২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পসিবল, আলট্রাটেক প্রযুক্তির মাধ্যমে

পসিবল, আলট্রাটেক প্রযুক্তির মাধ্যমে - নয়া দিগন্ত

একটি বিজ্ঞাপনচিত্রের কথা বলছি। ছেলে বাড়ি বানাবে। বাপ সে জায়গাটা দেখতে গিয়েছেন। রেললাইনের পাশে প্লট। ট্রেন এলে দেয়ালে টানানো জিনিসপত্র পড়ে ভেঙে যায় ঝরঝর করে। বাবা বললেন, এখানে বাড়ি? ইম্পসিবল। তখন একজন তরুণীর আবির্ভাব। তিনি ঝটপট বললেন, পসিবল, আলট্রাটেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তাতে লোহার রড আর সিমেন্ট এমনভাবে আটকে যায় যে, আর নড়ন চড়ন নেই। সেগুলো এমনই শক্তভাবে জোড়া লেগেছে যে, চায়ের কাপ রাখলে, কাপের চা পর্যন্ত কাঁপে না। কী দারুণ মজার ব্যাপার, না? টাকা আর দুর্নীতি কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে এমনি এক শক্ত বন্ধন তৈরি করেছে। ব্যাংক থেকে চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি হলমার্ক গ্রুপ। হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদের ভায়রা তুষার আহমেদ। তিনি ছিলেন হলমার্কের জেনারেল ম্যানেজার। টাকা তসরুফের অভিযোগে তারা কারাগারে আটক আছেন।

বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে দুর্নীতির খবর কম বেশি সবাই জানেন। কারাগারের ভেতরে শুধু টাকার খেলা। টাকা ঢাললে সুস্থ লোক আরামে থাকতে পারেন কারাহাসপাতালে। পেতে পারেন উন্নতমানের খাবার। অতিরিক্ত কম্বল। নেশার সামগ্রী গাঁজা মদেরও অভাব হয় না। সামান্য কারারক্ষী থেকে শুরু করে ডিআইজি প্রিজনরা কারাগারে বসেই আয় করেন মোটা অঙ্কের টাকা। ধরাও পড়েছেন বেশ কয়েকজন। কিন্তু এসব অপরাধের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়, তা থেকে যায় সাধারণ মানুষের অগোচরে। গাঁজা মদ তো বুঝলাম, কিন্তু টাকা ঢাললে যে কারাগারের ভেতরে নারীসঙ্গ পাওয়া যেতে পারে, এমন ধারণা অন্তত আমার ছিল না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তেমন ঘটনা ঘটছে হামেশাই। এই তুষার আহমেদই বছরের পর বছর টাকা ঢেলে নারীসঙ্গ উপভোগ করেছেন কারাগারের ভেতরেই। আর সেই অনৈতিক অপকর্মের জন্য কারা কর্মকর্তা ছেড়ে দিচ্ছেন তাদের অফিস কক্ষ। কাজ শেষে আবার নির্বিঘ্নে ওই নারীকে তারা বেরও করে দিচ্ছেন নিরাপদে। এখন করোনাকালে কারাগারে দর্শনার্থী প্রবেশে বিধিনিষেধ রয়েছে। টাকা সব বিধিনিষেধের গিঁট ছুটিয়ে দিয়েছে। কারা অধিদফতরকে অবহিত না করেই গাজীপুরের কাশিমপুরে কারাগার-১ এ একজন কয়েদির সাথে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন এক নারী।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, কারাগারে গিয়ে তুষারের সাথে এক নারী অন্তরঙ্গভাবে মিশছেন। নিয়ম ভেঙে কয়েদির সাথে কারাগারে বসে দীর্ঘ সময় নারীসঙ্গের ঘটনায় সাময়িক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কারা অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রি জে মামুন জানিয়েছেন, এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে কারা অধিদফতরে সংযুক্ত করা হয়েছে।

কারাগার সূত্রে জানা যায়, ৬ জানুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই নারী কারাগারের ভেতরে ঢোকেন। তিনি বিকেল ৫টার দিকে বেরিয়ে যান। সিসি ক্যামেরায় পুরো সময়টা ধরা পড়েনি। এর মধ্যে রহস্য লুকিয়ে আছে। একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ওই নারী কারাফটকে আসার পর ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন ও সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায় ওই নারীকে অন্য কর্মচারীদের সামনেই গ্রহণ করেন। এর জন্য মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে বলে জানা যায়। ওই নারী অন্তরঙ্গ ছাড়াও নানা ভঙিতে বেশ কিছু সময় কাটান কারাফটকের ভেতরে। এটা কিভাবে সম্ভব এ প্রশ্ন সচেতন মহলের। এই ঘটনা ফাঁস হওয়ার পরপরই কারা কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কালামকে প্রধান করে গত ১২ জানুয়ারি পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ইতোমধ্যে ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন ও সার্জেন্ট প্রশিক্ষক আবদুল বারীসহ তিনজনকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে মিডিয়ার সাথে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায়।

প্রাথমিকভাবে শুধু এটুকু বলা যায় যে, একজন কয়েদির সাথে একজন নারী দেখা করেছেন। সেটা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।

ভাইরাল হওয়া সিসি ক্যামেরার ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ওই নারী অন্য দুই যুবকের সাথে কারাফটক পেরিয়ে অফিসকক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তখন দুপুর ১২টা ৫৬ মিনিট। এরপর কাশিমপুর কারাগার-১ এর ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন ও সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায় ওই নারীকে গ্রহণ করেন। ওই নারীর পরনে বেগুনি রঙের সালোয়ার কামিজ ও মুখে মাস্ক ছিল।

অনেকটা আয়েশি ভঙিতে কালো প্যান্ট ও কালো টি শার্ট পরে তুষার কারাগার থেকে ফটকের পাশে বাম পাশের একটি কক্ষে ঢুকে পড়েন। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই নারীও পাশের কক্ষে ঢুকে পড়েন। তখন সাকলাইন ওই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। ৮ মিনিট পর ফেরেন তুষারকে নিয়ে। ১০ মিনিট পর অফিস ছাড়েন। বেরিয়ে যান সিনিয়র সুপার রত্না রায়। কিছু সময় তারা দু’জন ওই কক্ষে কাটানোর পর বেরিয়ে আসেন। কারাগারের কর্মচারী ও নিরাপত্তা কর্মীদের সেখানে দেখা যায়। দু’জন হেঁটে বের হয়ে যাওয়ার সময় তুষার ওই নারীকে একবার প্রকাশ্যে জড়িয়েও ধরেন। এরপর আবার ওই কক্ষে ঢুকে পড়েন দু’জন। বাইরে কড়া নিরাপত্তা। তারা একান্তে সময় কাটান পৌনে ১ ঘণ্টা। কারাগার সূত্র বলেছে, এটা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েনি। শুধু এ অংশই নয়, অনেক কিছুই ধরা পড়েনি। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই নারী ঢোকেন কারাগারে। বেরিয়ে যান বিকেল ৫টার দিকে। কারাগারের ভেতরে এমন তুঘলকি কাণ্ডে হতবাক অনেকেই। কারা কর্মকর্তারা বলছেন, মোটা অঙ্কের টাকা ছাড়া এটা হয়নি। দোষী যেই হোক, তাদের শাস্তি চাইছেন কারা সহকর্মীরা। পরে ৩ জন কর্মকর্তাকে ক্লোজড করে তাদের কারা অধিদফতরে সংযুক্ত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘এটা জঘন্য কাজ। এর সাজা হবেই’। কিন্তু খুব বেশি আশা করা কতটা সঙ্গত হবে, সেটাও ভাববার বিষয়। সিসিটিভি ফুটেজে প্রমাণ আছে যে, তারা সবাই কারাগারের ভেতরে নারীঘটিত অনৈতিক কাজে জড়িত আছেন, তাহলে তাদের শুধু ক্লোজড করা হবে কেন? আমরা সাধারণ মানুষরা মনে করি, তাদের গ্রেফতার করে তদন্ত শুরু করা উচিত ছিল। কিন্তু তাদের প্রতি এমন কোমল আচরণ নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

বলা হচ্ছে, ওই নারী একজন ব্যবসায়ী, ফ্যাশন হাউজের মালিক। আবার বলা হচ্ছে, জেলেই তুষার ওই নারীকে অত্যন্ত সঙ্গোপনে বিয়ে করেছেন; যা তার স্ত্রী জানেন। বিয়ের আয়োজনটা কি তবে কারা কর্তৃপক্ষই করেছিল? তুষার কারাগারে আসার পর তার স্ত্রী তাদের দুই সন্তান নিয়ে মালয়েশিয়ায় চলে গেছেন এবং সেখানে নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন। ধারণা করা হয়, হলমার্ক কেলেঙ্কারির বিরাট অঙ্কের টাকা তারা মালয়েশিয়ায় পাচার এবং সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছেন।

এর কোনো সত্যই এখন আর গোপন থাকবে না। সরকার চাইলে কারা কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি, তাদের ব্যাংক হিসাব এবং ব্যাংকের বাইরে দুর্নীতির টাকার খবর বের করে আনা কঠিন কিছু নয়। আর সে ব্যবস্থা করতে পারলে আল্ট্রাটেক প্রযুক্তিরও সন্ধান মিলতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement