২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

শেখ আহমেদ সালাহ জামজুম : বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রসারে অবদান অনেক

শেখ আহমেদ সালাহ জামজুম : বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রসারে অবদান অনেক - ছবি : লেখক

শেখ আহমেদ সালাহ জামজুমের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় প্রফেসর সৈয়দ আলী আশরাফের মাধ্যমে। সৌদি আরবের সবচেয়ে পুরনো বিলিয়নিয়ার জামজুম পরিবার। এই পরিবারের সদস্যরা শিক্ষাদীক্ষায় খুবই অগ্রসর। সালাহ জামজুম নিজেও ডক্টরেট। শেখ আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির তৎকালীন ডিন ছিলেন এই পরিবারের ছেলে। প্রফেসর আশরাফকে আমরা সবাই চিনি। তিনি ছিলেন বিখ্যাত ক্যাম্বিজের ডক্টরেট। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও ইংরেজি বিভাগের প্রধান। এরপর তিনি দেশে না ফিরে কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং সৌদি আরবেই দীর্ঘদিন কাটান। ১৯৭৭ সালে মক্কায় প্রথম মুসলিম বিশ্বের শিক্ষার ওপর বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তার প্রস্তুতি কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন প্রফেসর আশরাফ। এই সম্মেলন করার প্রস্তাবটিও তার ছিল। ওই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সালাহ জামজুম এবং ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুল্লাহ ওমর নাসিফ। কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটি ছিল সম্মেলনের স্পন্সর। ইউনিভার্সিটিকে স্পন্সর হতে রাজি করান সালাহ জামজুম।

ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে সম্মেলনের তহবিল সৌদি সরকারই জোগান দেয়। তখন পাপুয়া নিউগিনিতে অধ্যাপনা করছি এবং পরের বছর কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেই। প্রসঙ্গক্রমে বলা ভালো যে, সালাহ জামজুম ছিলেন কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৬৪ সালে জেদ্দায় এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তহবিল সংগ্রহে শীর্ষস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। প্রথমে এটি ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সালাহ জামজুম ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। তিনি আজীবন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবা করে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের কার্যক্রমে সামনের সারিতে তিনি থাকতেন।

কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেয়ার পর সৈয়দ আলী আশরাফকে আমি সহকর্মী হিসেবে পাই। আমরা দু’জন পাশাপাশি বসতাম। তিনি লন্ডন থেকে ইসলামী শিক্ষার ওপর একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। বইটি স্পন্সর করেছিলেন সালাহ জামজুম। ওই বইয়ে কন্ট্রিবিউট করেছিলাম। প্রফেসর আশরাফ একদিন আমাকে জামজুমের অফিসে নিয়ে যান। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলে জামজুম জানতে চান, আমি টাকা-পয়সার জন্য এসেছি কি না। বললাম, ইয়োর এক্সেলেন্সি, আমি বাংলাদেশী। সবাই তো টাকা-পয়সার জন্যই আসে। তবে আমি সেজন্য আসিনি। এসেছি আপনি যেন ‘ইনভেস্ট’ করেন। তিনি বললেন, কোথায়? আমি বললাম, ‘ইসলামী ব্যাংকে। আমি চাচ্ছি আপনি দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করুন। ক্ষুদ্রঋণ দেয়ার মতো কাজগুলো করতে পারেন।’

সালাহ জামজুম ইংল্যান্ড থেকে এমবিএ করে সৌদি আরবের সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তৎকালীন বাদশাহ সউদ বিন আবদুল আজিজ তখন তরুণ জামজুমকে ডেকে এনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। এক বছর পর বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজের মন্ত্রিসভায় তাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। সালাহ জামজুম হন সৌদি আরবের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী। সেই সূত্রে সৌদির মন্ত্রী হিসেবে তিনি ছিলেন অনেকের সিনিয়র যদিও বয়স ছিল অপেক্ষাকৃত কম। যা হোক, আমার কথা শুনে জামজুম কিছুটা আগ্রহী হন। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অন্যতম উদ্যোক্তা আবদুর রাজ্জাক লশকর তখন তহবিল সংগ্রহের জন্য সৌদি আরব গিয়ে বিভিন্নস্থানে ধরনা দিচ্ছিলেন। আমি তাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছিলাম। তখন ব্যাংকের ‘পেইড আপ ক্যাপিট্যাল’ ছিল মাত্র তিন কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংকের জন্য ঝুঁকি নিয়ে এই টাকা দেয়ার মতো লোক তখন বাংলাদেশে ছিল না। এ ব্যাপারে জামজুমকে উৎসাহিত করি। তিনি এগিয়ে আসেন। পরে ‘থ্রি-সেক্টর মডেল’-এর ভিত্তিতে যখন সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেই, তাতেও তিনি সহায়তা করেছিলেন। ক্ষুদ্রঋণের মতো বিষয়গুলোতে জামজুমের ধারণা ছিল খুব কম। তাকে ‘নন-ফর্মাল সেক্টরে’ ব্যাংক কিভাবে কাজ করতে পারে তা বুঝাই। বলেছি, করপোরেট ব্যাংকিং সবাই বোঝেন; কিন্তু রাস্তার টোকাইকে ব্যাংকিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা। ওই সময় আমার মেয়ে রেশমি অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করত। সে আমার কনসেপ্টের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি তৈরি করে। ‘থ্রি-সেক্টর মডেলের ব্যাংক’ কিভাবে কাজ করবে, তা ডকুমেন্টারিতে তুলে ধরা হয়। তিনি ওমর নাসিফকে ডাকলেন (নাসিফ সম্পর্কে ইতঃপূর্বে এই কলামে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। নাসিফও ডকুমেন্টারিটি দেখেন। চোখে দেখা ও মুখে বলার মধ্যে অনেক তফাৎ। ভিডিও দেখে সালাহ জামজুম বললেন, ঠিক আছে, তুমি আমার বাসায় আসো। সৌদিরা সাধারণত বাড়িতে দাওয়াত করে বিদেশী কাউকে খাওয়ায় না। কিন্তু জামজুমের বাড়িতে আমি অনেকবার খেয়েছি। প্রিন্স মোহাম্মদ ফয়সাল ও আবদুল্লাহ ওমর নাসিফের বাসায় কতবার গিয়েছি, তার হিসাব নেই। তাদের পাশাপাশি ওআইসির তৎকালীন মহাসচিব হামিদ আল গাবিদকে নিয়ে আমরা একটি টিমের মতো হয়ে যাই।

সৌদি এয়ারলাইন্স গঠনের পর সালাহ জামজুমকে এর দায়িত্ব দেন বাদশাহ ফয়সাল। তার নেতৃত্বে সৌদি এয়ারলাইন্স বিশ্বের সেরা এয়ারলাইন্সে পরিণত হয়েছিল। সরকারি দায়িত্ব পালন শেষে তিনি পারিবারিক ব্যবসায় ফিরে যান। মূলত মোটর গাড়ি ও ভারী যন্ত্রপাতির ব্যবসা ছিল তাদের। পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরার পাশাপাশি ইসলামের বিস্তারে দাতব্য কাজে মনোনিবেশ করেন তিনি। তার কাজের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে ছিল ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী অর্থনীতির বিস্তার।

১৯৮০-এর দশকে তার উৎসাহ ও সহযোগিতায় ‘ইসলামিক অ্যাকাডেমি ক্যাম্ব্রিজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বহু বছর এই অ্যাকাডেমির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রফেসর আলী আশরাফ ১৯৮৯ সালে ঢাকায় যে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেন তাতেও সহায়তা করেছেন সালাহ জামজুম ও ওমর নাসিফ। তারা দু’জন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন জামজুম। পরে নাফিসও চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। আমি কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালেই প্রফেসর আশরাফ আমাকে বলেছিলেন, চলুন, দেশে গিয়ে শিক্ষার জন্য কিছু করি। বললাম, না এখন যেতে পারছি না; আপনি যান। তিনি মারা গেলে প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরেন। আমি দেশে আসার পর আমাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। আলী আহসান মারা যাওয়ার পর এটি স্রেফ সার্টিফিকেট বিক্রির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এগুলো দেখে সেখান থেকে সরে আসি।

সালাহ জামজুম বাহরাইনে প্রিন্স মোহাম্মদ বিন ফয়সালের ‘ফয়সাল ইসলামী ব্যাংক’ এবং সুদান, মিসরসহ অনেক দেশে ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। তিনি আমার সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে দেখা করে কথা বলেছেন। আমি যখন এই উদ্যোগ নিয়েছিলাম তখন ব্যাংকের পেইড-আপ ক্যাপিটাল বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ কোটি টাকা। বাংলাদেশে আসার পর তা হয় আট কোটি টাকা। যখন ব্যাংক নিবন্ধনের জন্য যাই, তত দিনে এই অঙ্ক ২০ কোটি হয়ে গেছে। ১৯৯৫ সালে এই বাড়তি তিন কোটি টাকা জোগাড় করাও অনেক কঠিন ছিল। এই তহবিল জোগাড়ে সাহায্য করেন জামজুম। কোনো অনুদান নেইনি বরং তাকে ব্যাংকের অংশীদার করেছি। তার পাশাপাশি, আবদুল্লাহ ওমর নাফিস ও হামিদ আলগাবিদ আমাদের ব্যাংকের স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার হলেন। শুধু তাই নয়, তাদের শেয়ার পরিচালনার জন্য আমাকে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ দিয়েছেন। এ জন্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে তারা ঢাকা পর্যন্ত আসেন। নোটারির সামনে আমমোক্তার নামায় সই করেন। তারা চাইলে দেশের বাইরে বসেই এ কাজটি করতে পারতেন। কিন্তু তারা সেটা চাননি এবং কোম্পানি সেক্রেটারির উপস্থিতিতে কাজটি করেছেন। এখনো আমার ড্রয়ারে তাদের দেয়া সেই ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’র কপি আছে। ২০১০ সালে সালাহ জামজুম মারা যাওয়ার পর এসআইবিএলে তার সব শেয়ার বিক্রি করে নমিনি হিসেবে ছেলে যেন নিয়ে যান সে ব্যবস্থা আমি করেছি। অন্যরাও তাদের শেয়ার বিক্রি করে মুনাফাসহ নিয়ে গেছেন।

সালাহ জামজুমের সুপারিশে তখন সৌদি ভিসা ইস্যু হতো। যে কারো জন্য ভিসা ইস্যু করার ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়েছিল। তার সাথে সাক্ষাতের পর থেকে যতবার সৌদি আরব গেছি, তার কাছ থেকেই ভিসা নিয়ে গেছি। আমার ভিসা তিনি ইস্যু করতেন। তিনি অনেকবার বাংলাদেশে এসেছেন। প্রতিবার তিনি আবদুল্লাহ ওমর নাসিফকে সাথে নিয়ে আসেন। ব্যাংকে তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ব্যাংকের বোর্ড রুমের মিটিংয়ে আমার এক পাশে জামজুম ও অন্য পাশে নাসিফ। এই পরিবেশ আমার মনে যে অনাবিল আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এটা ছিল আমার এক বিশাল প্রাপ্তি। আমি যাদের সাথে কাজ করেছি তারা আমাকে কতটা বেশি ভালোবাসেন। এসব মানুষের সংস্পর্শে আসাটা আমার জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি। ভালোবাসা কিন্তু রেসিপ্রোকাল। আমিও তাদের ভালোবেসেছি। তা না হলে এই প্রতিদান পেতাম না। সৌদিদের একটি বড় গুণ হলো, যদি তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন তাহলে তারা আপনার জন্য জীবন দিয়ে দেবেন। এটা বেদুইন সংস্কৃতির একটি অংশ। আমাদের দেশে ঠিক উল্টো; যা বলে তা করে না। যা করে তা বলে না। কোনো সৌদি যদি বলে যে, সে আপনাকে সাহায্য করবে, তাহলে করবেই। আর করতে না চাইলে বলবে, ‘মাশাআল্লাহ, বোখরা’। এই ‘বোখরা’ শব্দের মানে, কালকে দেখা যাবে। তখন বুঝে নিতে হবে কাজটি হচ্ছে না। কোনো কাজের জন্য গেছেন, আর সৌদি বলে দিলো ‘বোখরা’। আপনাকে বুঝে নিতে হবে কাজটি সে করবে না। কাউকে না বলার সৌদি রীতি এটি।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মুভমেন্টে শেখ আহমেদ জামজুমের অবদান অনেক বেশি। তিনি সত্যিকারের দরদি মন নিয়ে মানবতার সেবা করে গেছেন। সে কারণেই তাকে স্মরণ করি। মানুষ হিসেবে কেউ এত ভালো হতে পারেন, তা এদের না দেখলে বুঝা যায় না। আল্লাহ তায়ালা হয়তো সময়ে সময়ে এমন লোকদের দুনিয়ায় পাঠান। আমরা এই দুনিয়ার ক্ষণিকের নশ্বর জীবন নিয়ে খুব কমই ভাবি। মানুষের ওপর জুলুম, অত্যাচার করাই যেন আমাদের ধ্যানজ্ঞান। মানব উন্নয়ন না হলে শুধু দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে সত্যিকারের উন্নয়ন হয় না। শোষণ, বৈষম্য, দুর্নীতির বিস্তার কি উন্নয়নের মাপকাঠিতে নিয়ে আসা যায়? মানব উন্নয়ন মানে নৈতিকতার উন্নয়ন, সহানুভূতির উন্নয়ন। দেশে দেশে এমন কিছু মানুষ থাকলে এই বিশ্ব অনেক বেশি শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠত মানুষের দুর্দশা লাঘব হতো। আমাদের দেশেও যদি থাকত, তাহলে ‘সোনার বাংলা’ না হোক, অন্তত একটি দরদি সমাজ কায়েম হতো।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement