২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

করোনার টিকায় নতুন দিন!

করোনার টিকায় নতুন দিন! - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশও করোনাভ্যাকসিন যুগে প্রবেশ করেছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের দীর্ঘ দশ মাস পর ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশে এসেছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকা। ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে একজন নার্সকে টিকাদানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিকাদান কর্মসূচির ভার্চুয়াল উদ্বোধন করেছেন।

প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে। এ টিকা ভারতের ‘মৈত্রী টিকা’ হিসেবে অভিহিত। শুধু বাংলাদেশই নয়, মালদ্বীপ, ভুটান এবং মিয়ানমারকেও ভারত ‘মৈত্রী টিকা’ পাঠিয়েছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ‘কোভিশিল্ড’ নামে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করেছে। বাংলাদেশ সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে সংগ্রহ করবে তিন কোটি ডোজ টিকা। ইতোমধ্যে সরকার, সেরাম ও বেক্সিমকো ফার্মার মধ্যে এ নিয়ে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, ৫০ লাখ ডোজের প্রথম চালান ২৫ জানুয়ারি সোমবার দেশে এসে পৌঁছেছে।

ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ টিকা আবিষ্কার ও বাজারে আসার পর বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে এই টিকার প্রয়োগ অর্থাৎ টিকাদান শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ৪০টিই ধনী দেশ, এসব দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও দেশের ১৪ কোটি মানুষকে টিকাদানের সাহসী কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে। আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি আনন্দের খবর। টিকা আসার খবরে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও স্বস্তি দেখা দিয়েছে। করোনামুক্ত হওয়া যাবে, এটাই স্বস্তির কারণ।

উৎপাদিত চারটি টিকার মধ্যে ফাইজার বায়োএনটেক এবং মডার্নার টিকা যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ইউরোপ ছাড়াও এশিয়ার দেশগুলোতে আসছে। তবে রাশিয়ার টিকা এখন পর্যন্ত সে দেশেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যে টিকাগুলো উৎপাদিত হয়েছে তা মানবদেহের জন্য নিরাপদ ও কার্যকর। এ টিকার কার্যকারিতা থাকবে এক বছর পর্যন্ত। অর্থাৎ, টিকা দেয়ার পর এক বছর পর্যন্ত কোনো ভয় নেই। এক বছর পর আবারো করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, শুধু টিকা নিলেই চলবে না। একই সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি
মোট চারটি পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রায় ১৪ কোটি অর্থাৎ জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়া হবে। বাকি ২০ শতাংশ মানুষকে ‘হার্ড ইমিউনিটি’র কারণে টিকা দেয়ার প্রয়োজন পড়বে না। প্রথম পর্যায়ের ‘এ’ ধাপে ৫২ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হবে; যা মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশ। প্রথম পর্যায়ের ‘বি’ ধাপে দেয়া হবে এক কোটি ২০ লাখ মানুষকে। তারা ষাটোর্ধ্ব বয়সী। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১ কোটি ৭২ লাখ মানুষ টিকা পাবে যারা ৫৫ বছর বা তদূর্ধ্ব। তৃতীয় পর্যায়ে টিকা দেয়া হবে তিন কোটি ৪৫ লাখ মানুষকে। এরা ৫০ থেকে ৫৫ বছর বয়সী। চতুর্থ ও শেষ পর্যায়ে টিকা দেয়া হবে ৪১-৮০ শতাংশ মানুষকে। তারা সংখ্যায় প্রায় সাত কোটি। রাজধানীর ৩০০টি কেন্দ্রে করোনার টিকাদান করা হবে। তবে এ টিকা ১৮ বছরের নিচের কাউকে এবং গর্ভবতী ও দুর্বল মানুষকে দেয়া হবে না। দ্বিতীয় ধাপে দেয়া হবে ৭ শতাংশ মানুষকে, এরপর ১০ ও ২০ শতাংশ মানুষকে এবং সর্বশেষ দেয়া হবে ৪০ শতাংশ মানুষকে টিকা।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার বাইরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘কোভ্যাক্স উদ্যোগ’ থেকে বাংলাদেশ টিকা সংগ্রহ করছে। বাংলাদেশের ২০ শতাংশ মানুষের জন্য বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে টিকা দেবে বৈশ্বিক উদ্যোগ ‘কোভ্যাক্স’। কোভ্যাক্স থেকে জানানো হয়েছে, আপাতত কোভ্যাক্স ফাইজার-বায়োএনটেকের আট লাখ ডোজ টিকা তারা বাংলাদেশকে দেবেন। এ টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। এ মাত্রার অতিশীতল ফ্রিজারের জন্য বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতা চেয়েছে। কোভ্যাক্স থেকে বাংলাদেশ মোট ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা পাবে। আরো চার কোটি ৯০ লাখ টিকা কেনার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ সরকার। চীন থেকেও বাংলাদেশ ‘সিনোভ্যাক’ উপহার পাবে।

ঢাকার চারটি হাসপাতালকে তৈরি করা হয়েছে। প্রথম দিন ২০-২৫ জনকে টিকা দিয়ে কর্মসূচি শুরু করা হবে। এরপর ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে টিকা দিয়ে এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে ব্যাপক টিকাদান শুরু হবে।

অনলাইনে নিবন্ধন ছাড়া কাউকে করোনার টিকা দেয়া হবে না। প্রথমে জরুরি সেবাদানকারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, সামনের সারির সেবাদানকারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সাংবাদিক ও শিক্ষককে ভ্যাকসিন দেয়া হবে।

করোনায় ২১ লাখ মৃত্যু
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ার পর এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের ১০ কোটির বেশি মানুষ। মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে ২১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় ২৯১টি টিকা নিয়ে বিভিন্ন দেশে কাজ চলছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খুশির খবর হচ্ছে, এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি টিকা বিজ্ঞানীরা মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে তুলেছেন। অথচ একটি টিকা আবিষ্কার ১০-১২ বছরের কম সময়ে হয় না।

টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা!
করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণের কিছু নির্দেশনা মানা জরুরি। টিকা দেয়ার আগে কোনো জটিলতা থাকলে তা চিকিৎসককে অবশ্যই জানাতে হবে। যেমন আগে টিকা দেয়ার সময় যদি কোনো তীব্র অ্যালার্জি হয়ে থাকে, যদি টিকা নেয়ার সময় তীব্র জ্বরসহ কোনো অসুস্থতা থাকে, কোনো অসুস্থতা বা ওষুধের কারণে শরীরে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কম থাকে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, এইচআইভি সংক্রান্ত অসুস্থতা, হাই ডোজের স্টেরয়েড অথবা ক্যান্সারের যদি ওষুধ সেবন করা হয়ে থাকে, রক্তপাত বা আঘাত সংক্রান্ত সমস্যা, গুরুতর কোনো অসুস্থতা, গর্ভবতী বা দুগ্ধপোষ্য শিশু থাকলে এগুলো চিকিৎসককে জানাতে হবে। তাহলে চিকিৎসক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বুঝতে পারবেন টিকা দেয়া যাবে কিনা। কারণ এমন রোগীদের ওপর টিকার ট্রায়াল হয়নি। অন্য কোনো অ্যালার্জি, অ্যাজমা বা হাঁপানির মতো রোগ থাকলেও চিকিৎসককে জানাতে হবে। টিকা নেয়ার জন্য মানুষকে সাহসী ও উৎসাহী করে তোলার জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং সেলিব্রেটিদের টেলিভিশনের সামনে প্রকাশ্যে টিকাদান করা যেতে পারে।

করোনামুক্তির স্বস্তির খবর!
বাংলাদেশে গত তিন সপ্তাহ ধরে পরীক্ষার তুলনায় করোনা রোগী শনাক্তের হার ১০ শতাংশের নিচে। সর্বশেষ, এক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। ২৫ জানুয়ারি রোগী শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি বছরের অধিকাংশ দিন এক হাজারের কম রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশের ২৬ জেলায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়নি। আইইডিসিআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এস এম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, করোনা সংক্রমণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে বিভিন্ন জেলায় মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কাজ শুরু করেছে জনস্বাস্থ্যবিদ নিয়ে গঠিত প্রতিনিধিদল।

বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ১৮ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকে। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সংক্রমণ ২০ শতাংশের উপরে ছিল। এরপর থেকে নতুন রোগীর পাশাপাশি, শনাক্তের হারও কমে আসে। মাস দুয়েক সংক্রমণ নিম্নমুখী থাকার পর গত নভেম্বরের শুরুর দিক থেকে নতুন রোগী ও শনাক্তের হার আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়। ডিসেম্বর থেকে আবার তা কমতে শুরু করে। করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট আক্রান্ত পাঁচ লাখ ৩২ হাজার ৪০১ জন। আক্রান্ত লোকজনের মধ্যে সুস্থ হয়েছে চার লাখ ৭৬ হাজার ৯৭৯ জন।

মহামারী মোকাবেলায় বাংলাদেশ ভালো করেছে। তবে মহামারীতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ঘাটতিগুলো ধরা পড়েছে। পরবর্তীতে করোনা মহামারী মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা বেড়েছে। নতুন নতুন ল্যাব তৈরি হয়েছে। আইসিইউ শয্যা বেড়েছে। হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে।

করোনায় মৃতদের অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের ৫২ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে শুধু কোভিড-১৯ রোগে। বাকি ৪৮ শতাংশের মৃত্যু কোভিড-১৯ এর পাশাপাশি অন্যান্য রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, ক্যান্সার, ফুসফুসের রোগ, হাইপোথাইরয়েড এবং অ্যাজমা; অর্থাৎ একসাথে একাধিক রোগে আক্রান্ত থাকার কারণে। বাংলাদেশে করোনায় বয়স্করা যেমন মারা গেছেন, তেমনি অপেক্ষাকৃত কম বয়স্করাও মারা গেছেন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষ মারা গেছেন প্রায় ৮০ শতাংশ। এর মধ্যে ষাটোর্ধ্ব ৫৫ শতাংশ এবং ৫১ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত প্রায় ২৫ শতাংশ। মৃতদের মধ্যে ৪১-৫০ পর্যন্ত বয়সের মারা গেছেন ১১ দশমিক ৭২ শতাংশ, ৩১-৪০ বয়সের মারা যান ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং ২১-৩০ বছরের বয়সের মারা যান ২ দশমিক ১০ শতাংশ।

শুরুতে করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল, সেটা কেটে গেছে। হাসপাতালে যেমন চিকিৎসাসেবা গড়ে উঠেছে, তেমনি মানুষও মহামারী থেকে বাঁচার নিজস্ব কৌশল শিখে গেছে। এর মধ্যে করোনা ভ্যাকসিন বা টিকা মানুষের মধ্যে নতুন আশাবাদের সৃষ্টি করেছে। বহু বছর ধরে এ দেশে শিশুদের টিকা দেয়া হচ্ছে। শিশুদের টিকা দেয়ার ব্যাপারে মা-বাবারাও স্বতঃস্ফূর্ত। টিকার সুফলও পেয়েছে এ দেশের মানুষ। বাংলাদেশের ইপিআই বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি সফল। এ জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক প্রশংসাও পেয়েছে।

করোনাভাইরাসের টিকাও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে সবাইকে দেয়া সম্ভব হলে সফলতা আসতে পারে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক,
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব


আরো সংবাদ



premium cement