা এমএস বা পিএইচডি লেভেলকে বলি পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন, আমেরিকাতে বলে গ্র্যাজুয়েশন। তারা পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন শব্দ ব্যবহার করে না। এটা ব্রিটিশ সিস্টেম।

আমি মনে করি, তারই পিএইচডি করা উচিত যে তার ডিগ্রি দিয়ে কনট্রিবিউট করতে পারবে। আমি তাদের পিএইচডি করতে উৎসাহিত করি যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হবে। যারা বিদেশ থেকে পিএইচডি করে আসে তারা কোনো না কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ পেয়ে যায়। দেখা যায়, কারো পিএইচডির আগে রেজাল্ট আহামরি তেমন কিছু নয়। সে কোথাও সুযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু পিএইচডি করে আসার পর সে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। মেয়েরা দেশ থেকে পিএইচডি করলেও অগ্রাধিকার পায়।

আমাদের দেশের সামাজিক ও পারিবারিক ব্যবস্থায় মেয়েরা শিক্ষকতা পেশা গ্রহণে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কিন্তু সেখানে শিক্ষকতা করার সুযোগ পায়নি তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে আসে। যারা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চায় তাদের পিএইচডি করা উচিত। যদিও আমাদের দেশে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলতে মাত্র দুটি- অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন ও বিসিএসআইআর (সায়েন্স ল্যাব)। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে কেবল সরকারি চাকুরেরাই কাজ করার সুযোগ পায়। আমাদের কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো গবেষণা হলেও সেখানে কাজ করতে পারে যাদের মৌলিক পড়াশোনা কৃষি বিষয়ের ওপর। ফলে অন্য কেউ পিএইচডি করে এলেও তারা সেখানে কাজ করার সুযোগ পায় না। তবে কৃষি গবেষণার জন্য দেশে বড় বড় কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

তাই আমি বলছি, কারো দেশে বা বিদেশে এমন কোন বিষয়ে পিএইচডি করা উচিত যা তার কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটানো যাবে। সেটা না পারলে পিএইচডি করার জন্য অনর্থক চেষ্টা চালানো ঠিক হবে না। দেশে পিএইচডি করলেও সময়ের অপচয় হবে। যে প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দেবে সেটা কোনো কাজে লাগবে না। আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাহিদাভিত্তিক ৮-১০টি বিষয় পড়ানো হয় বিধায় শিক্ষকতা করতে আগ্রহী কেউ অন্য কোনো বিষয়ে পিএইচডি করে এলে সেটা অকেজো হয়ে পড়ে। আমি দেখেছি সরকারি চাকরিতে গিয়ে কেউ পিএইচডি করছে। সেটা তার কর্মক্ষেত্রে তেমন কাজে লাগে না। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। অর্থ, পরিকল্পনা বা এ ধরনের কিছু মন্ত্রণালয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা বা পিএইচডি কাজে সহায়তা করতে পারে।

আমি ডেপুটেশনে সরকারি চাকরি করেছি। সচিব হতে পিএইচডি কোনো বাড়তি যোগ্যতা হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। সরকার কখনো কখনো প্রশাসনের কাউকে পিএইচডি করিয়ে আনে। কোনো সরকারি কর্মকর্তা আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি করে এলে এটা তার চাকরিতে খুব কি কাজে লাগে? এখানে পদোন্নতি হয় সিনিয়রিটি ও পারফরম্যান্সের ওপর।

ডাক্তারদের কর্মসংস্থানের জন্য পিএইচডি করার দরকার হয় না। তাদের কর্মসুযোগও বেশি। এমন নয় যে ডাক্তারি পাস করে সে বেকার বসে থাকবে। তারা হায়ার এডুকেশন ছাড়াই ভালো চাকরি করতে পারে। মেডিক্যাল কলেজ বা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য পিএইচডি চাওয়া হয় না। তারা এমএস করতে পারে, এফআরসিএস, এমডি, এফসিপিএস করতে পারে। এগুলো করে তারা প্র্যাকটিস করতে পারে। তাদের শিক্ষকতা করারও অনুমতি আছে। এই অঙ্গনে এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়া কারো প্রবেশের সুযোগ নেই। ফার্মাকোলজি বা ফিজিওলজির মতো চিকিৎসাবিদ্যার সাথে ঘনিষ্ঠ বিষয়ে পিএইচডি করে এলেও তারা সুযোগ পায় না।

তাই আমার মতে, কাজে লাগাতে না পারলে কেন কেউ পিএইচডি করবে? সে বিদেশে গিয়ে থেকে যেতে চাইলে ভিন্ন কথা। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষকতা থেকে পিএইচডি করতে বিদেশে গেলেও দেশে ফিরে তার আগের চাকরিতে জয়েন করার সুযোগ থাকে। এতে তার পদোন্নতিও হবে। তাই অন্তত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারবে এমন বিষয়ে পিএইচডি করা উচিত। যদিও সেখানে বিষয় সংখ্যা সীমিত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিবিএ, ট্রিপল-ই, সিএসই, ফার্মেসি, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি। এগুলোতে পিএইচডি করে শিক্ষকতায় জড়িত না হলেও তার জন্য দেশেই অন্যান্য ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ রয়েছে।

আমাদের কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর গবেষণা হয়। কিন্তু সেগুলো কেবল সরকারি চাকরিরতদের জন্যই সীমিত। কেউ মাইক্রোবায়োলজিতে পিএইচডি করেছেন। আমাদের সরকারি পর্যায়ে এমন ল্যাবও আছে। কিন্তু তিনি সেখানে কাজ করতে পারবেন না। কারণ তিনি সরকারি চাকুরে নন। তাহলে তিনি কেন দেশে আসবেন? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ ধরনের বিষয় পড়ায় না। আমি দেখেছি, জাপান থেকে কেউ পিএইচডি করে এসে বাংলাদেশে কাজ করতে পারে না। সেখানকার পিএইচডির মান অনেক উন্নত। তাদের কাজ করার মতো ল্যাব খুবই ব্যয়বহুল, যা এ দেশে নেই। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর পিএইচডি করে বাংলাদেশে এসে কেউ কাজ করতে পারবে না। তাই তারা যেমন দেশে আসতে পারছে না তেমনি তাদের যে এক্সপার্টাইজ, তাদের যে জ্ঞান, তাদের যে পাবলিকেশন সেটা আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। এদেরকে প্রোভাইড করতে সে মানের সফিসটিকেটেড ল্যাব তৈরি করতে হবে। এমন একটি ল্যাব করতে ৮-১০ কোটি টাকা প্রয়োজন। সরকার উদ্যোগ নিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটা করতে পারে।

তখন আমাদের অনেক মেধাবী ছাত্র দেশে ফিরে আসতে পারে। তাই যারা পিএইচডি করার কথা ভাবছেন তাদের আমি উপরোক্ত বিষয়গুলো চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে বলব। যারা শুধু নামের সঙ্গে একটি পিএইচডি লাগাতে চান তাদের কথা ভিন্ন। এ ছাড়া ডিগ্রি বাস্তব ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে না পারলে সময়ের অপচয় না করাই ভালো।

লেখক : ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স এবং সাবেক ডিন ও অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মেইল : cmhasan@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement