২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গোলওয়ালকার এবং এক মন্ত্রীর টুইট

গোলওয়ালকার এবং এক মন্ত্রীর টুইট - ফাইল ছবি

এমএস গোলওয়ালকার। ছিলেন ভারতের হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ) প্রথম সঙ্ঘ পরিচালক হেডগেওয়ারের পর দ্বিতীয় সঙ্ঘ পরিচালক বা প্রধান। তিনি পরিচিত বড় মাপের এক হিন্দুত্ব আইডিওলগ। তার সময়ে ছিলেন আরএসএসের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। তার নানাধর্মী বিতর্কিত মন্তব্য রয়েছে ভারতীয় রাজনীতি ও ধর্ম সম্পর্কে। তিনিই প্রথম তুলে ধরেন ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ নামের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার ‘রাজীব গান্ধী সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি’র দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নাম দিয়েছে গোলওয়ালকারের নামানুসারে। এই নামকরণের প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এবং কংগ্রেস। কারণ- রাজনৈতিক দল দুটি মনে করে, তিনি উগ্র সাম্প্রদায়িক। তিনি ভারতে ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মকে বিবেচনা করতেন বিদেশী ধর্ম হিসেবে। তার মনে, খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা ভারতের স্বাভাবিক নাগরিকত্ব পেতে পারে না। ভারত নামের হিন্দুরাষ্ট্র কেবলই হিন্দুদের জন্য। তীব্র সমালোচনা আছে- তিনি বর্র্ণবাদের গোঁড়া সমর্থক, নারীর বিপরীতে পুরুষের প্রাধান্যের নীতিতে বিশ্বাসী, হিন্দুত্ববাদের অন্ধ ভক্ত, স্বভাবগতভাবে মিথ্যাবাদী, ভারতের সংবিধানসম্মত ধর্মনিরপেক্ষ-গণতন্ত্রবাদী জাতীয় রাজনীতির প্রবল সমালোচক। একই সাথে ভারতে নাৎসিবাদ কায়েমের অন্যতম সমর্থক। সমালোচকদের এসব দাবির পেছনে যৌক্তিক বহু কারণ রয়েছে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ও আরএসএস মনে করে- ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে গোলওয়ালকারই হবেন দেশের নয়া ‘জাতির পিতা’!

গোলওয়ালকার মারা যান ১৯৭৩ সালে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ছিল তার ১১৪তম জন্মবার্ষিকী। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম মোদি সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী প্রহলাদ সিং প্যাটেল ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের যাবতীয় রাষ্ট্র্রীয়নীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই জন্মবার্ষিকীর দিনে এক টুইট বার্তায় গোলওয়ালকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তার এই টুইট বার্তা বিজেপি ও আরএসএসের নেতাকর্মীদের উৎফুল্ল করলেও, এর বাইরে থাকা গোটা ভারতীয়দের নিশ্চিত ক্ষুব্ধ করেছে। মন্ত্রী প্রহলাদ সিং প্যাটেল টুইট বার্তায় দাবি করেন, ‘গোলওয়ালকার একজন গ্রেট থিঙ্কার, স্কলার ও একজন রিমার্কেবল লিডার’ হিসেবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ‘প্রেরণার ও দিকনির্দেশনার উৎস’ হয়ে থাকবেন। কিন্তু মন্ত্রীর নিয়োগ পেয়ে তিনি শপথে অবশ্যই ঘোষণা দিয়েছিলেন ভারতের ‘গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ’ আদর্শভিত্তিক সংবিধান মেনে চলবেন। তাই প্রশ্ন উঠেছে- তাহলে মন্ত্রিত্বের শপথ অনুষ্ঠানে তিনি কি অসত্য উচ্চারণ করেছিলেন? কিংবা গোলওয়ালকারের ভূয়সী প্রশংসায় নেমে তিনি কি তার শপথ ভঙ্গ অথবা ভারতীয় সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন? তবে এরই মধ্যে এমন কথা ছড়িয়ে পড়েছে- হিন্দুত্ববাদীরা তাদের আরাধ্য স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর গোলওয়ালকারকেই জাতির পিতার আসনে বসাতে চায়! সঙ্গত কারণে গোলওয়াকারের পরিচয় এ লেখায় তুলে ধরা হলো। তার প্রকৃত পরিচয় পেতে আরএসএসের নিজস্ব আর্কাইভই যথেষ্ট।

প্রথমত, গোলওয়ালকার বরাবরই ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক রাজনীতির ওপর কালিমা লেপন করে গেছেন। আরএসএস ১৯২৫ সালে গঠিত হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক স্বাধীন ভারত’ প্রতিষ্ঠার স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতার জন্য। সব ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ এক ভারত গড়ায় ছিল গোলওয়াকারের চরম বিতৃষ্ণা। তিনি গভীরভাবে ঘৃণা করতেন ভারতের ত্রিরঙ্গা পতাকা। ১৯৪৬ সালের ১৪ জুলাই নাগপুরে এক গুরুপূর্ণিমা সমাবেশের ত্রিরঙ্গা পতাকার বিরোধিতা করে ভাষণে তিনি বলেছিলেন : ‘স্যাফ্রন ফ্ল্যাগ’ (জাফরানি রঙের পতাকা) সামগ্রিকভাবে ইন্ডিয়ান তথা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। এটি ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি। আমরা বিশ্বাস করি শেষ পর্যন্ত পুরো জাতি একদিন এই স্যাফ্রন পতাকার নিচে মাথা নত করবে।’

অন্যদিকে ভারত স্বাধীন হলে ‘ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’ ভারতের জাতীয় পতাকা হিসেবে ত্রিরঙ্গা পতাকাকেই গ্রহণ করা হয়, যা আজো বহাল আছে। তখন আরএসএসের ইংরেজি মুখপত্র ‘অরগানাইজার’-এর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সংখ্যায় এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে লেখা হয় : ‘যারা ভাগ্যের জোরে আজ ক্ষমতায় আসীন, তারা আমাদের হাতে ত্রিরঙ্গা পতাকা তুলে দিতে পারেন, কিন্তু হিন্দুরা কখনোই তা নিজের বলে মেনে নেবে না এবং এই পতাকার প্রতি সম্মান দেখাবে না।’ ‘তিন’ শব্দটি নিজেই একটি দুষ্ট শব্দ, আর পতাকায় ‘তিন রঙ’ নিশ্চিতভাবে সৃষ্টি করবে একটি মন্দ মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব এবং দেশের জন্য আঘাত।’

আরএসএসের মতে, ভারতীয় জাতীয় পতাকাকে হিন্দুরা কখনোই সম্মান দেখাতে পারে না। এটি একটি অশুভ সঙ্কেত ও দেশের জন্য একটি আঘাতস্বরূপ। স্বাধীনতা লাভের পরও সংগঠনটি এটিকে জাতীয় পতাকা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। গোলওয়ালকার ত্রিরঙ্গা পতাকাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করে তার লেখা বই ‘বাঞ্চ অব থটসে’ ‘ড্রিফিটং অ্যান্ড ড্রিফিটং’ শীর্ষক রচনার এক জায়গায় উল্লেখ করেন : ‘আমাদের নেতারা আমাদের দেশের জন্য একটি পতাকা নির্ধারণ করেছেন। তারা কেনো এমনটি করলেন? এটি ঠিক একটি ‘ড্রিফটিং অ্যান্ড ইমিটেটিং’ (উদ্দেশ্যহীন ভেসে চলা কৃত্রিম) বিষয় ... আমাদের জাতি গৌরবজনক অতীত সমৃদ্ধ এক প্রাচীন ও মহান জাতি। অতীতে কি আমাদের কোনো পতাকা ছিল না? হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের কি জাতীয় প্রতীক ছিল না? নিঃসন্দেহে ছিল। তাহলে আমাদের মনে কেন এই চরম রিক্ততা, এই নিরেট শূন্যতা?’

দ্বিতীয়ত, গোলওয়ালকার গণতন্ত্রকে দেখেছেন ঘৃণার চোখে। আরএসএস গণতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অব্যাহতভাবে দাবি করেছে, ভারত শাসিত হবে একটি টোটালিটারিয়ান তথা সমগ্রবাদী সরকারের অধীনে। অর্থাৎ দেশ শাসিত হবে একটি মাত্র দল দিয়ে, এর বাইরে ভিন্ন কোনো দল দিয়ে নয়। ১৯৪০ সালে ১৩৫০ জন শীর্ষস্থানীয় আরএসএস ক্যাডারের সামনে বক্তব্য রাখার সময় গোলওয়ালকার ঘোষণা দেন : ‘আরএসএস এই মহান ভূমির প্রতিটি কোণায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার এক পতাকা (স্যাফ্রন), এক নেতা, হিন্দুত্বের আলোকে আলোকিত এক আদর্শ।’ এক পতাকা, এক নেতা, এক আদর্শ’- এই স্লোগান সরাসরি ধার করে আনা হয়েছে নাৎসি কর্মসূচি এবং ইউরোপের ফ্যাসিবাদী দলগুলো থেকে।

তৃতীয়ত, ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের অভিমত- সংবিধানের ফেডারেল কাঠামো হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতির এক মৌল বৈশিষ্ট্য। আরএসএসের পুরোপুরি বিরোধী। বিষয়টি স্পষ্ট হয় ১৯৬১ সালে ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিলের প্রথম অধিবেশনে গোলওয়ালকারের পাঠানো এক কমিউনিকেশন থেকে। এতে উল্লেখ আছে : ‘আজকের ফেডারেল কাঠামোর সরকার সেপারেটিজম তথা বিচ্ছিন্নতার মনোভাবের শুধু জন্মই দেয়নি, সেই সাথে ‘এক জাতি’ বিষয়টি অস্বীকার ও ধ্বংস করার মাধ্যমে এর পরিপ্ষ্টুও সাধন করেছে। অবশ্যই এর সমূলে উৎপাঠন করতে হবে। সংবিধানের পরিশুদ্ধায়ন ও ইউনিটারি ধরনের সরকার অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’

আরএসএসের আদর্শিক পাঠ্যসূচি ‘বাঞ্চ অব থটস’ বইয়ে ‘ওয়ান্টেড অ্যা ইউনিটারি স্টেট’ শিরোনামে আলাদা একটি অধ্যায় রয়েছে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে গোলওয়ালকার দাবি তোলেন : ‘সংবিধানের ফেডারেল ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান থেকে ‘অটোনোমাস, সেমি-অটোনোমাস রাজ্যগুলোর অস্তিত্ব বিলোপ করে এগুলোকে ‘ভারত’ নামের ‘ওয়ান স্টেট’-এর আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং ঘোষণা দিতে হবে ‘ওয়ান কান্ট্রি, ওয়ান স্টেট, ওয়ান লেজিসলেচার, ওয়ান এক্সিকিউটিভ’-এর। ইউনটারি ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠায় সংবিধান পর্যালাচনা করে নতুন করে রচনা করতে হবে।’

অন্যদিকে, আরএসএস ক্যাডারদের কাছে ‘বাঞ্চ অব থটস’ হচ্ছে একটি পবিত্র গ্রন্থ। আসলে এটি গোলওয়ালকারের লেখালেখি ও আরএসএসের অন্যান্য প্রকাশনার একটি সঙ্কলন। এতে ‘ইন্টারনাল থ্রেটস’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ অধ্যায় রয়েছে। এতে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের বর্ণনা করা হয়েছে ১ নম্বর ও ২ নম্বর থ্রেট বা হুমকি হিসেবে। তার মতে- ভারতের প্রতিটি মুসলমান অননুগত এবং তারা আস্থার অযোগ্য।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আরএসএসের মুখপত্র ‘অরগানাইজারে’ যে সম্পাদকীয় লেখা হয় তাতে সব ভারতীয় সংখ্যালঘুকে ভারতীয় জাতীয়তার বাইরে রেখে ‘হিন্দু ন্যাশন’-এর ধারণা তুলে ধরা হয়।

গোলওয়ালকার মনে করতেন শিখ, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম আলাদা কোনো স্বাধীন ধর্ম নয়। আরএসএস মনে করে, শিখ, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম যেহেতু স্বাধীন কোনো ধর্ম নয়, তাই এগুলোর প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই; তবে তারা মনে করেন এগুলো হিন্দু ধর্মেরই অংশ। গোলওয়ালকারের এ সম্পর্কিত ঘোষণা হচ্ছে : ‘দ্য বুড্ডিস্টস, দ্য জৈনস, দ্য শিকস আর অল ইনক্লুডেড ইন দেট ওয়ান কমপ্রিহেনসিভ ওয়ার্ড হিন্দু’। আসলে গোলওয়ালকার বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্ম সম্পর্কে এই ধারণা নিয়েছিলের হিন্দুত্ব আইকন ভিডি সাভারকারের কাছ থেকে, যিনি বিশ্বাস করতেন আর্যসমাজ, ব্রাহ্মসমাজ, দেবসমাজ ও ভারতে সৃষ্ট অন্যান্য ধর্মীয় সমাজের অনুসারীরা আসলে হিন্দু, তাদের নিয়েই গঠিত হিন্দু জনগোষ্ঠী। আরএসএস মনে করে ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরা ভারতে অভিবাসী। সোজা কথায় বিদেশী। তারা হিন্দুরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।

অনেকেই জানেন, ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের কিছুটা অনুসমর্থন ছিল আরএসএসের প্রতি। আরএসএস নেতাকর্মীদের কাছে তিনি ফেভারিট হিসেবেই বিবেচিত ছিলেন। কিন্তু সেই বল্লভভাই প্যাটেলও মনে করতেন, গোলওয়ালকারের নেতৃত্বাধীন আরএসএস ভারত বিভাগোত্তর সময়ের নির্বিচারে মুসলিম হত্যায় দায়ী। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে গোলওয়ালকারের কাছে লেখা এক চিঠিতে বল্লভ ভাই প্যাটেল উল্লেখ করেছিলেন : ‘অরগানাইজিং দ্য হিন্দুজ অ্যান্ড হেল্পিং দেম ইজ ওয়ান থিং বাট গোয়িং ইন ফর ইটস সাফারিংস অন ইনোসেন্ট অ্যান্ড হেল্পলেস মেন, উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন ইজ কোয়াইট অ্যানাদার থিং।’

এদিকে নিকট অতীতে আমরা দেখেছি, ২০১৪ সালে ভারতে নরেদ্র মোদিও বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর দেশটিতে গোঁড়া আরএসএস গোষ্ঠীর গো-হত্যার অজুহাতে যেখানে-সেখানে মুসলমানদের নির্যাতন চালিয়ে হত্যা ও তাদের সম্পদ লুট ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার এক নয়া উপদ্রব শুরু হয়। সারা ভারতে তা ব্যাপকভাবে ঠাণ্ডা মাথায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। গোলওয়ালকারের মিথ্যাচারের কারণেই কার্যত এই উপদ্রবটির জন্ম হয়। গোলওয়ালকার বলে গেছেন, বিদেশী অনুপ্রবেশকারীরা আসার পরই ভারতে গো-হত্যার সূচনা হয়। মুসলমানরা ভারতে এসে গো-হত্যার সূচনাও করে। কিন্তু হিন্দুদের লেখা বৈদিক ইতিহাসও তা সমর্থন করে না। আরএসএস স্বামী বিবেকানন্দকে বিবেচনা করে মহান এক হিন্দু দার্শনিক হিসেবে। ১৯০০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনায় শেক্সপিয়র ক্লাবে দেয়া এক ভাষণে সেই তিনি বলেছিলেন : ‘আমার কথা শুনে আপনারা অবাক হবেন, পুরনো পর্বানুষ্ঠান মতে- যে গরুর গোশত খায় না, সে একজন ভালো হিন্দু নয়। কিছু সুনির্দিষ্ট অনুষ্ঠানে একজন হিন্দুকে ষাঁড় জবাই করে এর গোশত খেতে হবে।’

আরেকটি অনুষ্ঠানে বিবেকানন্দ বলেছিলেন : ‘ভারতে একটা সময় ছিল, যখন কোনো ব্রাহ্মণ গরু না খেলে ব্রাহ্মণ থাকতে পারতেন না। ‘আপনারা বেদ পড়ে দেখতে পারেন, কী করে একজন সন্ন্যাসী, একজন রাজা, একজন মহামানব ঘরে প্রবেশ করতেন সর্বোত্তম গরুটি জবাই করে।’

এই গোলওয়ালকারই দাবি তুলে গেছেন, মনুসংহিতা হবে ভারতের সংবিধান। যেসব আরএসএস সমর্থক মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের ‘বিদেশী’ আখ্যায়িত করে ভারতে তাদের অস্তিত্ব বিলীন করতে চায়, তাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার অস্বীকার করে, তারা শুধু বাস্তবতার অর্ধেকটুকুই জানে। হিন্দু জাতি গড়ার প্রকল্পের দাবি ভারতীয় সংবিধানে সাব-হিউম্যানের মর্যাদা পাবে শূদ্ররা (দলিতরা)। ফলে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের সমান মর্যাদা ও সুযোগ দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট কাউন্সিল যে সংবিধান চূড়ন্ত করে, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি আরএসএস। এর চারদিন পর ৩০ নভেম্বর আরএসএসের মুখপত্র ‘অরগানাইজার’ এর সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করে : ‘আমাদের সংবিধানে প্রাচীন ভারতে অনন্য সাংবিধানিক বিকাশের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। মনুর আইনগুলো লেখা হয়েছে লাইকারগাস অব স্পার্টা অথবা পার্সিয়ার সলোনের বহু আগেই। আজকের এই দিনে মনু’র আইনগুলোর ব্যাখ্যা-বিবৃতি ‘মনুস্মৃতি’ তুলে ধরা হয়েছে, তা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছ। কিন্তু আমাদের সংবিধান পণ্ডিতদের কাছে এর কোনো দাম নেই।’

আসলে গোলওয়ালকারের এই বর্ণবিভেদ প্রথা আর তাদের ‘হিন্দু ন্যাশন’ সমার্থক। অনেক হিন্দুই এই বর্ণপ্রথা মানতে নারাজ। যে জন্য ভারতীয় সংবিধানে এর স্থান নেই। মনুসংহিতার কিছু বিধান যে দলিত বা অস্পৃশ্যদের জন্য মর্যাদা হানিকর তা হিন্দুদের অনেকেই স্বীকার করেন। তা ছাড়া সর্বজনীন মানবাধিকারের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মনুর অনেক আইন নারীর জন্যও মর্যাদা হানিকর।

গোলওয়ালকারের এ ধরনের নানাধর্মী পরিচয় আরএসএসের আর্কাইভে রয়েছে। একটি মাত্র লেখায় তা তুলে ধরা একবারেই অসম্ভব। তবে এ লেখায় তার যেটুকু পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে এটুকু স্পষ্ট যে- এ ধরনের নীতি আদর্শের মানুষকে হিন্দুত্ববাদীরা তাদের কল্পিত ভারতের জাতীয় প্রেরণার উৎস হিসেবে যে মর্যাদার আসনে বসাতে চায়, তেমনটি ঘটলে বিশ্ব দরবারে ভারতের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় মর্যাদা কোন পর্যায়ে গিয়ে নামবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement