১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মোদির ব্যবস্থাপনায় ফেল ‘কারচুপি’ কতদূরে?

মোদির ব্যবস্থাপনায় ফেল ‘কারচুপি’ কতদূরে? - ফাইল ছবি

এই করোনাকালেও গত মাসজুড়ে ভারতের পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এর আবার দু’টি হলো আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ, যারা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব আর পশ্চিম সীমানাজুড়ে। এর মানে হলো গত মাসে আমাদের হিন্দুত্বের প্রবল প্রপাগান্ডার ভেতরে বসবাস করতে হয়েছিল। নির্বাচন শেষ হলেও ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে, পাঁচ রাজ্যের একই সাথে ২ মে সকাল থেকে।

এরই মধ্যে বিজেপিসহ ভারতের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরাও মনে মনে মেনে নিয়েছেন মোদি সরকার ফেল করেছে। অক্সিজেন সঙ্কট আর সৎকারের জায়গার ব্যাপক অভাব সরকারের পরাজয়ের সীমা কত গভীরে এটি প্রতি মুহূর্তে দেখার পরে আর কিছু অস্বীকার করার অবস্থা নেই। অর্থাৎ হিন্দুত্ব নয়, ব্যবস্থাপনা শিখেন ও বোঝেন ভালো করে আগে নইলে শুধু সরকার ফেল করবেন হিন্দুত্বও ফেল মারবে।

‘করোনা আবহে বদল ১৬ বছরের নীতি, চীনা সাহায্যেও এখন আপত্তি নেই দিল্লির’- এ ছিল গতকালের আনন্দবাজারের শিরোনাম। এ রিপোর্টের অর্থ হলো, ভারত গত ১৬ বছর ধরে মেনে চলার একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাও আনন্দবাজারের ভাষায় হলো, ভারত ‘দরিদ্র দেশের তকমা কাটিয়ে উঠতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে ত্রাণ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।’ অর্থাৎ এখানে ধরে নেয়া হয়েছে যে, প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় পরিস্থিতি সামলাতে কোনো দেশ যদি বিদেশের সাহায্য নিয়ে থাকে তা হলে সেটি গরিব দেশের লক্ষণ ও তকমা-লেবেল পাওয়া হবে। তবে এ দাবি ও অনুমান ভিত্তিহীন। তবু আনন্দবাজার জানায়, কিন্তু এখন করোনা বিপর্যয়ের সময়ে, তা সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ভারত ২০টি দেশ থেকে সাহায্য নিচ্ছে, যার মধ্যে চীনও আছে।

প্রথম কথা হলো, ভারতের যে করোনা বিপর্যয় দেখা দিয়েছে এটি কি ভারত গরিব দেশ বলে? নাকি ভারত রাষ্ট্র বা সরকারের আর্থিক পরিস্থিতি যাই থাক, মূলত মোদি সরকারের নিজেকে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে, এটিই কারণ ও বাস্তবতা? যে জিনিসটার এখানে অভাব সেটি ঠিক সরকারের হাতে মজুদ সম্পদ বা অর্থ নয়। বরং ব্যবস্থাপনা বা ম্যানেজমেন্ট- এটি পরিচালনা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকার পরিচালনায় কখন কোন সময়ের মধ্যে কোন জিনিসটি জোগাড় করতেই হবে এবং তা জোগাড়ে এখানে সরকারের হাতে অর্থ থাকা না থাকাটা কোনো বিষয় ছিল না- বরং সরকার তা জোগাড়ে ব্যবস্থা করতে ‘ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতা’ থেকে ভারতে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্র বা সরকারের ক্ষেত্রে, ব্যর্থতা মানেই প্রধানত তা রাষ্ট্র এরূপ বিশাল প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার ব্যর্থতাই হতে দেখা যায়। ‘ম্যানেজমেন্ট’ ব্যর্থতাই হয় সেটি। কারণ এমনকি কখনো তা অর্থের সঙ্কট-জাত ব্যর্থতাও যদি হয়ও সে ক্ষেত্রে সেটা, আসলে অর্থ জোগাড়ের ব্যর্থতা যেমন- ঋণ জোগাড়ের ব্যর্থতা।

তবে এর ভেতরে আরেকটা বড় সমস্যা আছে, তা হলো মুখে বলছে ‘রাষ্ট্র’; কিন্তু রাষ্ট্রকে ব্যক্তির সাথে গুলিয়ে ফেলছে। রাষ্ট্রের জন্য ঋণ জোগাড় আর ব্যক্তিজীবনের ঋণ জোগাড় করা এক জিনিস না। আমেরিকা রাষ্ট্র প্রায় ২০ বছর ধরে ঋণ করেই চলতে পারছে তবুও সে গ্লোবাল নেতা আমেরিকাই হয়ে থেকে যাচ্ছে। ব্যক্তি মানুষ নিজের সংসার চালাতে না পারলে তাকে ‘গরিব’ বলা যায়। রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার ব্যর্থতা- এ কথা বলতে সবই মূলত ম্যানেজমেন্ট ফেল করার ঘটনাই বুঝবে।

মোদি সরকারের ম্যানেজমেন্ট ফেল করাকে ভারতের পেটি-মধ্যবিত্ত মানুষ নিজ সংসারের টানাটানির সাথে গুলিয়ে ফেলেছে। আনন্দবাজারসহ ভারতের রাজনীতিতে তাদের রায় হলো এটি নাকি ‘গরিব দেশের লক্ষণ’। এভাবেই তারা বুঝে থাকেই। আর পেটি-মধ্যবিত্তের এই বুঝ ও চিন্তাধারাটা এতই আধিপত্যশীলভাবে প্রবল যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা রাজনীতিকরাও এতে প্রভাবিত হয়ে মনে করেন, প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় সামলাতে কোনো দেশ যদি বিদেশের ত্রাণ বা সাহায্য নিয়ে থাকে তা হলে সেটি গরিব দেশের লক্ষণ।

এ কথাটাই মেনে নিয়ে ১৬ বছর আগে (কংগ্রেস ও বিজেপি দুই দলই) একটা সরকার পরিচালনা রুল বানিয়েছিল যে, বিদেশী সাহায্য নেয়া যাবে না। কারণ নিলে ভারত গরিব দেশ বোঝাবে। কিন্তু মোদি সরকার এবার মূলত ফেল করে যা মূলত ম্যানেজমেন্ট ফেল করা। এভাবে সব হারিয়ে ওই সব রুল উঠিয়ে দিয়ে চীনসহ ২০ দেশের সাহায্য নিয়েছে। আর তা নিয়ে আনন্দবাজারও খোঁচা দিয়ে ওই রিপোর্ট লিখেছে। এটা এভাবে লেখা হয়েছে। কারণ এ লেখার পাঠক বা খাতকও মূলত ভারতের ওই পেটি-মধ্যবিত্ত; যাদের মধ্যে কলকাতার পেটি-মধ্যবিত্তদের এমন মূল্যবোধ বয়ে বেড়ানোর দিক থেকে সেরা মনে করা হয়।

তা হলে এখানে চিন্তার ত্রুটিটা হলো, ব্যক্তি আর রাষ্ট্রকে এক মনে করে গুলিয়ে ফেলা। তা করা যাবে না। ভারত ‘গরিব রাষ্ট্র’ বলেই সেখানে এত ব্যাপক কোভিড মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, ব্যাপারটা একবিন্দুও এমন নয়। তাই এখন বিদেশের সাহায্য নিলেই ভারত গরিব রাষ্ট্র বলে প্রমাণিত হবে এটি ভিত্তিহীন কথা। রাষ্ট্রকে পরিচালনায় ব্যর্থতা এক মারাত্মক ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতা- তার সাথে ভারত গরিব না বড়লোক রাষ্ট্র- এর কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তিনি ক্যাডার কূটনীতিক ছিলেন; সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পরে তাকে মোদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেছেন। তারই এক সাবেক কলিগ অশোক আমরোহি। তিনি কূটনীতিক হিসেবে এশিয়া ও আফ্রিকায় তিন চার দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি গত সপ্তাহে বিনা চিকিৎসায় এক হাসপাতালের পার্কিংলটে নিজ গাড়িতে বসে পাঁচ ঘণ্টা ধরে বেড ও চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করতে করতে মারা যান। তিনি হাসপাতালের বেড বা অক্সিজেন জোগাড় করতে কোনো সহায়তা পাননি। এ নিয়ে জয়শঙ্কর টুইটে এক শোকবার্তা দিয়েছেন। আমরোহির মৃত্যু তার বা ভারতের গরিবি হালের কারণে ঘটেনি। এটি ম্যানেজমেন্ট ব্যর্থতাই।

কথিত ‘আত্মনির্ভরশীলতা’
তবু ভারতের নেতা-পাবলিক সবার মনেই এক অদ্ভুত ভয় যে, বিদেশী সাহায্য নিলে ভারত গরিব দেশের তকমা পেয়ে যাবে। প্রায় ১৯০৫ সাল থেকে এমনই একটা মুখরোচক শব্দ চালু হয়ে আছে ভারতে- ‘স্বদেশিয়ানা’, কথিত এক স্বদেশিপনা। আর একালে মোদির হাতে পড়ে সেটিরই আরো উগ্র হিন্দু জাতিবাদী চমকদার হিন্দুত্বের স্লোগান হলো ‘আত্মনির্ভরশীলতা’। এটিই বিপজ্জনক হিন্দুত্ব-জাতি চিন্তার তথাকথিত ‘আত্মনির্ভর’ চিন্তা। এখান থেকেই হিন্দু-জাতিরাষ্ট্র, হিন্দু জাতশ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি ধারণার শুরু। অল্পকথায় বললে, একটা দেশের পাবলিকরা যে যা কিছু পণ্য সারাদিন ভোগ-ব্যবহার করে তার প্রতিটিই একমাত্র নিজ দেশের উৎপাদিত পণ্য হতেই হবে- এটিই আদর্শ ‘আত্মনির্ভরশীলতা’ আর এটিই সবচেয়ে ভিত্তিহীন বুঝ। ব্রিটিশ আমলে কলোনি দখল হয়ে থাকা দেশ হিসেবে সেকালে এর কিছু বাস্তবতা থাকলেও (যখন গ্লোবাল বাণিজ্য কী বোঝা যায়নি, বিকশিত হতে পারেনি কলোনি-দখল শাসন সম্পর্কের কারণে) একালে এসব বক্তব্য অর্থহীন। কারণ এটি গ্লোবাল বাণিজ্য বিনিময়ের যুগ। এ জিনিসটা এবং পণ্য উৎপাদন দক্ষতা জিনিসটাকে না বুঝলে এমনই হবে। গ্লোবাল পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা দুনিয়ার কোণে কোণে যত বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়বে তাতেই তা ‘শ্রমমুক্তির’ সম্ভাবনা তৈরি করবে; অন্যের শ্রমের ওপর ভাগ বসানোর কোনো ব্যবস্থার টিকে থাকা সম্ভাবনা তত কমবে।

অথচ মিথ্যা আত্মনির্ভরশীলতার বাকচাতুরি সেই থেকে চলছে। যেমন লক্ষ করা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল সক্ষমতা এখন যা করে আমাদের চলছে তা হলো- মূলত গার্মেন্ট আর বিদেশে সরাসরি (অদক্ষ, আধাদক্ষ) শ্রমবিক্রি। আর এ দিয়েই আমরা এগিয়েছি। তাতে মধ্যম আয়ের দেশের গল্প সাজিয়ে ফেলছি, নিশীথ ভোটের রাজনীতির দুরবস্থা এর পেছনে লুকাতেও দেখছি। অন্তত অর্থনীতিকভাবে আমরা কী করে টিকে আছি, যাচ্ছি সেটি আমাদের সবার বুঝে রাখা জরুরি। এর মানে হলো গ্লোবাল বাণিজ্য-বিনিময় ব্যবস্থার সুবিধায় মানে, এ ব্যবস্থাটা যেখানে যেখানে আমাদের জন্য নতুন নতুন সক্ষমতার সুযোগ সুবিধা নিয়ে হাজির হতে আমরা দেখছি, সেসবের খোঁজে থেকে নিজ দক্ষতা সেভাবে সাজিয়ে নিয়ে আমরা নিজেদের কম্পিটিটিভ বা প্রতিযোগী করে করে গড়ে তুলছি। আর তা পেরেছি বলেই আমরা গ্লোবাল অর্থনীতিতে টিকে যাচ্ছি। তা হলে এই বাস্তবতায় আমাদের জন্য ব্যাপক লেনদেন ও আমদানি-রফতানির এক গ্লোবাল সিস্টেম- বিকশিত হচ্ছে বলেই আমরা টিকে যাচ্ছি, আমরাও বিকশিত হচ্ছি।

তা হলে এখন পাঠকেরা বিবেচনা করে দেখতে পারেন যে, এমন ব্যাপক লেনদেন আমদানি-রফতানির এক গ্লোবাল সিস্টেম আমাদের জন্য ভালো, নাকি এর উল্টো কথিত আত্মনির্ভরশীলতা আমাদের জন্য ভালো? মানে আমার দেশের লোক যাই ভোগ-ব্যবহার করবে তার সবই আমাদের দেশেই তৈরি করতে হবে এমন কথিত আত্মনির্ভরশীলতা- এ ভাবনা কি ভালো ছিল? অবশ্যই না। এক কথায় বললে বরং আমরা মিথ্যা আত্মনির্ভরশীলতার পেছনে ছুটিনি বলেই ‘মধ্যম আয়ে’ পৌঁছেছি। আর মনে রাখতে হবে মিথ্যা আত্মনির্ভরশীলতা মানে শ্রম-অদক্ষতা, মফস্বলের শ্রমিক হয়ে লুকিয়ে থাকার জীবন। অদক্ষতা মানে বেশি শ্রমঘণ্টা লাগিয়ে পণ্যোৎপাদন। মানে, নিজ শ্রম ঢেলে যা আয় করব এর অনেকটাই পানিতে পড়ে অপচয় হয়ে যাবে; অথচ যা কারো ভোগে লাগবে না।

হিন্দুত্বের অর্থনৈতিক ভিত্তি
এ ছাড়া রাজনৈতিকভাবে এই মিথ্যা আত্মনির্ভরশীলতাই হিন্দুত্ব- এ নোংরা জাতশ্রেষ্ঠত্বের রাজনীতির অর্থনৈতিক ভিত্তি। তবে অবশ্যই এটি মিথ্যা। যেমন- লাদাখে চীন-ভারত সীমান্তের সঙ্ঘাতে প্রায় দুই বছরের কালে মোদি চীনা পণ্য বয়কটের মিথ্যা আত্মনির্ভরশীলতার স্লোগান ও নীতি ঘোষণা করেছিলেন। বাস্তবত এতে এ সময়ে উল্টো চীনা পণ্য আমদানি-নির্ভরশীলতা বেড়েছে; যার মূল কারণ ভারতের চেয়ে চীনা পণ্য কম্পিটিটিভ মানে সস্তা এবং দাম অনুপাতে মান ভালো। অথচ এর চেয়ে যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে ভারতের নিজ দক্ষতা আছে ভালো ও সুবিধা বেশি, সে দিকে মনোনিবেশ করে সেসব পণ্যে ভারতেরই পাল্টা চীনা বা অন্যদের বাজার ধরা উচিত ছিল- তাই নয় কী? ভারতের সব ভোগ্যপণ্য ভারতকেই উৎপাদন করতেই হবে কেন?

কিন্তু তবু মোদি মিথ্যা আত্মনির্ভরশীলতার পক্ষেই স্লোগান দিতে চলেছিলেন। কারণ এই মিথ্যা আত্মনির্ভরশীলতা ফুলঝুড়ির আড়ালেই মোদি তাদের হিন্দুত্বের জাতি ধারণা, নেশনস্টেট ধারণা দেন- ভুয়া জাতীয় পণ্য, হিন্দু জাতিশ্রেষ্ঠত্ব ধারণা, হিন্দু জাতি মহান, মহান ভারত আর এসব থেকে মহান হিন্দুত্বের পতাকাধারী বিজেপিকেই ভোট দেয়া, এভাবে সিদ্ধান্ত টানেন ও প্রপাগান্ডা করে থাকেন মোদি। তাই শেষ পর্যন্ত আত্মনির্ভরশীলতা একমাত্র অর্থ হয়ে যায় ‘হিন্দুত্ব’- ‘মহান ভারতে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ’ এমনই এক জাতগর্বের আত্মঘাতী ধারণা।

রাজ্য নির্বাচন ও কারচুপি
এবার এপ্রিল মাসের কিছু বেশি সময় ধরে ভারতে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন শেষ হলো। আর বলা বাহুল্য মোদির দল সেই একই হিন্দুত্ব, এরই হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ আর মিথ্যা আত্মনির্ভরশীলতার প্রপাগান্ডা নিয়ে নির্বাচন শেষ করল। নির্বাচন হলো ভারতের পাঁচ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, তামিলনাড়–, কেরালা ও পন্ডিচেরিতে। এখন এক সাথে ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে ২ মে সকাল থেকে। তবে এই রাজ্য নির্বাচনের বিশেষত্ব হলো, কলকাতায় মোদির বিজেপির জন্য হয় এটিই তাদের জয়ের একমাত্র সুযোগ। আর তা না হলে আর কখনো না। মোদির বিজেপি তাই এবার কলকাতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে বৈধ-অবৈধ সব পথে শক্তি নিয়োগ করেছিল। যেমন মোদি এই নির্বাচনে সভা করতে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন এক মাসে মোট ২২ বার, যা একটা রেকর্ড। মোদি কত মরিয়া এটিই এর প্রমাণ। একই সাথে, তা উল্টো বিচারে আঞ্চলিক দল, প্রদেশে ক্ষমতাসীন মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তির প্রকাশও বটে। ইতোমধ্যে বুথফেরত জরিপ বা এক্সিট পোল সমীক্ষা রিপোর্ট অনেক বেরিয়েছে।

আনন্দবাজার গ্রুপের ইংরেজি পত্রিকা টেলিগ্রাফ লিখেছে, ‘১০টা এক্সিটপোল সমীক্ষার ছয়টাই মমতা তৃতীয়বারের মতো রাজ্যসরকারে জিতে আসছেন বলে আভাস দিয়েছে; যেখানে মোট ২৯৪ আসনের এই নির্বাচনে ১৪৮ আসন প্রাপ্তি ঘটলেই বিজয়ী আর মমতা তা পাচ্ছেন বলেই আভাস।’ ভারতের এসব সমীক্ষা একেকটা গবেষক গ্রুপের পক্ষ থেকে করা হয়ে থাকে, যেখানে দেখা যায়, প্রতিটিই একটা না একটা মিডিয়াকে সাথে রেখেছে। সেবিচারে ‘সি ভোটার-এবিপি আনন্দের’ সাথে আছে আনন্দবাজার গ্রুপ। তাদের সমীক্ষায় মমতা সবসময় এগিয়ে থেকেছেন।

কিন্তু এসব কিছুর বাইরে, মুখে খুব বেশি বলা যায় না এমন কিছু কথা কলকাতার সবার মনে কাজ করেছে বোঝা যায়। ভারতে ভোট হয় ইভিএমে, মানে বোতাম-টেপা মেশিনে বা ইলেকট্রনিক প্রোগ্রামিং মেশিনে। আর সেখান থেকেই প্রোগ্রামিং বদলে দিয়ে কারচুপির করার অভিযোগ- এই হলো সেই সন্দেহ। আগে কারচুপি নিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে কথা উঠত, এভাবে তা একটা ইস্যু ছিল। কিন্তু গত ২০১৯ সালের মে মাসের কেন্দ্রীয় নির্বাচনে মোদির দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা থেকে এ অভিযোগ অনেক জোরদার ও সংগঠিত হয়ে উঠছে। বিশেষ করে গত বছর বিহার রাজ্য নির্বাচনে একই অভিযোগ আরো বড় করে উঠেছিল। ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রী নীতিশকুমার নিজ আঞ্চলিক দল বা এবারের নিজ জনতা দল হিসেবে হেরে যান। যেখানে বিজেপি-জনতা দল জোটে নির্বাচন করেছিল। কিন্তু নীতিশের সেই ঘাটতি পরিপূরণে দেখা যায় যেন, প্রায় ৭০ আসন বেশি পায় বিজেপি। এটিই অবিশ্বাস্যভাবে মানুষ দেখেছে। ফলে নীতিশের দল হারলেও বিজেপির সমর্থনে নীতিশই এখন মুখ্যমন্ত্রী। তাই মানুষের জিজ্ঞাস্য, আগের রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন কোয়ালিশন পার্টনার হিসেবে নীতিশ তো বিজেপির সাথেই ক্ষমতায় ছিলেন। তা হলে নীতিশের দলের পরাজয় হলে তাতে বিজেপিরও হেরে যাওয়া স্বাভাবিক বা আসন না কমে উল্টা বাড়ে কিভাবে? বিজেপির বেলায় প্রভাব উল্টো কেন?

সেই থেকে এ অভিযোগ আরো জোরদার হয় যে, মোদির হাতে মেশিনের প্রোগ্রামিং বাইরে থেকে বদলে নিয়ে কারচুপির মেকানিজম আছে। অনেকের অভিযোগ, এটি আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো কোরিয়া-ব্যাংকক-হংকং এ জোনের কোনো হ্যাকার গ্রুপ। আর এ ব্যাপারে সবার মনের কথা অভিযোগ আকারে মুখে নিয়ে এসেছেন কলকাতায় নচিকেতা চক্রবর্তী। কলকাতায় যদিও তিনি এখন পপুলার গীতিকার গায়ক হিসেবে পরিচিত, তার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড হলো- তিনি মূলত সাবেক সশস্ত্র নকশাল রাজনীতিক। তিনি এখন প্রকাশ্যেই বলেন, ‘আমি আদতে স্বাধীন বামপন্থী যদিও নিজস্ব কোনো দল নেই আমার’। আরো জানান, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে কী দেবেন! তিনিই মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে কখনো কিছু চাননি। গত সপ্তাহে তিনি আনন্দবাজারকে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, তিনি মনে করেন, ‘বুথে, ইভিএম মেশিনে কারচুপি না হলে শাসকদলই জিতবে।’

ঠিক এই কারচুপির সম্ভাবনা, এ অভিযোগ ইস্যুতেই নয়া দিগন্তে ‘রবিকান্তের হতাশা’ নামে গত ২৭ ডিসেম্বর আমার কলাম লিখেছিলাম। রবিকান্ত মূলত এশিয়া রিজিয়নের অর্থনৈতিক ইস্যুতে মন্তব্যকারী বা কলাম লেখক। তিনি বলেছিলেন, ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থায় দুর্বলতা ও অস্বচ্ছতা নিয়ে। এটিই তার হতাশার কারণ। ভারতের এক নাগরিক, ইভিএম বাক্স নিয়ে যেসব সন্দেহ অভিযোগ আছে বা প্রায়ই ওঠে তা কাটিয়ে তোলার এক প্রস্তাবের পক্ষে আগের প্রধান বিচারপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সক্রিয় হতে এবং এর পক্ষে আদেশ দিতে এক মামলা করেছিলেন। কিন্তু এরা দু’জন মিলে সেই প্রস্তাবকে ঠাণ্ডা ঘরে ফেলে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এই ছিল সারকথায় রবিকান্তের অভিযোগ। এ অভিযোগ মাথায় রাখলে বোঝা যায় কেন নচিকেতা চক্রবর্তী এত খোলাখুলি ও শক্তভাবে বলেছেন- ‘বুথে, ইভিএম মেশিনে কারচুপি না হলে শাসকদলই জিতবে।’

সর্বশেষ ইতোমধ্যেই গত শুক্রবার থেকে ভারতের মিডিয়ায় রব উঠে গেছে যে, ভারত নাকি তৃতীয় বিশ্বের দেশ। কারণ ভারতের সুপারপাওয়ারের আকাক্সক্ষা মোদি ধসিয়ে দিয়েছেন! অর্থাৎ বলতে চাচ্ছেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশেই এমন ধরনের শোচনীয় ম্যানেজমেন্ট ফেল করে বা সরকার চালাতে গিয়ে অযোগ্যতার ব্যর্থতা দেখা যায়!

এসব কথা শুনে একটাই মন্তব্য করা যায়। সুপারপাওয়ার নিজের মুরোদেই হওয়া যায়। যারা নিজ মুদি দোকানটাও চালাতে জানে না, এই ম্যানেজমেন্টও যারা পারে না তাদের সুপারপাওয়ার বোধের পরিণতি কি এমনই হবে না? পরের সোনা নিও না কানে, কেড়ে নেবে হ্যাঁচকা টানে!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement