১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একটি প্রতিবেদন ও কিছু কথা

একটি প্রতিবেদন ও কিছু কথা - ছবি : সংগৃহীত

‘সরকারপন্থী’ একজন সিনিয়র সাংবাদিকের সাথে একটি টকশোতে অংশ নিয়েছিলাম কয়েক দিন আগে। আলোচনার বিষয় আলজাজিরার রিপোর্টও ছিল। তিনি এ রিপোর্ট নিয়ে অনেক কিছু বলছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ, বিএনপি-জামায়াত, সরকারের দুনিয়াকাঁপানো উন্নয়ন, দেশরত্ন এমনি সব বিষয় নিয়ে তারা অবিরাম কথা বলে যাচ্ছিলেন। বলতে পারছিলাম সামান্যই। কারণ সত্য বলতে আমি ভীত ও কুণ্ঠিত ছিলাম। সত্য বলা এখন খুবই বিপজ্জনক। যুক্তিহীন গালগল্প গাল ফুলিয়ে বলা বড় সহজ। আমার আইনের ভয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইন বলে পুলিশ যেকোনো সময় যে কাউকে, যেকোনো অজুহাতে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই গ্রেফতার করে মাসের পর মাস আটকে রাখতে পারে। সে প্রক্রিয়ায় কারো মৃত্যু হলেও যায়-আসে না। ফলে কথা সাবধানে বলেছি।

ভদ্রলোক বলে বসলেন, এই যেমন ধরুন হাঙ্গেরি। একসময় তারা ওষুধ শিল্পে খুবই অগ্রসর ছিল। এখন সবই শেষ। আপনি জানেন, হাঙ্গেরি জরুরি প্রয়োজনে বাংলাদেশের কাছে ৫০০০ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন ‘ভিক্ষা’ চেয়েছে। আমার রুচি বা শিক্ষা কিংবা সাংস্কৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ড কোনো কিছুই এ ‘ভিক্ষা’ শব্দটিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারল না। বললাম, ভাই, একটু রয়েসয়ে বলুন। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৮৫৬ ডলার। আর হাঙ্গেরিয়ানদের মাথাপিছু আয় ১৬ হাজার ৭৩২ ডলার। তারা বাংলাদেশের কাছে ‘ভিক্ষা’ চাইছে?

কথাটির উৎস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। সুদর্শন প্রতিমন্ত্রী গত ৩১ জানুয়ারি বলে ফেলেছিলেন যে, হাঙ্গেরি বাংলাদেশের কাছে ৫০০০ ডোজ টিকা চেয়েছে। হাঙ্গেরি টুডে পত্রিকা ৪ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছে যে, বাংলাদেশ হাঙ্গেরিকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৫০০০ ডোজ টিকা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু হাঙ্গেরি সরকার তা ‘প্রত্যাখ্যান’ করেছে। হাঙ্গেরির পররাষ্ট্র ও বাণিজ্যবিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, এ প্রস্তাবের জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছি, কিন্তু প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছি। তবে তারা জানাননি কেন এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি হাঙ্গেরির ট্যাবলয়েড পত্রিকা ব্লিক জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের ৫০০ অগ্নিদগ্ধ রোগীকে হাঙ্গেরীয় ডাক্তাররা চিকিৎসা করে ভালো এবং জোড়া লাগা শিশু রাবেয়া ও রোকেয়াকে তারা অপারেশন করে আলাদা করে দিয়েছেন। রাবেয়া ও রোকেয়া ভালো আছে। এ কাজের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাংলাদেশ পাঁচ হাজার ডোজ টিকা অফার করেছিল। প্রতি ডোজ টিকার মূল্য তিন ডলার ধরলে ওই টিকার মূল্য ১৫ হাজার ডলার, যা একজন হাঙ্গেরিয়ানের পার ক্যাপিটা আয়ের চেয়ে কম। এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য প্রতিমন্ত্রীকে ফোন করেছিল একটি পত্রিকা। কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

টকশোতে ওই ভদ্রলোকের সাথে অত কথা হয়নি। আমি তার মুখের দিকে বেকুবের মতো তাকিয়ে ছিলাম। আসলে তিনি মন্ত্রীর কথার প্রতিধ্বনি করেছিলেন।

আলজাজিরার রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’। সেখানে বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের অধিকাংশ লোকই ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’। চ্যানেলটি একে একে তার ‘প্রমাণ’ তুলে ধরেছে। কিন্তু কেন তারা এটি তুলে ধরল? দুর্নীতি না হয় হচ্ছেই, তাই বলে সারা বিশ্বের কাছে তার ‘হাঁড়ি ভেঙে দিতে হবে’? প্রায় সাথে সাথেই সরকারের সুবিধাভোগীরা দাঁড়িয়ে গেলেন, আলজাজিরা, বিএনপি, ডেভিড বার্গম্যান যুদ্ধাপরাধী। তাদের এসব কথা বলার যুক্তি কতটা?

ঘটনা যাচাই না করেই আলজাজিরার প্রতিবেদনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক। ৪ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা বলেন, কাতারভিত্তিক সম্প্রচার মাধ্যম আলজাজিরা এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে উদ্দেশ্যপূর্ণ বিকৃত তথ্য প্রচার করে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। অতীতেও এই টেলিভিশন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং হেফাজতের শাপলা চত্বরে অবস্থানকে কেন্দ্র করে উদ্দেশ্যপূর্ণ মিথ্যা তথ্যসংবলিত সংবাদ প্রচার করেছে। এ চ্যানেলটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্বেষপূর্ণ সংবাদ প্রচার করে চলেছে। সম্প্রতি তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে গণধিকৃত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রবিরোধী একটি অপশক্তি। আমরা আলজাজিরা টেলিভিশনের এ ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানাই এবং উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার মোকাবেলায় সরকারের যথোপযুক্ত অবস্থান ও ব্যাখ্যা প্রত্যাশা করি। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন শামসুজ্জামান খান, রামেন্দু মজুমদার, ডা: সারওয়ার আলী, আবেদ খান, মামুনুর রশিদ, মফিদুল হক, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, গোলাম কুদ্দুছ, ডা: কামরুল হাসান খান, আশরাফুল আলম, ফকির আলমগীর, অ্যারোমা দত্ত, ম. হামিদ, বুলবুল মহলানবিশ ও হাসান আরিফ। তাদের বিবৃতি থেকে বোঝা গেল না, কী বিকৃত তথ্য, কী মিথ্যা প্রচারণা আলজাজিরা চালিয়েছে। তারা যদি বিষয়টি খোলাসা করতেন, ভালো হতো।

সত্য চাপা থাকে না। কিংবা ধর্মের ঢোল আপনি বাজে। আলজাজিরার রিপোর্টে অনেক কিছু প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো, হাঙ্গেরি প্রবাসী একজনের মাধ্যমে ইসরাইল থেকে টেলিফোনে আড়িপাতার যন্ত্র ক্রয়। সেটি খুবই শক্তিশালী এবং এই ডিভাইসের ফাঁক গলিয়ে কোনো সেলফোন কার্যক্রম পরিচালনা অসম্ভব। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই ডিভাইস ইসরাইল থেকে আমদানি করলেও দেখানো হয়েছে যে, সেটি হাঙ্গেরিতে তৈরি। বিস্ময়ের বিষয় এই যে, ওই ডিভাইস যে কোম্পানি তৈরি করে তার নাম ‘পিকাসক্স’। হাঙ্গেরিতে এই নামে কোনো কোম্পানি নেই এবং হাঙ্গেরি এ ধরনের যন্ত্র তৈরিও করে না বলে দাবি করা হয়েছে।

ওই রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর আন্তঃবাহিনী গণসংযোগ অধিদফতর আইএসপিআর একটি বিবৃতি দিলো। বিবৃতিতে তারা বললেন, ‘একটি স্বার্থান্বেষী চক্রের মাধ্যমে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ শিরোনামে আলজাজিরায় প্রকাশিত সাজানো এবং অসৎ উদ্দেশ্যে করা প্রতিবেদনের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে সেনা সদর দফতর। যে চক্রটি সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে, এ প্রতিবেদনটি তাদেরই সৃষ্টি। প্রতিবেদনে থাকা ভাষ্যকার ডেভিড বার্গম্যান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তি। প্রতিবেদনে ‘সামি’ হিসেবে প্রদর্শিত হওয়া জুলকারনাইন সায়ের খান মাদকাসক্তির কারণে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে বহিষ্কৃত সাবেক ক্যাডেট এবং তাসনিম খলিল অখ্যাত গণমাধ্যম নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক। তাদের অসৎ উদ্দেশ্য ও স্বার্থান্বেষী চরিত্রের বন্ধন অতীতেও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, এটি কোনোভাবে স্পষ্ট নয় যে, আলজাজিরার মতো একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কিভাবে এরকম একটি অসৎ, উদ্দেশ্যপূর্ণ ও অপরাধের ইতিহাস থাকা চক্রকে সহযোগিতা করছে। আলাদা বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সামাজিক ও ব্যক্তিগত ঘটনা প্রযুক্তির মাধ্যমে সমন্বয় করে ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন ঘটনা এডিট করে ব্যাকগ্রাউন্ডে ভয়েস লাগানো হয়েছে। ইসরাইল থেকে মোবাইল ফোন নজরদারির প্রযুক্তি কেনার বিষয়ে প্রতিবেদনে যে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়েছে, বাংলাদেশ আর্মি তার নিন্দা জানাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এ প্রযুক্তি হাঙ্গেরি থেকে আনা হয়েছে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা মিশনে থাকা একটি আর্মি কনটিনজেন্সের জন্য। এই ডিভাইসের কোথায়ও উল্লেখ বা লেখা নেই যে, এটি ইসরাইলে তৈরি। ইসরাইলের সাথে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। তাই দেশটি থেকে সামরিক প্রযুক্তি আমদানির কোনো সুযোগ নেই। প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের বিকাশ ও উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করতেই ওই স্বার্থান্বেষী মহল সরকারের বিভিন্ন অংশের মধ্যে থাকা ঐক্য বিনষ্টের চেষ্টা হিসেবেই এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে বলে মনে করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বর্তমান সব থেকে বেশি সুশৃঙ্খল এবং সংবিধান ও সরকারের প্রতি অনুগত। আমাদের সেনাবাহিনী অতীতেও সরকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মাতৃভূমির উন্নয়নের অংশীদার ছিল। ভবিষ্যতেও সেনাবাহিনীর এই ধারা অব্যাহত থাকবে।

৪ ফেব্রুয়ারি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিখকে আলজাজিরায় প্রকাশিত দুর্নীতি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। বলা হয়, ‘গুপ্তচরবৃত্তির সরঞ্জাম’ ক্রয় নিয়ে। জবাবে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগসংক্রান্ত আলজাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সম্পর্কে তারা অবহিত। তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে তারা অবগত। তিনি বলেন, অভিযোগগুলো একটি গুরুতর বিষয়। এই অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদন্ত করা উচিত। তিনি বলেন, আলজাজিরার তথ্যচিত্রে যেসব ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তার প্রয়োজনীয়তার কথা জাতিসঙ্ঘ কোনো চুক্তিতে উল্লেখ করেনি। আর জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনের বাংলাদেশ কনটিনজেন্সে এ ধরনের সরঞ্জাম রাখা হয়নি। এর মানে, ওই ডিভাইস জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর জন্য কেনা হয়নি।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের গণপিটুনিতে নিহত ২ নির্মাণশ্রমিক জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি সদস্যপদ লাভের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান

সকল