২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

উত্তেজনা আর নতুন সমীকরণ : আরেক যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে?

উত্তেজনা আর নতুন সমীকরণ : আরেক যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে? - ফাইল ছবি

মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতাবস্থার পরিবর্তনের নানা লক্ষণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুরো মেয়াদে আমেরিকান নীতি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল মধ্যপ্রাচ্যে। পররাষ্ট্র কৌশলে ইসরাইলের সাথে একাকার হয়ে যায় আমেরিকা। ফিলিস্তিনি এজেন্ডাকে এক পাশে সরিয়ে আরব-ইসরাইল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নতুন এক প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যে। ওআইসি সদস্যভুক্ত বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রও একই অবস্থানে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়। যেসব আরব রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে সেসব দেশের নিরাপত্তা কৌশল ও অর্থনৈতিক নীতির ওপর তেলআবিবের প্রভাব প্রকট হয়ে ওঠে।

এ ধরনের এক পরিস্থিতির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বাইডেনের এই ক্ষমতা গ্রহণে সামগ্রিকভাবে আমেরিকান পররাষ্ট্র কৌশল ও বিশেষভাবে মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা তৈরি হয়। জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর বাইডেন প্রশাসন তার কৌশল ও নীতি পদক্ষেপ সাজাতে কয়েক মাস সময় নেয়ার পর ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলন, জি-৭ সম্মেলন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বৈঠক এবং সর্বশেষ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে বহুলালোচিত শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাইডেন প্রশাসন কার্যকর যাত্রা শুরু করল বলে মনে করা হচ্ছে। এসব সম্মেলনে বাইডেন ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দের সাথে একাধিক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সাথেও তিনি বৈঠক করেছেন। বাকি রয়েছেন চীনা নেতা শি জিনপিং। এই বৈঠকও একসময় হতে পারে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক যুদ্ধের ডঙ্কা বেজে উঠেছে।

তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা : ইরান নির্বাচন
বিশ্বনেতাদের সাথে বাইডেন প্রশাসনের সংলাপের সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটছে। এই সময়েই ইরানে বহুলালোচিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এই নির্বাচনে ৬২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সাবেক প্রধান বিচারপতি ইব্রাহিম রাইসি। করোনা বিধ্বস্ত ইরানে যত কমসংখ্যক ভোটার এই নির্বাচনে অংশ নেবে বলে ধারণা করা হয়েছিল বাস্তব সংখ্যাটি তার চেয়ে অনেক বড়। ৫০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ ভোট দিয়েছে করোনা সময়ের এই নির্বাচনে। ইরানের রাজনীতিতে সংস্কারপন্থী ও রক্ষণশীল ধারার মধ্যপন্থী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ইব্রাহিম রাইসি। তার মতো এত বেশি সমর্থন নিয়ে সাম্প্রতিক নির্বাচনে কেউ প্রেসিডেন্ট হননি। আশি-ঊর্ধ্ব ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে তাকে তুলে ধরা হচ্ছে। ৪৫ দিনের মধ্যেই তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বলে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি জানিয়েছেন। কিন্তু তার আগেই যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তির আলোচনা শেষ করে আনার কথা বলা হলেও শেষ মুহূর্তে আলোচনা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।

ইরানের গভীর সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে মনে হচ্ছে, দেশটির নীতি প্রণেতারা যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তিতে ফিরে আসার বিষয়টি এখন আর প্রবলভাবে কামনা করছেন না। তারা এ কারণেই শর্ত দিয়েছেন, চুক্তির কার্যকারিতার জন্য সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। ওয়াশিংটন কতটা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে চুক্তিতে ফিরতে চাইবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আর চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র না ফেরার অর্থ হলো, তেহরানের অচিরেই পারমাণবিক শক্তি অর্জনের ঘোষণা।

তেহরানের কিছু সূত্র মতে, ইরান এর মধ্যে গোপনে গোটা পাঁচেক পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে না ফিরলে পরীক্ষা চালিয়ে পারমাণবিক ক্লাবে প্রবেশের ঘোষণা দেবে। আর পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় মস্কো-বেইজিং সব ধরনের সহযোগিতা দেবে তাকে। বাহ্যিকভাবে বৃহৎ দু’টি দেশ যা-ই বলুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তিতে ফিরে আসুক আর এ বিষয়ে বড় কোনো ছাড় তেহরান দিক, তা চীন-রাশিয়া চায় না। আলোচনা স্থগিত ঘোষণার পর পরই ইরানের মিডিয়াতে খবর বেরিয়েছে, বুশেহর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র শিগগিরই আবার চালু হবে। কারিগরি সমস্যার কারণে ইরানের বুশেহর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

ইরানের পরমাণু শক্তি অর্জনের ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় আলোড়ন তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন যে পরিস্থিতি অঞ্চলটিতে দেখা যাচ্ছে তার সাথে নানাভাবে এর সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নতুন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন জেনারেল কাশেম সোলাইমানির বেশ ঘনিষ্ঠ, যাকে যুক্তরাষ্ট্র বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে। ফলে রাইসির নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া খুবই নেতিবাচক। তার চেয়েও নেতিবাচক ছিল ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া। ইব্রাহিম রাইসির নির্বাচিত হওয়ার পর যে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে সেটি পরবর্তী পরিস্থিতির সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত হতে পারে।

বাইডেন-এরদোগান বোঝাপড়া কত দূর
সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ঘটনাবলির একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের সময় জো বাইডেন ও রজব তৈয়ব এরদোগানের শীর্ষ সম্মেলন। এই শীর্ষ সম্মেলন কতটা সফল বা বিফল তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের নানা মন্তব্য রয়েছে। দুই নেতাই আলোচনা ‘গঠনমূলক ও ইতিবাচক’ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তবে বৃহত্তর ঐকমত্য না হলে ক‚টনৈতিক ভাষায় এই দু’টি শব্দের ব্যবহার প্রায়ই লক্ষ করা যায়।

তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব ইস্যু রয়েছে সেগুলো একেবারেই এতটা সহজ নয় যে, তা নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছা দ্রুত হয়ে যাবে। এই ইস্যুগুলোর মধ্যে একটি হলো, সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ ওয়াইপিজি ও পেশমার্গাকে আমেরিকার সমর্থন দেয়া। তুরস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দি গ্রুপ পিকেকের সাথে সংশ্লিষ্ট এ দু’টি গ্রুপকে আইএস দমনের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে অথচ তাদের আঙ্কারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং অখণ্ডতার জন্য হুমকি বলে মনে করে। আঙ্কারা এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থনকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক মনে করে না। তাদের মধ্যে এ সংশয়ও রয়েছে যে, সিরিয়ার সমস্যা সমাধানে ওয়াশিংটনের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। একসময় বাশার আল আসাদের সরকার পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলে সিরিয়া দেশটিতে রুশ হস্তক্ষেপে পুরো ভারসাম্য পাল্টে যায়, বোমা হামলায় লাখ লাখ সিরীয় নিহত হয়। বাশার সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আমেরিকান নীরব সম্মতিতে এটি ঘটেছে বলে আঙ্কারার অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রভাবশালী ক্রাউন প্রিন্স সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। অথচ তুরস্কে থাকা সিরিয়ার প্রায় চার মিলিয়ন উদ্বাস্তুর জন্য নিরাপদ জোন গঠনের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের সমর্থন লাভ তখন অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ওবামা-বাইডেন প্রশাসন এ ব্যাপারে একবারেই কোনো সাড়া দেয়নি। ট্রাম্পের সময় এসে এ নিয়ে একটি চুক্তি হয়।

তুরস্ক চাইছে সিরিয়ার অখণ্ডতার কাঠামোর মধ্যে এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান নিশ্চিত করতে, যাতে সব উদ্বাস্তু নিরাপত্তাসহ সম্মানের সাথে নিজ দেশে ফিরতে পারে । আর সেটি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ইদলিব, আফরিন ও উত্তর সিরিয়ায় সিরীয় উদ্বাস্তুদের জন্য নিরাপদ জোন বহাল রাখা। বাইডেন সম্ভবত এখন চাইছেন প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা। আর এ ক্ষেত্রে ন্যাটোর অংশ হিসেবে তুরস্কের মুখ্য ভূমিকা নেয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো এটি হওয়া মানে, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সাথে তুরস্কের সর্বাত্মক সঙ্ঘাত তৈরি হওয়া, একই সাথে রাশিয়ার সাথে বোঝাপড়ার যে সম্পর্ক এর মধ্যে তৈরি হয়েছে সেটিও ভেঙে পড়া। তুরস্কের কৌশলগত ডকট্রিনের সাথে কোনোভাবেই এটি যায় না।

তুরস্কে এটি ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, ২০১৬ সালের যে সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা তার পেছনে ওবামা-বাইডেন প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। আর বাইডেন তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় তুরস্কে গণতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তন আনতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ অবস্থায় আমেরিকার হয়ে এমন যুদ্ধে নামা তুরস্কের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে, যাতে দুই প্রতিবেশী ইরান-রাশিয়া ক্ষুব্ধ প্রতিপক্ষ হবে আর সময় বুঝে ওয়াশিংটনের জন্য এরদোগানকে গাছে তুলে দিয়ে মই সরিয়ে নেয়ার সহজ সুযোগ তৈরি হবে।

রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষত বাইডেন প্রশাসনের অনমনীয় অবস্থান গ্রহণের সাথে ন্যাটোর সিদ্ধান্তের অধীনে থাকতে তুরস্ককে চাপ প্রয়োগের একটি সম্পর্ক রয়েছে। তুরস্ক চেয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো তুরস্ককে বাইরে ঠেলে দিতে চাইলে আঙ্কারার সামনে যাতে বিকল্প বৈশ্বিক বলয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। এ কারণে ন্যাটো বলয়ে থেকেও রাশিয়া ও চীন উভয়ের সাথে সীমিত পর্যায়ের সম্পর্ক রক্ষা করে গেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র যখন প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তখন রাশিয়ার সাথে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আঙ্কারা চুক্তির দিকে গেছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে, এস-৩৫ বিমানের জন্য অর্থ পরিশোধের পরও তা সরবরাহ করেনি আমেরিকা। এ ইস্যুতে এরদোগান বাইডেনের সাথে বৈঠকের সময় কোনো রাখঢাক না রেখেই কথা বলেছেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, এস-৪০০ নিয়ে ভিন্ন কিছু বিবেচনার অবকাশ নেই।

আমেরিকার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো আফগানিস্তান। বাইডেন সম্ভবত চাইছেন, তুরস্ক ন্যাটো সদস্য হিসেবে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করুক। আঙ্কারা এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিলেও তালেবানদের এতে সম্মত থাকার বিষয় রয়েছে। সব বিদেশী সেনা প্রত্যাহার শেষে দ্বিপক্ষীয়ভাবে তুরস্কের সাথে সমঝোতা চায় বলে মনে হয় আফগান তালেবান। তবে বৃহত্তর ইস্যুগুলোতে বিশেষত সিরিয়া ইরাক লিবিয়া ফিলিস্তিন বিষয়ে সমঝোতা ছাড়া ন্যাটো সদস্য হিসেবে তুরস্ক এমন কোনো ভূমিকা নিতে চাইবে বলে মনে হয় না, যাতে তালেবান অথবা ইরান রাশিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ানোর অবস্থা তৈরি হয়। রাশিয়াও আফগানিস্তানে ন্যাটোর যেকোনো দেশের সেনা রাখার বিপক্ষে।

তুরস্কের কৌশলগত লক্ষ্য হলো মুসলিম দেশগুলোর হানাহানি বন্ধ করে একটি অভিন্ন সহযোগিতার শক্তিবলয় তৈরি করা যা তাদের নিরাপত্তার জন্য ভিন্ন কারো মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে নিষ্কৃতি দেবে। একই সাথে পূর্ব ভ‚-মধ্যসাগর, লিবিয়া, আজারবাইজানের নাগরর্নো-কারাবাখে দেশটির স্বার্থ রক্ষা করেই উত্তেজনার প্রশমন করা। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত তুরস্কের ন্যাটোর সিদ্ধান্তের অধীন কোনো ভ‚মিকা প্রত্যাশা করে। এ ধরনের প্রত্যাশা তুরস্ককে দিয়ে পূরণ করার আশা নেই। আর সেটি না পেরে তুরস্কে রাজনৈতিক বা গুলেনিস্ট শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একেপি সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলবে, সেই অবস্থাও সম্ভবত এখন আর নেই।

বরং আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই প্রয়োজন হবে তুরস্ককে। ইরানের সাথে সমঝোতায় গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্যমান অবস্থাকে উল্টে দেয়ার ব্যাপারে একসময় যে আমেরিকান উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছিল সেটি এখন আর বাস্তব কোনো বিষয় নেই। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে তার সেনা প্রত্যাহার করছে। তার মিত্র দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রত্যাহারের বিষয় সামনে রেখে সমান্তরালভাবে বিকল্প বিশ্বশক্তির সাথে সম্পর্ক রাখছে। এই অবস্থায় তুরস্ক তার নিজস্ব ও উম্মাহর স্বার্থ সামনে রেখে সম্পর্কের বিষয় সাজাবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই নীতিতে অটল থাকতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তি হিসেবেই নয়, সে সাথে বৈশ্বিকভাবে প্রভাব সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবে তুরস্কের আবির্ভাব ঘটতে পারে।

আরেকটি যুদ্ধ চাইছে ইসরাইল?
ইসরাইলে অতিসক্রিয়তাবাদী ডানপন্থী নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ১২ বছর শাসনের অবসান ঘটেছে অতি সম্প্রতি। সরকার গঠিত হয়েছে নেতানিয়াহুর এক সাবেক সহযোগী ইয়ামিনা পার্টির প্রধান নাফতালি বেনেতের নেতৃত্বে। সরকার গঠন করা দলের মধ্যে অতি ডান, বাম, মধ্যপন্থী আর আরব-ইসরাইলি দলও রয়েছে। ভঙ্গুর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোটটি ক্ষমতায় এলেও এর পেছনে বাইডেন প্রশাসনের সমর্থন রয়েছে বলে মনে হয়। নাফতালি বেনেতের নীতি কৌশল কতটা নেতানিয়াহু থেকে আলাদা হবে এ মুহূর্তে সেটি কল্পনা করা কঠিন। তবে নেতানিয়াহু অধ্যায়ের সম্ভবত আপাতত অবসান ঘটেছে। নাফতালির ভ‚মিকা ইসরাইলের বৃহত্তর ডকট্রিনের অংশ হলেও কৌশলের বাস্তবায়নগত ভিন্নতা দেখা যেতে পারে নেতানিয়াহুর সাথে। তবে নাফতালির যুদ্ধবাজ পটভ‚মি রয়েছে।

আর ইসরাইলের রাজনৈতিক ঐতিহ্য হলো, সঙ্কটে পড়লে ফিলিস্তিনিদের ওপর নানা অজুহাতে হামলা চালানো। গাজার সা¤প্রতিক সামরিক হামলার বিষয়ে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী রূপ পাওয়ার আগেই নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে। শেখ জাররাহতে নতুন করে শুরু করা হয়েছে আরব উচ্ছেদ অভিযান। বায়তুল মুকাদ্দাসে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এমনকি বেলুন উড়ানোর অজুহাত দেখিয়ে গাজায় নতুন করে বিমান হামলাও চালানো হয়েছে। পশ্চিম তীরে দু’জন ফিলিস্তিনি গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে। এসবের পেছনে যে গাজায় আরেক দফা হামলা চালানো, সেটি সম্ভবত এখন আর অস্পষ্ট নেই। নাফতালি মনে করছেন, নেতানিয়াহুর যুদ্ধ ব্যর্থতার পর গাজায় পুনর্গঠন শুরু হওয়ার আগেই আবার হামলা চালিয়ে তার সরকারের শক্তিমত্তার জানান দিলে জাতীয়তাবাদী চেতনা তার পক্ষে থাকবে।

কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি ইসরাইলের আকাক্সক্ষা অনুসারে এগোবে বলে মনে হয় না। এই যুদ্ধে ইসরাইল সুস্পষ্ট পরাজয়ের সম্মুখীন হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। আগের গাজা যুদ্ধে হামাস তার পুরো শক্তি প্রদর্শন করেনি। এবার ইসরাইল যেমন যুদ্ধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে পারে ঠিক সেভাবে হামাসের পেছনে পাল্টা শক্তির মদদ বাড়তে পারে। আরেক দফা গাজা আক্রমণ হলে হিজবুল্লাহ, সিরিয়া এবং ইরান যেভাবেই হোক তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়তে পারে। মিসরের সিসি সরকার কাতার, তুরস্ক ও হামাসের সাথে বৈরিতা কমানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইরানের সাথেও যোগসূত্র তৈরির চেষ্টা করছে। মিসরে ব্রাদারহুডের ১২ জন নেতার সর্বোচ্চ আদালতে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখায় স্পষ্ট যে, দলটির সাথে এখনো সম্পর্ক নতুন করে যাত্রা শুরুর অবস্থায় যায়নি। তবে ফিলিস্তিনের সাথে নতুন সংঘর্ষে ইসরাইল তার গতানুগতিক মুসলিম মিত্রদেরও পাশে না পাওয়ার সম্ভাবনাই রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে কেবল সংযুক্ত আরব আমিরাত।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সূত্রের পূর্বাভাস অনুসারে, ইসরাইল চেষ্টা করবে আরেক দফা গাজায় অভিযান চালানোর অজুহাত সৃষ্টি করার। কিন্তু এ ধরনের কিছু সত্যি সত্যি নাফতালি বেনেত শুরু করলে আন্তর্জাতিক সমর্থন ইসরাইলের আরো কমে যেতে পারে। আর এই যুদ্ধে চীন-রাশিয়ার মতো শক্তিও যুক্ত হয়ে যেতে পারে।

বাইডেন-পুতিনের মুষিক প্রসব!
জো বাইডেন ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে যে শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন তার দৃশ্যমান ফল দু’টি। একটি হলো দুই দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়া আর দ্বিতীয়টি হলো কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণ আলোচনা স্টার্ট-৩ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সমঝোতা। বাইডেনের মূল এজেন্ডা ছিল চীনের সাথে রাশিয়ার কৌশলগত মৈত্রীর মধ্যে ব্যবধান তৈরি করা। এর কারণে জেনেভার বিমানে ওঠার আগে বাইডেন মন্তব্য করেছিলেন ‘চীন রাশিয়ার উত্থানকে দমন করতে মরিয়া হয়ে ঊঠেছে।’ আর পুতিনের সাথে শীর্ষ বৈঠক শেষ করার কয়েক দিন পরেই বিরোধী নেতা নাভালনির ওপর বিষ প্রয়োগের ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর আরো বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
বাইডেনের সা¤প্রতিক একাধিক কৌশলগত শীর্ষ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল চীনের বিরুদ্ধে এক মৈত্রী বলয় গঠন। আর চীনা মিত্রদের যথাসম্ভব বেইজিং থেকে দূরে সরানো। ন্যাটো মিত্রদের মধ্যে তুরস্কের সাথে পূর্ণ বোঝাপড়া হয়েছে এমন কোনো আলামত নেই। জার্মানি আর ফ্রান্স চীনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ে না নামার আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। আসিয়ানের সদস্যদের সাথে দক্ষিণ চায়না সাগর ও মিয়ানমার ইস্যুতে একটি মৈত্রী বলয় তৈরি করতে চাইছেন বাইডেন। এ ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান সাফল্য এখনো পর্যন্ত নেই। ভারত কোয়াডে থাকলেও সব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে নেই।
এভাবে চীনকে চেপে ধরার উদ্যোগ আয়োজনের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিতে দুইভাবে পড়ছে। প্রথমত, চীন আমেরিকার সাথে প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাতের আগে একটি ছায়া সঙ্ঘাতে দেশটিকে ব্যস্ত করার মধ্যে তার স্বার্থ দেখতে পাচ্ছে। এ কারণে ইরানের সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছে বেইজিং। আবার তার বিপরীত শক্তি সৌদি আরব ও মিত্রদের সাথেও সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। বেইজিং তুরস্কের সাথেও সম্পর্ক ক্রমাগতভাবেই বাড়াচ্ছে। সেই সাথে ইসরাইল-বিরোধিতার ব্যাপারে ধীরে ধীরে সরব হচ্ছে।

ইসরাইল গাজায় আরেক দফা যুদ্ধে জড়ানোর ঘটনা ঘটলে এর সাথে হিজবুল্লাহর মাধ্যমে হোক অথবা সরাসরি জড়িয়ে যেতে পারে ইরান। আর ইরানের পেছনে সরাসরি চলে আসতে পারে চীনও। এমনকি কিছুটা দূরত্ব রেখে হলেও এখানে আমেরিকার কৌশলগত মিত্র হিসেবে ইসরাইলবিরোধী জোটের পেছনে সমর্থন দিতে পারে রাশিয়াও।

সার্বিকভাবে আরেকটি যুদ্ধের ব্যাপারে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ সুবিধা লাভের জন্য হয়তো জুয়া খেলায় নামতে চাইতে পারেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাফতালি। আর সে বিষয়ে ওয়াশিংটন সমর্থন দিলে আরেকটি ইসরাইল-গাজা পূর্ণ যুদ্ধ শুরু হতে পারে। আর পুনর্গঠন কাজ শুরু হওয়ার আগেই আরেক দফা ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসতে পারে সঙ্কীর্ণ এই উপত্যকায়। তবে যুদ্ধটি মধ্যপ্রাচ্যের দুর্দমনীয় ইমেজের এই দেশটির বড়ভাবেই পতন সময়ের সূচনা করতে পারে।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর পাথরঘাটায় বদর দিবস পালনে দেড় হাজার মানুষের ইফতারি আদমদীঘিতে ৭২ হাজার টাকার জাল নোটসহ যুবক গ্রেফতার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : মন্ত্রী গাজীপুরে গাঁজার বড় চালানসহ আটক ২

সকল