২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনা-উত্তর পুনর্গঠন

করোনা-উত্তর পুনর্গঠন - নয়া দিগন্ত

২০১৯ সালে চীনের উহান প্রদেশে করোনা মহামারীর সূচনা। সেই থেকে বিশ্বজুড়ে এই মহামারীর তাণ্ডব চলছে। এরই মধ্যে ২১৮টি দেশ ও টেরিটরি এর তাণ্ডবের শিকার। এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডওমিটারসের দেয়া পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বে করোনা সংক্রমণের শিকার হয়ে মারা গেছে ১৯ লাখ ছয় হাজার ৬৩৩ জন। এ অবস্থা আর কতদিন চলবে তা কেউ বলতে পারছেন না। তবে এ কথা ঠিক, ভবিষ্যৎ কোনো এক সময়ে এই মহামারী থামবে। তখন আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে করোনা-উত্তর পরিবেশে এই বিশ্বের পুনর্গঠনের কাজ। সন্দেহ নেই, এই মহামারীর আমাদের জন্য রেখে যাবে অসংখ্য অর্থনীতিক ও মানবিক সমস্যা। এখন অনেকেই সেই পুরনো দিনের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে চান না। তারা মনে করেন সেই ‘পুরনো স্বাভাবিক’ অবস্থাটাই হচ্ছে সমস্যার একটি অংশ। তাই তারা চান- মহামারী-উত্তর পরিবেশে আমাদের পেতে হবে একটি পরিবর্তিত ও উন্নততর নতুন বিশ্ব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- সেই পরিবর্তিত নতুন বিশ্ব সৃষ্টি করা কি সম্ভব, বিশেষ করে এই করোনা-উত্তর পরিবেশে? অনেক গুণীজনের মতে, তা সম্ভব। তেমনি একজন হচ্ছেন, জন স্কেলিস অ্যাভারি। তিনি তো জোর দিয়েই বলেছেন, করোনা-উত্তর পরিবেশে উন্নততর বিশ্বসমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

জন স্কেলিস অ্যাভারি কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন। প্রচুর লেখাপড়া জানা বিজ্ঞানী ও সক্রিয় শান্তিবাদী; সর্বোপরি নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব। বয়োবৃদ্ধ মানুষটির জন্ম লেবাননে, ১৯৩৩ সালে। বাবা-মা আমেরিকান। তারাও ছিলেন বড় মাপের বিজ্ঞানী। অ্যাভারি একজন তাত্ত্বিক রসায়নবিদ। কোয়ান্টাম রসায়ন, তাপগতিবিদ্যা, বিবর্তন প্রক্রিয়া ও বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে লেখা বইয়ের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে তিনি একজন সক্রিয় শান্তিবাদী। সেই থেকে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান ও বিশ্বসমস্যা-বিষয়ক ‘পাগওয়াশ কনফারেন্স’ গোষ্ঠীর সাথে। ১৯৯৫ সালে এই গোষ্ঠী পায় নোবেল শান্তিপুরস্কার, এই পুরস্কারে তিনিও অংশীদার। বর্তমানে তিনি কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ান্টাম রসায়নের সহযোগী অধ্যাপক।

জন স্কেলিস অ্যাভারি মনে করেন, করোনা-উত্তর পরিবেশে নতুন উন্নততর দুনিয়া সৃষ্টি করা নিশ্চয়ই সম্ভব। তার মতে- আমাদের বর্তমান দুনিয়া প্রায় অকল্পনীয় মাত্রায় অন্যায়, লোভ আর নির্বুদ্ধিতায় পরিপূর্ণ। এগুলো দূর করেই তা করতে হবে। কেন এই পৃথিবীটা পরিপূর্ণ তীব্র ঝলমলে নানা দোষত্রুটিতে? এ প্রশ্নে আছে অ্যাভারির সুগভীর অভিজ্ঞতালব্ধ জবাব- ‘এর একটি কারণ পাওয়া যাবে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের তুলনায় জেনেটিক বিবর্তনের ধীরগতিতে চলার বিষয়টির মাঝে। আমরা একুশ শতকের সমস্যা মোকাবেলা করি আবেগিক প্রকৃতি নিয়ে। এর পরিবর্তন ঘটেনি সেই তখন থেকে, যখন আমাদের পূর্বসূরিরা বসবাস করত ছোট ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীর মাঝে, যারা প্রতিযোগিতা করত ভূমির জন্য। আমাদের আবেগিক প্রকৃতিতে রয়েছে উপজাতীয়তাবাদ বা ট্রাইবালিজমের একটি উপাদান। আর এখানেই সামরিকতন্ত্রী বা মিলিটারিস্টরা সহজেই আবেদন রাখতে পারে। ট্রাইবালিজমে মানবিক প্রবণতার উদ্ভব হয় তখন, যখন আমাদের দূরবর্তী পূর্বপুরুষরা বসবাস করত ছোট ও জেনেটিকভাবে সমপর্যায়ের নৃগোষ্ঠীর মধ্যে। তখন একটি উপজাতি হয় সার্বিকভাবে টিকে থাকত, নয়তো বিলুপ্ত হয়ে যেত। ব্যক্তির বদলে বরং পুরো উপজাতিই ছিল একটি ইউনিট, যার ওপর তখন কার্যকর ছিল ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব। এটি এক লাখ বছর আগের সারভাইভাল ট্রেইট, অর্থাৎ টিকে থাকার বৈশিষ্ট্য। তাপ পারমাণবিকসমূহ ধ্বংস সাথে নিয়ে এই ট্রাইবালিজম আজ মানবসভ্যতার জন্য এক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরেক গুণীজন অস্ট্রিয়ান প্রাণিবিজ্ঞানী-নৃবিজ্ঞানী-পক্ষিবিজ্ঞানী ও নোবেল বিজয়ী কোনার্ড লোরেঞ্জ এটিকে দেখেন এভাবে- ‘আজকের দিনে একুশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে আমরা বসবাস করি জাতিরাষ্ট্রগুলোতে। তবে এখনো আমরা পূর্বসূরি উপজাতীয়দের আবেগের মতোই আবেগ ধারণ করি। মৌল রাজনৈতিক ও সামাজিক ইউনিটকে আরো বড় ও অপরিহার্য করে তোলা সম্ভব হয়েছে উন্নততর পরিবহন ও যোগাযোগের মাধ্যমে। সেই সাথে যুদ্ধকৌশলে পরিবর্তন আনার মাধ্যমেও। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির বিয়োগান্তক দিকটি হচ্ছে- যারা উপজাতির জায়গায় জাতিরাষ্ট্র নিয়ে এসেছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক ইউনিট হিসেবে, সেই একই শক্তিগুলো অব্যাহতভাবে একই কাজ করে যাচ্ছে আরো বড় আকারে। এ করণেই পুরোপুরি সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রগুলোতে আজ চলছে বিপজ্জনক অ্যানার্কিজম তথা নৈরাজ্যবাদ। যদিও আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে পুরো পৃথিবী এখন সক্রিয় একটি একক ইউনিট হিসেবে, তবু এর রাজনৈতিক কাঠামোটি রয়ে গেছে চরমভাবে সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিভাজিত। এগুলো উপজাতির তুলনায় বড়, কিন্তু আজকের দিনের প্রযুক্তির জন্য অতি ছোট। কেননা এগুলো সমগ্র মানবজাতিকে অন্তর্ভুক্ত করে না।

অপর নোবেল বিজয়ী জৈব রসায়নবিদ অ্যালবার্ট জেন- গিয়র্গি মনে করেন- মানুষের জীবনের অংশ দু’টি, যা বিভাজিত আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের মাধ্যমে। প্রথম অংশের সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির জন্ম হতো সেই জগতে, যাকে তার চিন্তাচেতনায় গ্রহণ করে নিত। দ্বিতীয় অংশে মানুষ পদার্পণ করে নতুন কসমিক জগতে যে জগত তাদের কাছে পুরোপুরি নতুন। মানুষের দিক থেকে শক্তি তখন আর ভূমিভিত্তিক থাকেনি। তখন তা হয়ে ওঠে কসমিক তথা মহাজাগতিক শক্তি। এই শক্তি নতুন আকার দেয় মহাবিশ্বকে। এটি শুরু মাত্র। এর অন্তহীন দ্বিমুখী সম্ভাবনা রয়েছে : মানুষ হয়ে উঠবে স্বপ্নাতীত অপরিমেয় সম্পদ আর মর্যাদার অধিকারী, নতুবা অভাবনীয় দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে বিশ্বের আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটবে। মানুষ আজ এমন এক মহাজাগতিক জগতে বসবাস করছে, যার জন্য মানবজাতিকে তৈরি করা হয়নি। মানবজাতির টিকে থাকাটা নির্ভর করে মানুষ তাদের সব ধারণা, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন করে কতটা ভালোভাবে ও কতটুকু দ্রুত নতুন এই জগতে মানিয়ে নিতে পারবে, তার ওপর। যেসব বিষয় জাতিতে জাতিতে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে, সেগুলোর মধ্যে আছে সময় ও দূরত্ব। আধুনিক বিজ্ঞান তা দূর করেছে।

এসব গুণীজন তাদের এই অভিজ্ঞতার আলোকে একটা কথাই বলতে চান- আমাদের অতীতের নির্বুদ্ধিতা ও দোষত্রুটি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিদায় জানাতে হবে জাতীয়তাবাদী সঙ্কীর্ণতাকে। দূর করতে হবে জাতিতে জাতিতে বিচ্ছিন্নতা ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা। থামাতে হবে যুদ্ধবিগ্রহ। শান দিতে হবে মানবিক চেতনায়। ভুললে চলবে না- পরম সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র ও যুদ্ধ-প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে বিপজ্জনক নৈরাজ্যবাদ। চিন্তাশীল পর্যবেক্ষকরা একমত- মানবসভ্যতা একটি সঙ্কটের যুগে প্রবেশ করছে। সব নেতিবাচক প্রবণতাই ঊর্ধ্বমুখী : জনসংখ্যা, উৎপাদন, ভোগ, দূষণ, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার-উদ্ভাবনের হার, মানসিক ও পরিবেবেশিক পীড়ন, আবহাওয়ার বিপজ্জনক পরিবর্তন ও পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তৃতি। এসবই মানব সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য হুমকি। স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব এখনো অনুপস্থিত। সামনে অমীমাংসিত সমস্যার পাহাড়।

তবে সুখের কথা জ্ঞানের বিকাশ আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে অনেক সুযোগ। যাবতীয় সমস্যা ঠেলে আধুনিক সমাজ গড়তে প্রয়োজন সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি। কারণ, আমরা বিমান চড়তে পারি, কিন্তু এককভাবে কেউই বিমান তৈরি করতে পারি না। আমরা রোগ সারাতে পারি, তবে এর জন্য প্রয়োজন গবেষক, ওষুধ কোম্পানি ও চিকিৎসকদের পারস্পরিক সহযোগিতা। নতুন দুনিয়া সৃষ্টিতে অপরিহার্য এমন সব সহযোগিতা। বলা হয়- মানুষের বুকে দুটি আত্মা : একটি উষ্ণ ও উপকারী, অপরটি প্রাণঘাতী। তাই মানুষ মানবিক হয়, আবার গণহত্যায়ও লিপ্ত হয়। মানুষই ধর্মযুদ্ধের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে, যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞে নামে, জন্ম দেয় হলোকাস্টের। এই মানুষই ধ্বংস করে হিরোশিমা, নাগসাকিসহ আরো কত নগর-জনপদ। কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, রোয়ান্ডা ও দারফুরকে পরিণত করে মৃত্যু উপত্যাকায়। এর বিপরীতে মানুষের মানবিক হয়ে ওঠার অসংখ্য উদাহরণ আছে। মানুষের অন্ধকার দিককে পরাজিত করে উজ্জ্বল দিক ফুটিয়ে তুলতে পারে। করোনা-উত্তর নতুন দুনিয়া গঠনে চাই মানুষের সেই ইতিবাচক দিকটিই। নতুন বিশ্ব গড়তে চাইলে- মানুষকে সব সময় সচল রাখতে হবে তার বুকের উষ্ণ উপকারী আত্মাকে।

আমরা স্পষ্টভাবেই দেখছি, বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো কোভিড-১৯ ও আবহাওয়া পরিবর্তন ঠেকানোরর জরুরি অবস্থার সময়েও নানা বৈপরীত্য প্রদর্শন করে চলেছে। কোভিড-১৯ অবশ্যই মানবজাতির জন্য একটি বড় বিপদ। বিশ্বব্যাপী তা মোকাবেলায় ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। বিমান পরিবহন কার্যত অচল হয়ে পড়ে। শিল্পকারখানা, রেস্তোরাঁ, বিনোদন কেন্দ্রও বন্ধ করা হয়েছে। বন্ধ করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নিয়ন্ত্রণ করা হয় মানুষের চলাফেরা। মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হয়। বজায় রাখতে বলা হয় সামাজিক দূরত্ব। সারা দুনিয়ায় মানুষের চলাচলে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু বিপরীতে আমাদের অন্যান্য হুমকি মোকাবেলার পদক্ষেপও সমভাবে নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু, ফসিল জ্বালানি উত্তোলন ও ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি হলেও তা করায় কোনো পদক্ষেপ নেই। ফসিল জ্বালানি মানবজাতির জন্য করোনার চেয়ে কম হুমকি নয়। আবহাওয়ার পরিবর্তনে ও পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে করোনা মহামারীর চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। এটি জন্ম দিতে পারে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের, মারা যেতে পারে অগণিত মানুষ আর জীবজন্তু। বিশ্বের অনেক এলাকা বা দেশ হারাতে পারে মানুষের বসবাসের উপযোগিতা। হতে পারে পানিশূন্য বিরানভূমি কিংবা ডুবে যেতে পারে। কিন্তু এই ফসিল জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে রাষ্ট্রগুলোর পদক্ষেপ কই? বেশির ভাগ দেশ ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি মোকাবেলার কথাই শুধু বলছে, কাজের কাজ কিছুই করছে না।

যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও সৌদি আরব তো ক্লাইমেট ইমার্জেন্সির বিষয়টি স্বীকারই করতে চায় না। এসব দেশ এ ক্ষেত্রে আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। বিশ্বের অন্যান্য দেশ আবহাওয়া পরিবর্তন মোকাবেলায় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব বেড়েই চলেছে। হুমকির মুখে অতি প্রয়োজনীয় ওজোন স্তর। ওজোন স্তর রক্ষা ও অম্লবৃষ্টি ঠেকানোতে নেই কার্যকর উদ্যোগ। কার্বন ডাই-অক্সসাইড নির্গমন বন্ধেও তেমন সাড়া নেই। এ ধরনের ভয়াবহ হুমকিগুলো মোকাবেলায় কেনো এই অবহেলা?

আমরা প্রতিদিন দেখছি ও শুনছি- করোনা মহামারীতে মানুষ মারা যাচ্ছে। এই মহামারী শেষ হওয়ার আগে বিশ্বে কোটি লোক মারা যেতে পারে। ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হতে পারে আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে। সেই ধ্বসযজ্ঞ থামাতে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া দরকার। হয়তো আমাদের অনেকেই তা দেখার জন্য বেঁচে থাকব না, কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তখন উত্তপ্ত এই পৃথিবীতে রোগেশোকে ও না খেয়ে মারা যাবে। তাই আমাদের কর্তব্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বসবাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়া। এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিলে হয়তো বর্তমান শতাব্দীর মাঝামাঝিই বিশ্বে ঘটতে পারে মহাদুর্ভিক্ষ। আজকে যারা শিশু তারাই হবে এর শিকার।

করোনা মহামারী যখন বিদায় হবে, তখন সব দেশের সরকারকে নামতে হবে আর্থনীতিক ধ্বংষাবশেষ মেরামতে। পরিস্থিতিটা হবে তেমন, যেমনটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে মোকাবেলা করতে হয়েছিল ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার সময়ে। তখন জন মেনার্ড কেইনসের অনুপ্রেরণায় তিনি ফেডারেল তহবিল খরচ করেছিলেন দেশজুড়ে অতি-প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার পেছনে। তার কর্মসূচি ‘নিউ ডিল’ মহামন্দার অবসান ঘটিয়েছিল। আজ একই ধরনের ধারণা ‘গ্রিন নিউ ডিল’ বিশ্বজুড়ে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। এ ধারণার সার কথা হচ্ছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকিত কর্মসূচিগুলোর লক্ষ্য হবে দুটি : কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও একই সাথে জরুরি নবায়নয়োগ্য জ্বালানি অবকাঠামো গড়ে তোলা। গ্রিন নিউ ডিল চলবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সামাজিক অনাচারের শুদ্ধায়ন হিসেবে।

সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া কিছু অর্থনীতিবিদের মধ্যে এক ধরনের নৈরাশ্যবাদী প্রবণতা কাজ করে। তারা নিজেদের চিন্তাভাবনা সীমিত রাখেন স্বল্পমেয়াদি ভবিষ্যতের মাঝে। তারা নিজেদের আরোপিত ক্ষীণ দৃষ্টি দিয়ে কয়েক দশকের ভবিষ্যতকে বিবেচনায় আনতে নারাজ। তাদের দৃষ্টি প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে, সমর্থন করেন অন্তহীন প্রবৃদ্ধি। তারা বুঝতে পান না, প্রবৃদ্ধি আজ আর অর্থনৈতিক উন্নতির পরিমাপের উপযুক্ত মাপকাঠি নয়। শুধু প্রবৃদ্ধির দিকে থাকালে বৈষম্য বাড়ে, সর্বসাধারণের কল্যাণ নিশ্চিত হয় না। তাই তারা নতুন বিশ্ব গড়ার পথে বাধা।

করোনা মহামারী শিখিয়েছে- আমাদের অভিন্ন সমস্যা সমাধানে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। উন্নততর বিশ্ব গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন নয়া স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি একটি ‘সোশ্যাল কন্ট্যাক্ট’। এই সামাজিক চুক্তি মানবজাতির অভিন্ন স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। আজকের দিনের অর্থায়ন ব্যবস্থা টেকসই নয়, তা কাজ করে কিছু ধনী মানুষের স্বার্থে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন টেকসই স্থিতিশীল অর্থব্যবস্থা, যা কমিয়ে আনবে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং কাজ করবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে। তাই মোটা দাগে এখনই যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে তার মধ্যে আছে : বন্ধ করতে হবে অর্থহীন যুদ্ধ ও অস্ত্রের পেছনে বিপুল অর্থ খরচ; এ অর্থ খরচ হবে গঠনমূলক কাজে- স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ও গবেষণার মতো খাতে। ফসিল জ্বালানি উত্তোলন ও ব্যবহার চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে; কার্বন নিঃসরণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; দেশে দেশে পুনরুদ্ধার করতে হবে গণতন্ত্র ও বন্ধ করতে হবে জাতি-রাষ্ট্রিক আগ্রাসন, অবসান ঘটাতে হবে লোভাতুর করপোরেশনের, অবসান ঘটাতে হবে যুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও মিলিটারিজমের, প্রযুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে জোরদার করতে হবে নীতি-নৈতিকতা, সেই সাথে উন্নততর বিশ্ব গড়ায় নানা জন যেসব ধারণা তুলে ধরছেন, নজর দিকে হবে সেদিকেও।

অনেকের কাছেই মনে হতে পারে- করোনা-উত্তর পরিবেশে উন্নততর নতুন এক বিশ্ব গড়ে তোলা ইউটোপিয়ান চিন্তা বই কিছু নয়। তবে আশাবাদী ও শান্তিবাদী মানুষ তা মনে করেন না। ‘ইউটোপিয়া’ শব্দটি চালু করেন স্যার থমাস মুর। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত তার একটি বইয়ের শিরোনাম ছিল এটি। একটি কাল্পনিক দ্বীপ বুঝাতে তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেন। আসলে মুর এই শব্দটি দিয়ে একটি অতি-আদর্শিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝাতে চেয়েছেন, যা কল্পনায় আছে কিন্তু বাস্তবে নেই। অনেক গুণীজনই মনে করেন, করোনা-উত্তর উন্নতর দুনিয়া কোনো ইউটোপিয়া নয়, এটি বাস্তব। এটি যথার্র্থ অর্থেই সম্ভব। তবে তা সম্ভব করে তুলতে চাই মানবজাতির সামাজিক প্রতিশ্রুতি।

লেখক : সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement