২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কুরআনের আয়াত পরিবর্তনে রিট

কুরআনের আয়াত পরিবর্তনে রিট - ফাইল ছবি

ভারতে শিয়া ওয়াক্ফ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ ওয়াসিম রিজভী পবিত্র কুরআনের ২৬টি আয়াতের ওপর আপত্তি তুলে পরিবর্তনের আবেদন জানিয়ে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে রিট দায়ের করেছেন। এর প্রতিবাদে উপমহাদেশের মুসলিম জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। ওয়াসিম রিজভী তার আবেদনে উল্লেখ করেন, ‘২৬টি আয়াত বিদ্বেষ, সন্ত্রাসবাদ ও জিহাদকে উসকে দিচ্ছে এবং কাফিরদের হত্যায় প্রলুব্ধ করছে। তার ভাষায়- আর্জিতে উল্লিখিত ২৬টি আয়াত আল্লাহর কালাম নয়। হজরত আবুবকর রা:, হজরত উমর রা: ও হজরত উসমান রা: পরদেশ গ্রাস করার মানসে এ আয়াতগুলো কুরআনে সন্নিবেশিত করেছেন।’

ভারতীয় উপমহাদেশের বরেণ্য স্কলার, লক্ষ্ণৌ থেকে প্রকাশিত মাসিক আল ফুরকানের সম্পাদক আল্লামা মানজুর নুমানী রহ: ‘ইমাম খোমেনি আওর ইসলাম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, একশ্রেণীর উগ্রবাদী শিয়া বিশ্বাস করেন, বর্তমানে মুসলিম সমাজে প্রচলিত কুরআন সংশোধিত এবং মূল কুরআনের দুই-তৃতীয়াংশ বর্তমানে অবশিষ্ট আছে। বাকিগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি সূরার নাম সূরায়ে ‘বেলায়েত’। তিনি তার গ্রন্থে এ সূরার একটি পাতার ছবি প্রকাশ করেছেন। অথচ হজরত আলী রা:সহ আহলে বায়াতের কোনো সদস্য এমন জঘন্য আকিদা পোষণ করতেন না। হজরত ইমাম হাসান রা:, হজরত ইমাম হোসাইন রা:, হজরত ইমাম জায়নুল আবেদিন রা:, হজরত ইমাম বাকির রা:, হজরত ইমাম জাফর সাদিক রা:, হজরত ইমাম মুসা কাজিম রা:, হজরত ইমাম হাসান আসকারি রা:সহ নবী বংশের ইমামরা সারা জীবন হজরত হাফসা বিনতে উমর রা:-এর কাছে সংরক্ষিত এবং হজরত উসমান রা:-এর যুগে সঙ্কলিত, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং এর শিক্ষা জনগণের মাঝে প্রচার করতেন। এটা যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে জিবরাইলের মাধ্যমে মহানবী সা:-এর ওপর অবতীর্ণ, এতে তাদের বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না।

পবিত্র কুরআন মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হওয়া সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। এটা মানবজাতির মুক্তির একমাত্র সংবিধান। পবিত্র কুরআন আল্লাহ তায়ালার কালাম। তিনি নিজেই কিয়ামত অবধি কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। (সূরা হিজর-৯) মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাস, অবতীর্ণ হওয়ার দিন থেকে শুরু করে আজ অবধি একটি আয়াত, এমনকি একটি অক্ষরও পরিবর্তন করা হয়নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না। ধর্ম বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পবিত্র কুরআনে কোনো প্রকার পরিবর্তনের দাবিকারী মুসলমান থাকতে পারে না। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নাজিলকৃত, ধর্মীয় গ্রন্থের সংযোজন ও বিয়োজনের কোনো ক্ষমতা ও এখতিয়ার পৃথিবীর কোনো আদালতের বা রাষ্ট্রপ্রধানের নেই।

ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দু জানিয়েছে, কুরআনবিদ্বেষী সৈয়দ ওয়াসিম রিজভীর বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন ভারতের সর্বস্তরের সুন্নি মুসলিমরা। তারা রাজপথে নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এক বিবৃতিতে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতা মানজুর ভাট বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেছি। আমরা চাই দ্রুততর সময়ে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক। ধর্ম বা ধর্মীয় গ্রন্থের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি।’ বিজেপির আরেক নেতা আলতাফ ঠাকুর শিয়া নেতার বক্তব্যকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘কুরআন আমাদের ভালোবাসা, প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। কুরআন সহিংসতা ও উগ্রতা শেখায় না।’ অবমাননামূলক বক্তব্য দিয়ে বিশ্বের সব মুসলিমের অন্তরে আঘাত দেয়ায় সরকারের কাছে রিজভীকে আটকের দাবি জানান বিজেপির এ নেতা। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার মুহতামিম (রেক্টর) মুফতি আবুল কাসেম নুমানী এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, পবিত্র কুরআনের পরিমার্জন ও সংশোধনে বিশ্বাসী ব্যক্তি মুসলিম হতে পারে না। আজ পর্যন্ত এতে কোনো ধরনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়নি। সরকারের কাছে এ ধরনের কটূক্তিমূলক বক্তব্যের প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান।

ন্যাশনাল কনফারেন্সের সভাপতি ড. ফারুক আবদুল্লাহ বলেন, ‘রিজভীর রিট জঘন্যতম অপরাধের শামিল। পবিত্র কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে অবতীর্ণ হয়েছে। তাতে কোনো পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। বিশ্বের অসংখ্য মুসলিমের বিশ্বাসে আঘাত দেয়ায় তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক।’ (The Hindu, March, 18, 2021; The India Express, March,14, 2021).

লক্ষ্ণৌর ইমামবাড়াকেন্দ্রিক শিয়া জনগোষ্ঠী ও ওয়াসিম রিজভীর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং শান্তি মিছিল বের করেছে। ইমামবাড়ায় ওয়াসিম রিজভীর জন্য নির্ধারিত কবরের জায়গার বরাদ্দ বাতিল করা হয়। সৈয়দ ওয়াসিম রিজভী এর আগে বাবরি মসজিদ নিয়ে মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী মন্তব্য করেছিলেন। ইসলামের শত্রুদের শিখণ্ডী রূপে তিনি ভূমিকা পালন করে আসছেন। ভারতের উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যে ভাষায় কথা বলে, রিজভীর ভাষায় এর প্রতিধ্বনি লক্ষ করা যায়। এর নেপথ্যে কোনো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি আছে কি না আগামীতে পরিষ্কার হবে। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, কোনো চক্র বা গোষ্ঠী রিজভীকে সামনে রেখে এ ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেছে। পৃথিবীর কোনো একটি আদালত থেকে আয়াত পরিবর্তনের একটি অর্ডার নিতে পারলে সেটা দিয়ে মুসলমানদের বিব্রত করা ও সংশয়ের কুজ্ঝটিকায় আচ্ছাদিত করা যাবে এবং সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে বলে মনে করা হয়েছে। কিন্তু তাদের এ দুরভিসন্ধি ও চক্রান্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য। পূর্ববর্তী যুগেও আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নাজিলকৃত ঐশীগ্রন্থের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং এর ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা ভীষণ চক্রান্ত করেছিল। কিন্তু তাদের চক্রান্ত আল্লাহ রহিত করেন, যদিও তাদের চক্রান্ত এমন ছিল, যাতে পাহাড় টলে যেত।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত-৪৬)

ভারতের ইতিহাসে কুরআন নিষিদ্ধ করার আবেদন জানিয়ে রিট করার নজির আছে। জনৈক চাঁদমল চোপড়া ১৯৮৫ সালের ১৬ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত দাখিল করেন যাতে কুরআন প্রচার, চর্চা ও মুদ্রণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ২৯ মার্চ তিনি ভারতে কুরআন বন্ধের আবেদন জানিয়ে ভারতীয় পেনাল কোডের ১৫৩এ এবং ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডের ৯৫ সেকশনের অধীনে কলকাতা হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। তার বক্তব্য ছিল- কুরআনের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য আছে এবং কাফিরদের হত্যার নির্দেশ রয়েছে। তখন সারা ভারতে হইচই পড়ে যায়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন এলাকায় মামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের হয় এবং পুলিশের গুলিতে ১২ জন কুরআনপ্রেমী শাহাদতবরণ করেন। আদালত শুনানির প্রথম দিনেই মামলা খারিজ করে দেন। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, ‘কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ বন্ধের এখতিয়ার আদালতের নেই’ (The court cannot set in judgment on a holy book like the Quran, the Bible, the Geeta and the Grantha Sahib.) পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এ মামলাকে A despicable act বলে অভিহিত করেন। পুলিশ মামলার বাদিকে গ্রেফতার করেছিল। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে The Calcutta Quran Petition নামে গ্রন্থ রচিত হয়। লেখক হচ্ছেন সীতারাম গোয়েল।

কিছুদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যক্তি দিনক্ষণ ঘোষণা দিয়ে কুরআন শরিফ পোড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০১০ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার ফ্লোরিডা স্টেটের Christian Dove World Outreach Centre in Gainesville-এর যাজক টেরি জোন্স টুইন টাওয়ার ধ্বংসের প্রতিবাদে ২০০ কপি কুরআন পোড়ানোর ঘোষণা দেন। তার এ ঘোষণা বিশ্বব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভে মানুষ অংশ নেয়। এতে ২০ জন প্রতিবাদকারী প্রাণ হারান। পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র কুরআন পোড়ানোর উদ্যোগের নিন্দা জানিয়ে তা বন্ধ করার দাবি জানায়। জোন্স তখন এ কর্মসূচি বাতিল করে ভবিষ্যতে এ জাতীয় কোনো কর্মসূচি না দেয়ার শপথ নেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়- ২০১১ সালের ২০ মার্চ Gainesville গির্জায় কুরআনের বিচার অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে (Crime against humanity) দোষী সাব্যস্ত করে গির্জার কম্পাউন্ডে কুরআনের কপি ভস্মীভূত করা হয়। এ ঘটনার জেরে আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফ এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতা জাতিসঙ্ঘ সাহায্য মিশন কার্যালয়ে হামলা চালায়। এতে দু’জন মার্কিন সেনাসহ ৩০ জন নাগরিক প্রাণ হারান। পরবর্তীতে টেরি জোন্সের বিচার হয় এবং আদালতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন ও কারাবরণ করেন।

পাঠকের মনে আছে, ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দু’টি মসজিদে ব্রেন্টন হ্যারিসন ট্যারান্ট (২৫) নামক এক সন্ত্রাসী কুরআন তিলাওয়াত ও নামাজরত ৫১ জন মুসল্লিকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা এবং কমপক্ষে ৫০ জনকে আহত করেছে। গুলি করার দৃশ্য সে সরাসরি অনলাইনে সম্প্রচার করে। নিউজিল্যান্ডের সরকার ও জনগণ মুসলমানদের সাথে একাত্মতা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। উগ্রজাতীয়তাবাদ, ইকোফ্যাসিজম, ইসলাম আতঙ্ক, শে^তাঙ্গ আধিপত্য ও বর্ণবাদ এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ। আদালত ঘাতককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন এবং রায়ে উল্লেখ করেছেন, সে কখনো প্যারোলে বাইরে যেতে পারবে না।

এ প্রেক্ষাপটে পবিত্র কুরআনের অনুসারীদের সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, কৌশল, সচেতনতা ও ঈমানী জজবার পরিচয় দিতে হবে। শত বাধা ও শত্রুর কূটজাল ছিন্ন করে পবিত্র কুরআন তার সম্মুখ অভিযাত্রা অব্যাহত রাখবে। আল্লাহ তায়ালার স্পষ্ট ঘোষণা, ‘তারা মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।’ (সূরা আছ-ছফ-৮) নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দুনিয়ার কুরআনপ্রেমীদের সিসার দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখনই সময়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement