২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রক্ত দিয়ে কেনা, সের দরে বেচা

রক্ত দিয়ে কেনা, সের দরে বেচা - নয়া দিগন্ত

সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন যা জনগণের সার্বিক নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। নাগরিকদের সাথে রাষ্ট্রের অঙ্গীকারনামা বা চুক্তিই (Contract) নামান্তরে সংবিধান। রাষ্ট্র কোনো কারণেই এ চুক্তি লঙ্ঘন করতে পারে না, অর্থাৎ সংবিধান লঙ্ঘন করতে পারে না। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের দ্বারা সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতি পদে পদে। সংবিধান লঙ্ঘনের কারণে সব কিছুই একপেশে চলছে, এ কথা যে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে, তাকেই অনেক অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সংবিধানকে প্রটেক্ট করার দায়িত্ব যাদের তারাও দেশকর্তার গুণগান নিয়ে ব্যস্ত, রাষ্ট্র নায়ককে কার আগে কে খুশি করতে পারবে এখন চলছে তারই প্রতিযোগিতা নামক সার্কাস।

সংবিধানের ১৮ ক অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ কিন্তু দেশের খ্যাতিমান বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ভূমিদস্যু খ্যাত বসুন্ধরা গ্রুপ জলাভূমি, খাল-বিল, নদী-নালা, তিন ফসলি জমি আবাসন প্রকল্প করার জন্য ড্রেজার লাগিয়ে বালু দ্বারা ভরাট করে ফেলছে। এ জন্য কৃষকরা হাহাকার করছে, করছেন আর্তনাদ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীসহ প্রশাসনের কর্ণকুহরে কৃষকদের আর্তচিৎকার পৌঁছতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃষকদের আর্তনাদ যারা পৌঁছাবে তারাও ভূমিদস্যুদের থেকে সুবিধা আদায়ের বিনিময়ে প্রকৃত ঘটনা চেপে রাখে। বরং ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে। এয়ার মার্শাল একে খান তার বইতে লিখেছেন যে, ‘গোয়েন্দারা কোনো সময়ই প্রকৃত তথ্য কর্তৃপক্ষকে জানায় না। কর্তৃপক্ষ যে কথা শুনলে খুশি হবে গোয়েন্দারা সে তথ্যই কর্তৃপক্ষকে শুনিয়ে থাকে।’ ফলে যখন ধস নামে তখন চক্ষু দিয়ে দেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন যে, তাকে ছাড়া সবাইকেই ক্রয় করা যায়।

সমাজের বিত্তশালীরা জমি দখলের বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে। বরং বিত্তশালীরা গ্রামবাসীকে এ মর্মে বুঝাচ্ছে যে, বসুন্ধরা ইংরেজ বেনিয়াদের মতো এতই শক্তিশালী যে তাদের বাধা দিয়ে কোনো কাজ হবে না, বিনিময়ে দালালরা বসুন্ধরা থেকে পাচ্ছে নানাবিধ সুবিধা। নারায়ণগঞ্জের উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, নিম্ন আদালতের এক আইনজীবী প্রথমে ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে (ভোলাব ইউনিয়ন) অবস্থান নেয়ার জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন, পরবর্তীতে দেখা গেল যে, একটি প্রাইভেটকার ও সস্ত্রীক হজে যাওয়ার ব্যবস্থা পেয়ে উল্টো ভূমিকা রেখেছেন। যারা বিত্তশালী তাদের কাছে সমাজের অবহেলিত মানুষের প্রত্যাশা থাকে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সে প্রত্যাশার গুড়েও এখন বালি।

বাংলাদেশের সংবিধান একটি গণমুখী ও জনবান্ধব সংবিধান, বিশেষ করে সংবিধানের তৃতীয় ভাগে অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে ৪৭ক অনুচ্ছেদ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে বিভিন্ন স্তরের যে নিশ্চয়তা দেয়া আছে, পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের চেয়ে তা কম নয়। কিন্তু রাষ্ট্রনায়করা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সংবিধান নামক দলিলটি পদদলিত করে, ছিন্নভিন্ন করে অকার্যকর করছে। সংবিধানের পরিপন্থী অনেক নিবর্তনমূলক আইন পাস করেছে এবং শেখ হাসিনা সরকার দেশটি দু’ভাগে বিভক্ত করেছে, যাদের মধ্যে রয়েছে একদল শাসকগোষ্ঠী, বাকি সব শোষিত যারা সরকারি দালালি করে না বরং সুযোগ মতো সমালোচনা ও প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদকারীরাও এখন চুপসে গেছে। সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে গুম খুন ছাড়াও মিথ্যা মামলা, চার্জশিট ও রিমান্ড বাণিজ্য তো রয়েছে। অধিকন্তু শুরু হয়েছে দুদকের নোটিশ। সরকার কোনো বিষয়ে কারো প্রতি বিরক্ত বা নাখোশ হলেই দুদক একটি নোটিশ ধরিয়ে দেয়। প্রতিবাদকারীদের মুখ বন্ধ করার জন্য দুদকের একটি নোটিশই তো বর্তমান বাজারে একটি শান দেয়া ‘তরবারি’ হিসেবে কাজ করছে। সত্য কথা বলতে গিয়ে কে চায় একটি তরবারির নিচে নিজের মাথাটি এগিয়ে দিতে, কারণ কারো ঘাড়ে তো আর দুইটি মাথা থাকে না (!)

সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বা প্রমোশনের ক্ষেত্রটি শাসকগোষ্ঠীর ছেলে/সন্তানদের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। অন্য দিকে চাকরি প্রার্থীর পরিবার বা নিকট আত্মীয় যদি বিরোধী দলের হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে নিয়োগ বা প্রমোশন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ, এ নীতিতে চলছে সরকার। অথচ সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে,
‘১। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।
২। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।
৩। এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই :
(ক) নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে,
(খ) কোনো ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোনো আইন কার্যকর করা হইতে,
(গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোনো শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত করিবে না।

সম্প্রতি রাজনীতি অঙ্গনে একটি ‘নতুন কথা’ চালু হয়েছে। পুলিশের অনুমতি ব্যতীত সভ্য-সমাবেশ করা যাবে না। অথচ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩৬, চলাফেরা করার স্বাধীনতা, অনুচ্ছেদ-৩৭ এ সমাবেশের স্বাধীনতা, অনুচ্ছেদ সংগঠনের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।

অনুচ্ছেদ-৩৬ এ বলা হয়েছে যে, ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের অবাধ চলাফেরা, ইহার যেকানো স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’

অনুচ্ছেদ-৩৭ এ বলা হয়েছে যে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’

অনুচ্ছেদ-৩৮ এ বলা হয়েছে যে, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে। তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি -
(ক) ইহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়,
(খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়,
(গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়, বা
(ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।’

অনুচ্ছেদ-৩৯ এ বলা হয়েছে যে,
‘(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।
(২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে,
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং
(খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’

এই সংবিধানকে কার্যকর রাখার এবং সংবিধান মোতাবেক নিজ দায়িত্ব পালন করার জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সাংবিধানিক পদপ্রাপ্ত সবাই শপথ করেছেন। অথচ শপথ ভঙ্গ হচ্ছে তাদের দ্বারা যাদের হাতে সংবিধানকে রক্ষা করার দায়িত্ব।

বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার উল্টো পথে হাঁটছেন। উল্টো পথে বিগত সরকারগুলোও হেঁটেছে। তবে উল্টো পথে চলার রেকর্ড সৃষ্টি করেছে শেখ হাসিনা সরকার। রাষ্ট্রনায়কের মুখের কথাই আইন, তিনি যে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন সে মতেই সবকিছু বাস্তবায়িত হচ্ছে। তার নির্দেশে পুলিশ সংবিধানের ওপরে বুট রেখে রাজপথে আন্দোলনকারীদের গরুর মতো পেটায়, গ্রেফতার, মিথ্যা এজাহার, রিমান্ড বাণিজ্য তো আছেই। মেজর (অব:) সিনহার মামলার তদন্তের পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, সিনহা প্রদীপের (ও.সি) ইয়াবা ব্যবসা সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার কারণেই থানায় বসেই সিনহাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। পুলিশ প্রধান র‌্যাবের বক্তব্য বিরোধিতা করে বলেছেন যে, হত্যার পরিকল্পনা থানায় হয় না। আমি পুলিশ প্রধানকে অনুরোধ করছি র‌্যাব ও আপনার বক্তব্যের মধ্যে জনগণ কোনটা বিশ্বাস করে তা দয়া করে একটু যাচাই করে দেখলেই গণআস্থায় আপনারা কতটুকু আস্থা ভাজন আছেন তা উপলব্ধি করতে পারবেন। দেশটা স্বাধীন করা হয়েছিল গণমানুষের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য। ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য, সম্মান নিয়ে বাঁচার নিশ্চয়তার জন্য, কিন্তু সংবিধানের মৌলিক অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত, কারণ সংবিধান তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। বাঙালির রক্তের বিনিময়ে সংবিধান কেনা (অর্জন) হয়েছিল, তা এখন সের দরে বিক্রি হয়েছে। জনগণের মৌলিক অধিকার অর্জন না হওয়া পর্যন্ত জনগণের কাছে এ সংবিধান একটি কাগুজে পাণ্ডুলিপি মাত্র। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সংবিধানের অপব্যবহার করা যেন এখন নেশায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা মনে করে, সংবিধান যেখানে থাকার থাকুক, চাই শুধু ক্ষমতা আর ক্ষমতা এবং এ জন্যই উল্টো পথে চলার সংস্কৃতি চালু হয়েছে, যা চলছে এখন নগ্নভাবে।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement