২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অস্থির সময়! দিশেহারা মানুষ

অস্থির সময়! দিশেহারা মানুষ - ফাইল ছবি

২০২১ সালের এপ্রিল মাসের ২০ তারিখে যখন আজকের নিবন্ধটি লিখছি তখন সারা বাংলাদেশে যা ঘটছে তা নিবন্ধটি প্রকাশের তারিখে কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে সেটি একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামিনই বলতে পারবেন। আমাদের দেশে এখন গ্রীষ্মকাল চলছে। এই সময়ে মানুষের চিত্ত সাধারণত অস্থির থাকে। মস্তিষ্ক থাকে গরম এবং পরিপাকতন্ত্রও কেন জানি দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড রোদ, ভাপসা গরম এবং কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডবে দেশের সর্বত্র অহরহ দুর্ঘটনা ঘটে। বৈশাখ মাসের চিরায়ত বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে এবার করোনার দ্বিতীয় ওয়েভের তাণ্ডব এবং পবিত্র রমজান মাসের রোজা-নামাজসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার কারণে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ ধৈর্যহারা হয়ে ঘরে-বাইরে এমন সব লঙ্কাকাণ্ড ঘটাচ্ছে যা কিনা সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো দিন ঘটতই না।

করোনা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছে গত ১৪ এপ্রিল। ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল, এক সপ্তাহ পর্যন্ত লকডাউন চলবে এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় তা বাড়ানো হতে পারে। লকডাউন ঘোষণার পর করোনা পরিস্থিতির যে অবনতি হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষ মনে করছেন যে, রমজান মাসজুড়ে লকডাউন কার্যকর থাকতে পারে। এমনকি রমজানের পরেও তা অব্যাহত রাখতে হতে পারে।

লকডাউন শব্দটি আমাদের দেশে একেবারেই আনকোরা। গত বছর যখন দুনিয়াব্যাপী করোনার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করল তখন পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে আমরা সর্বপ্রথম লকডাউন শিখলাম। তারা করোনার মতো ভয়াবহ ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দেশের সব নাগরিককে নিজ নিজ ঘরে আবদ্ধ থাকার নির্দেশনা জারি করল। এই সময়ে রাষ্ট্র নগদ অর্থ, খাদ্য, চিকিৎসাসহ অন্যান্য জরুরি সেবা বিনামূল্যে প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছে দিলো। মার্কিন মুলুকে প্রতিটি নাগরিক লকডাউনের সময় ঘরে আবদ্ধ থাকার জন্য জনপ্রতি এক হাজার মার্কিন ডলার ভাতা পেত, যা মাসের নির্দিষ্ট দিনে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যেত।

নগদ অর্থ ছাড়াও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য রাষ্ট্র দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টার জরুরি সেবা চালু করল, যার অধীন শিশুদের প্যাম্পাস থেকে শুরু করে নর-নারীর অন্তর্বাস পর্যন্ত সরবরাহ করা হতো। ফলে নাগরিকরা লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি-উল্টো দরিদ্র ও প্রাপ্তিক জনগণ লাভবান হতে থাকল। তো পশ্চিমা দুনিয়ার মতো আমরা ২০২০ সালে লকডাউন ঘোষণার পরিবর্তে জগাখিচুড়ি মার্কা সাধারণ ছুটির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। ২০২০ সালের পুরোটা সময় সম্ভবত প্রকৃতি আমাদের দয়া করেছিল। কারণ সেই বছরের করোনার জীবাণুগুলোর যে বৈশিষ্ট্য ছিল তা আমাদের সাধারণ মানুষজনকে কুপোকাত করতে পারেনি। ফলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে জীবনের ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে আমরা সর্বনিম্ন স্তরে ছিলাম।

২০২০ সালের করোনার আঘাতে আমাদের জীবিকাও তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যাদের দৈনন্দিন চাহিদা খুবই সামান্য, তারা প্রথম দিকে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তারা সবকিছু সামলে নেয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি সত্যিকার অর্থে বিপদে পড়ে এবং তা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। অন্য দিকে ধনিক শ্রেণীর বিরাট অংশ মুখে মুখে হাপিত্যেশ করলেও বাস্তব অবস্থা হলো করোনাকালে নতুন করে কয়েক হাজার কোটিপতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এশিয়ার দেশগুলোর জন্য যে অর্থনৈতিক প্রতিবেদন তৈরি করে সেখানে ২০২০ সালের বাংলাদেশের অর্থনীতি তাদের কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হয়েছে। তারা খুব অবাক হয়ে লক্ষ করেছে যে, কোনো রকম পূর্ব পরিকল্পনা এবং সক্রিয় ব্যবস্থাপনা ছাড়াই একটি দেশের অর্থনীতিকে করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারী পঙ্গু করতে পারিনি।

২০২০ সালের উল্লেখিত অবস্থার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার অনেকটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে। তারা মনে করতে থাকে যে, তাদের প্রধানমন্ত্রী আসলে একজন ম্যাজিক্যাল লেডি। তার জাদুর স্পর্শে সব অসম্ভব সম্ভব হয়ে যায়। সরকার সমর্থক সংবাদপত্র-টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমের এক শ্রেণীর সাংবাদিক দশমুখে প্রচার করতে থাকে যে, মূলত প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতা, সাহসী সিদ্ধান্ত এবং সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ করোনা মোকাবেলায় বিশ্বের কাছে রোলমডেলে পরিণত হয়েছে। অনেকে আগ বাড়িয়ে এ কথাও বলার চেষ্টা করেছে যে, ইউরোপ-আমেরিকার উচিত বাংলাদেশে এসে ট্রেনিং নেয়া যাতে করে তারা অনাগত দিনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সীমিত সম্পদ দিয়ে অসীম সমস্যাকে সামাল দেয়ার বাংলাদেশী কৌশল রপ্ত করে নিজ দেশের জনগণের তকদির পাল্টে দিতে পারে।

চাটুকারদের উল্লেখিত কথাবার্তার ফলে কর্তাব্যক্তিদের অনেকেই হয়তো মনে করেছেন যে, তারা সত্যিকার অর্থেই করোনা মোকাবেলায় ল্যান্ড মার্ক কিছু করে ফেলেছেন। এ কারণে অনাগত ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোনো রকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই তারা ২০২০ সালের শেষ তিন মাস এক ধরনের আত্মতৃপ্তি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে এবং ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে এমন কিছু কাজকর্ম শুরু করে যা দেখে মনে হতে পারে যে, করোনা সারা দুনিয়া তছনছ করলেও বাংলাদেশে ঢুকতে পারবে না। কারণ এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ যায়গাগুলোতে করোনার চেয়েও শক্তিশালী মানুষগুলো যেভাবে মুগুর হাতে বসে রয়েছে এবং তাদের ভয়ে যেহেতু বাঘে-মহিষে একঘাটে পানি খায় সেহেতু করোনার মতো অতিশয় ক্ষুদ্র জীবাণুও মুগুরের ভয়ে বাঘ-মহিষের সঙ্গে একই ঘাটে পানি খেতে বাধ্য হবে।

যারা মনে করেছিল করোনা নিয়ন্ত্রণ করা কোনো ব্যাপার নয় বা আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী তাদের কিঞ্চিৎ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে ২০২১ সালের নতুন প্রজাতির করোনা। এই করোনার চরিত্র আচার-আচরণ মোটেও ভালো না। তারা ধনী-দরিদ্র-লাঠিওয়ালা মুগুরওয়ালা কাউকে চেনে না এবং কাউকেই একটু ছাড় দেয় না। ফলে তাদের তাণ্ডবে আমাদের দেশে কিছু কিছু মহলে এমন ভয়-আহাজারি এবং আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে যারা এই কয়দিন আগেও বুকচিতিয়ে এমন ভাব দেখাত যে, তারা কোনো দিন মরবে না। এ অবস্থায় সরকার তাড়াহুড়ো করে সারা দেশে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করেছে যার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রতিদিনই যত্রতত্র ভেসে উঠছে।

আমাদের দেশের চলমান লকডাউনে পশ্চিমা দুনিয়ার মতো সমন্বয় নেই। নেই ক্ষতিগ্রস্ত লোকদেরকে আশ্বস্ত করার বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। ফলে সাধারণ জনগণ লকডাউন মানতে চাচ্ছে না বা চেষ্টা করেও মানাতে পারছে না। দেশের সতের কোটি মানুষের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা সাকুল্যে কুড়ি লাখ, যারা এই লকডাউনের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। অন্য দিকে বাকি কর্মজীবীরা কমবেশি আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। যারা দিন আনে দিন খায় তারা দুমুঠো ভাতের জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে। যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তাদের কর্মস্থল যদি খোলা থাকে তবে তারাও চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হচ্ছে। যারা মাছ-গোশত-তরিতরকারি-ফলমূলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় অথচ পচনশীল দ্রব্যাদির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা প্রাণ হাতে নিয়ে রাস্তায় বের হতে বাধ্য হচ্ছে।

উল্লেখিত শ্রেণী-পেশার মানুষজন ছাড়াও রোগাক্রান্ত লোকজন এবং তাদের আত্মীয়স্বজনকে ছুটতে হচ্ছে হাসপাতালে। সরকারি অফিসের পাওনা যথা গ্যাস, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খাজনা পরিশোধের জন্য ছোটাছুটি করা লোকজনের সংখ্যাও কম নয়। বন্দর, কাস্টমস, ব্যাংক, বীমা, রফতানিবাণিজ্য, শিল্প কলকারখানায় কর্মরত লোকজনের চলাফেরার জন্যও রাজপথে প্রচুর ভিড় হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি অপরিহার্য সেবার সঙ্গে জড়িত লোকজন, সরকারি নির্মাণকাজে নিয়োজিত কর্মীদের চলাচল এবং গ্রামাঞ্চলে কৃষি, পশু পালন এবং মৎস্য চাষ বা আহরণ কর্মে নিয়োজিত মানুষজনের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে লকডাউনের অন্তর্ভুক্ত করা অসম্ভব। ফলে আমরা বুঝতে পারছি না কী লকডাউন চলছে এবং কিভাবে চলছে। ফলে লকডাউন যারা বাস্তবায়ন করছেন সেই পুলিশ বাহিনী এবং লকডাউন যাদের ওপর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেই জনগণের সঙ্গে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে অপ্রীতিকর এবং হৃদয়বিদারক নানা ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটছে।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওর মাধ্যমে জানতে পারছি যে, সরকারি কর্মে নিয়োজিত বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোকজন লকডাউন নিয়ে দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। ডাক্তার বনাম পুলিশ বনাম ম্যাজিস্ট্রেটের ভাইরাল হওয়া বিতণ্ডাটি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। রিকশাওয়ালা ঠেলাওয়ালা অথবা সিএনজি চালকেরা ক্ষুধার যন্ত্রণায় বেপরোয়া হয়ে পড়ছে। যে পুলিশ দেখলে একসময় তারা ভয়ে থর থর করে কাঁপত সেই পুলিশের সঙ্গে এখন রীতিমতো হাতাহাতি করার জন্য মারমুখো আচরণ করছে। তারা ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। কেউ তাদের লকডাউনের দোহাই দিয়ে কিছু বললেই তারা ক্ষুধার্ত পেটের ওপর সজোরে থাপ্পর মারতে মারতে চিৎকার করে বলছে- ভাত দাও!

সাধারণ শ্রেণীপেশার মানুষজন ও বেপরোয়া আচরণ শুরু করেছে। বিভিন্ন বয়সের লোকজন পুলিশের সঙ্গে যেভাবে বাদানুবাদ করছে তা আগে আমরা কখনো দেখিনি। অন্য দিকে পুলিশের অনেক সদস্যও তাদের মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না। তারা তাদের পদ-পদবি, দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে গিয়ে পথচারীদের সঙ্গে এমন আচরণ শুরু করেছে যা দেখে মনে হতে পারে, স্বার্থসংশ্লিষ্ট মূল্যবান ধন-সম্পত্তির বিরোধের কারণে পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন দু’টি পক্ষ একে অপরের দিকে তেড়ে আসছে।

করোনার প্রকোপ, গৃহবন্দী মানুষের মনোবেদনা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্ক ছাড়াও সাম্প্রতিককালে প্রায় সব পরিবারেই অদ্ভুত গৃহবিবাদ শুরু হয়েছে। বিনোদন, খানাপিনা, সামাজিক মেলামেশা ইত্যাদি বিষয়গুলো স্বাভাবিক নিয়মে না চলার কারণে সব বয়সের নারী-পুরুষের জৈব-রাসায়নিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদিতে নানা রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক পরিবার ভেঙে যাচ্ছে- অনেকে বাউণ্ডুলে হয়ে পড়েছে এবং অনেকে বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে এসব মানুষ যখন রাস্তায় বের হচ্ছে তখন তারা নিজেদের অজান্তেই সীমা অতিক্রম করে অভিনব লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে।

উল্লেখিত, পরিস্থিতি কেবল আমাদের দেশে নয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই শুরু হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের বিচক্ষণ সরকার যে সহমর্মিতা ও সততা নিয়ে পুরো পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে আমরা তা না করে বাংলা বাগধারার ধামাচাপা-লুকোচুরি, ছাইচাপা, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা, অকালকুষ্মাণ্ড, গোবর গণেশ ইত্যাদি শব্দমালার অধ্যয়ন এবং ভাবসম্প্রসারণ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement