২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্ফীত সামরিক ব্যয় বনাম দুই মহামারী

স্ফীত সামরিক ব্যয় বনাম দুই মহামারী - ফাইল ছবি

বিশ্বের কোথাও করোনার দ্বিতীয়, কোথাও বা তৃতীয় ঢেউ ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হয়েছে। রাশিয়ায় তৃতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়ায় ৩১ মার্চে এক দিনে নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে আট হাজার ২৭৭ জন। ওই দিন মারা গেছেন ৪০৯ জন। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনার শিকার হয়ে মারা গেছেন প্রায় এক লাখ। সব রেকর্ড ভেঙে সম্প্রতি করোনা সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ব্রাজিলে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বিবেচনায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দেশটিতে ৩১ মার্চে ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন প্রায় চার হাজার। এক দিনে সেখানে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন আরো ৮৯ হাজার ২০০ জন। আমাদের দেশেও করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। হু হু করে বাড়ছে ভাইরাসটির প্রকোপ। দেশে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৯ সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্যমতে- এ পর্যন্ত গোটা বিশ্বে করোনায় মারা গেছেন প্রায় সাড়ে ২৮ লাখ। ব্রাজিলের চরম ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট বলসোনারো এরই মধ্যে তার মন্ত্রিসভার ছয়জন মন্ত্রীকে বাদ দিয়েছেন। দুই বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রিসভায় এটি সবচেয়ে বড় রদবদল। মহামারী দমনে ব্রাজিল সরকারের ব্যর্থতায় তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। তিনি অব্যাহতভাবে কোয়ারেন্টিন পদক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছিলেন। তার অভিমত ছিল- যদি কোয়ারেন্টিন পদক্ষেপ নেয়া হয়, তবে করোনার প্রভাবে যে ক্ষতি হবে; তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে অর্থনীতির। ব্রাজিলিয়ানদের তিনি বলতেন, করোনা নিয়ে ‘চেঁচামেচি বন্ধ করো’। কিন্তু বাস্তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় ব্রাজিলের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বজুড়ে মানবজাতি এখন করোনাভাইরাসের ভয়ে ভীত। দিশেহারা।

আজকের এ দিনে যদি বিশ্বজুড়ে মানবসমাজে একটি গণভোট আহ্বান করা হয় এবং জানতে চাওয়া হয়- তারা নিজেদের করের অর্থ যুদ্ধাস্ত্রের পেছনে ব্যয় করতে চান, নাকি চান করোনা মহামারী মোকাবেলা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সেবা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য নিরসন, শিক্ষা ও গুরুত্বপূর্ণ জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতে। যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার হবে নির্বিচারে মানুষ মারার কাজে। অন্য দিকে এ অর্থ করোনা মোকাবেলার পেছনে খরচ করলে মানুষর মৃত্যু ঠেকাবে। সহজেই অনুমেয় এ অর্থ কোন খাতে ব্যয় হলে মানব সভ্যতায় সুখ-শান্তি নিশ্চিতভাবে বাড়বে। এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রস্তাবিত গণভোটে বিশ্বের মানুষ তাদের করের টাকায় অস্ত্র কেনার বিরুদ্ধেই রায় দেবেন। আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না- আজকের দিনে বিশ্বজুড়ে সামরিক খাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, এর ক্ষুদ্র একটি অংশও যদি এমন একটি বিশ্ব কল্যাণ তহবিলে দেয়া হতো এবং যদি এই তহবিলের অর্থ আন্তরিকতার সাথে মানবিক চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে ব্যাপকভাবে,স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য নিরসন ও জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় করা যেত, তবে আমরা পেতাম এক শান্তিময় বিশ্ব, যেখানে যুদ্ধবিগ্রহ থাকত না, থাকত না ক্ষুধা-দারিদ্র্য। বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ তেমনটিই চান। কারণ তারা জানেন, যুদ্ধবিগ্রহ ছোট-বড় সব দেশের মানুষের জীবনেই বয়ে আনে শুধু দুর্ভোগ। কিন্তু তাদের করের অর্থ কোথায় ব্যয় হবে, সে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ তাদের হাতে থাকে না, থাকে মিলিটারিজমে বিশ্বাসী রাজনীতিবিদদের হাতে।

মিলিটারিজম হচ্ছে কোনো একটি দেশের সরকারের বা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস বা প্রত্যাশার নাম। মিলিটারিজমে বিশ্বাসীরা মনে করেন- একটি রাষ্ট্রকে শক্তিধর সামরিক সক্ষমতা ধারণ করতে হবে। আর এই সামরিক শক্তি আগ্রাসীভাবে ব্যবহার করতে হবে জাতীয় স্বার্থ, ভাবমর্যাদা ও শৌর্যবীর্য সম্প্রসারিত করার কাজে। সেই সাথে তারা মনে করেন, একটি দেশের প্রশাসনে সেনাবাহিনীর প্রাধান্য থাকা উচিত। ইতিহাসজুড়ে এই মিলিটারিজম একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান ছিল সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী দেশগুলোর নীতি-আদর্শে। এর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে আসিরীয় সাম্রাজ্য, গ্রিক নগররাষ্ট্র স্পার্টা, প্রুশিয়া কিংডম, বিভিন্ন রাজতন্ত্র, ওসমানীয় সাম্রাজ্য, জাপান সাম্রাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, মুসোলিনির শাসনামলের ইতালি সাম্রাজ্য, জার্মান সাম্রাজ্য ও নেপোলিয়ানের শাসনাধীন প্রথম ফরাসি সাম্রাজ্যে। এরই মধ্যে অনেক সাম্রাজ্যের অবসান ঘটেছে। তবে এখনো পৃথিবীটা সেই মিলিটারিজমের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সমকালীন বিশ্বের অনেক দেশ এখনো সেই অতীতের মিলিটারিজমকে আঁকড়ে ধরে আছে।

যুক্তরাষ্ট্র এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্র এর মিত্ররা সন্ত্রাস দমনের নামে মিলিটারিজমের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটিয়ে চলেছে। ‘স্মিথসোনিয়ান’ ম্যাগাজিনের ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন পাঠে এ সম্প্রসারণের ব্যাপকতা আঁচ করা যায়। সে প্রতিবেদনে এরা একটি ইনফোগ্রাপ মানচিত্র প্রকাশ করে। এই মানচিত্রে দেখানো হয় ইউএস আর্মি বিশ্বের কোন কোন দেশে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে নানা রকম যুদ্ধ জারি রেখেছে। স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনের এই মানচিত্র অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী এখন বিশ্বের ৪০ শতাংশ দেশে সামরিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ সূচিত তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ চলছে বিগত ১৭ বছর ধরে। সত্যিকার অর্থে এটি এখন রূপ নিয়ছে একটি বৈশ্বিক যুদ্ধে। এই যুদ্ধে এখন বিশ্বের ৮০টি দেশে লড়াই করছে মার্কিন বাহিনী। সেসব তথ্যের বিস্তারিতে যাওয়ার কোনো অবকাশ এ লেখায় নেই।

বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষকে বিষয়টি নিয়ে ভাবার চূড়ান্ত সময় মানুষ মিলিটারিজমকে না মানবিক কল্যাণকে অগ্রাধিকাার দেবে। কারণ শুধু গরিব দেশগুলোর মানুষই নয়, ধনী দেশশুলোর মানুষের জীবনেও আজ অন্তহীন দুর্ভোগ। ধনী দেশগুলোতেও অনেক সামাজিক অধিকার আজকাল মেনে নেয়া হচ্ছে না। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া একটি মৌলিক সামাজিক অধিকার। সামাজক সেবাগুলোকে ক্রমবর্ধমান হারে পণ্য করে তোলা হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে সহায়তা দেয়ার পরিবর্তে তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিতে হচ্ছে স্বাস্থ্যবীমার পলিসি কিনে। স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানির শেয়ার মালিকদের ভালো মুনাফা নিশ্চিত করেই সাধারণ মানুষকে পেতে হচ্ছে সেই সেবা। সাড়ে চার কোটির মতো আমেরিকান মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা পান না। বিশ্বে সবচেয়ে ধনী দেশটির অবস্থা এই।

কম উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সুস্থ ও মর্যাদাকর জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক সম্পদ উৎসে প্রবেশ পায় না। বিশ্বের মানুষের প্রতি ৯ জনে একজন ক্ষুধার শিকার। কোভিড-১৯ এই সঙ্কট পরিস্থিতিকে আরো ব্যাপভাবে এলোমেলো করে তুলেছে। এখন বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা আগের চেয়ে দ্বিগুণ। এ সময়ে বিশ্বেও ২৪ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজন মানবিক সহায়তা। ক্ষুধায় নিপতিত সাড়ে তিন কোটির মতো মানুষ। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ তাদের চাহিদা মেটাকে বড় মাপে অক্ষম। এ বছরেও হাজার হাজার মানুষ ক্ষুধায় মারা গেছেন। এক দিকে এসব মানুষের জন্য সহায়তা তহবিল কমছে, অন্য দিকে বাড়ছে মানবিক সহায়তার চাহিদা। জীবনদায়ী সেবায় সহায়ক সংস্থাগুলো বাধ্য হয়ে সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে- বিশ্ববাসীর সামনে এখন ভয়াবহ দুই চ্যালেঞ্জ করোনাভাইরাস ও ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়া।

এর পরও বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো শত শত কোটি ডলার ব্যয় করছে প্রতিরক্ষা খাতে, সোজা কথায় অস্ত্র কেনায়। বরং এ খাতে ব্যয়ের অঙ্ক বাড়িয়েই চলেছে। অথচ চোখের সামনেই তাদের বর্তমান ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা। বর্তমানে সারা বিশ্ব মুখোমুখি সবচেয়ে খারাপ ধরনের সঙ্কটে।

আজকের দিনে অন্যতম বিবেচ্য হচ্ছে- আমরা মানবিক চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে আমাদের অগ্রাধিকার করণীয়গুলো নির্ধারণ করব কি না? কারণ আমরা এ পর্যন্ত নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ক্ষেত্রগুলোতে অর্থব্যয়কে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে আসছি। উদাহরণ টেনে বলা যায়- ২০২০ সালেও আমরা রেকর্ড পরিমাণে সামরিক ব্যয় অব্যাহতভাবে রেখেছি। ২০২১ সালেও সে প্রবণতা বিপরীতমুখী হওয়ার কোনো সামান্যতম চিহ্নও দেখতে পাচ্ছি না। জানা যায়, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃত বিবেচনায় এর সামরিক ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ১,৮৩ ট্রিলিয়ান (১ ট্রিলিয়ন = ১০১২) ডলারে পৌঁছেছে, যদিও করোনা মহামারীর কারণে দেশটির অর্থনীতির সঙ্কোচন ঘটেছে ভয়াবহ মাত্রায়। বিশ্বে সামরিক ব্যয়ের দু-পঞ্চমাংশই করে যুক্তরাষ্ট্র, যার পরিমাণ পরবর্তী বেশি সামরিক ব্যয়ের ১০টি দেশের সম্মিলিত সামরিক ব্যয়ের চেয়েও বেশি। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, দেশটি পাঁচ কোটির মতো নাগরিক ভুগছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়। অন্য দিকে যুক্তরাজ্য ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে চলেছে সামরিক বাজেট। বিগত ৭০ বছরের মধ্যে দেশটির এবারের সামরিক বাজেট সবচেয়ে বেশি। এবার দেশটি এর পারমাণবিক অন্ত্র খাতের বাজেট বাড়িয়েছে ব্যাপকভাবে। এর বিপরীতে দেশটি গরিব দেশগুলোতে এর অর্থসহায়তা কমিয়ে দিয়েছে ৩০ শতাংশ।

ভেবে দেখুন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের সামরিক বাজেটের একটি ক্ষুদ্র অংশও যদি দুর্নীতিব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা ও লাভজনক যুদ্ধশিল্পে খরচ করার বদলে খরচ করা যেত মানবিক পরিস্থিতি উন্নয়নের পেছনে, তবে কেমন দাঁড়াত আমাদের এই ধরিত্রী।

জাতিসঙ্ঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও অস্ত্র নিরোধসংক্রান্ত ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধির মতে, আমরা গোটা বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের মাত্র ৩ শতাংশ খরচ করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজির) ১ ও ২ নম্বর লক্ষ্য পূরণ করতে পারতাম। এ লক্ষ্য দু’টিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘বিশ্বের সর্বত্র সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান’ ও ‘বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত’ করা তথা ‘জিরো হাঙার’ অর্জন।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট থেকে ৭৫ হাজার কোটি ডলার নিয়ে সারা বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা যেত। নারীদের পরিচালিত শান্তি, মানবাধিকার ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ও সামরিকবাদ অবসানের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘কোডপিঙ্ক’-এর সক্রিয় শান্তিবাদী লেখক মেডিয়া বেঞ্জামিন এমনটিই মনে করেন।

‘গ্লোবাল ক্যাম্পেইন অন মিলিটারি বাজেট’-এর দেয়া তথ্যমতে, গোটা বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্র খাতের বাজেট জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মিলিত বাজেটের ১০ গুণ। ট্র্যান্সফর্ম ডিফেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী- বিশ্বের সামরিক বাজেটের মাত্র ২৫ ভাগের ১ ভাগের সমান হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘কোভিড-১৯ সলিডারিটি রেসপন্স ফান্ড’-এর সমান। বিশ্বেও সামরিক বাজেটের ৭ শতাংশের পরিমাণ অর্থ দিয়ে গোটা বিশ্বের মানুষের জন্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা যেত অনায়াসে। এ তথ্য অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের।

এ ধরনের আরো অনেক তথ্যই তুলে ধরা সম্ভব, যা থেকে স্পষ্ট ধারণা মিলে আমরা কী বিপুল পরিমাণ অর্থ যুদ্ধ খাতে ব্যয় না করে সহজেই মানবিক পরিস্থিতি উন্নয়নে ব্যয় করতে পারতাম। করোনাভাইরাস আমাদের জানান দিয়েছে, আমরা সামাজিক হুমকি মোকাবেলায় কতটুকু বেখেয়াল, অপ্রস্তুত? আমরা জাতীয় নিরাপত্তার নামে যুদ্ধাস্ত্র কিনে বিশ্বে সামরিকতন্ত্র জিইয়ে রেখে কার্যত মানুষ মারার উন্মাদনাই চালিয়ে যাচ্ছি। অন্য দিকে করোনা মোকাবেলায় অবহেলায় বিশ্বে এরই মধ্যে মারা গেছে ৯ লাখেরও বেশি মানুষ। বললে ভুল হবে না, বিশ্বজুড়ে এখন চলছে অভূতপূর্ব হেলথ কেয়ার ইমারজেন্সি। যুদ্ধ আর মারণাস্ত্রের বাজেট বাড়িয়ে করোনার শিকার মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সম্ভব হবে না। করোনা দমনে প্রয়োজন সামরিক বাজেট কমিয়ে অন্তত এর একটি অংশ স্বাস্থ্যসেবায় খরচ করার সম্মিলিত বিশ্ব সিদ্ধান্ত। এখন সময় স্ফীত সামরিক বাজেটকে স্থানান্তর করে মৌল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক প্রয়োজনে খরচ করার তহবিলে, যেমনটি বিধৃত রয়েছে সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে। এ সনদের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে- এগিয়ে যাওয়ার উপায়। বলা আছে এগিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন সবার জন্য খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য তাগিদটা হচ্ছে সব জাতিকে সহায়তা দেয়ায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার। বিশেষ করে এই তাগিদ আরো জোরালো হয়েছে এই করোনা মহামারীর কারণে। বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করার কারণেও। জাতিসঙ্ঘ ও এর সামনের কাতারের সংস্থাগুলোকে আজ তীব্রভাবে মোকাবেলা করতে হচ্ছে ‘ক্ষুধা মহামারী’। এর ওপর যোগ হয়েছে করোনা মহামারী। কিন্তু এই দুই মহামারী দমনে জাতিসঙ্ঘের হাতে প্রয়োজনীয় তহবিল নেই। সরকারগুলোও সেভাবে এই প্রয়োজনীয় তহবিল জোগানে এগিয়ে আসছে না।

এমন পরিস্থিতিতে বড় বড় সামরিক বাজেটের দেশগুলোর কাছে মানবিক দিক বিবেচনায় পরামর্শ : এসব দেশ যেন ক্ষুধা ও করোনা দমনে সামরিক বাজেটের সামান্য একটা অংশ খরচের দ্রুত ব্যবস্থা করে। বিশেষ করে বিশ্বে ভযাবহ যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষের ক্ষুধামুক্ত ও করোনা দমনে সহায়তার ব্যাপারে এই অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। তা না হলে নিকট ভবিষ্যতে অসংখ্য মানুষ করোনা আর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের শিকার হয়ে মারা যাবেন। জাতিসঙ্ঘ বারবার এ ধরনের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে যাচ্ছেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement