২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অ্যাকাডেমিক চৌর্যবৃত্তি বন্ধে যা দরকার

অ্যাকাডেমিক চৌর্যবৃত্তি বন্ধে যা দরকার - ছবি : প্রতীকী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের অ্যাকাডেমিক চৌর্যবৃত্তির কারণে শাস্তি পাওয়া নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমে কিছু দিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। অপরাধীদের গুরু পাপে লঘু দণ্ড দেয়া হয়েছে কি না অথবা যাদের সহযোগিতায় তারা এহেন কাজ করছেন সেই সহযোগীরা শাস্তির আওতার বাইরে থাকবেন কি না তা নিয়েও কথা হচ্ছে। আমি এসব বিতর্কে যাবো না। কারণ দেশে দুর্নীতির যে মহামারী চলছে তাতে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। এমন আরো কত ঘটনা অপ্রকাশিত রয়ে গেছে, কে জানে! বহু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। নিজে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলাম। ১৯৬০ সালের গোড়ার দিকে সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিটি কলেজে পড়িয়েছি। পাপুয়া নিউগিনি, নাইজেরিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি করে পাপুয়া নিউগিনির বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেই। তখনো এই ভূখণ্ড অস্ট্রেলিয়ার শাসনাধীন। আমি সেখানকার স্বাধীনতা আন্দোলন দেখেছি। স্যার মাইকেল সোমারে ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনিও এক সময় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। তার সাথে আমার বন্ধুত্ব তৈরি হয়। কিন্তু কোথাও আমাদের দেশের মতো পরিস্থিতি দেখিনি। শিক্ষাকে এতটা রাজনীতিকীকরণ কোথাও দেখিনি। এ দেশের মতো ছাত্র ও শিক্ষকদের এত ভয়াবহভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে দেখিনি।

আমেরিকাতে কম হানাহানি, কম রাজনৈতিক বিতর্ক হয় না। এই কিছু দিন আগেও সেখানে ট্রাম্পের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক শোরগোল দেখেছি। কিন্তু তাতে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল কতটা? এমনকি পাকিস্তানের ছাত্ররাও এতটা রাজনীতিতে জড়িত নয়। ছাত্রদের রাজনীতির মাঠে টেনে এনে এ দেশের রাজনীতিকরা শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশ করেছেন। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হতো। আজ বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এর কোনো অবস্থানই নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের অনাস্থার প্রমাণ এটা। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা ছাত্রদের দেশের বাইরে কেউ স্বীকৃতি দিতে চায় না। আমি যখন মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছি তখন সেটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্যাম্পাস। সারা দুনিয়া থেকে ভিড় জমানো ৪৫ হাজার ছাত্রছাত্রী ছিল। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্টাফ মিলিয়ে এক এলাহি ব্যাপার। একে বিশ্ববিদ্যালয় না বলে বলা হতো বিশ্ববিদ্যালয় শহর। তখন ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিস্ট স্যার জন ওয়াল্টার অ্যাডামস। দুই বছর পর তিনি ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার, আপনি পদত্যাগ করলেন কেন? তিনি বললেন, ‘প্রশাসনিক কাজ আমার পছন্দ নয়। গবেষণামূলক কাজ করতে আমি ভালোবাসি।’ তিনি পদত্যাগ করলে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করে। তারা বলে, আমরা তোমাকে ‘পয়েন্ট ফোর’ দেবো। শিক্ষকদের মূল্যায়নের জন্য এই নম্বর দেয়া হতো। আর ‘পয়েন্ট ফোর’ ছিল সর্বোচ্চ নম্বর। সেখানেও ছাত্র রাজনীতি দেখেছি। তবে জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতি। রাজনৈতিক দল ছিল। ডেমোক্র্যাট, রিপাবলিকান ছিল। অনেক ছাত্র সমাবেশ হতো, কিন্তু কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের স্লোগান শুনিনি। সেখানে গবেষণামূলক কাজ না থাকলে শাস্তি পেতে হয়। গবেষণা কর্ম প্রকাশ করতে হবে। ‘পাবলিশ অর প্যারিশ’-এটা পশ্চিমা প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্লোগান। এর পুরোপুরি বিপরীত চিত্র দেখা যায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।

আসলে আমাদের শিক্ষাদান প্রক্রিয়াটিই ত্রুটিপূর্ণ। ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা এই প্রজা বানানোর শিক্ষাব্যবস্থা পেয়েছি। এই শিক্ষাব্যবস্থাতেই অ্যাকাডেমিক চৌর্যবৃত্তির সুযোগ রয়ে গেছে। ডিগ্রি পাওয়ার জন্য যদি ১৬ বা ১৮ ঘণ্টা কমপ্রিহেনসিভ পরীক্ষা দিতে হতো, আর থিসিস লেখা যদি সামগ্রিক কাজের খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ হতো তাহলে তারা এমন কাজ করত না। আমেরিকান সিস্টেমে পিএইচডি করতে হলে কমপ্রিহেনসিভ পরীক্ষা দিতে হয়। আমি দেখেছি, তখন এই উপমহাদেশ থেকে যারা যেত তাদের ডিগ্রি পেতে অন্তত পাঁচ বছর লাগত। আরব দেশগুলোর ছাত্রদের ১০ বছরও লেগে যেত। পূর্ণ ছাত্র হিসেবে প্রতি টার্মে চারটি সাবজেক্টে চার ক্রেডিট আওয়ার করে ১৬ ক্রেডিট আওয়ার শেষ করতে হতো। ৪৮ ক্রেডিট আওয়ারে একটি মাস্টার্স ডিগ্রি হবে। প্রতিটি টার্মের শেষে পরীক্ষা হয় তাতে পাস ফেল হয়। চারটি সাবজেক্টে চার ঘণ্টা করে ১৬ ঘণ্টা কমপ্রিহেনসিভ পরীক্ষা দিতে হবে। ফেল করলে আবার পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হয়। পাঁচটি বিষয় থাকে। চারটি পিএইচডির সাথে যুক্ত। একটি ঐচ্ছিক। এই পাঁচটি বিষয়ে কমপ্রিহেনসিভ পরীক্ষায় পাস করার পরেই ধরে নেয়া হয় যে, তোমার পিএইচডি হয়ে গেছে। এরপর থিসিসের অংশটি খুবই ক্ষুদ্র। সব বিষয়ে পাস করার পর পছন্দসই কোনো বিষয়ে থিসিস লিখলে সেটা চারজন অধ্যাপক যাচাই ও অনুমোদন করার পর পিএইচডি কমিটি কাউকে ডিগ্রি দেবে। এভাবে কেউ ডিগ্রি পাওয়ার পর তার পক্ষে সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিভাগের শিক্ষার্থীদের পড়ানো সম্ভব হয়।

আসলে ওখানকার শিক্ষাব্যবস্থায় এডুকেশনাল মেথডলজিটা শেখানো হয়। আর এতসব বিষয় পড়তে হয় যে, এডুকেশনাল মেথডলজি না শিখে উপায় থাকে না। অধ্যাপনাকালে আমি ইসলামিক ইকোনমিকস পড়িয়েছি। কিন্তু সেটা আমার পিএইচডির বিষয় ছিল না। পশ্চিমাদের কাছ থেকে আমি এডুকেশনাল মেথডলজিটা শিখে এসেছি। এই শিক্ষা নিয়েই আমি ইসলামিক অর্থনীতি বিষয়ে পড়িয়েছি, লিখেছি।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি কমপ্রিহেনসিভ হতো, চেক অ্যান্ড ব্যালান্স থাকত তাহলে অন্যের লেখা চুরি করার প্রবৃত্তি জন্মাত না। দু’টি কারণে এই নৈতিক অধঃপতন হয়েছে। প্রথমত, আমাদের সিস্টেমে এমন কোনো সেফটি ভাল্ব নেই যা এ ধরনের চুরি প্রতিরোধ করতে পারে। কমপ্রিহেনসিভ পরীক্ষা দিতে হলে তো কেউ চুরি করার অবকাশই পাবে না। এখানে নাকি শিক্ষকদের সাথে খাতির থাকলে আর একই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করলেই ডিগ্রি পাওয়া যায়। আসলে আমাদের দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্যিকারের পিএইচডি দেয়ার সামর্থ্য আছে বলে আমার মনে হয় না। যদি তাই থাকত তাহলে কেন বিদেশে এসব পিএইচডির স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। যে পণ্য বাজারে বিক্রি করা যায় না সেই পণ্য তৈরি করে কী লাভ? আমাদের পিএইচডি বিশ্ববাজারে যদিও না বিকোয় তাহলে এই ডিগ্রি দিয়ে লাভ কী? কেউ গাড়ির মতো কিছু তৈরি করল কিন্তু সেটা বাজারে অচল তাহলে সেটাকে কি আমরা গাড়ি বলব? আমরা শিক্ষা কারখানায় তৈরি পণ্যগুলো বিক্রিযোগ্য হচ্ছে না। এ দেশ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী কাউকে আমেরিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ কি শিক্ষকতার জন্য ডাকছে। এমন মূল্যহীন শিক্ষা নিয়ে আমরা কিভাবে এগিয়ে যাবো?

আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কারের সময় এসেছে। এ জন্য এখনই দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে সামাজিক দুর্দশা থেকে আমাদের মুক্তি আসবে না। আজ আমাদের কারিকুলামের সাথে বাস্তব অবস্থার কোনো মিল নেই। আমি বলছি না ছাত্ররা রাজনীতি করবে না, কিন্তু ছাত্রদের জন্য দলীয় রাজনীতির প্রয়োজন নেই। তাদের রাজনীতি হবে জ্ঞানভিত্তিক। জাতির ক্রান্তিলগ্নে তারা এগিয়ে আসবে। ছাত্ররা এগিয়ে আসবে জাতির মহাবিপর্যয় বা যুগসন্ধিক্ষণের মতো ঘটনাগুলোতে। যেমন- ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার প্রশ্ন ইত্যাদি। এসব ঘটনার সাথে জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। এমন ঘটনা একটি জাতির জীবনে দুই একবার আসে বা কখনো আসেও না। এসব ঘটনা একেকটি মহাকারণ। ছাত্ররা রাজনীতি করবে মহাকারণের জন্য। ছাত্ররা যখন দলীয় রাজনীতির দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়, এর প্রভাব থেকে শিক্ষকরাও মুক্ত থাকতে পারে না। ফলে শিক্ষকরা যেসব অনৈতিক কাজ করছেন সেটা পরিস্থিতির ধারাবাহিকতা মাত্র।

এ ক্ষেত্রে আমরা পশ্চিমাদের কাছ থেকে ভালো জিনিসটি গ্রহণ করতে পারি। তাহলে এ সমাজ এগিয়ে যাবে। আমেরিকার পিএইচডি যদি ভালো হয় তাহলে আমরা কেন সেই ভালো পদ্ধতি অনুসরণ করব না। অন্য জাতির ভালো জিনিসটি গ্রহণ করেই তো মানবসভ্যতা এগিয়ে গেছে। রোমানদের জ্ঞান মুসলমানদের কাছে এসেছে। সেই জ্ঞান আরো সমৃদ্ধ হয়ে ইউরোপিয়ানদের কাছে গেছে। সে কারণেই ইবনে সিনার বই ইউরোপের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ৫০০ বছর পাঠ্য ছিল। মোট কথা, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। একে ক্ষতিকর রাজনৈতিক উপাদান থেকে মুক্ত করতে হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোসাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল