২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গরিবের বাজেট হবে কবে?

গরিবের বাজেট হবে কবে? - ফাইল ছবি

বাজেট মানে বছরের হিসাব-নিকাশ। ভালো সংসারীরাও বছরের শুরুতে আনুমানিক বাজেট করেন। গাঁওগেরামের হিসাব-নিকাশ শুরু হয় বাংলা বছর ঘিরে। শহুরে নাগরিকরা পাশ্চাত্যের অনুসরণে জানুয়ারি-ডিসেম্বরে হিসাব মেলাতে চান। আবার পুঁজিবাদী বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত বার্ষিক বাজেট যেহেতু জুলাই থেকে পরের বছরের জুন পর্যন্ত সেহেতু আমাদের সরকারও তাদের অনুসরণ করে। কেতাবি ভাষায়- বাজেট হচ্ছে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পদের কর্তৃত্বপূর্ণ বণ্টন। যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে রাষ্ট্রের সমুদয় সম্পদ থাকে তাদের করতলগত। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই সম্পদ বণ্টনে সরকার থাকে সদা সতর্ক। প্রতি পদে পদে তাদের জবাব দিতে হয়। তাদের অর্থ বরাদ্দ ও খরচের পদ্ধতিও তেমন। আর আমাদের দেশে সরকার দেশের সম্পদকে তাদের একান্ত সম্পত্তি মনে করে। তাই বরাদ্দ ও ব্যয় নিয়ে তাদের জবাবদিহিতা নেই। বরং কিভাবে ওই জবাবদিহিতা এড়িয়ে যেতে হয় তার বিধিব্যবস্থা সরকার প্রণীত আইন ও পদ্ধতিতেই বিধৃত থাকে। মনীষী মার্কস বলেছেন, প্রতিটি কার্যক্রমই অর্থনৈতিক। একে তারা বলেন, ‘অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ’। আর ওই নির্ধারক নির্ণিত হয় শ্রেণী চরিত্র দ্বারা। একটি ধনিক-বণিকের সরকার যদি ক্ষমতায় থাকে তা হলে তাদের স্বার্থেই ‘বড়লোকের বাজেট’ প্রণীত হয়। আর যদি গরিবের সরকার হয় তাহলে বাজেটও হবে গরিবের। গরিবের সরকার তখনই হবে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের ভোটের অধিকার থাকবে। আজকালকার বিশ্বে ভোটের মাধ্যমে নির্ণীত হয়- সরকারটি গরিবের হবে নাকি বড়লোকের। তবে যদি বড়লোকেরা দেখে ভোট হলে তাদের সর্বনাশ। তারা কখনোই ক্ষমতায় আসবে না, তখন তারা ভোট ভোট খেলা করে। বাইরের লোকেরা দেখে ভোট হচ্ছে। লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। কেন্দ্র আছে।

ব্যালটপেপার আছে। পোশাকি লোক আছে। আইনের মানুষ আছে। আসলে সোজা কথায় ভোট আছে-ভোটার নেই। সাধারণ মানুষের ভোট নেই। সব ভোট অসাধারণ মানুষের। তারা সব মানুষের ভোট দিচ্ছে। দিচ্ছে মানে ভোটের ষোলোআনা মালিক-মোক্তার তারাই। স্লোগানটা উল্টে গেছে- ‘আমার ভোট আমি দেবো, তোমার ভোট আমি দেবো, সবার ভোট আমি দেবো, একদলকে সব দেবো।’

বাংলাদেশের শাসকদল আওয়ামী লীগ পাকিস্তান আমলে পেটি বুর্জোয়া বা আধা পুঁজিপতি বলে কথিত হতো মার্কসবাদীদের দ্বারা। এখন আর তারা আধা-পুঁজির মালিক নয়, ষোলোআনা পুঁজির মালিক। যারা আওয়ামী লীগ করেন এখন আর তাদের নাম গরিবের খাতায় নেই। বরং ব্যাংকের হিসাব-নিকাশ নিলে তাদের বেশির ভাগই বড়লোক, কোটিপতি। এরা কিভাবে আধা পুঁজিপতি থেকে কোটিপতিতে পরিণত হলেন- সে ইতিহাস এক করুণ ইতিহাস! তাদের বালক শিক্ষার্থীরাও গাড়ি-বাড়ির মালিক। তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে কোটি কোটি টাকা পাচারের খবর আসে। বাংলাদেশের খাল-বিল, নদীতীর যেমন তারা দখল করেছে, তেমনি ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। সরকারের ত্রাণ অথবা প্রকল্প যে দুর্নীতির নামান্তর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদেরই একজন সংসদ সদস্য বলেছেন, ‘এসব দেখে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়’। যাই হোক, তারা যে ধনিক-বণিকের প্রতিনিধিত্ব করেন, বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী তা মোটেই লুকাতে চাননি। বাংলাদেশের বিগত দিনের লুটপাটে, চোটপাটে কত কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে, অথচ রাস্তার ছিন্নমূল মানুষের জন্য কোনো একটি মেগা প্রকল্প গৃহীত হয়নি। ভিখারির হাতে শ্রমের কুঠার কখনোই তুলে দেয়া হয়নি। কত টাকা লাগে এসব গরিবগারবা সাধারণ মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য! তাদের মুখে দু’মুঠো ভাত জোটানোর জন্য! অথচ এ দেশের একজন সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা খুবই সামান্য টাকা।

জাতি অর্থনৈতিকভাবে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ দুর্যোগের দুটো ধরন- একটি হলো করোনা মহামারী। আরেকটি হলো রাজনৈতিক মহামারী। এক-দেড় বছর ধরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেনি বাংলাদেশসহ অনেক দেশ। এ সময় গরিব মানুষের এই দেশে আরো গরিব হয়েছে। অর্থমন্ত্রী হিসাব দিয়েছেন, আমরা এখন ২০.৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করছি। অবশ্য বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন দারিদ্র্যসীমা ৩০ শতাংশ। এরপর করোনার কারণে নতুন করে গরিব হয়েছে আরো বিপুল মানুষ। প্রস্তাবিত বাজেটে বা ঘোষিত প্রণোদনায় এই বিপুল গরিব মানুষের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ২০২১-২২ অর্থবছরের নতুন বাজেটে খুশি হবেন ব্যবসায়ীরা। তাদের করপোরেট করহার কমানো হয়েছে। সুরক্ষা দেয়া হয়েছে স্থানীয় শিল্পকে; যা তারা ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ বলছেন। ব্যবসায়ীদের টার্নওভার করও কমেছে। বাজেটে নেই সাধারণ মানুষের জন্য কোনো ছাড়। তাদের প্রতি আরোপিত কর বা ভ্যাট আদৌ কমেনি। যেখানে নতুন গরিব মানুষের জন্য ব্যাপক প্রণোদনা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকা উচিত ছিল। সাধারণ মানুষের মাঝে অর্থ সরবরাহ যাতে সহজ হয়, এমন কোনো ব্যবস্থা এই বাজেটে রাখা হয়নি। অর্থমন্ত্রীর এই বাজেট সবচেয়ে বেশি আঘাত করবে মধ্যবিত্তদের। আর চিরকালই মধ্যবিত্তরা এ ধরনের বড়লোকবান্ধব সরকারের কাছে কোনো সহায়তা পায় না।

টিকার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সঙ্কট কিছুটা লাঘব হতে পারে। এ কারণে বাজেটে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়ার লক্ষ্যের কথা বলেছেন। কিন্তু তার দেয়া লক্ষ্য অনুযায়ী মাসে যদি ২৫ লাখ করে টিকা লাগে তাহলে প্রায় ১৮ কোটি মানুষকে টিকা দিতে কত বছর লাগবে তা হিসাব করা কঠিন। অর্থমন্ত্রী বাজেটের শিরোনাম দিয়েছেন ‘জীবন-জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। জীবন বাঁচাতে হবে, রক্ষা করতে হবে জীবিকাকেও- এতে কোনো সন্দেহ নেই। টিকা দেয়ার বাস্তব পরিকল্পনা যেমন বাজেটে নেই। নানা ধরনের কর ছাড় পেয়ে ব্যবসায়ীরা উদ্যোগ বাড়াবেন, বাড়বে তাদের বিনিয়োগ, উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে- বড়লোক আরো বড়লোক হবে। কিন্তু তাতে গরিষ্ঠ গরিব মানুষের কি কোনো উপকার হবে! নিঃসন্দেহে ছয় লাখ কোটি টাকার বাজেট বাংলাদেশের জন্য বিশালই বটে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ৭.২ শতাংশ জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। প্রাক-বাজেট আলোচনায় অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, এবার আর জিডিপি বা বাজেট ঘাটতির আলোচনার প্রয়োজন নেই। সরকারকে দুই হাতে টাকা খরচ করতে হবে। যেমনটি করে থাকি আমরা আমাদের পারিবারিক বিপদ-আপদে। বাজেটে যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের কাছে টাকা পয়সা যাওয়ার কোনো বিধিবিধান নেই। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য এবার কমানো হলো ২.৫ শতাংশ করপোরেট কর। এর আগের বছরও সমপরিমাণ ছাড় দেয়া হয়েছে। ফলে দুই বছরে ব্যবসায়ীদের করপোরেট হার কমেছে ৫ শতাংশ। উল্লেখ্য, এ ধরনের ধনিক-বণিক শ্রেণীর যারা কোটি কোটি টাকা লোন নিয়েছেন, তাদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণ মাফ ও নানা ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছে।

ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং ঋণখেলাপি সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়া হয়েছে। বড়লোক যাতে আরো বড়লোক হতে পারে এ জন্য নতুন নতুন কর সুবিধা দেয়া হয়েছে দেশে উৎপাদিত মোবাইল ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতকে। করোনা বাস্তবতায় তা যথার্থ। কিন্তু এর বিতরণ এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নীতিমালার অভাবে অপচয়, অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রকোপ আরো বাড়বে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো সরকারের দলীয়করণ প্রবণতা। বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি দলের লোকেরা স্বাস্থ্য খাতসহ সব ত্রাণ কার্যক্রমে যে দুর্নীতি করছে, টিআইবির সাম্প্রতিক রিপোর্টে তা ফুটে উঠেছে। এ বাজেটে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ১৫ শতাংশ কর প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, এটি শিক্ষা খাতকে আরো সঙ্কুচিত করবে। উল্লেখ্য, করোনাকালে ব্যবহারিক শিক্ষা ব্যাহত হওয়ায় শিক্ষা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি সরকারের যথাযথ প্রণোদনার অভাবও শিক্ষার সর্বনাশ ডেকে এনেছে।

বর্তমান বাজেটের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো- স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন। এটি দেশের ৫০তম বাজেট। বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা এসব সংস্কারের কথা দীর্ঘকাল ধরে বলে আসছেন। বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থা আরোহ পদ্ধতির; অর্থাৎ উপর থেকে নিচে চাপানো। অথচ ব্যবস্থাটি হওয়া উচিত অবরোহ প্রকৃতির; অর্থাৎ নিচ থেকে উপরে যাওয়া। কয়েক বছর আগে জেলাভিত্তিক বাজেট প্রস্তাবনার কথা শোনা গিয়েছিল। সেটি হলে আঞ্চলিক পর্যায়ের ন্যায্যতা নিশ্চিত হতে পারে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পেশা, প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সরকারভিত্তিক বাজেট সার্বিকভাবে জনস্বার্থের পরিপূরক হতে পারে।

ব্যবসায়ীরা এই বাজেটে খুশি হলেও তারা আবার নানা ধরনের করারোপের বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, সরকার এক দিকে দিচ্ছে আবার নানা কৌশলে তা নিয়ে নিচ্ছে। তারা অভিযোগ করছেন, দেশের কর ব্যবস্থা ব্যবসাবৈরী। ব্যাংক খাতের অব্যবস্থা ও অপব্যবস্থার কথা সবাই বলছেন। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়াস অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত গবেষণা সংস্থা সিপিডি বাজেটকে অনুমানভিত্তিক বলেছে। তারা আরো বলছে, প্রবৃদ্ধি অর্জনের কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা রয়েছে। অবিশ্বাস্য কর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজেটটি সম্প্রসারণমূলক না হয়ে সঙ্কোচনমূলক হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো অগ্রাধিকার খাত নেই। পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য তেমন কিছু নেই। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন স্মল অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশ-নাসিব সভাপতি অভিযোগ করেছেন, বড়দের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ মুহূর্তেই বিতরণ হয়ে যায়, হয় না শুধু ছোট ও মাঝারি ধরনের শিল্পে। এ ব্যাপারে সমীক্ষা হওয়া দরকার। দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান এ বাজেটকে ‘বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর সাথে আপস করার দলিল’ বলে অভিহিত করেছেন। আর একটি মূল্যায়নে বলা হয়েছে, এ বাজেটকে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে রাজনীতিই নিরঙ্কুশ। জনগণের বা রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি এ বাজেটের উদ্দেশ্য নয়।

বাজেটে যেভাবে বাস্তবে এবং নীতিগতভাবে ব্যবসায়ী তথা ধনিক-বণিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে, তা থেকে যথার্থই উপসংহার টানা যায় যে, আসলেই গত ১২ বছরে রাজনীতির ‘বাণিজ্যিকীকরণ’ ঘটেছে। বর্ষীয়ান জননেতা তোফায়েল আহমেদ একবার বলেছিলেন, ‘রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই’। এর সাথে সাম্প্রতিককালে যুক্ত হয়েছে আরেকটি নেতিবাচক অভিধা ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন’। বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্বৃত্তায়নকে চলমান দুর্নীতি যে নতুন মাত্রা দেবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে রাজনীতির খোলনলচে পাল্টে ফেলা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement