২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘দিস ইজ অ্যাপারথেড’

‘দিস ইজ অ্যাপারথেড’ - ছবি : সংগৃহীত

বি’সালেম (B’Tselem) হচ্ছে জেরুসালেমভিত্তিক একটি অলাভজনক সংগঠন, যার বিবৃত লক্ষ্য, ইসরাইলের অধিকৃত ভূখণ্ডগুলোতে ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাক্ষ্য-প্রমাণ সংরক্ষণ করা এবং এ ভূখণ্ড থেকে ইসরাইলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো। এটি নিজেকে পরিচিত করে ‘ইসরাইলি ইনফরমেশন সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস ইন দ্য অকুপাইড টেরিটরিজ’ হিসেবে। সংগঠনটি স্বীকার করে- ফিলিস্তিনে একমাত্র ইসরাইলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটানোর মধ্য দিয়ে এমন একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব, যেখানে ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি জনগণের জন্য সমভাবে নিশ্চিত হবে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সাম্য; যাদের বসবাস জর্দান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে। সংগঠনটির বিশ্বাস- ইসরাইলের অব্যাহত দখলদারিত্ব বজায় রেখে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো উপায় নেই। বি’সালেম সংগঠনটির উপস্থিতি রয়েছে ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘বি’সালেম ইউএসএ’ নামে। এর জন্ম ১৯৮৯ সালে। সেই থেকে এটি কাজ করে আসছে জেরুসালেমসহ পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের। বি’সালেম প্রকাশ করে নানা পরিসংখ্যান, প্রমাণপত্র, প্রত্যক্ষ সাক্ষীর বিবরণ, ভিডিও ফুটেজ ও রিপোর্ট। গত ১২ জানুয়ারি এ সংগঠন প্রকাশ করেছে এর ‘অ্যা রিজিম অব জিউইশ সুপ্রিম্যাসি ফ্রম দ্য জর্ডান রিভার টু মেডিটারানিয়ান সি : দিস ইজ অ্যাপারথেড’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট। এই রিপোর্টে ইসরাইলের চারটি ক্ষেত্রে বর্ণবাদী বৈষম্যনীতি প্রয়োগের কথা বিশেষভাবে জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে : ভূমি, নাগরিকত্ব, স্বাধীন চলাফেরা ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। বি’সালেম এই রিপোর্টের মাধ্যমে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে : এই বর্ণবাদী আচরণ হচ্ছে ইসরাইলের সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।

রিপোর্টে বলা হয়- জর্দান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে মোটামুটি হিসেবে এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ বসবাস করে একটি একক রিজিম তথা শাসনব্যবস্থার অধীনে। এ জনগোষ্ঠীর অর্ধেক ইহুদি ও বাকি অর্ধেক ফিলিস্তিনি। কিন্তু জনগণ, রাজনৈতিক মহল ও গণমাধ্যমের মধ্যে প্রচার আছে, এই এলাকা পাশাপাশি দুই শাসনব্যবস্থার অধীনে চলছে, যা আলাদা করা হয়েছে গ্রিনলাইনের মাধ্যমে। একটি শাসনব্যবস্থা বলবৎ আছে গ্রিন লাইনের ভেতরে সার্বভৌম ইসরাইলে। আর এটি হচ্ছে স্থায়ী গণতান্ত্রিক দেশ। অন্য অংশটি ইসরাইল দখলে নেয় ১৯৬৭ সালে। ধরে নেয়া হয় এর চূড়ান্ত মর্যাদা নির্ধারিত হবে ভবিষ্যৎ কোনো সমঝোতার মাধ্যমে। এখন অস্থায়ীভাবে এই ভূখণ্ডের ও এর ৫০ লাখ ফিলিস্তিনের ওপর জারি রয়েছে ইসরাইলি দখলদারিত্ব।

এই সুদীর্ঘ সময় ধরে এই দুই ধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্যকার পার্থক্য বিস্তৃত হয়েছে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে। এ ধরনের অবস্থা বিরাজ করছে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। এখন হাজার হাজার ইহুদি সেটেলারে বসবাস করে গ্রিন লাইনের পুবদিকে স্থায়ী বসতগুলোতে, যদিও এরা আগে বসবাস করত গ্রিন লাইনের পশ্চিমে। পূর্ব জেরুসালেমকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইল তার সার্বভৌম ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত করে নিয়েছে। পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও কার্যত সংযুক্ত করা হয়েছে ইসরাইলের সাথেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- আচ্ছন্ন করে রাখা সত্যটি হলো, ভূমধ্যসাগর ও জর্দান নদীর মধ্যবর্তী পুরো ভূখণ্ড পরিচালিত হয় একটি বর্ণবাদী নীতির আওতায়। এ নীতি ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ওপর ইহুদি নামের একটি গোষ্ঠীর সুপ্রিম্যাসিকে প্রতিষ্ঠিত ও সুসংহত করার নীতি। সব কিছু মিলিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়- এই দুই শাসনব্যবস্থা সমান্তরাল নয়। আসলে পুরো এলাকাটিই শাসিত হচ্ছে একটিমাত্র ইসরাইলি শাসনব্যবস্থার অধীনে একটিমাত্র নীতি অবলম্বন করে। এই শাসনব্যবস্থার বর্ণবাদী নীতিটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে ২০১৮ সালে, ইসরাইলের মৌলিক আইন ‘ইসরাইল- দ্য ন্যাশন স্টেট অব দ্য জিউইশ পিপল’ পাস করার মধ্য দিয়ে; কিংবা ২০২০ সালে পশ্চিম তীরের অংশবিশেষ ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত করার আলোচনা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার মধ্য দিয়ে। সদ্যবিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘টু-ন্যাশন থিওরি’ ভুলে যাওয়ার পরামর্শ এবং তার ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ প্রকাশের পর তা আরো সুস্পষ্ট হয়।

বি’সালেমের এই রিপোর্টে বিশ্লেষণ করা হয়, কী করে ইসরাইলি শাসনব্যবস্থা পুরো এলাকাটিকে (ইসরাইলের সার্বভৌম ভূখণ্ড, পূর্ব জেরুসালেম, পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা) নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়টি স্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে চলেছে। আর সময়ের সাথে তাদের এই তৎপরতা কেবলই জোরালো করে তোলা হচ্ছে। আসলে যারা শুরু থেকেই বলে আসছেন- ইসরাইল কোনো গণতান্ত্রিক দেশ নয়, একটি বর্ণবাদী দেশ, এটি অব্যাহত ও নিয়মিত এর বর্ণবাদী আচরণ প্রদর্শন করে আসছে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে, ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে দশকের পর দশক ধরে, যাবতীয় কর্মকাণ্ডে ইহুদিদের প্রাধান্য দিচ্ছে, আর ফিলিস্তিনি জনগণের যাবতীয় ন্যায্য অধিকার অস্বীকার করে চলেছে; বি’সালেমের রিপোর্ট যেন তাদের কথারই প্রতিফল। বি’সালেমের রিপোর্টে জোর দিয়ে বলা হয়েছে : ইসরাইল গণতান্ত্রিক দেশ নয়, বর্ণবাদী দেশ।

এ ধরনের মন্তব্যের মাধ্যমে ইসরাইলের এই ডানপন্থী সংগঠন কী বোঝাতে চায়, সে বিষয়টি স্পষ্ট করা যাক। সংগঠনটি এর মাধ্যমে এ কথা বলছে না- ইসরাইল পরিণত হতে যাচ্ছে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্রে কিংবা এটি কাজ করছে গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধে অথবা ইসরাইল শুধু অধিকৃত ফিলিস্তিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি অগণতান্ত্রিক বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থা। এর কোনোটাই বি’সালেম দাবি করছে না। বরং, এই সংগঠন দীর্ঘ কয়েক দশক থেকে ইসরাইল সরকারের রাজনৈতিক, সামরিক, ভূমি-মালিকানা, পানি সরবরাহ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও আরো অনেক ক্ষেত্রের কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য বর্ণবাদী সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে আসছে। সংগঠনটির মতে- ইসরাইলে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পুরোপুরি বর্ণবাদী একটি অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। বি’সালেমের নিজস্ব সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে করা এই উপলব্ধিগত বিবেচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ, এর ভিত্তিতে ফিলিস্তিনি জনগণ ও ইসরাইলের ইহুদিদের সামনে সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে সমঝোতার মাধ্যমে ইসরাইলকে এই বর্ণবাদ থেকে বের করে নিয়ে আসার। সেই সাথে, দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক একটি সমাধানের মাধ্যমে এ এলাকায় বাস্তবভিত্তিক ও ন্যায়ভিত্তিক স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যেখানে উভয় রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি ও ইহুদিরা সমান অধিকার নিয়ে স্বাধীনভাবে পাশাপাশি বসবাস করতে পারে। ইসরাইলের বর্ণবাদী অগণতান্ত্রিক নীতি প্রয়োগ ও ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্ব বহাল রেখে সে লক্ষ্যে পৌঁছা যে সম্ভব নয়, তা প্রমাণিত হয়ে গেছে পেছনে ফেলা আসা কয়েক দশকের ইতিহাস থেকে। আর ইসরাইলকে বর্ণবাদী বৃত্ত থেকে বের করে এনে একটি ঘৃণিত রাষ্ট্র থেকে মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়োজনেও ইহুদিদের জন্য তা অপরিহার্য। মনে হয়, এ কাজে বিশ্বসমাজ তো বটেই, এমনকি বিবেকবান ইহুদি সমাজও এর অপরিহার্যতা উপলব্ধি করে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসার চরম সময় এখন। কারণ, ইসরাইল আর কতকাল থাকবে একটি ঘৃণিত রাষ্ট্র আর ফিলিস্তিনইবা আর কতদিন থাকবে বর্ণবাদী ইসরাইলের দখলে?

বিশ্ব মানবসমাজের চোখের সামনে ইসরাইলি বর্ণবাদ পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে দেশটি অনুসরণ করে আসছে ‘ডিভাইড, সেপারেট অ্যান্ড রুল’ নীতি। গাজা উপত্যকা ছাড়া বাকি পুরো এলাকায় ইসরাইলি ইহুদি নাগরিকরা বিচরণ করে একটি একক ভূখণ্ড হিসেবে। গ্রিন লাইনের অর্থ, ইসরাইলিরা এর পশ্চিমে কিংবা ভেতরেই বসবাস করুক, এই লাইন পার হয়ে তাদের কিছুই করার নেই। আমরা জানি- গ্রিন লাইনের পুবদিকের বসতি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত করা হয়নি, অথচ সেখানে তাদের অধিকার ও মর্যাদা অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা হয়েছে। অপর দিকে যে এলাকায় ফিলিস্তিনিরা বসবাস করে, ইসরাইল সরকার সেটিকে বেশ কয়েকটি ইউনিটে বিভক্ত করেছে। এসব ইউনিটে বিভিন্ন সংজ্ঞায় শাসন চলে ভিন্ন ভিন্ন কায়দায়। বিভিন্ন ইউনিটের ফিলিস্তিনিরা ভোগ করে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার অধিকার। এই বিভাজন শুধু ফিলিস্তিনিদের বেলায়ই প্রযোজ্য। যে ভৌগোলিক এলাকা ইহুদিদের জন্য সংক্রামক, সেটি ফিলিস্তিনিদের জন্যই নানাভাবে বিভাজিত।

ফিলিস্তিনি ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের সার্বভৌম ভূমিতে (কোনো কোনো সময়ে এটিকে বলা হয় ‘আরব-ইসরাইল’) বসবাস করত। তখন সে রাষ্ট্রে ইসরাইলি নাগরিক ছিল ১৭ শতাংশ। তখন তারা এমন সব অধিকারও ভোগ করত যা আইনে ও প্রথায় অন্তর্ভুক্ত অধিকারের চেয়েও বেশি। কিন্তু ইসরাইলের অধিকৃত এলাকায় ফিলিস্তিনিরা যেসব অধিকার নিয়ে দশকের পর দশক বসবাস করছে, তা পুরোপুরি অমানবিক, অগণতান্ত্রিক ও ন্যায়নীতিবহির্ভূত।

মোটামুটি সাড়ে তিন লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করে পূর্ব জেরুসালেম। এতে রয়েছে ৭০ হাজার ‘ডুনাম’। প্রতিটি ডুনামের আয়তন এক হাজার বর্গমিটার। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল পূর্ব জেরুসালেমকে এর সার্বভৌম ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত করে নেয়। তাদেরকে ইসরাইলের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এরা বিশেষ কোনো পারমিট ছাড়াই ইসরাইলে বসবাসের ও কাজের অধিকার পায়, সুযোগ পায় স্বাস্থ্যবীমা ও সামাজিক সুবিধা পাওয়ার, সেই সাথে পায় নির্বাচনে ভোট দেয়ার অধিকার।

যদিও ইসরাইল কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম তীরকে ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত করেনি, তবুও দেশটি এই ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে নিজের ভূখণ্ড হিসেবে। ২৬ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি প্রজা (!) সেখানে কঠোর ইসরাইলি সামরিক শাসনের আওতায় কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছাড়াই বসবাস করে। এদের বসবাস কয়েক ডজন বিচ্ছিন্ন এনক্লেভ তথা ছিটমহলে; অন্য দেশের ভেতরে থাকা এলাকা হিসেবে। এই ভূখণ্ডের ৪০ শতাংশ ইসরাইল হস্তান্তর করেছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) বেসামরিক প্রশাসনের কাছে। তা সত্ত্বেও, সেখানে ‘পিএ’ হচ্ছে ইসরাইলের সাব অর্ডিনেট তথা অধস্তন। পিএ সেখানে ইসরাইলের সম্মতিক্রমে সীমিত ক্ষমতাই প্রয়োগ করতে পারে।

গাজা উপত্যকায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস। সেখানেও তাদের রাজনৈতিক অধিকার নেই। ২০০৫ সালে ইসরাইল সেখান থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। সেখানে ইসরাইলের গড়ে তোলা বসতি ভেঙে ফেলা হয়। সেই সাথে ফিলিস্তিনি জনগণের দায়দায়িত্ব থেকে ইসরাইল সরে আসে। ২০০৭ সালে হামাস দায়িত্ব নেয়ার পর গাজা উপত্যকায় ইসরাইল অবরোধ আরোপ করে, সে অবরোধ আজো বহাল। এ অবরোধের বছরগুলোতে ইসরাইল বাইরে থেকে গাজা উপত্যকার প্রায় সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে।

উল্লিখিত প্রতিটি ইউনিটে ফিলিস্তিনিদের ইসরাইল ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অধিকার দেয়। এসব অধিকারের কোনোটাই ইসরাইলের ইহুদি নাগরিকদের অধিকারের সাথে কোনো বিবেচনায়ই তুলনা করা যায় না। প্রতিটি ইউনিটে এগিয়ে যাচ্ছে ইহুদি সুপ্রিম্যাসি প্রতিষ্ঠার কাজ। এসব ইউনিট এলাকায় তাদের অন্যায়ের মাত্রাও বিভিন্ন। অবরোধের অধীন গাজায় বসবাসের অভিজ্ঞতা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি প্রজা, ইসরাইলি ভূখণ্ডে পূর্ব জেরুসালেমের ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বসবাসের অভিজ্ঞতা এক নয়। এসব বিভিন্নতা সত্ত্বেও একটি বিষয় সত্য : ফিলিস্তিনিরা সার্বিকভাবে পরাধীন এক পরিবেশে বসবাস করছে ইসরাইলের শাসনাধীনে। একই এলাকায় বসবাস করেও তারা ইহুদিদের অধস্তন। এদের ওপর অব্যাহতভাবে কার্যকর রয়েছে ইহুদিদের বর্ণবাদী যাঁতাকল। এভাবেই ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্ণবাদী ‘ডিভাইড সেপারেট, রুল’ নীতি প্রয়োগ করে চলেছে। আর এতে সক্রিয় সহযোগিতা আছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের।

দুনিয়ার সব মানুষ জানে, ফিলিস্তিনিদের কথা বলার স্বাধীনতা বরাবরই সীমিত। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্বের নিছক সমালোচনা ছাড়া কার্যকর কিছুই করেনি। অপর দিকে ইসরাইলি সরকার এই দখলদারিত্বের মাত্রা চরমে পৌঁছিয়েছে। ফিলিস্তিনের ওপর অত্যাচার থামছে না। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন, গ্রেফতার, কারাগারে পাঠানো, এমনকি হত্যা চলছে অবাধে। বি’সালেমের মতো কিছু ইসরাইলি এনজিও এর বিরুদ্ধে কথা বলছে। সরকার তাদের ওপর ক্ষুব্ধ। ২০০২ সালে ইসরাইল সরকারের অর্থায়নে একটি সংগঠন ‘এনজিও মনিটর’ প্রতিষ্ঠা করা হয় অধিকৃত এলাকায় আদ্দামির, আল-মিজান স্টোর, আল-হক, পিসিএইচআর প্রভৃতি সংগঠনের ওপর নজর রাখার লক্ষ্যে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইলি সেনাবাহিনী তল্লাশির নামে রামাল্লাহভিত্তিক মানবাধিকার গোষ্ঠী আদ্দামিরের অফিস তছনছ করে। এ ধরনের আরো অনেক হামলা চালানো হয় অনেক মানবাধিকার সংগঠনের অফিসে।

অতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলি সরকারের তৎপরতা থেকে বোঝা যায়, ইসরাইল সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোকেও সরকারের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করেছে। এসব সংগঠনের ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হচ্ছে, বাধা দেয়া হচ্ছে ইসরাইলি জনগণের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে। সর্বশেষ, গত ১৭ জানুয়ারি ইসরাইলের শিক্ষামন্ত্রী উয়াব গ্যালেন্ট এক টুইট বার্তায় তার মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন যেসব সংগঠন ইসরাইলকে ‘বর্ণবাদী দেশ’ বলে উল্লেখ করে, ওগুলোকে তার মন্ত্রণালয়ে ঢুকতে না দেয়ার জন্য। আসলে এই মন্ত্রী বি’সালেমকে লক্ষ করেই এ ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন।

কারণ, এই সংগঠনটি ইসরাইল নিজেকে গণতান্ত্রিক ও অবাধ বাক-স্বাধীনতার দেশ দাবি করার প্রতি সোচ্চার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। সংগঠনটি বলেছে, ইসরাইল সরকার মানবাধিকারকর্মীর সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে এবং বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের ভিন্নমত পোষণের অধিকার হরণ করে বাক-স্বাধীনতা খর্ব করেছে।

ওই মন্ত্রীর এই নির্দেশে বি’সালেম পিছু হটেনি। বরং এই সংগঠন দৃঢ়তার সাথে বলেছে, তারা বাস্তবতার সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষণ করে যাবে এবং তারা ইসরাইলের বর্ণবাদী তৎপরতা সম্পর্কে যা জানতে পারবে তার প্রতিবাদ করবে এবং সেই সাথে ইসরাইলের জনগণ ও বিশ্ববাসীকে তা জানাবে। বি’সালেমের পরিচালক হ্যাগাই এল-অ্যাড গত জানুয়ারি মাসে শত শত ইসরাইলি শিক্ষার্থীর সাথে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। তিনি তাদের জানিয়েছেন সামরিক দখলদারিত্ব ও তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ঘটনার কথা। এই বৈঠকের পর এল-অ্যাড এক টুইট বার্তায় জানান- ‘The @btselem lecture did take place this morning. The Israeli government will have to contend with us until the apartheid regime ends.’

বি’সালেমের দৃঢ়তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলো ইসরাইলি বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে বর্ণবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনে তার দখলদারিত্বে অবসান ঘটাতে বাধ্য হবে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোকে সব বিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানোও অপরিহার্য। তখনই শুধু দুই রাষ্ট্রভিত্তিক ফিলিস্তিন সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন অবশ্য তেমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন। এখন দেখার পালা তিনি শেষ পর্যন্ত কী করেন। আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, ইসরাইলেও অনেক বিবেকবান শান্তিবাদী ইহুদি রয়েছেন, যারা চান যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্ণবাদী দখলদারিত্বের অবসান হোক, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হোক; ফিলিস্তিন ও ইসরাইল রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি ও ইহুদিরা সম-অধিকার নিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করুক। সেই সাথে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে আসুক স্থায়ী শান্তি।


আরো সংবাদ



premium cement