২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাজেট-উত্তর বাংলাদেশ কোন পথে

বাজেট-উত্তর বাংলাদেশ কোন পথে - ছবি : নয়া দিগন্ত

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা একপ্রকার থিতিয়ে এসেছে। ৩০ জুন যথারীতি ছোটখাটো কিছু সংশোধনীসহ বাজেট অনুমোদন হয়ে যাবে। প্রতিবারের বাজেট পরিসংখ্যানে ও এর আড়ালে সুপ্ত কিছু বার্তা নিয়ে আসে। বাজেটে কিছু লোকের সুবিধা বৃদ্ধি পায়। একটি শ্রেণী রাষ্ট্রের সম্পদ আহরণের শিকার হয়ে রুগ্ণ হয়ে পড়ে। বাজেটের আগে দেশী-বিদেশী গ্রুপগুলোর মধ্যে যাদের লবি শক্তিমান থাকে তারা নিজেদের পক্ষে রাষ্ট্রের রাজস্ব নীতিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। এবারের বাজেটের পটভূমি বেশ খানিকটা ভিন্ন হলেও ব্যতিক্রম হয়তো খুব বেশি নেই।

কী ছিল চ্যালেঞ্জ, কী করা হয়েছে?
কোভিড-১৯ জীবন জীবিকার ওপর বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টির অবস্থায় এবারের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। মোটা দাগে মহামারীর মুখে জীবনের বিপন্নতা রোধ এবং বেকার ও আধা বেকার হয়ে পড়াদের জন্য কর্মসংস্থান ছিল এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ এখন বাংলাদেশে চলছে, এর মধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে যাওয়ার খবর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছে। এটি প্রতিরোধের জন্য লকডাউন বাস্তবায়ন অনেকটাই সরকারের প্রশাসনিক বিষয়। কিন্তু বাজেটের সাথে সংশ্লিষ্ট হলো টিকাপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে চিকিৎসা সুবিধা সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ।

কোভিড ১৯-এর কারণে স্বাস্থ্য খাত এবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা থাকলেও এখাতে সম্পদ বরাদ্দের অনুপাত বাড়েনি। স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু সরকারি ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে সবচেয়ে কম, মাত্র ৮৮ ডলার। পাকিস্তানে এটি ১২৯, ভারতে ২৬৯, শ্রীলঙ্কায় ৩৬৯ এবং মালদ্বীপে দুই হাজার মার্কিন ডলার। টাকার অঙ্কে বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও বাজেটের অংশ এবং জিডিপির অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে গতবারের চেয়ে এবার বরাদ্দ কমেছে। গত বাজেটে জিডিপির অংশ হিসেবে বরাদ্দ ছিল ১ দশমিক ০২ শতাংশ। এবার তা কমে জিডিপির দশমিক ৯৫ শতাংশ হয়েছে।

যে সম্পদ বরাদ্দ বাজেটে রয়েছে তা দিয়ে টিকা সংগ্রহে হয়তো সঙ্কট সৃষ্টি হবে না যদিও স্বাস্থ্যের অন্য উপখাত থেকে সম্পদ এখানে স্থানান্তরিত করতে হবে। কিন্তু টিকা পেতে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের কর্মকৌশল। এর সাথে ভূ-রাজনৈতিক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা যুক্ত হয়ে পড়েছে। এক সময় চীনারা বাংলাদেশকে টিকা সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছিল। বাংলাদেশ তখন চীনা টিকার ওপর ভরসা না করে ভারতের সিরামের তৈরি অ্যাস্ট্রোজেনেকার টিকার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করেছে। অগ্রিম অর্থ দেয়া টিকা ভারত থেকে সরবরাহ না পেয়ে অবশেষে আবার টিকার জন্য চীন রাশিয়ার কাছে ধরনা দিয়েছে। আমেরিকার কাছেও টিকা চেয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের যে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পড়ে গেছে তাতে টিকাপ্রাপ্তি সময়মতো ঘটবে এমন নিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে না। করোনা আক্রান্ত বিভিন্ন দেশ এর মধ্যে ৬০-৭০ শতাংশ জনগণকে টিকার আওতায় নিয়ে এসেছে। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও করোনা সংক্রমণের উচ্চ হার নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে টিকাপ্রাপ্তি এখনো ২ শতাংশের কোটায়। যেভাবে টিকা দানের পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে প্রয়োজনীয় কাভারেজের জন্য চার বছর সময়ের প্রয়োজন হবে। উচ্চ সংক্রমণের অনাকাক্সিক্ষত কোনো কিছু ঘটলে তা ঠেকানো কঠিন হতে পারে।

জীবিকার বিষয়ে বাজেটের শিরোনামে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হলেও বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ সেভাবে দৃশ্যমান নয়। সামাজিক নিরাপত্তা জালে কিছু বরাদ্দ টাকার অঙ্কে বাড়ানো হয়েছে। এর বিতরণ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় এর সুবিধা একটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ছে। এর পরও মূল চ্যালেঞ্জ হলো কাজের ব্যবস্থা করা। দুই তরঙ্গের করোনায় ঘরবন্দী হয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ কর্মক্ষেত্র থেকে ছিটকে পড়েছে। তাদের নতুন করে পুঁজির সরবরাহের ব্যাপারে ব্যাংক বা এনজিও খাতের মাধ্যমে কোনো উদ্যোগ নেয়ার বিষয় বাজেটে নেই। ফলে যে দুই কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্য রেখার নিচে নেমে যাওয়ার কথা বিভিন্ন জরিপে উঠে আসছে, তাদের উত্তরণ অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গেছে।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার দাঁড়াবে ২৩ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা দাঁড়াবে ১৭ শতাংশ। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, ওই সময় দারিদ্র্য ১২ দশমিক ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে। অথচ সব জরিপেই দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার ন্যূনতম ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে। উন্নয়ন অন্বেষণের হিসাব অনুসারে, লকডাউন পরিস্থিতি বাড়তে থাকলে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়ে ৪৭ শতাংশে দাঁড়াবে।
সব সমীক্ষায় করোনায় নতুন করে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও অর্থমন্ত্রী দারিদ্র্যের এই চিত্রটাই অস্বীকার করছেন। পরিস্থিতির বাস্তবতা স্বীকার করা হলে এ ব্যাপারে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা আশা করা যায়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অস্বীকার করা হলে তা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপ কিভাবে আশা করা যেতে পারে?

বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা
খ্যাতিমান সাহিত্যিক সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদের একটি বহুল আলোচিত লেখার শিরোনাম ছিল ‘বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা স্বাধীনতা।’ এই বাক্যটা বাংলাদেশ সরকারের বাজেট আয় ব্যয়ের চিত্রের সাথে বিশেষভাবে মিলে যায়। সরকার বরাবরের মতো এবারো বাজেটের ব্যয়ের অঙ্ক আগে নির্ধারণ করেছেন। টাকার চলতি অঙ্কে বাজেট ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৬.২৮ শতাংশ। সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন উভয় খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। সরকারের সামরিক বেসামরিক প্রশাসন যন্ত্রকে তুষ্ট করার জন্য ২০১৮ সালের বিশেষ নির্বাচনের আগ থেকে সুযোগ-সুবিধা অনেক বাড়ানো হয়েছে। সেই সুবিধা কাটছাঁট করার সাধ্য সরকারের নেই। এর ওপর ধার করে বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নের অঙ্ক বেড়ে যাওয়ায় দেশী-বিদেশী দায়ের সুদের অঙ্ক আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে। ফলে সরকারের পরিচালন বাজেটের অঙ্কের রাশ টেনে ধরতে চাইলেও সরকার পারবে না।

অন্য দিকে মেগা প্রকল্পের ছড়াছড়িতে উন্নয়ন বাজেটের ব্যয় কমানোর সুযোগও কমে এসেছে। এসব মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমানোর অর্থ হলো সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়া যা এর মধ্যে হতে শুরু করেছে। আর প্রকল্প শেষ হতে বিলম্ব মানে এর খরচ বেড়ে যাওয়া এবং প্রাপ্ত সুবিধা সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়া। ফলে মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমানোর অবকাশ কম রয়েছে। এর মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য আনার জন্য চলমান প্রকল্পের নতুন পর্যায় সম্প্রসারণ না করার কথা বলা হয়েছিল। সেটিও কঠিন এই কারণে যে সরকারের নেয়া এসব বৃহৎ প্রকল্পের অনেকগুলোর সাথে সরকারের ক্ষমতায় থাকা না থাকার দরকষাকষির যোগসূত্র রয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিনের বড় সময়ে কোনো কাজে আসে না। বিদ্যুৎ না নিয়েও ন্যূনতম বিদ্যুতের দাম পরিশোধের বাধ্যবাধকতার চুক্তি থাকায় বেসরকারি খাতের ৪৮ শতাংশ বিদ্যুতের দাম রাষ্ট্র ব্যবহার না করেই পরিশোধ করছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নতুন বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে সেই বিদ্যুৎ কতটা কাজে লাগানোর অবকাশ থাকবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদগণ। অথচ বাজেটে এই প্রকল্পের বিপুল বিনিয়োগের দায় যুক্ত হবে।

বাজেটে প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্থের ব্যবহার কেমন হয় তার চিত্র এখন নিয়মিতভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। ১০ টাকা দামের উপকরণ কেনা হয় হাজার টাকায়। লাখ টাকার উপকরণের দাম পড়ে কোটি টাকা। বাংলাদেশ একটি ব্রিজ বানাতে যে অর্থ খরচ করে সেই টাকা দিয়ে প্রতিবেশী দেশ পাঁচটি ব্রিজ বানাতে পারে। সাধারণভাবে একটি অনুমান করা হয় যে, বাজেটের ১০০ টাকা উন্নয়ন ব্যয়ে প্রকৃত সুবিধা পাওয়া যায় ২০ টাকার।

প্রশ্ন হলো এই যে বেহিসেবি ব্যয় সে অর্থ আসে কোত্থেকে। এক কথায় জবাব হলো জনগণের পকেট থেকে। সরকারের আয়ের ৮০ শতাংশ আদায় করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর। এই সংস্থা যে রাজস্ব আদায় করে তার ৭০ ভাগই হলো পরোক্ষ কর মানে আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর ইত্যাদি। এসব কর/শুল্কের অর্থ পণ্যের খরচের সাথে যুক্ত করে ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। যে ভিক্ষুক বা বস্তিবাসী একটি কাপড় কাচার সাবান কিনছেন তিনিও সাবানের দামের মধ্যেই সরকারকে কর দিচ্ছেন। অন্য দিকে অগ্রিম আয়কর গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করের একটি অংশকেও পরোক্ষ কর বানিয়ে ফেলে ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। আর কর বহির্ভূত যে রাজস্ব তথা আরোপিত বিভিন্ন ফি, জুডিশিয়াল স্টাম্প ইত্যাদি খাত থেকে নিচ্ছে সেটিও সরকার সব শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকেই নিচ্ছে। ফলে বলা যায়, সরকার প্রশাসন চালানোর খরচ আর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে রাজস্ব নিচ্ছে তার ৮০ শতাংশই সাধারণ মানুষকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। আর জনগণ এই টাকা সরকারকে দিচ্ছে তাদের অতি কষ্টার্জিত আয় থেকে। ফলে যেটা দাঁড়াচ্ছে তা হলো, জনগণের অতি কষ্টে উপার্জিত টাকা সরকার অনেক ক্ষেত্রে অন্যের পকেট ভরতে ব্যয় করছে। আর এই ব্যয়ের জন্য যাতে জবাবদিহি না করতে হয় তার জন্য সরকারের কেনাকাটিতে পাইকারিভাবে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে।

বিপদের ঘনঘটা?
রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যারা থাকেন তারা জনগণের কল্যাণ চান না এমনটি যারা ভাবেন তারা হয়তো সঠিক চিন্তা করেন না। কিন্তু জনকল্যাণের ওপরে অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের পকেট ভরার স্বার্থ অগ্রাধিকার পাওয়ায় সেই চেষ্টা তেমন ফল দেয় না। রাষ্ট্র যদি তার সম্পদ জনগণের তুষ্টির জন্য খরচ বা বিতরণ করতে থাকে তবে সেই দেশের দেউলিয়া হয়ে যেতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। এ জন্য বিনিয়োগ বা উন্নয়ন খাতে সম্পদ ব্যয় করতে হয় যাতে মানুষ নিজে উপার্জন করে চলতে পারে এবং জাতীয়ভাবে সম্পদ সৃষ্টি হয়। এ জন্য জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ বা প্রবৃদ্ধি অর্জনের ওপর এতটা গুরুত্ব দেয়া হয়।
রাষ্ট্রের সম্পদ তৈরির পরিবেশ সৃষ্টিতে দু’টি খাত মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এর একটি হলো ব্যাংক বা আর্থিক খাত আর অপরটি হলো শেয়ারবাজার। বাংলাদেশের শিল্পায়ন বা অর্থনৈতিক উন্নয়নে শেয়ারবাজার কতটুকু কী ভূমিকা পালন করতে পারছে সেটি মনে হয় এখন আর বিতর্কের বিষয় নেই। কয়েক দফা বিপর্যয় ঘটার মধ্য দিয়ে শেয়ারবাজার মূলত মাফিয়া ধনপতিদের টাকা বানানোর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। মূলত রাষ্ট্রের তহবিল ও নীতি সহায়তা এবং আর্থিক খাতের সমর্থন দিয়ে শেয়ারবাজারকে জীবিত রাখা হয়েছে।

এখন শিল্পায়ন বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের শেষ ক্ষেত্র রয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক খাত। ’৮০ দশকের শেষ ও ’৯০-এর দশকে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই ক্ষেত্রটিকে শক্তিমান করা হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে অল্প পুঁজি বিনিয়োগে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক বা মালিক বনে যাওয়াদের হাত থেকে ব্যাংকে রাখা জনগণের আমানতকে হেফাজতের একটি ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই ব্যবস্থা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভেঙে পড়েছে। আর এ ক্ষেত্রে দায় এড়ানোর অবকাশ নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দু’টি প্রধান কাজ হলো মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও তফসিলি ব্যাংকগুলোর তদারকি করা। মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজটি মূলত সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়। মুদ্রা সরবরাহ ও ঋণের বিস্তার বা সঙ্কোচনের নীতিগত পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় নেয়। মুদ্রানীতি গ্রহণের ইস্যুতে অর্থনীতিবিদরা ছোটখাটো পরামর্শ দিয়ে থাকলেও তা নিয়ে বড় একটা আলোচনা হয় না। কিন্তু ব্যাংক তদারকির দ্বিতীয় আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটির ব্যাপারে এখন নানাভাবে সমালোচনার সৃষ্টি হচ্ছে। আগে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যে অর্জন বাংলাদেশ ব্যাংক করেছিল তার অনেক কিছুই এখন হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দৈনন্দিন ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল, ব্যাংকের ঋণ অনুমোদনে পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকা নীতিগত ও সামষ্টিক ক্ষেত্রে সীমিত করা হয়েছিল। ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যাতে একক কোনো গোষ্ঠীর হাতে সীমিত না হয়ে যায় তার জন্য পরিচালক ও চেয়ারম্যান পদে থাকার সময় সীমিত করা হয়েছিল এবং ব্যাংক শেয়ার একক গ্রুপের হাতে কেন্দ্রীভূতকরণ ঠেকানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। সংস্কার কার্যক্রমের আরেকটি লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা ও এখতিয়ার বৃদ্ধি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর কোনোটিই এখন কার্যকর নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের আগে উল্লিখিত সংস্কারগুলো শিথিল করার জন্য এখন নানা সার্কুলার ইস্যু করতে দেখা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলগুলো অতীতে বিভিন্ন খাতে কেলেঙ্কারি উদঘাটন করে ব্যাংক খাতকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছে। এখন অজ্ঞাত কারণে সেই ভূমিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর দেখা যাচ্ছে না। যেকোনো ব্যাংক বা শাখায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা প্রয়োজন মনে করলেই পরিদর্শন বা অডিটে যেতে পারেন বলে মনে হয় না। ব্যাংকগুলোতে গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় প্রবল হয়ে উঠেছে বলে গণমাধ্যমের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকের বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে যখন তখন ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন কমানো, পদাবনতি, কর্মচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের পরিচালনা পর্ষদের চাপে পড়ে ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু করা বা এগিয়ে নিতে কর্মকর্তাদের বাধ্য করা হয় অথচ পরিচালকরা দালিলিকভাবে এর সাথে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা রাখেন না। ঋণখেলাপি হলে বা জালিয়াতির ঘটনা উদঘটিত হলে জেল জরিমানা ও মামলার শিকার হন ব্যাংকাররা। এই পরিবেশ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য কোনোভাবেই সুখবর নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখন ব্যাংক তদারকির ক্ষেত্রে সবচেয়ে অসহায় এক অবস্থানে দেখা যাচ্ছে।

বাজেটের আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সে লক্ষ্য অর্জনে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিরাট অবদান রয়েছে। ব্যাংক খাত করোনার কারণে এর মধ্যে বড় ধরনের চাপের মুখে রয়েছে। খেলাপি ঋণ হিসাব করার বিষয়টি স্থগিত থাকায় ঋণ বা বিনিয়োগ আদায়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। ব্যাংক নতুন করে বিনিয়োগের তহবিল যেমন পাচ্ছে না তেমনিভাবে সার্বিক চাহিদা হ্রাস ও অন্যবিধ পরিবেশের কারণে ভালো বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক ঋণ নিতে সেভাবে সাহস করছেন না। প্রভাবশালীরা দেশী ব্যাংক ছেড়ে বিদেশী ব্যাংক ও উৎস থেকে ঋণ গ্রহণে উৎসাহিত হচ্ছেন।

এই অবস্থা সার্বিক শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও আর্থিক গতিশীলতার জন্য মোটেই ইতিবাচক পরিবেশ নয়। এই পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে ২০১৯-২০, ২০২০-২১ অর্থবছরের মতো নতুন অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ে বিরাট ঘাটতি তৈরি হবে। আয় কমলে বাজেট বাস্তবায়নকে সঙ্কুচিত করতে হবে। তা না হলে ঋণের দায় আরো স্ফীত হবে। এটি অর্থনীতির জন্য মোটেই সুখকর হবে না।

এর মধ্যে বাংলাদেশের রফতানি আয় কমতে শুরু করেছে। রেমিট্যান্স যে উচ্চ হারে বাড়ছে সেটি কতটা পাচার করা অর্থ ফিরে আসা আর কতটা সত্যিকার প্রবাসী আয় তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে। ফলে বৈশ্বিকভাবেও একটি বৈরী পরিস্থিতি নতুন অর্থবছরে হাজির হতে পারে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ কমে গেলে নতুন করে বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনাও অবশ্য রয়েছে। তবে আশা-নিরাশার এই দোলাচলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা বাজেটের গতিশীল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন বিশেষভাবে। সেটি কতটা হচ্ছে সেটিই বড় উদ্বেগের বিষয়।

mrkmmb@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement
আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত

সকল