২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উন্নয়নের ইসলামী দৃষ্টিকোণ ও সামাজিক শান্তি

-

‘উন্নয়ন’ একটি বহুল উচ্চারিত শব্দ। চার দিকে উন্নয়নের কথা শুনছি। কিন্তু যে উন্নয়ন দেখছি সেখানে বৈষম্য কমছে না, উল্টো বাড়ছে। এর কারণ হলো কথিত ‘উন্নয়নটি’ হলো পশ্চিমাদের কাছ থেকে ধার করা একটি ধারণা। এই ধারণায় শুধু বস্তুগত বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। মানবিক, মানসিক বা নৈতিক উন্নয়নের কথা নেই। অথচ মানবসমাজ শুধু সম্পদে চালিত নয়, মানবিক গুণাবলিও এর সাথে জড়িত। পশ্চিমা ধারার উন্নয়ন আমাদের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হওয়ার পেছনে এটাই কারণ। উন্নয়নের সার্বিক দৃষ্টিকোণটি ইসলামে পাওয়া যায়। একে ইসলামী দৃষ্টিকোণ না বলে মানবিক দৃষ্টিকোণও বলা যায়। ইসলামে উন্নয়নের সীমাটি এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক অপরিহার্যতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। এই হিসাবে, কোনো মুসলিম সমাজে উন্নয়ন শব্দটি প্রচলিত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ নয়। ইসলাম বলে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হতে হবে উদ্দেশ্যমূলক (purposeful)। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে একই সাথে বাস্তব বস্তুগত সুফল, দৃষ্টিগ্রাহ্য সামাজিক সুবিধা ও আধ্যাত্মিক পরিতৃপ্তি থাকতে হবে। এই তিনটি মিলে একটি প্যাকেজের মতো। এই প্যাকেজই ইসলামে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়।

কেউ বাজারে কিছু কিনতে গেল। সেখানে একই পণ্য কয়েক ধরনের থাকে। সেখানে তিনটি দামে যেমন : ৫, ৬ ও ৭ টাকায় একই জিনিস বিক্রি হচ্ছে। কেউ যদি ৭ টাকায় জিনিসটি কেনে তাহলে তার অগ্রাধিকার প্রকাশিত হয়ে গেল। ভোক্তার আচরণ বিশ্লেষণ করে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন এই ‘প্রেফারেন্স রিভিল্ড’ (preference revealed) তত্ত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ কেনার অভ্যাস দেখে ক্রেতা কিসে অগ্রাধিকার (preference) দিচ্ছে তা বোঝা যায়। স্যামুয়েলসনের বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা হলো, তিনি শুধু আর্থিক অগ্রাধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন। এটা আসলে সেক্যুলার প্রেফারেন্স। পশ্চিমা অর্থনীতির ধারাই হলো সেক্যুলার। এখানে মানবিকতা বা মূল্যবোধের কোনো কথা নেই। স্যামুয়েলসনের তত্ত্বটি ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করতে গিয়ে আমি দেখি ইসলাম অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তিন অগ্রাধিকারের (Triple- preference) কথা বলে। এই অগ্রাধিকারগুলোর প্রকাশ (revealed) ঘটতে হবে। অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের (economic preference) পাশাপাশি আরো যে দুটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে সেগুলো হলো : সামাজিক অগ্রাধিকার (social preference) ও নৈতিক অগ্রাধিকার (moral preference)। উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় এগুলোও প্রকাশিত হতে হবে। অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার মানে কত মানুষ এর সুফল পাচ্ছে। এটাকে আমরা বলছি বিতরণ। সামাজিক অগ্রাধিকারের মানে হলো উন্নয়ন করতে গিয়ে আমরা সমাজের ভারসাম্য বিনষ্ট করছি কি না সেটা বিবেচনায় রাখা। আর নৈতিক অগ্রাধিকার হলো উন্নয়ন করতে গিয়ে নৈতিক বা মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে কি না সেটা দেখা। ইসলাম বলে, এই তিনের ভারসাম্য রক্ষিত হলেই প্রকৃত উন্নয়ন হবে।

এরই আলোকে বাংলাদেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে তার উতরে যাওয়ার কারণ নেই। অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের কথা বললে, এখানে সম্পদ বিতরণপ্রক্রিয়ায় গলদ রয়ে গেছে। বণ্টন ঠিকমতো না হওয়ায় সমাজের একটি শ্রেণী অস্বাভাবিক ধনীতে পরিণত হয়েছে। আরেক শ্রেণী দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে নেমে গেছে। পুরো উন্নয়নের কাজটি ধনিকশ্রেণীর কব্জায় চলে গিয়েছে। যে উন্নয়ন সম্পদের বণ্টন নিশ্চিত করে না সেটাকে বাস্তবিক অর্থে উন্নয়ন বলা চলে না।

আমরা কি উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় সামাজিক অগ্রাধিকার প্রকাশ করতে পেরেছি? এ প্রসঙ্গে আমি প্রায়ই একটি উদাহরণ দিয়ে থাকি। সেটা হলো, হাসকিং মেশিন বা ধান ছাঁটাইয়ের কল। গ্রামে একসময় ঢেঁকি ছিল। এখনো দু’এক জায়গায় হয়তো আছে। ঢেঁকিছাঁটা চাল স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু একটি হাসকিং মেশিন পঞ্চাশটা ঢেঁকির কাজ করতে পারে। তাহলে ঢেঁকির দরকার কী? আমি বলছি, হ্যাঁ, হাসকিং মেশিন নিয়ে আসা যায় কিন্তু আমাকে এর সামাজিক মূল্যটি ভাবতে হবে। আমার দেখা উচিত, ঢেঁকি পাড় দিয়ে চাল তৈরির কাজটি কারা করে; হাসকিং মেশিন বসিয়ে কাদেরকে বেকার করছি! গ্রামের অভাবী, যাদের বেশির ভাগ বিধবা অথবা অন্য কাজ জানে না তারাই সাধারণত ঢেঁকি পাড় দেয়। হাসকিং মেশিন বসানো হলে এই মেয়েগুলো বেকার হবে। এই মেয়েগুলো কী করবে? তারা শহরমুখী হবে। অভ্যন্তরীণ অভিবাসন সৃষ্টি হবে। আমরা শহরে যত বস্তিবাসী দেখি এদের ৯০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট। এরা সামাজিক সমস্যা তৈরি করছে। উন্নয়নের বিবেচনায় এসব বেকারের কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা কি রাখা হয়েছে? উন্নয়ন পরিকল্পনায় সামাজিক অগ্রাধিকার বিবেচনায় না নেয়ার কারণে আজ সামাজিক বুননটি (social fabric) ছিঁড়ে যাচ্ছে।

আমরা নারীর ক্ষমতায়ন করার জন্য ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছি। আমাদের গ্রাম-গঞ্জে হাজারে হাজারে এনজিও এই ঋণ দিচ্ছে। এদের কিন্তু পারিবারিক ক্ষমতায়নের কোনো কর্মসূচি নেই। নারীর ক্ষমতায়ন করতে গিয়ে পরিবারের ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। এটা এক ধরনের ‘টুইস্ট’। আমি আমার ব্যাংকের কর্মীদের বলতাম যে ‘ক্রেডিট ট্রান্সফার পাওয়ার’। এই পাওয়ারটাকে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিবার ধ্বংসের কাজে। তুমি পরিবারকে ঋণ দিচ্ছ না। পরিবারের কোনো পুরুষকে দিচ্ছ না, দিচ্ছ শুধু নারীকে। ফলে ওই পুরুষটি কাজের খোঁজে বাড়ি ছাড়ছে, শহরে এসে ভিড় করছে। অন্য দিকে গ্রামে থেকে যাওয়া মেয়েটি একা হয়ে পড়ছে। পরিবার বিপর্যয়ের ফলে দেশে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ঘটছে। শহরগুলোতে যেসব বড় বড় বস্তি দেখি সেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা এরা। কাজ না পেয়ে এক একসময় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এই সোশ্যাল ডিজরাপশনের ফল এখন বোঝা যাচ্ছে চার দিকে নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্রে। তাই বলছি উন্নয়নের সাথে সামাজিক অগ্রাধিকারও যোগ থাকতে হবে।

আমাদের পশ্চিমা ধারার উন্নয়নে নৈতিক অগ্রাধিকারকে বিবেচনায় আনা হয়নি। ফলে এখানে এক দিকে আর্থিক দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে, অন্য দিকে ঘটেছে নৈতিক অবক্ষয়। কিভাবে টাকা বানানো যায়, সম্পদ জমানো যায়, শুধু এই চিন্তা। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর আমরা ত্রাণ লুট হতে দেখেছি; রক্ষকরা ভক্ষক হচ্ছে। আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকাও আজ পর্যন্ত পুরোপুরি স্বচ্ছ করতে পারিনি। ক্যাসিনো কালচার, মাদক ব্যবসা, গুণ্ডামি, বাঁদরামি, কর ফাঁকি, ইত্যাদি কত ধরনের অর্থনৈতিক ও নৈতিক অপরাধ। আমারতো মনে হয় দুনিয়ায় যত ধরনের অর্থনৈতিক অপরাধ রয়েছে সব বাংলাদেশে আছে। ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির যেসব খবর শোনা যায় তা তো রীতিমতো আতঙ্কিত হওয়ার মতো। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে দেশের বাইরে সম্পদ-সম্পত্তি গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব অনিয়মের সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশেরও খবর আসছে। এটাই কি উন্নয়ন? দেশের মেগা প্রকল্পগুলো যেন দুর্নীতির মেগা আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

তাই আমাদের দেশের বর্তমান উন্নয়নকে আমার পক্ষে উন্নয়ন বলা খুবই কঠিন। সমাজের জন্য এই উন্নয়ন টেকসই হবে না। এটা সমাজকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে ফেরার আর কোনো পথ থাকবে না। উন্নয়ন টেকসই করতে হলে উপরোক্ত তিনটি অগ্রাধিকার আমলে নিতে হবে। আমি ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নয়নের বিশ্লেষণ করলেও এটা আসলে সব বিচারেই মানবিক। মানবিক মানদণ্ডে উন্নয়নের বিচার করতে গেলেও এই তিনটি বিষয়ই সামনে আসবে। উন্নয়নের উদ্দেশ্য হলো, দিনের শেষে আমি যেন প্রশান্তির ঘুম ঘুমাতে পারি। আমার দৈনন্দিন জীবন যেন শান্তিপূর্ণ হয়। এই শান্তি বস্তুগত ও মানসিক- দুই ক্ষেত্রেই হতে হবে। যে উন্নয়ন বিষণ্ণতা তৈরি করে, ঘুম নষ্ট করে, নারী নির্যাতন বৃদ্ধি করে, নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে, সড়কে বের হলে ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা থাকে না, অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করে, হানাহানির জন্ম দেয় সেটা উন্নয়ন হয় কি করে? তাই আমরা শুধু উন্নয়ন উন্নয়ন বলে চিৎকার করলেও তাতে কি সামাজিক শান্তি ফিরে আসছে? আজ কোনো সরকারি অফিসে গেলে ঘুষছাড়া খুব কম কাজই হয়। শিক্ষাকেও আজ আমরা পুরোপুরি পণ্য বানিয়ে ফেলেছি। মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল সড়ক এগুলো দৃশ্যমান উন্নতি করছে। কিন্তু এসব অদৃশ্য বৈষম্যও বাড়াচ্ছে। উন্নয়নের ইকোলজিক্যাল আসপেক্টও ইসলামী দৃষ্টিকোণের বাইরে নয়। এর মানে হলো সুন্দরবনের কাছে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগে এটি পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে সেটিও দেখতে হবে।

উপরোক্ত তিন অগ্রাধিকারের আলোকে দেশের উন্নয়নের বিচার করা হলে আমি বলব উন্নয়ন পূর্ণতা লাভ করেনি। তাই আমাদের উন্নয়ন নীতিটিই ঢেলে সাজানো দরকার। আমি পশ্চিমা অর্থনীতি পুরোপুরি বর্জন করতেও বলছি না। তাদের ভালো কাজগুলো অবশ্যই আত্তীকরণ করতে হবে। তবে আমাদের সমাজ পশ্চিমা কোনো সমাজ নয়, এখানকার ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলমান। তাই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নয়ন ধারণার প্রচলন করতে হবে। আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় সামাজিক ও নৈতিক উপাদান যুক্ত করতে হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement