১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বোয়ালের আণ্ডা বোয়ালে ভাঙে

আবদুল কাদের মির্জা - ফাইল ছবি

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘তোমরা যা গোপন করো, আল্লাহর অভিপ্রায় হলো তা প্রকাশ করা।’ কুরআনের বক্তব্য লঙ্ঘন বা খণ্ডন হওয়ার প্রমাণ অদ্যাবধি পাওয়া যায় না। যেকোনো ঘটনা বা অপরাধ অতি গোপনে করলেও তা প্রকাশ পেয়ে যায় এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, নির্মম সত্যটি নিজের লোকের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। এটাও সৃষ্টিকর্তার একটি কৌশল হতে পারে।

অতিসম্প্রতি নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র ও আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবদুল কাদের মির্জা অতি সহজ সরলভাবে আঞ্চলিক ভাষায় বলেছেন, ‘এ দেশে কি ভোটডাকাতি বন্দ অইত ন’? অইবো-অইবো। গত নির্বাচনে শেখ হাসিনা চাইছে ফল। আংগো দেশে কিছু দুর্নীতিবাজ আমলা আছে, কিছু দুর্নীতিবাজ নেতা আছে- হেগুনে শেখ হাসিনারে গাছসহ দিয়ালাইছে। চাইছে ফল, গাছসহ দিয়ালাইছে হেগুনে। হিয়ান কইলে হয়তো আঁর ছাকরিও থাইকত ন। হিয়ান আঁই কই দিছি।’ (এ দেশে কী ভোটডাকাতি বন্ধ হবে না? হবে হবে। গত নির্বাচনে শেখ হাসিনা চেয়েছেন ফল। আমাদের দেশে কিছু দুর্নীতিবাজ আমলা আছে, কিছু দুর্নীতিবাজ নেতা আছে, এরা শেখ হাসিনাকে গাছসহ দিয়েছেন। চেয়েছেন ফল, তারা দিয়েছেন গাছসহ। সেসব বললে হয়তো আমার চাকরিও থাকবে না। কিন্তু আমি বলে দিলাম।) আওয়ামী লীগ নেতা ফেনীর জয়নাল হাজারী আবদুল কাদের মির্জার বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (দক্ষিণ) মেয়র ও সাবেক মেয়র একজন আর একজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এখন প্রকাশ্যে চলছে মিডিয়াতে। কে কতটুকু দুর্নীতি করেছেন এটা তদন্ত করার এখতিয়ার আমার নাই। তবে Beauty of the Show হলো একই দলের একজন আর একজনের ‘আণ্ডা’ ভেঙে গোমর ফাঁস করে দিচ্ছেন। কে সত্য বা কে মিথ্যা বলছেন তা আলোচনার মুখ্য বিষয় নয়; বিষয়টি হলো গৃহবিবাদ এখন ক্ষমতাসীনদের নিজেদের মধ্যে।

প্রতিদিনই মিডিয়াতে সরকারের দুর্নীতির কথা প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন-২১টি প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগে খরচ দেখানো হচ্ছে দুই হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। মিডিয়ার মতে পরামর্শক নিয়োগে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। সরকারের এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে না। সরকারি ভাষ্য মতে, দেশে এখন কোনো প্রকার খাদ্যের অভাব বা ঘাটতি নেই। তবে কেন বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে? সরকারের শরিক দলের এমপি রাশেদ খান মেনন দাবি করেছেন, দেশে করোনাকালে ৪০ শতাংশ মানুষ গরিব হয়ে গেলেও ১১.৪ শতাংশ ধনী বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতঃপূর্বেই আমরা বলেছি, দেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষগুলো দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। যার ছিল ১০ বিঘা সম্পত্তি সংসারের ঘানি টানতে টানতে সে হয়েছে নিঃস্ব। অন্য দিকে যার ছিল ২০০ বিঘা জমি, সে হয়েছে এক হাজার বিঘা জমির মালিক।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, ‘বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়ক বেয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।’ ইট, বালু, সিমেন্টের যৌথ প্রণয়নকে প্রধানমন্ত্রী যদি উন্নয়ন বলে বুঝে থাকেন তবে তার মন্তব্য যথার্থ। আর যদি গণমানুষের উন্নয়ন বুঝিয়ে থাকেন তবে তাকে বস্তুনিষ্ঠ মানসিকতা নিয়ে আরো গভীরে প্রবেশ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর চলা ফেরার সময়ে Special সিকিউরিটি থাকে। তিনি একজন রাজনীতিবিদ ও দলীয় প্রধান, তিনি যদি বাংলাদেশে ছদ্মবেশে বিভিন্ন এলাকায় ঘোরেন তবে দেখতে পারবেন, দেশের মানুষ কতটুকু শান্তিতে আছে। তবে একশ্রেণীর লোক সুখে-শান্তিতে আছে যারা তার দল করে এবং আমলারা যারা মনে করে যে, তাঁকে ক্ষমতায় বসানো ও ক্ষমতায় তাঁর টিকে থাকার পেছনে তাদের অবদান সবচেয়ে বেশি। বাকি লোকেরা রয়েছে নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করার মধ্যে যারা সরকারি দল করে না বরং বিরোধী দলের সাথে সম্পৃক্ত। শাসক দলের লোকেরা কারো জমি দখল করেছে, কারো বাড়ি দখল করেছে, দোকান দখল করেছে এবং আরো কত কী ঘটনা। এসব ঘটনার অবশ্যই অবসান হওয়া দরকার। নতুবা ইতিহাসের পাতা যেমন কাউকে ক্ষমা করেনি এবারও করবে না।

পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, ছাত্রলীগ যুবলীগে মারামারি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকারদলীয় ব্যক্তিদের নিজেদের মধ্যে সন্ত্রাসী হামলা। সব কিছুই ঘটছে হালুয়া রুটির জন্য, বাংলাদেশে যা সহজে প্রাপ্য। অর্থাৎ হাট, ঘাট, টেন্ডার, নিয়োগবাণিজ্য সবই এখন সরকারি দলের পকেটস্থ। বিরোধী দল বনাম সরকারি দলে কোনো ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এখন লক্ষ করা যায় না। সবই হয় এখন একতরফা, কারণ সরকার বিরোধী দলকে কোনো Space দিচ্ছেন না। তাদের সব ক্ষমতা যেন বিরোধীদলীয় রাজনীতিকে কবর দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত।

সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকসহ তিনি দলের মুখপাত্র হিসেবে প্রতিদিন বিরোধী দল অর্থাৎ বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছেন। এমন কোনো দিন নেই যেদিন ঘরে বসেই বিএনপির দোষ ধরে টিপ্পনী কাটছেন না। অথচ নিজ মন্ত্রণালয়ের প্রতি তিনি অনেক ক্ষেত্রে উদাসীন। একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ, ‘২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে চার হাজার ৭৩৫টি। নিহত পাঁচ হাজার ৪৩১ জন এবং আহত সাত হাজার ৩৭৯ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৮৭১, শিশু ৬৪৯। এক হাজার ৩৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত এক হাজার ৪৬৩ জন। দুর্ঘটনায় এক হাজার ৫১২ জন পথচারী নিহত হয়েছেন। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৩৮ জন। বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্যগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। বছরব্যাপী ১১৯টি নৌদুর্ঘটনায় ২৭২ জন নিহত, ১৩৭ জন আহত এবং নিখোঁজ ৬২ জন। ১০৮টি রেল দুর্ঘটনায় নিহত ২২৮ এবং আহত ৫৪ জন। এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে ০.৮৯ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ৪.২২ শতাংশ এবং আহতের মাত্রা বেড়েছে ৩.৮৮ শতাংশ (৯ জানুয়ারি ২০২১ জাতীয় পত্রিকা)।

ধর্ষণ অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান করে বর্তমান সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন আইন সংশোধন করেছেন। তার পরও কি গণহারে ধর্ষণ বন্ধ হয়েছে? সরকার সবক্ষেত্রকে ডিজিটাল করেছেন। এদিকে, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে মোবাইল। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে সর্ব প্রকার যৌনাচার এখন ছেলেমেয়েদের অত্যন্ত প্রিয়। একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর বদৌলতে দেশে দিন দিন ধর্মহীনতা বাড়ছে। সংস্কৃতিক অঙ্গনে ধর্মবিরোধী কথাবার্তা উসকানিমূলক। ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিবর্তে ধর্মহীন সমাজ গড়া যেন সফল হয়েছে, ফলে মৃত্যুদণ্ডের আইন পাস হলেও ধর্ষণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। ধর্ষণ বন্ধ করার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে, ধর্মহীনতা পরিবর্তে ধর্মীয় মূল্যবোধের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকার পাঁচমিশালি চিন্তা করলে চলবে না, বরং মানুষের মন মগজে পরিবর্তন আনতে হবে যা শুধু ফুলের উপঢৌকনের ওপর নির্ভর করবে না, দরকার একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার। ক্ষমতাবান মহলের স্বেচ্ছাচারিতার কাহিনী সম্পর্কিত অনেক লেখাই পত্রিকায় স্থান পাচ্ছে। তবে স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ সরকারের নেই। উদ্বেগ রয়েছে সাফাই গাওয়ার।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তা হলো, বোয়ালের আণ্ডা বোয়ালে ভাঙে। অর্থাৎ জনবিরোধী কর্মকাণ্ড যতই গোপনে করা হোক না কেন, তা প্রকাশ পেয়ে যায় নিজেদের মধ্য থেকেই। নোয়াখালীর আবদুল কাদের মির্জা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আপন ছোট ভাই। কাদের মির্জা এবং ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। আবদুল কাদের মির্জা স্থানীয় পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং আসন্ন নির্বাচনেও দলের প্রার্থী। জনাব ওবায়দুল কাদের সরকারের অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি এবং প্রতিদিনই মিডিয়াতে তাঁকে দেখা যায়। কিন্তু আবদুল কাদের মির্জার একটি বক্তৃতায়ই তিনি জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন; অন্য দিকে মিডিয়াপ্রিয় ওবায়দুল কাদের সারা দিন-রাত্রি মিডিয়াতে বলে যাচ্ছে। কিন্তু জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন কি?

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানগণসহ দেশরক্ষা বাহিনীর প্রধান যারা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, সবাই বলেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এবং অতি উৎসাহী হয়ে তাদের মধ্যে একজন বলেই দিয়েছেন যে, এরকম সুষ্ঠু নির্বাচন তিনি এর আগে দেখেননি। একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলা হয়েছে যে, এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে আরো সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করা হবে। আবদুল কাদের মির্জার বক্তব্য মতে, নির্বাচনে ডাকাতি হয়েছে এবং তিনি প্রত্যাশা করেন যে, একদিন ভোটডাকাতি বন্ধ হবে। নির্বাচন কমিশনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভোটডাকাতদের যে প্রশংসা করেছে তার এবং তাদের মতে আরো সুষ্ঠু নির্বাচন করার প্রত্যাশার কাছে জাতির প্রত্যাশা কি বিলীন হয়ে যাবে?

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement