১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘অটো’ অথবা ‘টেন্ডারে ইলেকশন’ প্রস্তাব

-

এখন এ দেশে যেভাবে ইলেকশন হয় তাকে ‘ফিকশন’ বলাই ভালো। ফিকশন মানে অবাস্তব, অসার, অকল্পনীয় চিন্তা-ভাবনানির্ভর গল্পকথা। তাতে রোমাঞ্চ আছে। জটিলতা আছে। কুটিলতা ও অসমাপ্তি আছে। এরশাদের সময়ে ইলেকশন ছিল। ‘নির্বাচন প্রকৌশল’ ছিল। এর রকমফের ছিল। সে সময়ে এমনি এক কলামে ইলেকশনকে তিন ভাগ করেছিলাম।

১. ইলেকশন বাই ইলেকশন; সাধারণ স্বাভাবিক নির্বাচন; ২. ইলেকশন বাই কালেকশন; ভোটকেন্দ্র দখল করে মাস্তানদের মাধ্যমে ভোট সংগ্রহ করা ও ৩. ইলেকশন বাই ডিক্লারেশন; স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক ভোট যেভাবেই অনুষ্ঠান অথবা সংগ্রহ করা হোক না কেন- অবশেষে তার তোয়াক্কা না করে শুধু ঘোষণা দেয়া। খারাপেরও ব্যাকরণ থাকে। হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর পিপ্পা নরিস ২০০৪ সালের দিকে একটি তথ্যনির্ভর বোগাস ইলেকশনের রকমফের বর্ণনা করেন। গ্রন্থটির নাম দিয়েছেন ‘ইলেক্টোরাল ইঞ্জিনিয়ারিং’। বাংলায় ওই গ্রন্থের নাম দেয়া যায়- ‘নির্বাচন প্রকৌশল’।

এতে প্রকারান্তরে ওই তিন রকমের ইলেকশনের বর্ণনা আছে। এখন আমরা যে ইলেকশনের প্রকারভেদ দেখছি তা ওই সব তত্ত্বকথা ও ব্যাকরণকে অতিক্রম করেছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্র কর্তৃত্ব বিএনপিকে পরাজিত করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। সে নির্বাচনে কারসাজি ছিল। বিএনপি ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্র কর্তৃত্বের কারো কারো বিপদ-আপদের সম্ভাবনা ছিল। সুতরাং তারা ‘উপযুক্ত’ প্রকৌশল গ্রহণ করেছিলেন। এ সম্পর্কে মাহমুদুর রহমান ঢাউস এক গবেষণা গ্রন্থ উপস্থাপন করেছেন। সে নির্বাচন সম্পর্কে সাধারণ মন্তব্য ‘উপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট’।

২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে এ ধরনের মন্তব্য করার আর সুযোগই থাকল না। তার কারণ, এর ভিতর বাহির নেই, সবই ‘সদরঘাট’। ভোটার ব্যতীত, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ব্যতীত কিভাবে বোগাস ইলেকশন করা যায় তা ছিল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ২০১৮ সালের নির্বাচনে যা হয়েছে তা উপরোক্ত ইতিহাস ও ভূগোলকে অতিক্রম করেছে। সেটি ছিল ‘নিশীথ রাতের নির্বাচন’। কেউ কল্পনাও করেনি যে, এমনটি হতে পারে। এবার চট্টগ্রাম সিটির নির্বাচন এবং পৌরসভা নির্বাচনগুলোতে যে দৃশ্য দেখা গেছে তা কোনো ব্যাকরণেই সিদ্ধ বলা যাচ্ছে না।

তাই জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু নৈরাজ্য, সহিংসতা, ভোটডাকাতি এড়াতে অটো নির্বাচনের প্রস্তাব করেছেন। তিনি এর যৌক্তিকতা সমর্থনে সাম্প্রতিক এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অটো পাসের উদাহরণ দিয়েছেন। আমার মতে, এটি একটি উত্তম প্রস্তাব! সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য অটো পাস যেমন কার্যকর তেমনি নির্বাচনী ফলাফলের জন্য অটো পাস একটি মোক্ষম উপায় হতে পারে। পড়াশোনা করার জন্য যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং নানা ধরনের পরীক্ষার ঝামেলা পোহাতে হয়, অটো পাসে এরকম কোনো প্রথা ও পরিশ্রম ছাড়াই সার্টিফিকেট অর্জন করা যায়। নির্বাচন মানেই হচ্ছে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অর্থব্যয় এমনকি জীবনহানি। সুতরাং আওয়ামী লীগ সরকার এই অভিনব প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে নমিনেশন পেপার সাবমিট করার পর তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে পাস বলে ঘোষণা করতে পারেন। এভাবে ঘুষ, দুর্নীতি ও রাহাজানি ব্যতিরেকে সহজেই নির্বাচন পরিচালনা করা যায়।

আজকাল সর্বত্রই ফেসবুকের প্রবল প্রতাপ। সম্ভবত বাবলুর প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়ে একজন ফেসবুকে প্রস্তাব করেছেন- নির্বাচনটি টেন্ডারে দেয়ার জন্য। কোনো প্রকল্পের জন্য যেমন দরপত্র বা টেন্ডার আহ্বান করা হয়, নির্বাচনটিও তদ্রুপ হতে পারে। টেন্ডারের শর্তও সবাই জানেন। যেকোনো ক্ষেত্রে একটি ন্যূনতম প্রক্কলিত ব্যয় বরাদ্দ থাকে। নির্বাচন ক্ষেত্রেও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এরকম ন্যূনতম ফিগার থাকতে পারে। যেমন- ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বারের জন্য পাঁচ লাখ, চেয়ারম্যানের জন্য এক কোটি, পৌর চেয়ারম্যানের জন্য পাঁচ কোটি ইত্যাদি। জাতীয় সংসদের বিগত নির্বাচনগুলোয় বেচাবিক্রির অভিযোগ ও প্রতি-অভিযোগ বিস্তর। প্রধানমন্ত্রী নিজেই অভিযোগ করেছিলেন, বিএনপির লোকজন নির্বাচন করার জন্য যে টাকা পায় তা-ও খরচ করে না।
বিরোধী দলের অভিযোগ, সরকারি দল নমিনেশনের জন্য অকল্পনীয় অর্থ গ্রহণ করে থাকে। একেকটা নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের সময়ে যে অর্থ ব্যয় হয় তার হিসাব-নিকাশ নেই। যদি ১০০ কোটি ন্যূনতম ব্যয় বরাদ্দ হয়, তাহলে প্রার্থীর অভাব ঘটবে না। এভাবে টেন্ডারের মাধ্যমে যদি ইউপি মেম্বার থেকে সংসদ সদস্য পর্যন্ত নির্বাচন করা হয় তাহলে জাতি বিপুলভাবে লাভবান হতে পারে। এ ক্ষেত্রে, নির্ধারিত অর্থ নির্দিষ্ট স্থানে ব্যয় করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। যেমন- মেম্বার তার গ্রামে সে অর্থ ব্যয় করবেন।

চেয়ারম্যান তার ইউনিয়নের উন্নয়নের জোয়ারের জন্য এই অর্থ ব্যয় করবেন। জাতীয় সংসদের অর্থ অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হতে পারে। তাতে দেশজ অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠবে। এসব নির্বাচন অটো অথবা টেন্ডারে হোক- দল নিয়ে ঝগড়া বাধবেই। সে কারণে বিরোধ মীমাংসায় একক কর্তৃত্বের জন্য ‘বাকশাল’ ঘোষণা করা যেতে পারে। ‘এক নেতা এক দেশ’ হলে আর ঝগড়া থাকবে না। সবাই একইভাবে একই প্রতীকে নির্বিঘ্নে নির্বাচন করতে পারবেন। দেশে ‘কবরের শান্তি’ কায়েম হবে তখন।

বাকশাল আমলে আমরা এরকম ‘শান্তি’ লক্ষ করেছি। তাহলেও তার একটি আইনগত ভিত্তি ছিল। এখন যা হচ্ছে তা সেই বাকশালের চেয়েও নিকৃষ্ট। তখন নির্যাতন, নিপীড়ন, মামলা-হামলা এবং রক্তারক্তি এ সময়ের মতো ছিল না। নির্বাচন নির্বাচন খেলার মাধ্যমে যে দুঃসহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে তা রোধে জিয়াউদ্দিন আহমেদের প্রস্তাব অভিনব, সন্দেহ নেই। তিনি বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের সিটি নির্বাচনে দু’টো গরিব মায়ের বুক খালি হয়েছে। নির্বাচনে জীবনহানি হয়েছে। প্রশাসনকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছে। সরকার বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে!

একটি পত্রিকা চসিক ও পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে বড় জয়ে ফুরফুরে মেজাজে আছে সরকার, এরকম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আসলেই সরকারের ফুরফুরে মেজাজে থাকার কথা। পরীক্ষা না দিয়ে অটো পাসে ছাত্ররা যেমন ফুরফুরে মেজাজে আছে, তদ্রুপ সরকার বা আওয়ামী লীগের ফুরফুরে মেজাজে থাকা স্বাভাবিক। তবে অস্বাভাবিক হচ্ছে- নির্বাচন কমিশনের প্রশান্তি। নির্বাচন সম্পর্কে কমিশন সচিবের মন্তব্য অনেকের হাসির খোরাক হয়েছে। তার মতে- দেশ উন্নতির পথে; তাই মানুষ ভোটের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। উন্নতির পথে হলে সেই আনন্দে ভোটারদের তো আরো বেশি ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কথা। প্রশস্তি কিভাবে গাইতে হয় সে ন্যূনতম বোধটুকুও এদের নেই। তবে ইসি সচিবের দ্বিতীয় মন্তব্যটি অবশ্যই যৌক্তিক।

তিনি বলেছেন, ভোটাররা মনে করেন, ভোট দিয়ে কী লাভ? নির্বাচনের আগে ভোটারদের মুখে মুখে এ কথাটি বলতে দেখা গেছে। তারা বলছেন, ভোট যেখানেই দিক জিতবে নৌকা। সুতরাং ভোট দিয়ে কী লাভ! বেশির ভাগ নির্বাচন কেন্দ্রে তারা প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করেছেন। তারা স্লোগান দিয়েছেন ‘চেয়ারম্যান ওপেনে, মেম্বার/কাউন্সিলর গোপনে’। আর বিরোধী দল বরাবর অভিযোগ করে আসছে, ইভিএম পদ্ধতিটি আসলে ক্ষমতাসীনদের জয়কে নিশ্চিত করার একটি পদ্ধতি মাত্র। ‘লোকজন বলাবলি করছে, ইভিএমের কারসাজি এরকম যে, বোতাম টিপলেই একটি নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট চলে যায়।’

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এতটাই সার্থক ও সফল যে, সিইসি বলেছিলেন, ‘আমেরিকা বাংলাদেশের নির্বাচন থেকে শিখতে পারে’। রসিকজনের মন্তব্য- আসলেও তো তাই। আমেরিকার নির্বাচন কমিশন যদি বাংলাদেশ থেকে শিখত, তাহলে তো ট্রাম্প কোনো দিনই কোনোভাবেই পরাজিত হতে পারতেন না। আমাদের নির্বাচন কমিশনের সেখান থেকে শেখার কিছু নেই।

কারণ, আমেরিকায় অবশেষে গণতন্ত্রই জয় লাভ করেছে। একজন বিশ্লেষক চট্টগ্রামের নির্বাচনকে দশের মধ্যে ছয় দিয়েছেন। সাধারণ মানুষ মনে করে, তাদের শূন্য পাওয়া উচিত। কারণ নির্বাচন-পূর্ববর্তী ব্যবস্থা ছিল লোকদেখানো। নির্বাচনের দিনের ব্যবস্থা ছিল সহিংস। নির্বাচন-পরবর্তী ব্যবস্থা ছিল নির্লজ্জভাবে নির্লিপ্ত। অবস্থাদৃষ্টে এ নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে মন্তব্য করা যায়, তারা ‘কানে দিয়েছে তুলো, পিঠে বেঁধেছে কুলো’। জনগণের কোনো আওয়াজ ও আর্তনাদ তারা শুনতে পায় না। গণমাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের কোনো গালমন্দের তারা তোয়াক্কা করে না। বিবেকশূন্য হলে এরকম হতে বাধা নেই।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। তাদের সেই বাছাই প্রক্রিয়াও ছিল কারসাজির। রাষ্ট্রপতি দৃশ্যত নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছিলেন। প্রতিটি রাজনৈতিক দল থেকে নাম আহ্বান করেছিলেন এ জন্য। আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে নমিনেশন দিলে নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন্ন হয়, সে কারণে ১৪ দলের নামে নেহাত বিশেষ এক দলের তালিকায় ছিল বর্তমান সিইসির নাম। এভাবে ক্ষমতাসীন দল কৌশলেই তাদের প্রার্থীকে জিতিয়ে নেয়।

এক বছর পরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। তাদের মাধ্যমেই পরিচালিত হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। এ ধরনের লোকজন যাতে মনোনীত হতে না পারেন, এখন থেকেই সে আয়োজন ও আন্দোলন থাকতে হবে। একটি স্বচ্ছ ও ক্ষমতাবান নির্বাচন কমিশন যে, বাংলাদেশেও কার্যকর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে, তার উদাহরণ বাংলাদেশেই রয়েছে। এম এ সাইদ ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজনের নিকটাত্মীয়। তার বাড়ি ছিল ওদিকটায়।

অথচ ২০০১ সালে নির্বাচনে যখন বিএনপি বিজয়ী হলো তখন তাকে আওয়ামী লীগ ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে গাল দিয়েছিল। তখন এম এ সাইদ বলেছিলেন, ‘আমি নিরপেক্ষ নই; কিন্তু নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা আমার দায়িত্ব’। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ওই নির্বাচন বাতিল করার জন্য চাপ দিয়েছিল। তিনি রাজি না হওয়ায় তাকেও ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র লকব পেতে হয়। আগাম বলে রাখা ভালো যে, আগামী নির্বাচন যেন তত্ত্বাবধায়ক ধরনের নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হয়। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে কোনো দিনই নির্বাচন সুন্দর, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। বিগত এক যুগের ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে।

এই নির্বাচন কমিশন বিগত সময়ে নিজেদের পক্ষপাতিত্ব, অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও দায়িত্বহীনতায় জাতির কাছে অযোগ্য প্রমাণ করেছে। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে দেশের শীর্ষস্থানীয় ৪২ জন নাগরিক তাদের পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলেন। গত জানুয়ারির শেষ দিকে তারা সেই আবেদন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তারা রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতির অভিযোগ তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের সামগ্রিক স্বার্থে, সততার স্বার্থে, স্বচ্ছতার স্বার্থে রাষ্ট্রপতি অনুকূল সিদ্ধান্ত নেবেন- সাধারণ মানুষের এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল