২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘শব্দদূষণ : নীরব ঘাতক’

‘শব্দদূষণ : নীরব ঘাতক’ - ছবি : সংগৃহীত

শব্দদূষণ বলতে মানুষের বা কোনো প্রাণীর শ্রুতিসীমা অতিক্রমকারী কোনো শব্দসৃষ্টির কারণে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বোঝায়। গাড়ির হর্ন, কলকারখানা, মাইকের অসতর্ক ব্যবহার, নির্মাণকাজ থেকে দূষণ সৃষ্টিকারী তীব্র শব্দের উৎপত্তি হয়। পরিবেশের কোলাহল থেকেও মারাত্মক শব্দদূষণের সৃষ্টি হতে পারে। কোলাহল হলো অনাকাক্সিক্ষত শব্দ যা বিরক্তির উদ্রেক করে এবং শোনার সময় তা অসংহত ও উচ্চ মনে হয়। উচ্চকিত কোলাহলের ফলে মানুষের ওপর অনুভূতিগত, শারীরিক অথবা মানসিক প্রভাব পড়তে পারে। অল্প মাত্রার সহনীয় শব্দ শরীর ও মনের জন্য ক্ষতিকারক নয়। তবে বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন অতি মাত্রায় জোরালো ও অপ্রয়োজনীয় শব্দ যখন মানুষের সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে বিরক্তি ঘটায় এবং স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে তখন তাকে শব্দদূষণ বলে। শব্দদূষণ সমগ্র বিশ্বেই এক গুরুতর সমস্যা। মানবসৃষ্ট যেকোনো উচ্চ শব্দ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

শহরের আবাসিক এলাকায় শব্দ বা আওয়াজের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৩৫ থেকে ৪৫ ডেসিবল, আর নগরে-বন্দরে ৪৫-৫০ ডেসিবলের বেশি নয়। কিন্তু আমাদের দেশে শহর, নগর ও বন্দরে শব্দদূষণের মাত্রা ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবলেরও বেশি। এ কারণে শব্দদূষণের পরিণাম অবশ্যই ভয়াবহ। শব্দদূষণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ চিন্তা ও চেতনায় বাধা সৃষ্টি করে। নগরজীবনে স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে শব্দদূষণ। সম্প্রতি শহর বন্দর নগরে নির্মাণকাজ এবং যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এ সমস্যা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এতে একদিকে জনগণ যেমন শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে রয়েছেন, সেই সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শব্দদূষণ দুশ্চিন্তা, অবসাদ, উদ্বিগ্নতা, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি বাড়িয়ে দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে ৩০টি কঠিন রোগের অন্যতম কারণ হলো শব্দদূষণ।

বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিত অতিরিক্ত হেডফোনের ব্যবহার, গাড়ির অনাকাক্সিক্ষত হর্ন, নির্মাণকাজের শব্দ, ধর্মীয় সভা-সমাবেশ, রাজনৈতিক প্রচারণায় মাইকের অসতর্ক ব্যবহার এবং গভীর রাতে বিভিন্ন মহল্লায়-কুকুরের উচ্চ শব্দ ইত্যাদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধীরে ধীরে বধিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে শব্দদূষণের কারণে অনেক মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। দেশের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, কোনো এলাকায় দিনের কোন সময়ে, কী ধরনের শব্দদূষণ সৃষ্টি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। শব্দদূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক। আর বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীতে শব্দদূষণের বহু উৎস রয়েছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। রাস্তাঘাটে মাইক ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করা, শিল্প-কারখানা কোনো ক্ষেত্রেই শব্দদূষণ বিষয়ে যেসব নিয়ম রয়েছে তা মানা হচ্ছে না।

শব্দের মাত্রা কেমন হতে হবে সেটাও আইনে উল্লেখ করা আছে। বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবল (শব্দ মাপার যন্ত্র) এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। কিন্তু সেটা মেনে চলা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও এসব ব্যাপারে একেবারেই নীরব। ঢাকা শহরে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে নানা ধরনের ভবন নির্মাণের কাজ দিনে রাতে সমানতালে চলছে। বিশেষ করে পাইলিংয়ের কাজ, ইটভাঙার যন্ত্র, সিমেন্ট মিক্সারের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। এসব ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কোনো সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা রয়েছে। তাতে উল্লেখ আছে, সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজের এসব যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণকাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু ঢাকা শহরে আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা বলতে কোনো কিছুই উল্লেখ নেই। অন্তত বড় শহরগুলোতে এমনও দেখা গেছে- মধ্য রাত এমনকি সারা রাতজুড়ে নির্মাণকাজ চলছে। কারো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে কি না, শিশুদের পড়াশোনার ক্ষতি, অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের কষ্ট কোনো কিছুই অসময়ে নির্মাণকাজ থামাতে পারেনি। আবদ্ধ কোনো স্থানে শব্দ করলে শব্দ যাতে বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ভবনে কোনো ধরনের নতুন কাজ, ড্রিল মেশিনের এবং অফিস বা বসবাসের ফ্ল্যাটে ডেকোরেশনে নিয়মিতই ভঙ্গ হচ্ছে এই নিয়ম। আমাদের দেশে ট্রাফিক সিগন্যাল একসাথে কয়েক শ’ গাড়ির হর্ন বাজানোকে শব্দদূষণের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জাপানের টোকিও শহরে কয়েক শত গাড়ি সারিবদ্ধ হয়ে চললেও কেউ হর্ন বাজায় না। উন্নত বিশ্বে সব দেশেই হর্নবিহীন গাড়ি চলাচল করে। অথচ বাংলাদেশে এই আইন কিতাবে আছে- বাস্তবে নেই। এ কারণে শব্দদূষণে আক্রান্ত হচ্ছে নগরীর অফিসপাড়ার মানুষ। সম্প্রতি একটি এনজিও পত্রিকায় এ ব্যাপারে তাদের মতামত তুলে ধরেছে। তারা বলেছে, নগরীতে যানবাহনের উচ্চ শব্দ মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে। পরিবেশ অধিদফতর বিষয়টি নিয়ে যেন তৎপর ভূমিকা রাখেন, এটা নগরবাসীর একান্ত প্রত্যাশা। মাইক ও লাউড স্পিকারের ব্যবহার ইদানীংকালে খুবই জনপ্রিয় বাংলাদেশে। রাজনৈতিক সভা থেকে শুরু করে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইকের অসতর্ক ব্যবহার- পুরো সমাজব্যবস্থাকে রোগাক্রান্ত করে তুলছে।

খোলা জায়গায় বিয়ে, খেলাধুলা, কনসার্ট ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ধরনের সভা, মেলা, যাত্রাগান ইত্যাদির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে এবং পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় এই ধরনের শব্দ করা যাবে না এবং রাত ১০টার মধ্যে এসব অনুষ্ঠান অবশ্যই শেষ করে ফেলতে হবে। এসব অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে শব্দের জন্য সহনীয় মাত্রার যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। উন্নত বিশ্বে শব্দ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বহু বছর থেকে চালু আছে।

পরিবেশের যথাযথ সংরক্ষণের ওপর আমাদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে। কোন পরিবেশ মানুষের জন্য কল্যাণকর, কোন পরিবেশে বসবাস করলে মানুষ সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারবে তা আমাদের ধর্মে ও রাষ্ট্রীয় আইনে নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণের মাধ্যমে মানুষ প্রতিদিন আল্লাহ প্রদত্ত অপার নিয়ামত এই পরিবেশ নানাভাবে নষ্ট করছে। শব্দদূষণে মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে। সরকার কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একার পক্ষে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে মসজিদের খতিব-ইমামগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। প্রতি শুক্রবার মসজিদের খতিব-খুতবায় পরিবেশের বিভিন্ন দিক নিয়ে কুরআন ও হাদিসের আলোকে বক্তব্য রাখতে পারেন। সড়ক পরিবহন আইনে শব্দদূষণের কারণে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে হলে জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ইতোমধ্যে পরিবেশ অধিদফতর আগারগাঁওকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বহু আগ থেকেই এই নিয়ম চালু আছে। আমরা চাই পুরো ঢাকা শহরে শান্ত নীরব পরিবেশ গড়ে উঠুক। দুঃখজনক যে, ঢাকা শহর দূষিত এবং অসুস্থ শহর হিসেবে গোটা বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। সুন্দর ও শান্তিময় শহর হিসেবে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড আছে প্রথম স্থানে। সরকার এবং নাগরিকদের অবহেলায় প্রাণশক্তি হারাচ্ছে রাজধানী শহর ঢাকা। বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব নয়েজ কন্ট্রোল বলছে, যাত্রাপথের শব্দের কারণে যেকোনো মানুষের হাইপারটেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত শব্দের পরিবেশে থাকলে শিশুর শরীরে স্থায়ী ত্রুটি তৈরি হতে পারে। শব্দদূষণের কারণে ব্লাডপ্রেসার, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, এমনকি হজমের সমস্যা তৈরি হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছে, দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শব্দদূষণে বাংলাদেশে বধির হওয়ার মাত্রাও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। নাক কান গলার রোগ বিশেষজ্ঞ ডা: মইনুল হাফিজ বলেছেন, অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে দীর্ঘদিন কাটালে শ্রবণশক্তি ধীরে ধীরে কমে যাওয়া এমনকি বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেছেন, অতিরিক্ত শব্দের কারণে কানের নার্ভ ও রিসেপ্টর সেলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মানুষ সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবল শব্দে কথা বলে। ৭০ ডেসিবল পর্যন্ত মানুষের কান গ্রহণ করতে পারে। ৮০’র ওপরে গেলেই ক্ষতি শুরু হয়। বছর কয়েক আগে পরিবেশ অধিদফতরের এক জরিপে উঠে এসেছে যে, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতোমধ্যেই দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। আসুন আমরা সবাই এ ব্যাপারে সচেতন হই।

লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক
E.m: harunrashidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement