২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আইনের শাসন বনাম প্রধান বিচারপতির আক্ষেপ

আইনের শাসন বনাম প্রধান বিচারপতির আক্ষেপ - ফাইল ছবি

জনগণের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যক্তিরা দীর্ঘ দিন যাবৎ বলে আসছেন, দেশে আইনের শাসন নেই। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে আইন ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয় দুর্বলের ওপর। সচরাচর ক্ষমতাসীনদের ওপর আইন প্রয়োগ করা হয় না। বাংলাদেশে স্পষ্টই আইনের প্রয়োগ দু’ভাগে হচ্ছে। ক্ষমতাহীনদের প্রতি আইন কঠোর হলেও ক্ষমতাসীনদের প্রতি আইন প্রয়োগকারীরা সম্পূর্ণভাবে উদাসীন। যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, যাদের হাতে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের সিনিয়র ডিঙ্গিয়ে প্রমোশন, লোভনীয় পদে পোস্টিং দেয়ার ক্ষমতা এবং যাদের অর্থ সম্পদ রয়েছে তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা খুবই আজ্ঞাবহ এবং এদের (ক্ষমতাসীন/ধনী) কোনো অপরাধই অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যতিক্রম কিছু হয়, কোথাও কোথাও আইন প্রয়োগ হতে দেখা যায় যদি সংঘটিত ঘটনা মিডিয়াতে ব্যাপক হারে প্রকাশিত হয়ে থাকে। তখন সরকার নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য লোক দেখানো কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা অত্যন্ত অপ্রতুল।

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় প্রধান আসামি ছিলেন ক্ষমতাধর এক মন্ত্রীর জামাতা যিনি কর্নেল ও অনেক ক্রসফায়ারের হোতা এবং র‌্যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসার। সাত খুনের একজন ভিকটিম যদি আইনজীবী না হতেন তাহলে মিডিয়াতে এত আলোড়ন সৃষ্টি হতো না। তখন সন্ত্রাসীরা এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ারে মারা গেছে বলে র‌্যাব প্রেস ব্রিফিং করে সরকার ও জনগণের বাহবা নিতো। মিডিয়া যখন সরকারি আমলা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জনবিরোধী ও বেআইনি কর্মকাণ্ড ফলাও করে প্রকাশ করে তখনই সরকারের কান গরম হয়ে কিছু কার্যক্রম শুরু হয়, নতুবা এগুলো ঢাকা পড়ে যায় অতল গহ্বরে। পুলিশ ও র‌্যাব ক্ষমতাশালী সরকারি এজেন্সি। তাদের মধ্যে একটি অংশ বিভিন্ন অপরাধসহ অপহরণ, মাদক কারবারে জড়িত। ক্রসফায়ার দেয়ায় নাম করে তারা কোটি কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে। টাকা না পেলে মাদক বা অস্ত্র পাওয়ার অভিযোগে কোর্টে চালান করে দেয়া হয়।

গোষ্ঠী/ব্যক্তিশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে আইনের শাসন এ দেশে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ আমলারা কার্যকর করেন না। ফলে কোর্টের আদেশ পেয়েও ভুক্তভোগী জনগণ প্রতিকার পাচ্ছে না। দু’জন সম্মানিত বিচারপতির (জনাব বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং জনাব বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম) লিখিত দু’টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি মাহমুদ হোসেন বলেছেন, রাষ্ট্রের সবার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর করা। আমরা কনটেম্পট (আদালত অবমাননা) করে হয়রান। কনটেম্পট করলেও যথাযথভাবে রায় কার্যকর হচ্ছে না। এটা দুঃখের বিষয়। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির এই দুঃখ বা আক্ষেপ গোটা দেশ ও জাতির অন্তরের বক্তব্যের প্রতিফলন। মাননীয় প্রধান বিচারপতির এ আক্ষেপ গোটা দেশবাসীর। মাননীয় বিচারপতিরা দুই-তিন পক্ষের (বাদি, বিবাদি ও রাষ্ট্রপক্ষ) বক্তব্য গভীর মনোযোগের সাথে শ্রবণকরত: পরিশ্রম করে যে রায় দেন তা কার্যকর না হওয়ায় দায়দায়িত্ব মাননীয় প্রধান বিচারপতি এড়াতে পারেন কি? তারপরও একটি কঠিন সত্যকে উপলব্ধি করতে পারায় প্রধান বিচারপতিকে অন্তরে অন্তঃস্তল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই এবং দেশবাসীও তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।

রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি আইনের ধারক ও বাহক। তিনি সংবিধানকে সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছেন। অন্যান্য মাননীয় বিচারপতিসহ তিনি যে শপথবাক্য পাঠ করেছেন তাতে উল্লেখ রয়েছে, ‘আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব’, ‘আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব’ এবং ‘আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’

প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের ১১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সব আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয়।’

অনুচ্ছেদ-১১২ তে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত সকল নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের সহায়তা করিবেন।’

মাননীয় সব বিচারপতিসহ প্রধান বিচারপতির শপথ ও সংবিধান তাদের যে ক্ষমতা দিয়েছে, সে মোতাবেক কনটেম্পট করেও যদি বিচার বিভাগীয় আদেশ কার্যকর করা না হয় সংবিধান অনুযায়ী এ জন্য দায়ী কে? রায় কার্যকর না হওয়ার কারণে জনগণের যে ভোগান্তি হচ্ছে, এ দায়িত্ব কে বহন করবে? বিষয়টি জনগণের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। কারণ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭(১) মোতাবেক, ‘জনগণই প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক।’

আইন অনুযায়ী পরিবেশ অধিদফতর বা জেলা প্রশাসনের কোনো প্রকার অনুমতি ব্যতিরেকে বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানি আবাসিক প্রকল্প করার জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলাধীন রূপগঞ্জ উপজেলার খাল, বিল, নদী-নালা, পুকুর, কবরস্থান, তিন ফসলি জমি ভরাট করে ফেলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী রিট পিটিশন করার পর শুনানিঅন্তে অবৈধভাবে বালু ভরাট বন্ধ করার জন্য পরিবেশ অধিদফতর, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রতি হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও উপরিউক্ত কর্মকর্তারা হাইকোর্টের রায় কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। উচ্চ আদালতের নির্দেশ যে, রাষ্ট্রীয় কর্মচারী অর্থাৎ আমলারা কার্যকর করেন না, এটাই তার একটি বড় প্রমাণ।

দেশের বিজ্ঞশালী লোকেরা মনে করেন, রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রশাসনিক যন্ত্রের মতো দেশের আইনআদালত তাদের পকেটস্থ হয়ে পড়েছে। ফলে কোর্টের আদেশ বিত্তশালীদের একটি বাতুলতা মাত্র। কারণ বিত্তশালীরা জানেন, আমলা, পুলিশ ও প্রশাসন দ্বারা কোর্টের রায় কার্যকর হয়। ফলে আদালতের রায় কার্যকরকারীরা যদি বিত্তশালীদের পকেটে চলে যায় সেখানে আদালতের রায়ের তোয়াক্কা তারা করবে কেন? আদালতের রায় যার বিরুদ্ধে যায় সে তো স্বাভাবিক কারণেই রায় মানতে চায় না, আইনের শাসন কায়েম করার জন্য রায় মানাতে হয়। গ্রাম এলাকায় গ্রাম্যসালিস প্রধানরা অনেক বিষয়ে আদালতে বিচারাধীন বিরোধ আপস মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে থাকেন। গ্রাম্য সালিসদের প্রদত্ত রায় তারাই কার্যকর করেন যারা রায় দেন।

রায়/আদেশ কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতির উদ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং তার সরল স্বীকারোক্তি প্রশংসার দাবি রাখে। তবে তার উদ্যোগকে শুধু আবেগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, জনস্বার্থে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য তাকেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান তাকে সে ক্ষমতা অর্পণ করেছে। তিনি যদি তার ক্ষমতাকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করেন তবে এমন কোনো শক্তি নেই যা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় নিজের মন মানসিকতা থেকে। অন্য দিকে পিরোজপুরের জেলা ও দায়রা জজ ক্ষমতাসীন দলের সাবেক এমপিকে জামিন না দেয়ায় জজ সাহেবকে ওই দিনই বদলি করে আরেকজন জজ বসিয়ে জামিন করানো হয়েছে। ফলে বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত বিচারকরা সে অদৃশ্য শক্তিকে কেন ভয় পাবেন না? সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিদায়ের নাটক বিচার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মনে কেন আতঙ্ক সৃষ্টি করবে না? এটাও একটি পর্যালোচনার বিষয়।

আদালত অবমাননা করে সাধারণত বিত্তশালীরা। কনটেম্পট বা আদালত অবমাননার শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা বিচারপতিদের হাতেই। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী মোজাম্মেল হক ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের আদালত অবমাননায় জরিমানা হয়েছে বটে, কিন্তু মোটা দাগে আদালত অবমাননার জন্য শাস্তির পরিমাণ চোখে পড়ার মতো নয়। এখনো এ ধরনের অনেক মামলা উচ্চ আদালতে পেন্ডিং আছে, এ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হলে আদালত অবমাননাকারীদের হয়তো হুঁশ হতে পারে, তবে এ জন্য আদালত থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সত্য প্রকাশ করতে সর্বোচ্চ বিচারালয়ের যে অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে, তা জাতির জন্য একটি অশনিসঙ্কেত। সর্বোচ্চ আদালতের রায়/আদেশ অমান্যকারীরাই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে যা স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী। বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের প্রস্তাবনা মোতাবেক সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিক সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার সর্বোচ্চ বিচার বিভাগের কোনো দায় দায়িত্ব আছে কি? বিষয়টি কি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির বিবেচনার দাবি রাখে?

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement