২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মৃতদের ভোটাধিকার চর্চা!

-

২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর দেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে মধ্যরাতে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ভর্তি হওয়ায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নিশি রাতের ভোটের খেতাবে ভূষিত হয়। ভোটের দিন বিবিসি বাংলার এক খবরে বলা হয়, চট্টগ্রাম-১০ আসনের শহীদনগর সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে গিয়ে সকালে ভোট গ্রহণের আগে ব্যালট বাক্স ভরা দেখেছেন বিবিসির সংবাদদাতা।

এর ছয় মাস পর ভোটের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সুজনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০৩টি আসনের ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। সেই প্রবণতা এখনো চলছে। শুধু চলছেই না, ক্ষণে ক্ষণে এই প্রবণতার পালে হাওয়া লাগে। তবে এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের দেশে শতভাগ ভোট পড়ার নজির অভূতপূর্ব নয়। রেকর্ড বলে, অতীতেও এমন কাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। একানব্বইয়ের পঞ্চম সংসদ নির্বাচন এবং ছিয়ানব্বইতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর এই প্রবণতা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। কিন্তু ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে আবার ফিরে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে শতভাগ ভোট পড়ার কদর খানিকটা বেড়েছে।

শতভাগ ভোট গ্রহণের বিষয়টি নেতিবাচকভাবে না দেখে বরং ইতিবাচকভাবে দেখলেই সব ‘ল্যাঠা’ চুকে যায়। মনে প্রশান্তি আসবে। মনোজ্বালা কমবে। শতভাগ ভোট গ্রহণ স্বদেশী গণতন্ত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশী গণতন্ত্রের সৌন্দর্যবর্ধক। বিস্ময়কর অর্জন। রীতিমতো রফতানিযোগ্য। যেমন ১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধিত হওয়ার পর সোভিয়েত রাশিয়া দেশে দেশে সাম্যবাদ রফতানিতে বহুমাত্রিক উদ্যোগ নেয়। সেই ধারা অব্যাহত ছিল সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। বিশ্ব -ইতিহাসে ওই সময়কে উল্লেখ করা হয় স্নায়ুযুদ্ধের কালপর্ব হিসেবে। যে সময় রাশিয়া আর আমেরিকার মধ্যে ছিল টান টান উত্তেজনা। বিশ্ব হয়ে পড়ে দুই শিবিরে বিভক্ত। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর সেটিও অনেক দেশে রফতানির চেষ্টা করে তেহরান। ঠিক তেমনি আমরাও দেশে দেশে গণতন্ত্র টেকসই করার স্বার্থে শতভাগ ভোট গ্রহণের কলাকৌশল, মানে নির্বাচনশৈলী রফতানি করতে পারি।

অস্বীকার করার কোনো জ্বো নেই, শতভাগ ভোট পড়ার উপরি পাওনা, মৃতদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার উত্তম পদ্ধতি। পরলোকগতদের ভোটাধিকার চর্চা। এর জন্য কে এম নুরুল হুদা নির্বাচন কমিশন ষোলোআনা কৃতিত্বের দাবিদার। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আমলেই এই নজির সাধারণীকরণের পর্যায়ে রয়েছে। শতভাগ ভোট পড়ার মাজেজা, মানে মাহাত্ম্য বুঝতে আমরা গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কুষ্টিয়ার মিরপুর পৌরসভার নওপাড়া ভোটকেন্দ্রকে নমুনা হিসেবে হাজির করতে পারি। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, ‘কুষ্টিয়ার মিরপুর পৌরসভার নওপাড়া এলাকার বাসিন্দা আতর আলী শেখ (৬২) বার্ধক্যের কারণে গত ৬ আগস্ট মারা যান। একই এলাকার রাবেয়া খাতুন (৭৮) গত ১০ জুলাই এবং নুর ইসলাম প্রামাণিক (৫০) গত ২১ ডিসেম্বর মারা যান। এ ছাড়া স্থানীয় লোকজন আরো কয়েকজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন। বেশ কয়েকজন কর্মসূত্রে বিদেশে এবং বিভিন্ন জেলায় অবস্থান করছেন। এরকম অন্তত ২৫ জন রয়েছেন বলে মুখে মুখে হিসাব করে জানালেন স্থানীয় লোকজন। তবে নওপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোটের হিসাব বলছে মৃত এবং বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিরাও ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মিরপুর পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দিতে এসেছিলেন! কারণ ওই কেন্দ্রে সে দিন শতভাগ ভোট পড়েছিল (প্রথম আলো, ২১ জানুয়ারি ২০২১)। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বরত রিটার্নিং কর্মকর্তা কেন্দ্রভিত্তিক যে ফল প্রকাশ করেছেন, তাতে এরকম চিত্রই উঠে এসেছে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কুষ্টিয়া, মিরপুর, ভেড়ামারা ও কুমারখালী নির্বাচনে মেয়র পদে কেন্দ্রভিত্তিক ফলের এসব উপাত্ত সংগ্রহ করেন গণমাধ্যমকর্মীরা।
গণমাধ্যমের খবরে আরো প্রকাশিত, ‘জেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে মিরপুর পৌরসভা নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৬ জানুয়ারি ব্যালটে অনুষ্ঠিত মিরপুর পৌরসভা নির্বাচনে মোট ১০টি কেন্দ্রে গড়ে ভোট পড়েছিল ৮৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এর মধ্যে সাতটিতে ৮০ শতাংশের উপরে, দু’টি কেন্দ্রে ৭৯ শতাংশের উপরে এবং নওপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে।

মিরপুর পৌরসভা নির্বাচনে ওই ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার বিষয়ে জেলাজুড়ে নানামুখী আলোচনা লোকমুখে শোনা যায়। মিরপুর পৌরসভা নির্বাচনের প্রচারণার সময় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী (বিজয়ী) এনামুল হক দু’টি পথসভায় বক্তব্যে প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে ভাইরাল হয়েছিল। প্রার্থীর ওই বক্তব্যের প্রভাবেই এরকম ভোট পড়েছে কি না, তা নিয়েও জল্পনা রয়েছে।

শতভাগ ভোট পড়ার অসাধ্য সাধনের বিষয়ে ওই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিজাইডিং কর্মকর্তা (স্কুলশিক্ষক) আবু বকর সিদ্দিকের ভাষ্য, ‘যারা বুথে ভোট গ্রহণ করেছেন, তারাই বলতে পারবেন কিভাবে ভোটাররা ভোট দিয়েছেন। যেহেতু শতভাগ ভোট পড়েছে, তাই এটা স্বাভাবিক বিষয়। কারণ ভোটের দিন কেন্দ্রে সুষ্ঠুভাবেই ভোট গ্রহণ হয়েছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’ শতভাগ ভোট পড়ার কৃতিত্ব অর্জনকারী বর্তমান সিইসি কে এম নুরুল হুদা একবার বাংলাদেশের নির্বাচন থেকে আমেরিকাকে শিক্ষা নিতে বলেছিলেন। মার্কিনিরা শিক্ষাটা নেননি। এ কথা হলফ করে বলা যায়, নিলে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে যেতে পারতেন। দুর্ভাগ্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। বাংলাদেশের সিইসির নসিহত আমলে না নেয়ায় পরাজয়ের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে পস্তাতে হচ্ছে। নির্বোধ আর কাকে বলে!

কে এম নুরুল হুদা কমিশন দায়িত্ব নিয়েছে ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। সেই হিসাবে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি চার বছর পূরণ হবে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে নিশ্চয়ই নুরুল হুদা কমিশনের আমলনামাও লিপিবদ্ধ হবে। সেই আমলনামা পড়ে নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীদের উত্তরসূরিরা আনন্দিত না লজ্জিত হবেন, বর্তমান মাননীয়রা দায়িত্ব পালনের চাপে একবারও এমন কথা ভাবার ফুরসতও পাননি, শুধু সংবিধান অর্পিত কর্তব্যকাজ করতে গিয়ে। নুরুল হুদা কমিশনের এমন অর্জনের পরও দেশের ৪২ বিশিষ্টজন ইসির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে একবার নয়, তিন তিনবার চিঠি দিয়ে নালিশ করেছেন। এটাকেই বলে পরশ্রীকাতরতা।

কিছু বিশিষ্টজনের মতে, বর্তমান ইসি শপথ নেয়ার পর থেকেই কমিশনের পদাধিকারী ব্যক্তিরা শপথ ভাঙতে শুরু করেন। নিজেদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও খামখেয়ালিপনা দেখাতে দেখাতে তারা নির্বাচনী ব্যবস্থাটি ধ্বংসের কিনারে নিয়ে এসেছেন। এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীরা নিজেদের এতটাই খেলো করে ফেলেছেন যে, কেউ মনে করেন না তারা সুষ্ঠু ও অবাধ দূরে থাক, মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারবেন। এই চার বছরে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে যেভাবে তারা ধ্বংস করেছেন, অতীতে কোনো কমিশন এমন কর্ম আর করেনি।

তবে বর্তমান কমিশন জীবিতদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও মৃতদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রাণপাত করছে। এটিও কম কী! বাংলা একটি প্রবাদ আছে, ‘ নাই মামার চেয়ে কানা মামাও ভালো’। এমন বাস্তবতায় দেশের মানুষ এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে, নাই বা পারল ইসি জীবিতদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। নিদেনপক্ষে মৃতদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নুরুল হুদা কমিশন নিয়েছে; তাকে অন্তত সাধুবাদ জানানো আমাদের পবিত্র কর্তব্য! হাজার হোক তারা তো গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তাদের একটা ইজ্জত আছে না?


camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement