২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাতৃভাষা বনাম রাষ্ট্রভাষা

-

পবিত্র কুরআন মাজিদের মতে, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাক মানুষকে কথা বলতে শিখিয়েছেন (সূরা আর-রহমান) এবং কথা বলার প্রধান মাধ্যম হলো ভাষা। জাতিসঙ্ঘ ‘ইশারা’ ভাষাকে ভাষার একটি ধরন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বটে, কিন্তু ভাষা ছাড়া শুধু ইশারার মাধ্যমে মনের ভাব সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না। যে মানুষটির কণ্ঠে ভাষা নেই, সে বুঝতে পারে পৃথিবীটা তার জন্য কতবড় বোঝা। যে পরিবারে একজন বধির বা বোবা জন্মগ্রহণ করে, সে পরিবারটি পৃথিবীর যে একটি ‘অন্ধকার’ চিত্র আছে তা উপলব্ধি করে বুঝতে পারে যে, পৃথিবীটা কতটুকু নিষ্ঠুর। ফলে ‘ভাষা’ পৃথিবীর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। এ মূল্যবান উপহারের মধ্যে আরো মূল্যবান হলো ‘মাতৃভাষা’।

বাঙালি তাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মর্যাদাবান করতে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে; তথা পাকিস্তান সরকারের বুলেটে রক্ত ঝরিয়েছে। পৃথিবীতে মাতৃভাষার জন্য গুটিকয়েক জাতি প্রাণ দিয়েছে তাদের মধ্যে বাঙালি অন্যতম। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারতের আসামে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে। বাঙালি জাতিকেও স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে। এ জাতির যা কিছু অর্জন, তা হয়েছে রক্তের বিনিময়ে। অনেক কম জাতিই আছে যারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে নিজ মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছে। এ কারণেই বাঙালি জাতি যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গৌরব বোধ করে। তবে দেশে স্বাধীনতার বীজ লুক্কায়িত ছিল মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করার আন্দোলনের মধ্যে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পাকিস্তানিদের মুখামুখি দাঁড়ানোই ছিল বাঙালির প্রথম প্রতিবাদ যা পর্যায়ক্রমে স্বাধিকার, পরে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়। ফলে ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করেছে। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতিসঙ্ঘ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছেন তারা বলেছেন, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা।’ এ প্রবাদটি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যা এখনো ‘বেদবাক্য’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক কবিতা, প্রবন্ধ রচিত হয়েছে, ছাপা হচ্ছে মনোমুগ্ধকর পোস্টার ও দেয়াল লিখন। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা বাংলাদেশে তো বটেই, বহির্বিশ্বেও যেখানে বাঙালি আছে সেখানে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে ভাষা শহীদদের স্মরণ করছে শ্রদ্ধার সাথে। কিন্তু বাঙালির প্রিয় মাতৃভাষা ‘বাংলা’ কি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রয়োগ করা হচ্ছে? এ দেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের ৩য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ কাগজ-কলমে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবিধানে ‘বাংলা’ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বটে; কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা কি ব্যবহৃত হচ্ছে? রাষ্ট্রের বিভিন্ন অফিস/আদালতে এখনো ইংরেজি ভাষাকে মর্যাদার আসনে বসানো হচ্ছে। আদালতসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দফতরে ইংরেজিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ইংরেজি যে না জানে, তার জীবনটাই যেন ব্যর্থ হওয়ার মানসিকতা এখনো আমাদের সমাজে বিদ্যমান। ‘ইংরেজি’ যেহেতু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, সেহেতু ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী থাকার অনেক গুরুত্ব রয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় দফতরে ইংরেজি ব্যবহার এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা এক কথা নয়। স্পষ্টভাবেই বলছি যে, আন্তর্জাতিক ভাবধারা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়, তবে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য যথাযথ নয়। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ও সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত বাংলাদেশের ইতিহাসে (১৭০৪-১৯৭১) ‘রাষ্ট্র ও শিক্ষা’ প্রবন্ধে (পৃষ্ঠা : ৭৯) দেখা যায়, ‘ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক অনুদানে মাদরাসা ও সংস্কৃতি কলেজ পরিচালিত হয়েছে। ওয়ারেন হেস্টিংসের আনুকূল্যে ১৭৮১ সালে কলকাতা মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৯২ সালে জোনাথন ডানকান প্রতিষ্ঠা করেন সংস্কৃতি কলেজ। ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক মেকলের ভারত উপমহাদেশে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রসারকে ভারত সরকারের শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য বলে গ্রহণ করেন। তৎকালীন সরকারি নীতির এ পরিবর্তনের ফলে ক্রমে বাংলায় বেশ কিছু সরকার পরিচালিত, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ইংরেজি স্কুল ও কলেজ গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা প্রধানত বাংলায় উচ্চাভিলাষী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখনই সরকারি চাকরিতে ইংরেজি শিক্ষিতদের অগ্রাধিকার প্রদানের নীতি প্রবর্তিত হয়।’

প্রখ্যাত লেখক বদরুদ্দীন উমর ‘ভাষা আন্দোলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শুধু সাংস্কৃতিক মহলই নয়, রাজনৈতিক মহলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ভাষাবিষয়ক কিছু উল্লেখযোগ্য চিন্তাভাবনা ছিল। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক কাউন্সিলের সামনে পেশ করার জন্য যে খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক ভারত বিভাগ সম্পর্কিত রোয়েদাদ ঘোষণার পর মুসলিম লীগের অল্পসংখক বামপন্থী কর্মীর উদ্যোগে জুলাই মাসে ঢাকায় গণআজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক গ্রুপ গঠিত হয়। কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ প্রভৃতি নেতৃস্থানীয় কর্মীর দ্বারা একটি কমিটি গঠিত হয়। এ গ্রুপ ‘আশু দাবি কর্মসূচি আদর্শ’ নামে যে ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে দেশে যথোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে।’ এতে প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই বাঙালি জাতি বাংলা ভাষার প্রয়োগের দাবিতে সোচ্চার ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োগ করার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানগতভাবে বাংলা একাডেমির ওপর বর্তায়। কিন্তু একাডেমি সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। বাংলা একাডেমি এখন ‘সরকারি দলের একটি অঙ্গসংগঠন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সরকারি অফিস আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য ভাষার প্রয়োগ সাবলীল করার পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির। কিন্তু গবেষণামূলক কার্যক্রম থেকে সরে গিয়ে সরকারের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা তারা বাস্তবায়ন করছেন। প্রতি বছর কয়েক দফা পদক বিতরণ করাই একাডেমির যেন মুখ্য কর্ম। কিন্তু পদক বিতরণে একাডেমি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন না করে শুধু সরকারি ঘরানার লোকদেরই পদক পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একটি রাষ্ট্রে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার যাতে দল মত নির্বিশেষে সব মতের মানুষ একত্র হয়ে মতবিনিময়ের মাধ্যমে জাতির জন্য অবদান রাখতে পারে। বাংলা একাডেমি সে ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান হতে পারত। কিন্তু এর পরিবর্তে একাডেমি সরকারি দলের স্বার্থরক্ষায় প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সরকারবিরোধী লেখকদের বই বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে না। গবেষণায় রয়েছে তাদের পক্ষপাতিত্ব। ইতিহাস সৃষ্টিতে রয়েছে সত্য-মিথ্যার দোলাচল; যে ইতিহাস রচনা করলে ক্ষমতাসীনরা খুশি থাকবেন, সে ইতিহাসই বাংলা একাডেমির গবেষণার ফল। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, একাডেমির অনেক জীবন ও সাধারণ সদস্য রয়েছেন। সদস্যদের মধ্যে দলমত নির্বিশেষে অনেকেই সদস্য রয়েছেন, যারা সরকারি ঘরানার বা সরকার সমর্থক সদস্য নন তাদের ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা বাংলা একাডেমির কাছে নেই। সরকার দাবি করে, দেশে গণতন্ত্র বিদ্যমান। অথচ বাংলা একাডেমি চলছে একটি অনির্বাচিত কমিটি দ্বারা। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই একাডেমি কোনো নির্বাচিত কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়নি। সরকার দেশের সংস্কৃতিকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণে উদ্দেশ্যেই বাংলা একাডেমিকে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত করছে।

মাতৃভাষা কোনো সরকারের সম্পদ নয়। এটি একটি জাতীয় ঐতিহ্য ও সম্পদ। এ এটাকে জাতীয়ভাবেই রক্ষা করতে হবে। সবক্ষেত্রে ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমেই তা সম্প্রসারিত হবে। সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বটে, কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশের মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিরক্ষর। স্বাধীনতা উত্তরকালে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য সরকারি যে উদ্যোগ ছিল তাও থেমে গেছে। স্বাধীনতার পর সরকারি উদ্দেশ্যেই কয়েকবার নিরক্ষরতা দূরীকরণে উদ্যোগ নেয়া হলেও আমলাতান্ত্রিক অসহযোগিতার জন্য সফল হতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে (কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) নিরক্ষরতা দূরীকরণ অর্থাৎ ধনী-গরিব নির্বিশেষে নিরক্ষর ব্যক্তিদের অক্ষর জ্ঞান দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও সে উদ্যোগও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অপমৃত্যুবরণ করে।

সমগ্র জাতিকে ভাষার সাথে পরিচিত করতে অক্ষর জ্ঞান শেখানো প্রয়োজন যা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্ভব নয়; এ দায়িত্ব নিতে হবে গোটা শিক্ষিত সমাজকে। বস্তিবাসী গরিব মেহনতি মানুষ যাদের ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ তাদের পক্ষে কোনো স্কুলে ভর্তি হওয়া সম্ভব নয় এবং অভাবের তাড়নায় বস্তিতে বেড়ে ওঠা তাদের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর পরিবর্তে কর্মস্থলে পাঠানোই মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষ জরুরি মনে করে। ভাষা শিক্ষার জন্য অক্ষর জ্ঞান এবং অক্ষর জ্ঞান সর্বস্তরে প্রদান করার জন্য সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারকে আরো উদ্যোগী ও সুদূরপ্রসারী টেকসই কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। হ

লেখক : আইনজীবী, কলামিষ্ট ও জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমি
প্রতিষ্ঠাতা : কেন্দ্রীয় নিরক্ষরতা দূরীকরণ সংস্থা
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement