১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

পরিসংখ্যান, না পরি’র সংখ্যা?

পরিসংখ্যান, না পরি’র সংখ্যা? - ফাইল ছবি

কথায় বলে, “বহু পরিকল্পনার ‘পরি’ (বা পরী) আকাশে উড়িয়া যায় আর কল্পনাটি মাটিতে পড়িয়া থাকে।” এখন দেখা যাচ্ছে, বিশেষত সরকারি পরিসংখ্যানের পরি উড়ে যায় আর সংখ্যাটা পড়ে থাকে। সন্দেহটা আগে থেকে ছিল যা দিন দিন বেড়েছে। এমনকি, সে সন্দেহ খোদ কৃষিমন্ত্রীর। কারণ তিনি বাস্তবতার সাথে হিসাব মিলাতে পারছেন না। মন্ত্রী শুধু কৃষি বিভাগের দায়িত্বই পাননি। তিনি একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী কৃষি বিশেষজ্ঞও। টাঙ্গাইলের উত্তরাঞ্চলের এই সন্তান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। তার একটি বক্তব্যে সেই পুরনো ইস্যু ফিরে এসেছে। তা হলো- আমাদের দেশে বিশেষ করে প্রশাসনের পরিসংখ্যান কতটা গ্রহণযোগ্য? রাজনৈতিক কিংবা অপরাধের বিষয়ে সরকারের দেয়া পরিসংখ্যান নিয়ে অনেক আগে থেকেই নানা প্রশ্ন। এবার স্বয়ং কৃষিমন্ত্রী কৃষি খাতের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিসংখ্যান প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে যে কথা বলেছেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ।

২৮ ফেব্রুয়ারি একটি ইংরেজি দৈনিকের ‘বিজনেস’ বিভাগে কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য উঠেছে। শিরোনাম- Agri minister doubts rice and potato statistics (কৃষিমন্ত্রী চাল ও আলু সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের ব্যাপারে সন্দিহান)। এ খবরে উল্লেখ করা হয়, কৃষিমন্ত্রী মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক দেশে চাল ও গোলআলু উৎপাদনের পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দিহান। তিনি বলেছেন, দেশের প্রধান খাদ্যশস্য আর কন্দ ফসলটি ফলন বেশি হলেও এগুলোর দাম চড়া। মন্ত্রীর ভাষায়, কৃষি ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ডাটা অতীব প্রয়োজনীয়। নানাজাতীয় শস্যের উৎপাদন ও চাহিদার বিষয়ে সঠিক তথ্য থাকলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সহজ ও সুন্দর হয়। মন্ত্রী রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছিলেন। উপলক্ষ ‘জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস’। অর্থাৎ, খোদ পরিসংখ্যানবিষয়ক জাতীয় দিবসে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা যে প্রধান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, তাতেই কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিষয়ক পরিসংখ্যান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন।

একটি পত্রিকা জানায়, কৃষিমন্ত্রীর এ বক্তব্য এমন সময়ে এলো যখন ভোক্তা জনগণকে বাজারে সরবরাহ সঙ্কটের দরুন প্রতি কেজি আলু কিনতে হলো ৫০ টাকা দিয়ে! অপর দিকে, সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর দাবি করেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে গোলআলু উৎপন্ন হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ টন, যা আগের বছরের চেয়ে বেশি।

এ অবস্থায় কৃষিমন্ত্রীকে বলতে হয়েছে, ‘আমার মনে হয় শস্য উৎপাদন, সংশ্লিষ্ট জমির পরিমাণ এবং একরপ্রতি ফলনের যে তথ্য, তা সঠিক নয়। তাই পরিসংখ্যান হতে হবে সঠিক তথ্যনির্ভর।’

পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা যেন নির্ভরযোগ্য ও মানসম্মত পরিসংখ্যানের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, সেজন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। বাস্তবসম্মতভাবে সংগ্রহ করে, প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করতে বলেছেন তিনি। খামারে উৎপাদনের ব্যাপারে পাশ্চাত্যের পদ্ধতিগুলো মূল্যায়ন করা উচিত বলে তার অভিমত।

একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সঠিক পরিসংখ্যানের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত পরিসংখ্যানের যথার্থতা নিয়ে গুরুত্ববহ প্রশ্ন তুলেছেন। এর আগে কোনো কোনো মন্ত্রী সরকারের দেয়া পরিসংখ্যানকে জোরালো সমর্থন দিয়ে বেসরকারি পরিসংখ্যানের সমালোচনা করেছেন। তবে সাধারণত প্রশাসনের দেয়া পরিসংখ্যান ‘ঘষামাজা’ করা হয়েছে বলে অনেকে অভিযোগ করে থাকেন।

গোলআলু নিয়ে মন্ত্রীর প্রশ্ন করা স্বাভাবিক ও যথার্থ। কারণ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) কর্তৃক প্রদত্ত হিসাব মতে, যদি আগের বছরের চেয়ে আলুর উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে, তাহলে কেন বাজারে আলুর ‘অভাব’ ও অগ্নিমূল্য?

এ অবস্থায় মনে পড়বে বিখ্যাত নাসিরুদ্দীন হোজ্জার (চীনে ‘এফেন্দি’ এবং অন্যত্র ‘নাসরুদ্দীন’ নামেও পরিচিত) সে কাহিনী। বাজার থেকে কিছু গোশত কিনে এনে ঘরে রেখেছিলেন হোজ্জা। বউ তা রান্না করার পর চেখে দেখতে গিয়ে পুরো খেয়ে ফেললেন নিজেই। হোজ্জা বাড়ি ফিরে সে গোশতের খোঁজ নিলে স্ত্রীর সাফ কথা- ‘গোশত তো ঘরের বিল্লিটা খেয়ে ফেলেছে।’ হোজ্জা দমবার পাত্র নন। তিনি বিড়ালটাকে ধরে এনে গোশতের জন্য ওজন করে দেখেন, খেয়ে ফেলা গোশতের চেয়ে বিড়ালের ওজন কম। তাই তার বিস্ময় : অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে গোশতের ওজন বিড়ালের তুলনায় বেশি হওয়ার কথা নয়। কারণ বিড়ালের ওজন আড়াই কেজি আর গোশত ছিল তিন কেজি। তিনি বললেন, ‘এটা যদি বিড়াল হয়ে থাকে, গোশত গেল কই? আর এটা গোশত হয়ে থাকলে বিড়ালটা গেল কোথায়?’ এর জবাব দিতে হবে তার স্ত্রীকে। তেমনি কৃষির সঠিক পরিসংখ্যানের দায় নিতে হবে দেশের কৃষি বিভাগকে।

পরিসংখ্যান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা সঠিক না হলে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝা যায় না। পরিকল্পনায় ভুল হবে তখন। পরিসংখ্যান ঠিক থাকলে এর ভিত্তিতে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ ভুল হতে পারে না। তখন পরিকল্পনা হবে যথার্থ ও বাস্তবসম্মত। তাই সংখ্যা নিছক ‘সংখ্যা’ই নয়, অনেক কিছু।

কয়েক দিন আগে একটি পত্রিকায় জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে বনাঞ্চল কমতে কমতে মোট ভূমির মাত্র ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। থাকার কথা ২৫ শতাংশ। আসলে কাগজকলমে হিসাব হয়তো ঠিকই রয়েছে। কিন্তু বনগুলোর ভেতরের অবস্থা কী? ভেতরটা ফাঁকা করে দেয়া হয়েছে। অবাধে বৃক্ষ কর্তনসহ নির্বিচারে বনজসম্পদ উজাড়ের পরিণতি এটা। বন বিভাগের দুর্নীতি প্রবাদপ্রতিম। তাই দেশে বনের প্রকৃত পরিসর যথাযথভাবে নির্ধারণ করা জরুরি। অন্যথায় পরিকল্পনা হবে অবাস্তব। এর ভিত্তিতে সঠিক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়। তাই সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যানকে হতে হবে বাস্তবসম্মত। না হয়, জনগণের টাকা জলে ঢালা হবে ভুল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে।

শিক্ষার বেলায়ও একই কথা। নিছক ‘সাক্ষরতা’ আর শিক্ষা অর্জন করে ‘শিক্ষিত’ হওয়া মোটেও এক নয়। ‘সাক্ষর’, মানে Literate হওয়ার অর্থ- নিজের নাম সই করতে বা লিখতে পারা। আমাদের দেশে অক্ষরজ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও অর্থাৎ ‘ক অক্ষর গো-মাংস’ হয়েও কথিত সাক্ষর হওয়ার নজির আছে। তা বলে তাকেও অন্তর্ভুক্ত করে দেশে শিক্ষা বা শিক্ষিতের হার বেশি দেখানো যায় না। সরকার বাংলাদেশে শিক্ষার যে উচ্চহার মাঝে মাঝে প্রকাশ করে থাকে, তা ক’জন বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন? সত্যিকার শিক্ষিত লোকের লম্বালেজের মতো কোনো ডিগ্রি না থাকলেও তিনি অনেক বিষয়েই হয়তো জ্ঞানী হতে পারেন। যেমন- একবার শ্রীলঙ্কার একজন ফল দোকানদারকে (যিনি মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছেন) Fluently ইংরেজি বলতে দেখেছি। তার মতো মানুষরা শিক্ষিত। অথচ আমাদের দেশে এমন লোকও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হয়ে যান, হয়তো যিনি মাতৃভাষায় লিখতে গিয়েও ভুল করে বসেন। তাই শিক্ষিতের প্রকৃত পরিসংখ্যান প্রকাশ করা উচিত। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে তা বাড়িয়ে দেখানো অনুচিত।


আরো সংবাদ



premium cement