২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ক্যাশ ওয়াকফ, এক চিরন্তন পুঁজি

ক্যাশ ওয়াকফ, এক চিরন্তন পুঁজি - নয়া দিগন্ত

পারপিচুয়াল ক্যাপিট্যাল বা চিরন্তন পুঁজি। গতানুগতিক পশ্চিমা অর্থনীতিতে এ ধরনের কিছু নেই। তবে ইসলামিক অর্থনীতিতে এটা হতে পারে। এই চিরন্তর মানে অবিনাশী নয়। এটা হলো এমন পুঁজি যা স্থায়ীভাবে গচ্ছিত থাকবে এবং সেটি প্রত্যাহার করা হবে না। আধুনিককালে ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেটের যে ধারণার বিকাশ ঘটেছে, সেটাই আসলে এই চিরন্তন পুঁজির উৎস হবে। এই খাতে বিশেষায়িত ব্যাংক হতে পারে। অথবা ইসলামি ব্যাংকগুলো বিশেষায়িত ক্যাশ ওয়াকফ শাখাও করতে পারে। আমি এর আগে এই কলামেই ওয়াকফ, ক্যাশ ওয়াকফ ও ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেটের বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সহজ কথায়, ক্যাশ ওয়াকফ হচ্ছে সমাজের বিত্তশালী জনগোষ্ঠীর সঞ্চয়ের একটি অংশ থেকে অর্জিত আয় সামাজিক সেবায় বিনিয়োগের এক মহৎ প্রয়াস। এটা ওয়াকফ সম্পত্তির মতোই পূর্বনির্ধারিত বিভিন্ন খাতে ব্যয় করা হবে। এই প্রয়াস বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি হলো ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেট। যিনি তার অর্থ ওয়াকফ করছেন তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের (বর্তমানে ব্যাংক) কাছ থেকে ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেট পাবেন। এটা ওয়াকিফ বা ওয়াকফকারীর প্রতি একটি স্বীকৃতিপত্র। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি ওয়াকফকৃত অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করবে। সেই মুনাফা ওয়াকিফ নির্ধারিত খাতে ব্যয় করা হবে। কিন্তু ওয়াকফকৃত মূল অর্থ অক্ষুণœ থেকে যাবে।

দারিদ্র্যবিমোচনে বাণিজ্যিক ব্যাংক যে কাজ করতে পারে সেটি এখন এক স্বীকৃত সত্য। ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেট একটি স্বীকৃত ব্যবস্থা এবং দেশের প্রতিটি ইসলামিক ব্যাংকে এটা চালু রয়েছে। এই সার্টিফিকেটকে কিভাবে দেশের তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিয়ে সমাজ ও মানবতার কল্যাণ করা যায় তা নিয়েই আজকের আলোচনা। আর ওয়াকফকৃত ক্যাশ বা টাকা এমন এক পুঁজি যা গচ্ছিত থাকলে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার জন্য আর কোনো ভাবনা থাকবে না।

আমি এর নাম দিয়েছি ‘এক ইউনিয়ন, এক বাড়ি’। আমাদের দেশে ৬৮ হাজারের বেশি গ্রাম রয়েছে, ইউনিয়ন রয়েছে সাড়ে চার হাজারের বেশি। থানার সংখ্যা প্রায় ৬৫০। এই ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেট কমিউনিটি পর্যায়ে হতে পারে, গ্রামভিত্তিক বা ইউনিয়নভিত্তিক হতে পারে। পরিশেষে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও হতে পারে। প্রাথমিকভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে বিবেচনা করার কারণ, এটা আমাদের পল্লী অঞ্চলের সর্বনিম্ন প্রশাসনিক একক। এখানে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত চেয়ারম্যান, মেম্বার থাকেন। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ক্যাশ ওয়াকফ বুথ স্থাপন করা যেতে পারে। সেখানে এমন কোনো বাড়ি খুঁজে বের করা হবে যার মালিক এই শর্তে একটি ঘর ওয়াকফ করবে যে সেখানে শুধু ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেট বিক্রি করা হবে, অন্য কোনো আর্থিক লেনদেন করা হবে না। আমার ধারণা, বাংলাদেশে এমন কোন ইউনিয়ন নেই যেখানে একটি ঘর ওয়াকফ করার মতো কোনো ধনী ব্যক্তি নেই। সেই ঘর পরিচালনা করবে ক্যাশ ওয়াকফের ব্যবস্থাপক কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ঘরটি ওয়াকিফের ইচ্ছা অনুযায়ী তার পিতা, মাতা, দাদা-দাদীর নামে নামকরণ করা হবে। এতে অপারেশনাল কস্ট কমে যাবে। বাড়ি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিবেচনার বদলে বিবেচনা হবে জনকল্যাণ। হিন্দু বা খ্রিষ্টানের বাড়িও হতে পারে। বরং ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেটকে সার্বজনীন রূপ দিতে সব ধর্মের মানুষকে এখানে একত্রিত করাই যুক্তিযুক্ত মনে করি। কারণ, ক্যাশ ওয়াকফের টাকা দিয়ে দেবোত্তর সম্পত্তি উন্নয়নে বাধা নেই। আমি তার পূজায় যাবো না; কিন্তু তার সামাজিক সমস্যা দূর করতে তো অসুবিধা নেই। ওয়াকফের কল্যাণ ভিন্ন ধর্মের মানুষও ভোগ করতে পারে। এমন ঘরকে আমি বলছি ওয়াকফ বুথ। ওই অঞ্চলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখা এই বুথের কমান্ড সেন্টার হিসেবে কাজ করবে। ব্রাঞ্চের ম্যানেজার হবেন কমান্ড অফিসার। বুথটি পরিচালনার জন্য উপযুক্ত স্থানীয় কোনো ভলান্টিয়ার অথবা কাউকে সম্মানী দিয়ে নিয়োগ দেবে ব্যাংক। তার কাজ হবে মানুষকে ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেট সম্পর্কে বোঝানো এবং এর কল্যাণকর দিকটি তুলে ধরা। কেউ ক্যাশ ওয়াকফ করলে বুথ থেকে সেই অর্থ ইলেকট্রনিক্যালি ব্রাঞ্চে গিয়ে জমা হবে। হেডকোয়ার্টার থেকে সংশ্লিষ্ট ওয়াকিফকে দেয়া সার্টিফিকেট বিতরণ করবে ভলান্টিয়ার।

একটি গ্রাম বা ইউনিয়ন থেকে কত ক্যাশ ওয়াকফ সংগৃহীত হতে পারে? এটা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করবে। তবে যে অঙ্কই সংগৃহীত হোক না কেন তা খরচ হবে ওই গ্রামের সামাজিক সমস্যা নিরসনে। এটা হতে পারে ওয়াকিফ নির্ধারিত খাত অথবা কোনো খাত নির্ধারণ করা না থাকলে যেকোনো খাতে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেট কেনা শুরু হলে সেটি কিন্তু হবে এক অন্তহীন প্রক্রিয়া। কখনো থেমে যাবে না। কারণ ওয়াকফ যে কেউ যেকোনো সময় করতে পারে। এলাকাবাসীর আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধির সাথে সাথে ওয়াকফ সার্টিফিকেট কেনা যেমন বাড়বে তেমনি ওয়াকফ থেকে মুনাফা প্রাপ্তিও বাড়বে; বাড়বে সামাজিক সমস্যা নিরসনের কাজও। অর্থাৎ এটা তখন হবে এক অন্তহীন চেইন রি-অ্যাকশন, যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।

এই ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেটের অর্থ ব্যাংকে জমা হবে চিরন্তন পুঁজির মতো। যা কখনো প্রত্যাহার হবে না। ওয়াকফকৃত সম্পদ কেউ ফিরিয়ে নেয় না। ফলে ব্যাংকের ‘কস্ট অব ফান্ড’ হবে ‘শূন্য’। ব্যাংকও তখন সম্ভাব্য সর্বোচ্চ হারে মুনাফা দিতে পারবে ওয়াকিফকে। আসলে ইসলামে যে সামাজিক সুবিচার করার কথা বলা হয়েছে তা বাস্তবায়নের এক অবারিত দিগন্ত এই ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেট ধারণা। ইসলামিক মূল্যবোধগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলামের মতো সব ধর্মে জীবন বিধান (কোড অব লাইফ) নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। ইসলামে জাকাত দিতে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যবিমোচনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, দরিদ্রকে সাহায্য করতে বলা হয়েছে, ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্ত করতে বলা হয়েছে। রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে সেটি বলা হয়েছে। মুসলমানদের কাছে ইতিহাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ যেটা অন্য ধর্মের কাছে নয়। ইসলামিক রাষ্ট্র দেখবে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না। মানবসেবা, ভালো কাজ করতে সব ধর্মেই বলা হয়েছে। এমনকি প্রকৃতি পূজারিরাও তা বলে। মানবতার মৌলিক মূল্যবোধগুলোর কথা সব ধর্মে একই। কিন্তু ইসলাম তার অনুসারিকে নির্দেশ দেয় সেগুলো তার জীবনে বাস্তবায়ন করার জন্য। অন্যান্য ধর্মে সেই নির্দেশনার অভাব রয়েছে। খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের নবীরা এই বার্তা দিয়ে গেছেন। সেই বার্তা তারা কার্যকর করতে পারেনি। তারা সুদ ছাড়া চলতে পারছে না। তাদের এই চলতে না পারার দায় তো ওই বার্তাবাহকের নয়, বরং তাদের নিজেদের। যদি বার্তার ব্যর্থতা হতো তাহলে আজকে বিশ্বে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ইসলামিক ফাইন্যান্স জমা হতো না। চার শ’র বেশি ইসলামিক ব্যাংক রয়েছে বিশ্বে, যেগুলো সুদবিহীন লেনদেন করছে।

ক্যাশ ওয়াকফের টাকায় সংশ্লিষ্ট এলাকার স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, শিক্ষা, পানির সমস্যা (আর্সেনিক দূষণ) ইত্যাদি সমস্যা দূর করা যায়। এক সমস্যা দূর করার পর আরেকটি সমস্যা দূর করা হবে। ক্যাশ ওয়াকফের মুনাফার টাকা প্রতি বছর পাওয়া যাবে। যত বেশি মানুষ সম্পৃক্ত হবে ওয়াকফ তহবিল তত বড় হবে, মুনাফা তত বাড়বে, জনকল্যাণে ব্যয়ও তত বাড়বে, মানুষের জীবনমান উন্নত হবে, সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।

ক্যাশ ওয়াকফ কিভাবে তৃণমূল পর্যায়ে কল্যাণ করতে পারে তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমার এলাকা সিরাজগঞ্জের নিমগাছিতে আমি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু সেখানে আর্সেনিক সমস্যা। শিক্ষার্থীদের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বহু দূরে এক জায়গার আর্সেনিকমুক্ত পানি সন্ধান পাওয়া গেল। তখন সেখানে গভীর নলকূপ বসিয়ে পাইপ বসিয়ে স্কুলে পানি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হলো। এখন ওই আর্সেনিকমুক্ত পানি এলাকার অনেকে ব্যবহার করছেন। এলাকায় গোরস্থান, সড়ক উন্নয়নে ক্যাশ ওয়াকফের টাকা খরচ করা যেতে পারে। এভাবে শুধু মানুষকে আর্থিক দৈন্যদশা থেকে মুক্তি দেয়াই নয়, সোনার বাংলাও গড়ে তোলা সম্ভব।

আসলে আমাদের দৈন্য সম্পদের নয়, চিন্তা ও চেতনার, ধ্যান-ধারণার। আমরা যে মূর্খ তেমনও নয়। আসলে অনেক বিষয় হয়তো আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারছি না। করোনাভাইরাসের মতো মহামারী ভবিষ্যতে যে আরো আঘাত হানবে না সেই নিশ্চয়তা কোথায়? এর বিরুদ্ধে চীনের প্রাচীরের মতো মজবুত আর্থিক ভিত্তি গড়ে দিতে পারে এই ক্যাশ ওয়াকফ সার্টিফিকেট।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement