২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাইডেন কমলার বাজিমাত খেলা শেষ ট্রাম্পের!

বাইডেন কমলার বাজিমাত খেলা শেষ ট্রাম্পের! - ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন সপ্তাহ পার হয়েছে। এ নির্বাচনে বিশাল জয় পেয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোসেফ বাইডেন। তিনি ইলেকটোরাল ও পপুলার উভয় ভোটে বিজয় লাভ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫৩৮ ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের ২৭০টি যিনি জিতে নেন, তিনিই বিজয়ী হন। এবারের নির্বাচনে জো বাইডেন পেয়েছেন ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট, অন্য দিকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২৩২টি। বিজয়ী বাইডেন পপুলার ভোট পেয়েছেন প্রায় আট কোটি। ৬০ লাখেরও বেশি পপুলার ভোটে ট্রাম্পকে পরাজিত করেন তিনি।

কিন্তু অবাক করার বিষয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এত দিনেও নির্বাচনে পরাজয় স্বীকার করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য হচ্ছে, বিজয়ী প্রার্থীকে পরাজিত প্রার্থীর অভিনন্দন জানানো। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ঐতিহ্যের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। উল্টো বলেছেন, নির্বাচনে তিনিই বিজয়ী হয়েছেন। ৪ নভেম্বর হোয়াইট হাউজে প্রেস ব্রিফিংয়ে নিজেই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে দেন। এরপর একের পর এক টুইটে ট্রাম্প ‘নির্বাচনে আমিই বিজয়ী’ বলে প্রচার করেছেন। জো বাইডেনের কাছে পরাস্ত হয়েছেন, অথচ ট্রাম্প কিছুতেই তা মানতে রাজি নন। গত ১৬ নভেম্বর রোববার একবার টুইটে তিনি নির্বাচনে পরাজয় স্বীকার করেন এই বলে যে, ‘নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলেই বাইডেন জিতেছেন।’ এর পরই আবার টুইট করেছেন, ‘হার মানার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, আমরাই জয়লাভ করব।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনো প্রমাণ ছাড়াই ভোট জালিয়াতি ও চুরির অভিযোগ তোলেন। তিনি ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে অসাংবিধানিক আখ্যায়িত করে মামলা করার হুমকি দিলেন।

তিনি দাবি করেন, লিগ্যাল ভোটে তিনিই জয়লাভ করেছেন। পোস্টাল ভোটকে তিনি বলছেন ‘অবৈধ’ ভোট। পোস্টাল ভোট বাতিলেরও তিনি বারবার দাবি জানান। কয়েকটি রাজ্যে আবার ভোট গণনারও দাবি করেন। তিনি নেমে পড়েন আইনি লড়াইয়ে। মিশিগান, উইসকনসিন, জর্জিয়া ও পেনসিলভানিয়ায় ভোট গণনা বন্ধ এবং পোস্টাল ভোট বাতিলের জন্য মামলা করেছিলেন। কিন্তু আদালতে সেসব মামলা খারিজ হয়ে যায়। কারচুপি নিয়ে ট্রাম্প তার অভিযোগের সপক্ষে একটি প্রমাণও তুলে ধরেতে পারেননি। তার পরও ট্রাম্পের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজ্যে তদন্ত করা হয়, ভোট পুনঃগণনা করা হয়। তদন্ত ও পুনঃগণনা শেষে নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তা তথা হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অর্থাৎ সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি (সিআইএসএ) স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, এই নভেম্বরের নির্বাচন ‘যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সুরক্ষিত নির্বাচন’। তারা এ কথাও জানিয়ে দেন, ‘এ নির্বাচনে কোনো ভোট মুছে যাওয়া, বাতিল হওয়া বা অন্য কোনো ধরনের জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’

ট্রাম্পের আইনি লড়াইয়ে টিম থেকে অন্যান্য আইনজীবী যখন সুবিধা হবে না ভেবে সটকে পড়তে থাকেন, ঠিক তখন প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে ট্রাম্পকে উদ্ধার করতে আসেন নিউ ইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি। তিনি একজন আইনজীবী। তবে আইন অঙ্গনে তিন দশক ধরে ছিলেন অনুপস্থিত। ট্রাম্পের জন্য ফেডারেল মামলায় প্রায় তিন দশক পর তিনি আদালতে উপস্থিত হন। ৯/১১ এর টুইন টাওয়ার হামলার সময় তিনি নিউ ইয়র্কের মেয়র ছিলেন। এ সময় তার সাহসী ভূমিকায় নিউ ইয়র্ক শহর আবার জেগে ওঠে। তিনি এ জন্য ‘আমেরিকার মেয়র’ নামে উপাধি পান। কিন্তু সেই জুলিয়ানি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভিত্তিহীন অভিযোগ আমলে নিয়ে তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে রাখার জন্য ট্রাম্পের আইনসংক্রান্ত প্রধান পরামর্শদাতা হলেন। তিনি দাবি করেন নির্বাচনে ‘কারচুপির প্রমাণ’ আছে তার কাছে। তিনি জানান, কানাডা থেকে ভোট গণনার যে মেশিন আনা হয়েছে তাতে এমন সফটওয়্যার দেয়া হয়েছে যাতে বাইডেনের পক্ষে ভোট চুরি করা হয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, জুলিয়ানির দায়ের করা সব মামলাও খারিজ হয়ে যায়। কারণ, আদালতে কোনো প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি। এ মামলার জন্য তাকে প্রতিদিন রিপাবলিকান শিবির তথা ট্রাম্পকে দিতে হচ্ছে ২০ হাজার ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে মুখরোচক আলোচনা, শেষ মুহূর্তে ট্রাম্পের কাছ থেকে রুডি জুলিয়ানির মোটা অঙ্কের কিছু টাকা হাতিয়ে নেয়া ছাড়া লাভের লাভ আর কিছু হবে না।

কিন্তু তারপরও ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের ফল পাল্টানোর জন্য ভিন্ন পথে হাঁটছেন। সর্বশেষ তিনি মিশিগানের আইন পরিষদের রিপাবলিকান নেতৃত্বকে হোয়াইট হাউজে ডেকে এনে চাপ দেন তারা যাতে বাইডেনের ফল অগ্রাহ্য করে এমন ইলেকটর বাছাই করেন যারা ট্রাম্পকে সমর্থন দেবেন। এই অবাস্তব প্রস্তাবে তারা নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এর আগে পেনসিলভানিয়া রাজ্যের ভোট গণনা স্থগিত রেখে, রাজ্য আইনসভাকে ইলেকটোরাল কলেজ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। তদুপরি, উইসকনসিন রাজ্যের জনবহুল এলাকাগুলোতে ভোট পুনঃগণনার জন্য ৩০ লাখ ডলার ফি জমা দেয়া হয়। রাজ্যগুলোর ভোটের ফলাফল সার্টিফাই না করার জন্য ট্রাম্পের পক্ষে আবেদন জানানো হলো।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান দ্য জেনারেল সার্ভিসেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিএসএ) সব রাজ্যের ভোটের ফলাফল সই করার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন পর্যন্ত এ ঘোষণা আটকে রেখেছেন। এমন ঘোষণা দেয়ার পরই ক্ষমতার পালাবদল বা ট্রানজিশনের কাজ শুরু হয়। ট্রানজিশনের জন্য ফেডারেল অর্থ উন্মুক্ত হয় এবং নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ব্রিফিং দেয়া হয়। জিএসএ এখন পর্যন্ত সব রাজ্যের ফলাফল সার্টিফাই না করায় ট্রানজিশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে জিএসএকে ফলাফল সার্টিফাই করতে হবে, এটাই নির্দেশনা রয়েছে।

সর্বশেষ খবর হচ্ছে, জর্জিয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বড় ধাক্কা খেয়েছেন। সেখানে হাতে ভোট গণনাও সম্পন্ন হয়েছে। রাজ্যজুড়ে নিরীক্ষা শেষে নির্বাচন কমিশন জো বাইডেনকে সরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেছে। পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্পের পক্ষে করা সর্বশেষ মামলাও বাতিল হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘খেলা শেষ’। এরই মধ্যে তিনি হোয়াইট হাউজে তার সহযোগী উপদেষ্টাদের কাছে স্বীকার করেছেন, নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছেন। ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক পরাজয় স্বীকার করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ট্রাম্পের যে মনমানসিকতা তিনি আদৌ নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানাবেন কি না, কেউই এর সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারছেন না।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন নানা অঘটন ঘটিয়ে চলেছেন। তিনি হোয়াইট হাউজে থাকবেন কাঁটায় কাঁটায় আরো দুই মাস। এ সময়ে আরো কী অঘটন ঘটান, এটাই ভয়ের কারণ। ইতোমধ্যে তিনি তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপারকে বরখাস্ত করেছেন। ৩ নভেম্বরের নির্বাচনকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে সুরক্ষিত নির্বাচন’ বলায় হোমল্যান্ড সিকিউরিটি প্রধান ক্রিস ক্রেবসকেও বরখাস্ত করেন তিনি। গোলান উপত্যকায় ইসরাইলি সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে ঘোষণাপত্রে সই করেছেন ট্রাম্প। সেই গোলানে শেষ সময়ে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেওকে পাঠিয়েছেন। ইসরাইলের দখলকৃত ফিলিস্তিনের এই অবৈধ ইহুদি বসতিতে পম্পেওর ভ্রমণকে ব্রিটিশ গণমাধ্যম নজিরবিহীন ঘটনা বলে বর্ণনা করেছে। এটি আন্তর্জাতিক আইনেরও পরিপন্থী। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরাইলি জবর দখলকে স্বীকৃতি দেয়নি।

বিশ্বের অন্যতম সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউসির ওপর প্রচণ্ড রেগে আছেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউজ ছাড়ার আগে ফাউসি ট্রাম্পের রোষানলে পড়ে বরখাস্তের শিকার হন কি না অনেকে আশঙ্কা করেছেন।

গত ২০ অক্টোবরের লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, করোনাভাইরাসই কি ট্রাম্পের কপাল পুড়বে? সেটিই সত্যে পরিণত হয়েছে। করোনা মহামারী মোকাবেলায় ব্যর্থতার জন্যই নির্বাচনে হেরে গেছেন ট্রাম্প। এটাই তার হারার প্রধান কারণ। অন্য দিকে করোনা মহামারী বাইডেনের জয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। করোনা বাইডেনের দিকে ভোট ঠেলে দিয়েছে। করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আড়াই লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন। ট্রাম্পকে অস্থিরমতির বলে উল্লেখ করেছিলাম লেখায়। এখন পর্যন্ত তার আচরণে সেটাই দেখা যাচ্ছে। বাইডেন বৃহস্পতিবারও বলেছেন, ট্রাম্পের পুরো আচরণ আমেরিকার জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠেছে। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা না করায় মহামারীতে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে বড় সত্য হচ্ছে, হোয়াইট হাউজ ট্রাম্পের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এর মালিকানা এখন জো বাইডেনের হাতে।
ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য বাইডেনের ট্রানজিশন টিম বিদায়ী সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে না। কোনো প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করে জেনারেল সার্ভিসেস অ্যাডমিনিস্টেশন (জিএসএ)। এবার সেই প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেন। কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো সংস্থার সাথেই কাজ করতে পারছেন না তিনি। নিয়মিত গোয়েন্দা ব্রিফিংও পাচ্ছেন না।

তবে ট্রাম্পের সাবেক ও বর্তমান কিছু কর্মকর্তা ইতোমধ্যে বাইডেনের ট্রানজিশন টিমের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছেন। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনও বসে থাকেননি। ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। তার প্রশাসনের জন্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিচ্ছেন। নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ করে মন্ত্রিসভা ঠিক করছেন। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হিসেবে ইতোমধ্যে তিনি করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করেছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে বৈঠক করেছেন। ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তাদের সাথে ভ্যাকসিন বিতরণ নিয়ে বৈঠক করেছেন। রাজ্যের গভর্নরদের সাথে বৈঠক করেছেন। মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আগামী ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয়ার পর তার করণীয় ঘোষণা করেছেন। প্রথম কাজ হবে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করা। এ ছাড়া ট্রাম্পের নেয়া নীতিমালা দ্রুত সংস্কার, যে সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা প্রত্যাহার, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরে আসা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় অনুদান দেয়া আবার শুরু করা, শিশু বয়সে যারা বৈধ কাগজ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করছে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া, প্রেসিডেন্ট ওবামার কিছু নীতির পুনর্বহাল, বর্ণভিত্তিক বৈষম্য উচ্ছেদ করতে প্রশাসনে ভিত তৈরি ইত্যাদি জরুরি পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করবেন। ইতোমধ্যে জো বাইডেন তার বিজয়ী ভাষণে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে ঐক্য, সহনশীলতা ও সহযোগিতার সমাজ গড়ে তোলাই হবে আমার কাজ। তিনি বলেন, আর বিভাজন নয়, বিভেদ নয়, ঐক্য চাই। কোন রাজ্য নীল আর কোন রাজ্য লাল, তা দেখব না। আমি দেখব যুক্তরাষ্ট্রকে। কে আমাকে ভোট দিলো আর কে দিলো না, তা নয়। আমি সবার প্রেসিডেন্ট হতে চাই। আমরা বিজ্ঞানকে অনুসরণ করব।’

ট্রাম্পের ফল না মানার তৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ট্রাম্পের এ তৎপরতায় নির্বাচনীব্যবস্থায় অনাস্থা বাড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে।

জো বাইডেনের বিজয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছেন। বলছেন, আমাদের আমেরিকা, তাকে আমরা ফিরে পেয়েছি। কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগ্রাসী আচরণ, বর্ণবাদ উসকে দেয়া, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের কর্মকাণ্ডে নিন্দা না জানানো এবং সর্বশেষ করোনা মহামারীকে উপেক্ষা করায় আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু এবং লাখ লাখ মানুষ বেকার হওয়ায় এক অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে এখন পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, এটিই যুক্তরাষ্ট্র এবং বাইরের দুনিয়ার মানুষ আশা করছে। কারণ এবারের নির্বাচনে বাইডেন-কমলা জুটি বাজিমাত করেছেন।

‘ভাগ্যে বিশ্বাসী’ জো বাইডেন!
নতুন বছর ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেবেন জো বাইডেন। গত শুক্রবার তিনি ৭৮ বছরে পা দিয়েছেন। রাজনৈতিক জীবন ৫০ বছরের। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনিই হচ্ছেন বয়স্কতম প্রেসিডেন্ট। আবার কম বয়সী সিনেটর হিসেবেও আছে তারই নাম। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর নির্বাচিত হন। জীবনে অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তিনি এ পর্যায়ে এসেছেন।

স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, ‘আমি ভাগ্য মানি- ভাগ্যের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস। আমার ব্যক্তিগত জীবন কখনই পরিকল্পনা অনুযায়ী চলেনি। কিন্তু যেটা চেয়েছি, সেটা কিভাবে যেন হয়ে গেছে- একটা অদৃশ্য হাত সেটি ঘটিয়ে দিয়েছে।’ জো বাইডেন বলেন, ‘বাবার একটি কথা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। এটা আমি কখনো ভুলি না। বাবা বলতেন, কে তোমাকে কত বড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো, সেটা বড় কথা নয়। কত দ্রুত তুমি উঠে দাঁড়াতে পারলে, মানুষ হিসেবে সেটিই হবে তোমার সাফল্যের পরিচয়।’ তিনি বলেন, ‘তাই আমি কখনো আশা ছাড়ি না। সব সময়ই আশা আছে- এটাই আমার বিশ্বাস।’

গত ফেব্রুয়ারিতেও তিনি ছিলেন হোয়াইট হাউজের দৌড়ে প্রায় একজন পরাজিত ব্যক্তি। প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দলের পূর্ব বাছাই বা প্রাইমারি নির্বাচনে তিনি জিততে পারবেন বলে মনে হয়নি। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রাইমারিতে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাকে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু কী ভাগ্য! প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াইয়ে হেরে গিয়েও লড়ে গেছেন বাইডেন। প্রতিটি পরাজয়ের পর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তার সহকর্মী সিনেটর বব কেরি বিবিসিকে বলেন, ‘জো কখনো হাল ছাড়ে না। দরকার না হলেও তার কাজ সে করে যায়।’ অনেকের মতে, ‘বাইডেন প্রতিকূলতা কাটিয়ে টিকে থাকা এক ব্যক্তি।’ তারই ফল, আজ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অনেক আপনজনকে হারিয়ে দিশেহারা হয়েছেন। প্রথম স্ত্রী নেইলি ও শিশু সন্তান নওমি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে বো বাইডেনও রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, ২০১৬ নির্বাচনের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দলীয় মনোনয়ন লড়াইয়ে তিনি যখন ব্যস্ত, ঠিক তখন ২০১৫ সালে বো’র মৃত্যুর শোক তাকে বড় মানসিক চাপে ফেলেছিল। সেটাও অতিক্রম করে রাজনৈতিক জীবন গড়ে তুলেছেন তিনি। আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল না তার পরিবার। বাবা ছিলেন একজন গাড়ি বিক্রয়কর্মী। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তি হিসেবে কংগ্রেসে প্রবেশ করেছিলাম। আবার সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তি হিসেবে কংগ্রেস থেকে বিদায়ও নিয়েছি। ছাত্রজীবনে তার সাইটেশন পেপারে আরেকজনের লেখা হুবহু ব্যবহার করেছিলেন। এটি নিয়মবহির্ভূত তা তিনি জানতেন না। এটি ছিল তার জীবনের একটা ভুল। ওই লেখাচুরির কলঙ্ক তাকে অনেক দিন তাড়া করেছে।

১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে এ কারণেই তিনি হেরে যান। আবারো ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে তিনি ওবামার কাছে হেরে গিয়েছিলেন। তবে বারাক ওবামা তাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে রানিং মেট করেন। ২০১৬ সালেও বাইডেন প্রার্থী হতে পারেননি। হিলারি ক্লিনটন হন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। অবশেষে ২০২০ সালে এসে অনেক বাধা ডিঙিয়ে সাফল্য ধরা দেয়। মনোনয়ন পেলেন এবং প্রেসিডেন্ট হলেন। জো বাইডেন ১৯৭৭ সালে স্কুলশিক্ষিকা জিল জ্যাকবসকে বিয়ে করেন। ইংরেজির এই শিক্ষক একজন ডক্টরেট। জো বাইডেন ১৯৬৫ সালে ডেলাওয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। আইসক্রিম তার খুব পছন্দ। তিনি বলেছেন, হোয়াইট হাউজে গিয়ে তিনি ও কমলা আইসক্রিম খেয়ে তাদের দু’জনেরই জন্মদিন পালন করবেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, তিনিও বাইডেনের জন্য আইসক্রিম পাঠাবেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব

 


আরো সংবাদ



premium cement