২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনা-পরবর্তী ভয় ফুসফুসের ফাইব্রোসিস!

করোনা-পরবর্তী ভয় ফুসফুসের ফাইব্রোসিস! - ছবি : সংগৃহীত

করোনা মহামারী বিশ্বব্যাপী তার থাবা গুটিয়ে আনছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারির আগের এক সপ্তাহে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ১৬ শতাংশ কমেছে। মৃত্যুর হারও ১০ শতাংশ কমেছে। বিশ্বের ছয়টি অঞ্চলের মধ্যে পাঁচটি অঞ্চলে করোনার সংক্রমণ কমতির দিকে। আফ্রিকায় সংক্রমণ কমেছে ২০ শতাংশ, ইউরোপে ১৮ শতাংশ, আমেরিকায় ১৬ শতাংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১৩ শতাংশ। তবে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে ৭ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বলেন, আশার কথা, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসার হার পাঁচ সপ্তাহ ধরেই দেখা যাচ্ছে।

জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও ওয়ার্ল্ডোমিটারসের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, করোনা মহামারীতে বিশ্বে এতে আক্রান্তের সংখ্যা এখন সাড়ে ১১ কোটি। করোনায় বিশ্বে মৃতের সংখ্যা সাড়ে ২৫ লাখ। গত ১০০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী এত বড় স্বাস্থ্য সঙ্কট আর দেখা যায়নি। করোনা মহামারীর কারণে পঞ্চাশ ও ষাটোর্ধ্ব একটি প্রজন্মকে আমরা হারিয়ে ফেলছি। করোনায় নারীর তুলনায় পুরুষ আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, করোনায় পুরুষের মৃত্যু ৭১ শতাংশ ও নারীর ২৯ শতাংশ।

বাংলাদেশে করোনায় শনাক্তের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ। মৃত্যু ৮ হাজার ছাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী করোনা থেকে সুস্থ হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ৯ কোটি। আর বাংলাদেশ প্রায় পাঁচ লাখ। অর্থাৎ করোনায় বিশ্বে গড়ে সুস্থতার হার ৭৮.৩৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ৯০.৬৮ শতাংশ। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষের। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘এ মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হৃদয়বিদারক’।

দেশে দেশে এখন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বা টিকা দেয়া হচ্ছে। ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন, স্পুটনিক-ভি এবং সিনোভ্যাকের টিকাদান চলছে। বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে ৩০ লাখ মানুষকে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘ কোভিশিল্ড’ টিকা দেয়া হয়েছে এবং টিকাদান অব্যাহত আছে।

এ টিকা নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক গেব্রেয়াসুস সমালোচনা করেছেন যে, মাত্র ১০টি দেশ সব টিকার ৭৫ শতাংশ দখল করে রেখেছে। বিশ্বের ১৩০টি দেশ এখনো টিকার একটি ডোজও পায়নি। সমানভাবে টিকা সরবরাহ কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। রয়টার্স রিপোর্ট করেছে- অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ যারা নিয়েছেন, তাদের হাসপাতালে যাওয়ার ঝুঁকি ৯৪ শতাংশ কমে গেছে। আর যারা ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নিয়েছেন, তাদের হাসপাতালে যাওয়ার ঝুঁকি কমেছে ৮৫ শতাংশ। এছাড়া খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার এক ডোজই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

করোনা মহামারী কমতির দিকে। করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার হারও বাড়ছে। অন্য দিকে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়ার পর করোনা মহামারী পুরোপুরি অবসানেরও প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। তবুও নানা শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার নতুন শঙ্কা
করোনার সংক্রমণ কমে আসার খবরটি আশাবাদের সৃষ্টি করলেও করোনার দীর্ঘমেয়াদে জটিলতা চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। পোস্ট কোভিড-১৯ কমপ্লিকেশন বা করোনা-পরবর্তী নানা জটিলতা নিয়ে ভুগছেন করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীরাও। দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার পরও দুর্বলতা কাটছে না। কারো শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট, কারো অস্থি বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, বুকে ব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড়, ঘুমের সমস্যা, পেটের সমস্যা কিংবা অ্যালার্জি হচ্ছে। অনেকে কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠে আচমকা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা অন্য কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। অনেকে মানসিক অবসাদে ভুগছেন, স্মৃতিভ্রমের মতো সমস্যা হচ্ছে। ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে। নতুন করে দেখা দিচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমদ এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন জানান, করোনা আক্রান্তদের সুস্থ হওয়ার পরও নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এ জন্য হাসপাতালে পোস্ট কোভিড-১৯ ফলোআপ সেবা চালু করা হয়েছে।

কোভিড-১৯ চিকিৎসার সাথে জড়িত দেশের বেশ কয়েকজন বক্ষব্যাধি, শ্বাসরোগ, অ্যাজমা রোগ বিশেষজ্ঞ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ জানান, করোনাভাইরাস খুবই খারাপ একটি রোগ। আর পাঁচটা সাধারণ ভাইরাস রোগের মতো এটি নয়। কোভিড-১৯ প্রাথমিকভাবে ফুসফুসকে আক্রমণ করে থাকে। কিন্তু ফুসফুসই কেবল এর লক্ষ্য নয়। হৃদযন্ত্র এবং মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। এই ভাইরাস শরীরে প্রধান অঙ্গগুলোকে অকেজো করে দিতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ফুসফুসের। ভাইরাসটির সংক্রমণে ফুসফুসের প্রাকৃতিক টিস্যু নষ্ট হয়ে সেখানে তৈরি হচ্ছে ফাইব্রাস টিস্যু। সঠিকভাবে চিকিৎসা না হলে এই ফাইব্রাস টিস্যু চিরস্থায়ী হয়ে ফুসফুসকে একেবারে দুর্বল করে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোভিড নিউমোনিয়ায় ফুসফুসের ভেতরে থাকা ছোট ছোট বায়ুথলি বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশির ভাগ সময় প্রায় সম্পূর্ণ সেরে উঠলেও অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত স্থানের বিস্তৃতি বেশি হলে সমস্যা তৈরি হয়। একে ‘লাং ফাইব্রোসিস’ বলা হয়। কোভিড সেরে যাওয়ার কয়েক মাস পরও ফুসফুসের সিটি স্ক্যান পরীক্ষায় ফাইব্রোসিস বা ফুসফুসের কলা শক্ত হয়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।

চিকিৎসকরা জানান- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ, কিডনি রোগের মতো সমস্যা আছে যাদের, করোনার প্রভাবে তাদের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে আরো গুরুতর। একইভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অবস্থায় দীর্ঘ সময় যাদের হাসপাতালে থাকতে হয়েছে, যাদের নিউমোনিয়া বা অক্সিজেন সমস্যা হয়েছে, আইসিইউতে বা ভেন্টিলেটরে থাকতে হয়েছে, তাদের হাসপাতাল ছাড়ার পর এ সমস্যা বেশি হচ্ছে। কোভিড থেকে সেরে ওঠার পরও বিভিন্ন পরীক্ষায় হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন ক্ষতি দেখা যায়। দ্রুত হৃদস্পন্দন, হার্ট ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাকসহ হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিচ্ছে।

চিকিৎসকরা জানান, যারা হার্টের মায়োকার্ডাইসিস বা ফুসফুসের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তারা পরবর্তী পর্যায়ে বেশি সমস্যা মোকাবেলা করছেন। অল্পতেই তারা হাঁপিয়ে উঠছেন বা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে যাদের নিউমোনিয়া ৩০ শতাংশের বেশি ছিল এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগে যারা আক্রান্ত তাদের পোস্ট কোভিড বা করোনা-পরবর্তী লাং ফাইব্রোসিস বা ফুসফুসের ফাইব্রোসিস বেশি হচ্ছে। আরেকটি গ্রুপের রোগী যাদের হাইপারইমিউন রি-অ্যাকশন, বেশি বেশি সাইটোকাইন রিলিজ হয় তাদের ‘সাইটোকাইন স্টর্ম’ হচ্ছে। তাদের করোনাভাইরাসকে মারার পাশাপাশি নিজ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির ফলে নিউমোনিয়া দীর্ঘায়িত এবং হার্টের মায়োকার্ডাইসিস হয়। ফলে তারা দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টে ভোগেন।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে শরীরে সাইটোকাইন উৎপন্ন হয়। এ সময় ভাইরাসের তুলনায় যদি সাইটোকাইন বেড়ে যায়, তখনই নানা সমস্যা তৈরি হয়ে থাকে। অনেকের করোনা সেরে গেলেও সাইটোকাইন উৎপাদন হতে থাকে। তার থেকেও নানা সমস্যা হতে থাকে। এর ফলে ফুসফুস, মস্তিষ্ক, যকৃতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফুসফুসে সাইটোকাইন উৎপাদন বেড়ে গেলে রোগীর শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি হবে। কিডনিতে বেড়ে গেলে কিডনির সমস্যা হবে। মস্তিষ্কে বেড়ে গেলে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাবে। কোভিডের কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক), খিঁচুনি, গুলেনবারি সিনড্রোমসহ অন্যান্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া কোভিডের কারণে দেহের বিভিন্ন রক্তনালীতে রক্তজমাট বাঁধার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ জন্য ‘পোস্ট কোভিড কেয়ার’ খুবই জরুরি।

ফুসফুসের ফাইব্রোসিস বেশি হচ্ছে
দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চীনের উহানে শুরুর দিকে করোনাভাইরাস নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২৬ শতাংশ রোগীর নিবিড় চিকিৎসা বা আইসিইউতে থাকা প্রয়োজন হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৬১ শতাংশেরই ‘এআরডিএস’ হয়েছে। ফুসফুসের বাতাস চলাচলের যে ক্ষুদ্র থলিগুলো আছে যাকে ‘অ্যালভিওলাই’ বলে তাতে তরল পদার্থ তৈরি হলে বলা হয় ‘এআরডিএস’ হয়েছে। এটা রক্ত প্রবাহে অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং অঙ্গগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ হতে দেয় না। এর ফলে অঙ্গ বিকল হয়ে যায়। এটা পালমোনারি ফাইব্রোসিস বা ফুসফুসে ক্ষত সৃষ্টির প্রাথমিক লক্ষণ বলে চিকিৎসকরা চিহ্নিত করেছেন। গত মার্চে চীনে চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, করোনা থেকে সেরে ওঠা ৭০ জন রোগীর মধ্যে ৬৬ জনেরই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ফুসফুসের এ ধরনের নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে।

করোনার শুরুর দিকে ব্রিটেনের একজন ট্যাক্সিচালক অ্যান্থনি ম্যাকহিউ ভাইরাসে প্রচণ্ড আক্রান্ত হয়ে ১৩ দিন ভেন্টিলেটরসহ হাসপাতালে চার সপ্তাহ ছিলেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে তিনি ছিলেন আরো দুই সপ্তাহ। বুকের সিটিস্ক্যান করে দেখা গেছে, তার দুটি ফুসফুসের ওপরই একটা সাদা কুয়াশার আস্তরণ তৈরি হয়েছে যা দেখতে অনেকটা ভাঙা কাঁচের মতো। এরপর ব্রিটেনে করোনায় গুরুতর আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছেন এমন এক হাজার মানুষকে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা, তাদের ফুসফুস চিরকালের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষায় দেখা যায়, অনেকেরই ফুসফুসেই ক্ষতের লক্ষণ স্পষ্ট। ব্রিটেনের রেডিওলজিস্ট ড. হেয়ার বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া ২০ থেকে ৩০ শতাংশ রোগীর ফুসফুসেই ক্ষত তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, সেরে ওঠার ছয় সপ্তাহ পর যেসব রোগীর ফুসফুসের স্ক্যান আমরা দেখেছি তা থেকে বোঝা যাচ্ছে করোনাভাইরাসের মারাত্মক সংক্রমণ থেকে ফুসফুসে বা অন্যান্য অঙ্গে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে তাতে মানুষকে দীর্ঘমেয়াদে এ ভাইরাস পঙ্গু করে দিয়েছে। ব্রিটেনের স্বাস্থ্য গবেষণাবিষয়ক জাতীয় ইনস্টিটিউটের গবেষক অধ্যাপক জিসলি জেনকিন্স বলেন, আমাদের জীবদ্দশায় এর আগে একই সাথে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের ফুসফুসে এ ধরনের আঘাত হতে দেখিনি।

ইন্ডিয়ান চেস্ট সোসাইটির প্রকাশিত মেডিক্যাল জার্নালে ডা: জাকির এফ উদোয়াদিয়া জানান, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগ রোগীই বেশি কাবু হচ্ছেন করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর। আগে মারাত্মক নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীদের মাঝে মধ্যে এ সমস্যা দেখা যেত। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে পালমোনারি ফাইব্রোসিস এখন পরিচিত নাম। সিটি স্ক্যানে ধরা পড়ছে ফুসফুসের এই ভয়ঙ্কর চিত্র।

‘ফাইব্রোসিস’ হলো ফুসফুসের নরম কোমল তন্তু বা কোষ বা টিস্যু শক্ত হয়ে যাওয়া; অর্থাৎ ফুসফুসের বাইরে কঠিন আস্তরণ পড়ে যাওয়া। এতে ফুসফুসের স্বাভাবিক সঙ্কোচন-প্রসারণ বাধা পায়। এ সমস্যা নিয়ে হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছেন অসংখ্য রোগী। ঢাকার বিএসএমএমইউ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ যেসব হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন, তাদের অনেকের মধ্যেই পালমোনারি ফাইব্রোসিস বা ফুসফুসের ফাইব্রোসিস হতে দেখা গেছে। যারা দীর্ঘদিন আইসিইউতে ছিলেন বা অনেকটা সময় যাদের হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার মাধ্যমে অক্সিজেন নিতে হয়েছে বা ভেন্টিলেটরে ছিলেন, তাদের মধ্যে এই সমস্যা প্রকট। বেশি অক্সিজেনও অনেক সময় ফুসফুসকে এভাবে অকেজো করে দেয়। এমন সমস্যা নিয়ে অসংখ্য রোগী প্রতিদিন ঢাকায় শ্বাসরোগ বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

ন্যাচার পদ্রিতার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জটিল করোনা থেকে মুক্তি পাওয়া রোগীদের ২০-২৫ শতাংশ রোগী ফুসফুসের ফাইব্রোসিস সমস্যায় ভুগছেন। ফাইব্রোসিসে আক্রান্তরা একটু হাঁটলে ক্লান্তিবোধ করেন। সামান্য পরিশ্রম করলেই হাঁপিয়ে উঠছেন। হাসপাতালে বুকের সিটি স্ক্যান করে দেখা যাচ্ছে, তাদের ফুসফুসের কোমল তন্তু ও অ্যালভিওলি যা রক্ত সংবহন করে সেটা শক্ত হয়ে গেছে। ফুসফুস সহজে কাজ করছে না। ফুসফুস বেলুনের মতো সঙ্কুচিত-প্রসারিত হচ্ছে না।

শ্বাসের ব্যায়াম অপরিহার্য
ফুসফুসের ফাইব্রোসিস বা ফুসফুসের দেয়াল মোটা হয়ে যাওয়া সরানো যায় না। কারণ এর কোষ একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা চিরস্থায়ী হতে থাকে। ফুসফুসের ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে নিঃশ্বাস নেয়া কষ্টকর হয়। ফলে ভবিষ্যতে অন্যান্য ধরনের ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ারও ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। তাই চিকিৎসকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থাকার পাশাপাশি রোগীদের শ্বাসের ব্যায়াম বা ব্রিদিং এক্সারসাইজ দিনে কয়েকবার করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। শ্বাসের ব্যায়ামের ক্ষেত্রে বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়া ও ছাড়া অর্থাৎ নাক দিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে পেটে দশ সেকেন্ড ধরে রেখে মুখ দিয়ে ছাড়া। আবার এক নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে নাকটি বন্ধ রেখে অন্য নাক দিয়ে ছাড়া। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এই ব্যায়ামকে ‘প্রাণায়ম’ ও ‘নাসায়ন’ বলে উল্লেখ করেছে। সুস্থ মানুষেরও এটি করা খুব জরুরি। এতে শরীরে অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা বেড়ে যায়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক


আরো সংবাদ



premium cement