২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দেশটা কি ‘মগের মুল্লুক’?

দেশটা কি ‘মগের মুল্লুক’? - ছবি : নয়া দিগন্ত

মুক্তিযোদ্ধা, দেশের একজন সেরা কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার মরমী কণ্ঠে গেয়েছেন, ‘শহরবাসী শোনো, তোমরা যাদের মানুষ বলো না, বিধিও যাদের কান্না শুনে না, এরাও মানুষ, আছে তাদের প্রাণ, আমি চোখের জলে শুনাই তাদের গান।’ এ গানটির যথার্থতা ও মর্মকথা যদি উপলব্ধি করতে চান, তবে আপনাকে নারায়ণগঞ্জ জেলাধীন রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখে আসতে হবে। ইতঃপূর্বে যদি কোনো দিন রূপগঞ্জে গিয়ে থাকেন তবে নিশ্চয়ই আপনি সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা রূপগঞ্জকে দেখেছেন যা বালু ও শীতলক্ষ্যা বিধৌত পলিমাটি দিয়ে বিধাতার আশীর্বাদপুষ্ট। দেখেছেন পুকুরে, খাল-বিলে, গ্রামবাসীর দলবেঁধে মাছ ধরার আনন্দ-উল্লাস। কিন্তু এখন দেখবেন রূপগঞ্জ প্রায় মরু অঞ্চল। সেখানে বালু চাষ হচ্ছে; ধান ও সবজি চাষাবাদ দেখা যাবে না। অথচ রাজধানীর সবজির চাহিদা পূরণ করত রূপগঞ্জের কৃষকরা। সেখানে ভূমিদস্যুরা জোর করে ড্রেজার বসিয়ে মাইলের পর মাইল তিন ফসলি জমি, খাল-বিল, নিচু জমি ইত্যাদি বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পের নামে ভরাট করে ফেলছে। যে বাধা দেয় তার ওপর খড়গ নেমে আসে, অথচ জনগণের বিপদে যাদের কাছে আশ্রয় নেয়ার কথা (জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন) তারাও ভূমিদস্যুদের পক্ষ নিয়েছেন। স্থানীয় জমির মালিক ও কৃষকদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে তারা (জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন) যেন বধির ও অন্ধ। জোর করে ভূমি দখলের বিষয়টি যেন ভূমিদস্যুদের ‘অধিকার’-এ পরিণত হয়েছে। বালু ভরাট বন্ধ করা ও বন্ধ রাখার জন্য মহামান্য হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশন জেলা প্রশাসক, নারায়ণগঞ্জকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সে নির্দেশ ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’।

অথচ জোর করে তিন ফসলি জমি, নদী-নালা, খাল-বিল, জলাশয়ে ভূমিদস্যুদের দ্বারা বালু ভরাট অব্যাহত রয়েছে। ৭০টি ড্রেজার দিয়ে কায়েতপাড়া ইউনিয়নে বালু ভরাট দিন-রাত অব্যাহত রেখেছে। এমনিভাবে ভূমিদস্যুরা তাদের দোসরদের মাধ্যমে রূপগঞ্জকে শ্মশানে পরিণত করেছে এবং এ ক্ষেত্রে ভূমিদস্যুদের প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন অনেক জনপ্রতিনিধি যাদের ছায়াতলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অবস্থান নেয়ার কথা ছিল। সরকার, তথা জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বালু ভরাট বন্ধের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ পাওয়ার পর Over Look করে যাচ্ছেন। সমাজের বিত্তশালী লোকেরাও বৈষয়িক সুবিধা আদায়ের জন্য ভূমিদস্যুদের সাথে হাত মিলিয়েছেন, রীতিমতো ‘দালালি’ করছেন। যারা প্রতিবাদ করে তাদেরকে পুলিশি হয়রানির মাধ্যমে থামিয়ে দেয়া হয়। যাদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দিতে পারেন না, ভূমিদস্যুদের কারো কারো মালিকানাধীন মিডিয়ায় প্রতিবাদকারীদের চরিত্র হনন করা হয়। মিথ্যা বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন করে হলুদ সাংবাদিকতা করছে। এ বিষয়টি নিয়ে বকধর্মী ব্যক্তিদের গায়ে কাটা ধরে না, কারণ দেশে তো এখন হাতেগোনা দুই-চারজন ছাড়া মজলুমের পক্ষে কথা বলার বুদ্ধিজীবী নেই, বরং পরজীবী সৃষ্টি হয়েছে যারা বিত্তশালীদের বাড়ি বাড়ি ফেরি করে নিজেদের ভাগ্য গড়েন এবং কে কার আগে সরকারের পক্ষে গান গাইবেন তার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

সমষ্টিকে নিয়েই পথচলা সমাজের একটি বিধিবদ্ধ সংস্কৃতি। কিন্তু সমষ্টির পরিবর্তে মানবজাতি এখন একলা চলার নীতিকে অনুসরণ করছে। শিক্ষিতদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। রূপগঞ্জের অনেক সন্তানই আইনজীবী হিসেবে যারা ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু এদের মধ্যে অনেকেই আন্দোলনে আসতে অনীহা প্রকাশ করে বলেন যে, ‘আমরা কি ওদের বিরুদ্ধে পারব?’ তখন আমার মনে হয় কেন মানুষ তার নিজ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পায় না? জমি একজনের অথচ আরেকজন বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলে, যার কোনো প্রতিকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা কোথাও পাচ্ছেন না। এসব কারণেই হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ মন্তব্য করেছেন, ‘দেশটা কি মগের মুল্লুক?’

হাইকোর্টের মন্তব্যে গোটা জাতি আশ্বস্ত হয়েছে, মজলুম পেয়েছে মানসিক প্রশান্তি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বলছেন, তিন ফসলি জমি ভরাট করা যাবে না, খাল-বিল, নদী-নালা প্রভৃতি ভরাট করা যাবে না, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না।’ অথচ ভূমিদস্যুদের দ্বারা সবই সংঘটিত হচ্ছে, এর পেছনে রহস্য কী? সরকারপ্রধান যেখানে প্রকাশ্যে তিন ফসলি জমি রক্ষার কথা জোর দিয়ে বলছেন সেখানে প্রধানমন্ত্রীর আদেশ উপেক্ষিত কেন? বিষয়টি দেখেও না দেখার নীতি অনুসরণ করা উচিত নয়।

অনেকেরই মন্তব্য, দেশে আইনের শাসন নেই। অন্য দিকে সরকার বলছেন, আইন মোতাবেকই রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। এখানে কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা? সত্যকে কি মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যায়? কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, ‘মিথ্যাই’ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। না হলে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বালু ভরাট হচ্ছে কিভাবে? এ জন্য সরকার তাদের ব্যর্থতাকে, কোন আঙ্গিকে জবাবদিহিতার মোকাবেলা করবে? সরকার ও প্রশাসন জানেন, এ দেশে ‘জবাবদিহিতার’ সংস্কৃতি উঠে গেছে। সরকারি প্রশাসনকে নিজেদের ব্যর্থতার জন্য কোনো জবাব দিতে হয় না। ফলে সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২১(২) এর নির্দেশনা মতে আমলারা এখন আর ‘জনগণের সেবক’ নন, বরং তারা মালিকে পরিণত হয়েছেন।

রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির কথা শোনা যায়, কিন্তু আমলাদেরও বেগমপাড়ায় বাড়ি গাড়ি থাকার কথা তারা স্বীকারই করে ফেলেছেন। কিন্তু তাদের মানিলন্ডারিংয়ের বিচার সুদূর পরাহত, শুধু নামেই শোনা যায়, কার্যত নয়।

সব বিষয়েই সরকার এখন ‘স্বাধীনতার চেতনা’র কথা বলে থাকেন। সরকারি দলের মনপূত কিছু না হলেই ‘স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে’। এখন জানতে ইচ্ছা হয় ‘স্বাধীনতার চেতনা’ কী এবং কত প্রকার? একজনের জমি আরেকজন জোর করে ভরাট করে ফেলার নাম তো স্বাধীনতার চেতনা নয়। ভূমিদস্যুরা তাদের দস্যুবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য কোনো কোনো পত্রিকাকে ‘হলুদ’ সাংবাদিকতার কাজে ব্যবহার করছে। এটাই কি কথিত চেতনা?

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে জাতি একটি সংবিধান পেয়েছে যার ৪২(১) অনুচ্ছেদে উল্লেøখ রয়েছে, ‘আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর ও অন্যভাবে বিলিব্যবস্থা করার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না।’ স্বাধীনতার নির্যাস থেকে প্রাপ্ত ‘সংবিধান’ লঙ্ঘন করে জোর করে মানুষের জমি দখল করার নাম স্বাধীনতার চেতনা হতে পারে না।

দেশে চলছে হালুয়া রুটি খাওয়ার মহোৎসব। এ মহোৎসবে কারা জড়িত তা দেশবাসী জানে। এ লুটেরাদের কাছে দেশ ও জাতি জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাদের প্রভাবেই প্রান্তিক চাষিরা দিনে দিনে ভূমিহীন হয়ে যাচ্ছেন। এ জন্যই কি দেশবাসী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন করেছিল? ‘স্বাধীনতা’ ছিল তখন সময়ের দাবি। স্লোগান ছিল ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না।’

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও কি দেশবাসী সমভাবে দু’বেলা খেতে পাচ্ছে, সবাই কি পাচ্ছে চিকিৎসা, সামাজিক নিরাপত্তা? সম্পদের সুষম বণ্টনের দাবি থেকে স্বাধিকার আন্দোলন এবং এ আন্দোলন যখন বেগবান হয়ে উঠে তখন বাঙালি জাতি স্বাধীনতাকেই তাদের মুক্তির সোপান হিসেবে বেছে নিলো। স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে কি একটি গোষ্ঠী বা শ্রেণীর জন্য যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ যে যেখান থেকে পারছে লুটেপুটে খাচ্ছে। খাদ্য চাহিদা পূরণে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য, কৃষিজমি ও কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করা রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব।

দৃশ্যত মনে হচ্ছে, রাষ্ট্র সে দায়িত্ব থেকে সরে এসেছে। নতুবা একজনের জমি আরেকজন জোর করে দখল করে কিভাবে? কোন নৈতিকতায় সরকার দুর্বল কৃষকদের পাশে না দাঁড়িয়ে ভূমিদস্যুদের আশকারা দিচ্ছে, অর্থাৎ অবৈধ জমি দখলে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা কেন সৃষ্টি করছে না? সার্বিক পর্যালোচনায় হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ যথাযথই বলেছেন, ‘দেশটা কি মগের মুল্লুক?’ এ আবেগ উৎকণ্ঠা পুরো জাতির। গোটা জাতি নীরবে নিভৃতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ছে, কিন্তু মুখ খুলতে পারে না যা পেরেছেন মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন। ‘ভয়’ এখন জনগণকে দুমড়ে মুচড়ে খাচ্ছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে সরকার জনগণকে শাসন করছে বটে, কিন্তু নিজেদের শ্রদ্ধার আসনে বসাতে ব্যর্থ হয়েছে।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)

E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement