১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডুবে আছি বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারে

ডুবে আছি বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারে - নয়া দিগন্ত

ঘরের দেয়ালজোড়া বইয়ের তাকটি কাঠমিস্ত্রি ডেকে মেরামত করেছি গত সপ্তাহে। সমস্ত বই, ফাইলপত্র নামিয়ে রাখা ছিল ঘরের মেঝেতে। হাঁটা-চলার জায়গা ছিল না। সোফার কুশন, ছোটখাটো সামান্য শো-পিস, ফ্লাওয়ার ভাস ইত্যাদি স্থানচ্যুত ও লণ্ডভণ্ড। ভয় ছিল ঘরের মানুষ কখন আলটিমেটাম দিয়ে বসেন। ভাগ্য ভালো, কী কারণে এবার তার দিলে আল্লাহ রহম পয়দা করে দিয়েছিলেন। বই গোছানোর জন্য তিনি আমাকে সময় দিলেন অফিস ছুটির দিন আসা পর্যন্ত। আমিও সে রকমই ভেবে রেখেছিলাম। দিন তিনেকের মাথায় ছুটির দিনে বই গোছাতে গিয়ে এক কেলেঙ্কারি অবস্থা। তিন দিনে বইয়ের ওপর এমন ধুলা জমেছে যেটা অবিশ্বাস্য। মনে হচ্ছিল, ঘরে নয়, বইগুলো যেন ব্যস্ত রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। বাস-ট্রাকসহ নানা ধরনের যান চলাচলের কারণে রাস্তার পাশের দোকানপাট, ঘরবাড়ির চালে, জানালায় যেমন ধুলার পুরু স্তর পড়ে, আমার বইগুলোর ওপরও তেমনই ধুলার স্তর পুরু হয়ে জমে আছে। অথচ ঢাকায় এখন রীতিমতো শীত। ঘরের সব জানালা বন্ধ। শুধু বারান্দার দিকের দু’টি দরজা দিনের শুরু থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে। আমার বাসাও রাস্তা থেকে দূরে নিরিবিলি আবাসিক এলাকায়। সে রাস্তায় বাস-ট্রাক দূরের কথা খুব বেশি গাড়িঘোড়াও চলে না। অথচ এত ধুলা জমেছে যা আগে সাত দিনেও জমত না। প্রতিদিন তো ঘরের আসবাব, বই সব মোছা সম্ভব না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটিই করতে হবে। পুরো ঢাকা শহরের বাতাসে ভাসছে ধুলাবালু এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো বিভিন্ন গ্যাস। আর এসবের উৎস হলো ইটের ভাটা, ডিজেলচালিত গাড়ি, কল-কারখানা ও নির্মাণকাজের কারণে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ। গত ১২ বছর ধরে চলমান খোঁড়াখুঁড়িও অন্যতম কারণ।

বইপত্র ঝাড়তে ঝাড়তে ঘর ধুলাচ্ছন্ন হয়। মুখে মাস্ক পরেও অবিরাম হাঁচি শুরু হয়ে যায়। ধুলাচ্ছন্ন অবস্থায় কাজ করতে গিয়ে মনে পড়ে, ঢাকায় ক’দিন থেকে সূর্যের চেহারা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। একধরনের কুয়াশার চাদর পুরো শহরটিকে ছেয়ে ছিল। এটিকে অনেকেই মনে করেছেন শীতের কুয়াশা। কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন, ‘বিকেলের জানালায় বসে আছি, ওপাশে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। কী ভীষণ কুয়াশা!’ হ্যাঁ, কুয়াশা হয়েও ছিল বেধড়ক। তবে সেটা ঢাকায় নয়, গ্রামে এবং বিশেষ করে বড় নদীতে। ঘন কুয়াশায় পথ হারিয়ে হাজারও যাত্রীবোঝাই কয়টি ফেরি কত ঘণ্টা যমুনার বুকে বেঘোরে ঘুরেছে, কত যাত্রী খাবার না পেয়ে প্রচণ্ড শীতে কষ্ট পেয়েছে সে খবর দিয়েছে জাতীয় পত্রিকাগুলো। কিন্তু ঢাকা শহরে সূর্যের মুখ দেখতে না পারার জন্য দায়ী কেবল কুয়াশা নয়। তার সাথে আরো কিছু ছিল, সেটি ধুলা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর এসেছে, গত সপ্তাহে বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করে নিয়েছিল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ভারতের দিল্লি ও চীনের বেইজিং এ ক্ষেত্রে ঢাকার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। ঢাকার সেই শীর্ষ অবস্থান এরই মধ্যে হারিয়েছে এমন নয়। কারণ বায়ুদূষণ রোধে সম্প্রতি ঢাকায় কোনো উদ্যোগ বা বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এমনটি জানা যায়নি। ফলে ধরে নেয়া যায়, অন্য কোনো প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে না পারলেও এই একটি ক্ষেত্রে ঢাকা সম্ভবত শীর্ষ অবস্থানেই আছে। এ অবস্থায় বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বায়ুর মান নিয়ে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঢাকাবাসীকে বায়ুদূষণ থেকে বাঁচার জন্য মাস্ক পরে ঘরের বাইরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, দূষিত বাতাস যাতে ঘরে দূষণ ছড়াতে না পারে সে জন্য জানালা বন্ধ রাখতে এবং বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের বাড়ির বাইরে না যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছে সংস্থাটি। যে শহরের মানুষ ঘাড়ের ওপর করোনা মহামারীর মতো মৃত্যুর হিম শীতল নিঃশ্বাস উপেক্ষা করে মাস্ক ছাড়াই ঘরের বাইরে অবাধে ঘোরে, দূরত্ব বজায় রাখার বদলে ভিড়াভিড়ি করে যানবাহনে যাতায়াত করে, তারা বায়ুদূষণ থেকে বাঁচতে মাস্ক পরবে এটি বোধ হয় কোনো পাগলেও আশা করবে না। পরিণতিটাও স্পষ্ট। তিন সপ্তাহ ধরে কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর সংখ্যা ৩০ এর ওপরে।

যা হোক, ‘এয়ার ভিজুয়াল’ নামের উল্লিখিত সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, চলতি মাসের বেশির ভাগ সময়ই ঢাকার বায়ুমান সূচক (একিউআই) ছিল অস্বাস্থ্যকর এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরম অস্বাস্থ্যকর। ১১ ডিসেম্বর ঢাকার বায়ুমান ছিল ২০১ একিউআই। এর আগে ৯ ডিসেম্বর অবস্থা ছিল আরো খারাপ। এয়ার ভিজুয়ালের তথ্য অনুযায়ী, সেদিন ঢাকার বায়ুমান ছিল ২৪৫ একিউআই, যাকে বলা হয় চরম অস্বাস্থ্যকর। বায়ুদূষণে মানুষের মৃত্যু ঘটে। গ্যাস চেম্বারে যেমন মুহূর্তের মধ্যে মানুষের মৃত্যু ঘটে বায়ুদূষণে ঠিক সেভাবে নয়, এ ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটে ধুঁকে ধুঁকে। বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় মানুষ। বায়ুদূষণজনিত কারণে বছরে যত মানুষের মৃত্যু হয় সেই সংখ্যাও লাখের ঘরে। সে হিসাবে ঢাকাকে এখন একটি বিষাক্ত গ্যাস চেম্বার বললে খুব বেশি বোধ হয় বাড়িয়ে বলা হবে না। সর্ব সাম্প্রতিক হিসাব জানতে পারিনি। তবে ২০১৯ সালের এক পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর দূষণজনিত নানা রোগে দুই লাখ সাত হাজার ৯২২ জনের মৃত্যু হয়। ল্যানসেট কমিশন অন পলিউশন অ্যান্ড হেলথ সারা পৃথিবীর দূষণের ওপর গবেষণা করে এই হিসাব তুলে ধরে। তাদের হিসাবে বায়ুদূষণে মৃত্যুর দিক থেকে ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬ নম্বরে। আরেকটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে বিশ্বে যত মানুষ মারা গেছে তার মধ্যে ১৫ শতাংশই মারা গেছে দূষণের কারণে। আমাদের সরকার আবার এসব পরিসংখ্যানে আস্থাশীল নয়। মানুষের সমস্যা লাঘবের চেয়েও অনেক বড় এজেন্ডা তাদের আছে। সেটা হলো দৃশ্যমান উন্নয়ন। তারা সেই উন্নয়নের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। কাজেই তাদের দোষও দেয়া যায় না। দেশের উন্নয়ন তো মানুষেরই উন্নয়ন!

এ দিকে বায়ুদূষণের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা শীতের অনেক আগে থেকেই সতর্ক করে আসছিলেন। তারা বলছিলেন, শীতের সময় স্বাভাবিকভাবেই কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। সেই সাথে বায়ুদূষণ অব্যাহত থাকলে মানুষের ফুসফুসের ক্ষতি হবে। আর করোনাভাইরাস সবার আগে মূলত মানুষের ফুসফুসকেই আক্রমণ করে এবং সেটিকে দুর্বল করে দেয়। ফলে দূষণ রোধ করতে না পারলে কোভিডে মৃত্যুর হার বেশি হবে। বায়ুদূষণে মানুষের শ্বাসযন্ত্র ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয় এবং এর ফলে নানা ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে যে, যেসব শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি তাদের করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে তৎপরতা জোরদার করতে হবে। বাস্তবে হয়েছেও তা-ই। কিন্তু দূষণ রোধে সরকারি কোনো সংস্থা তেমন কোনো কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বা বাস্তবায়ন করেছে এমন দেখা যায়নি। অথচ ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় বায়ুদূষণের কারণগুলো অনেক আগেই চিহ্নিত হয়েছে। ইটভাটা, উন্নয়ন কাজের জন্য বছরভর খোঁড়াখুঁড়ি, নির্মাণসামগ্রী খোলা জায়গায় ফেলে রাখা, নির্মাণকাজের সময় সংশ্লিষ্ট জায়গায় পরিবেশগত যেসব আইন-বিধি অবশ্য পালনীয় সেসব পরিপালন না করা এগুলোই ঢাকার দূষণের জন্য দায়ী। অথচ আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবেশ অধিদফতর আছে। তাদের কাজ পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু সেসব হচ্ছে না। ঢাকায় সিটি করপোরেশন দু’টি। নগরীর ভেতরে যেসব উন্নয়ন কাজ চলছে সেগুলো থেকে যাতে দূষণ না ছড়ায় সেটি দেখভালের দায়িত্ব তাদের আছে। কিন্তু মাঝে মধ্যে দায়সারাভাবে রাস্তায় দু-চার গাড়ি পানি ছিটানো ছাড়া তারা আর কোনো ব্যবস্থা নেয় বা নিচ্ছে এমনটি চোখে পড়ে না।

পরিবেশ দূষণের এসব বিষয় আদালতেও গড়িয়েছে এবং আদালতের নির্দেশে পরিবেশবিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কমিটির কোনো কার্যক্রম নেই। ফলে মানুষের ভোগান্তি দূর হওয়ার বা আপাতত লাঘব হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা যারা এই বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারের বাসিন্দা তাদের মৃত্যুর আগে এ সমস্যার সুরাহা দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হবে কি না সেটি উপরওয়ালাই সম্ভবত ভালো জানেন। আমাদের চোখে দূরে দেখার সমস্যা আছে, কুয়াশা, ধোঁয়াশাও আরেক কারণ। তাই অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে কী হতে পারে বা হতে যাচ্ছে সেই বিষয়ে পূর্বাভাস দেয়া আমাদের কম্ম না।

mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement