২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইথিওপিয়ায় অশান্তির আগুন

ইথিওপিয়ায় অশান্তির আগুন - ছবি : সংগৃহীত

নয়া প্রস্তর যুগের মানুষ তথা আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষের আদিবাস ছিল যে ভূখণ্ডে সেটি ইথিওপিয়া। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়া একজন প্রধানমন্ত্রী দেশটি শাসন করছেন। এটিই হলো পুরো আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান দেশ। সেই ইথিওপিয়ায় অশান্তির আগুন জ্বলে উঠেছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আধুনিক মানব প্রজাতি এই ইথিওপিয়া অঞ্চল থেকেই প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে ও পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ নব্যমুসলমানরা হিজরত করার অনুমতি পেয়ে এই ইথিওপিয়া বা আবিসিনিয়াতেই এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ দেশেই জন্ম নেন রাসূল সা:-এর প্রিয় কৃষ্ণাঙ্গ সাহাবি হজরত বেলাল রা:, যিনি ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন।

কেন্দ্রশাসিত গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী এই দেশটির অবস্থান ‘আফ্রিকান শৃঙ্গে’। এর উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ইরিত্রিয়া, পূর্বে জিবুতি ও সোমালিয়া, পশ্চিমে সুদান ও দক্ষিণে কেনিয়া। ভূমিবেষ্টিত দেশটি আফ্রিকার দ্বিতীয় ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে আটগুণ বড় দেশটির জনসংখ্যা সাড়ে ১০ কোটির মতো। আদ্দিস আবাবা রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী আবি আহমদ আলী গত সপ্তাহে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রদেশ টাইগ্রেতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সেনাবাহিনী তলব করেছেন। এর আগে গত বছরের শেষদিকে তিনি সেখানকার প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেন। সেখানে বিমান হামলা চালানো হয়েছে এবং প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে।

টাইগ্রের প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেয়ার পরই সেখানে সঙ্কটের সূচনা। সরকারি দল টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) নতুন নির্বাচন দাবি করেছে। কিন্তু আবি আহমদ বৈশ্বিক মহামারীর কারণে নির্বাচন পিছিয়ে দেন। এরপর সেখানকার সরকার কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করে গত ৯ সেপ্টেম্বর রাজ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন করে। স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্র ওই নির্বাচনকে অবৈধ হিসেবে নাকচ করে দেয়। বলা হয়েছে, টাইগ্রে ‘সংবিধান লঙ্ঘন করেছে এবং সাংবিধানিক পদ্ধতিকে সঙ্কটে ফেলেছে।’ এই বিতর্কিত নির্বাচন নিয়েই পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। গত সপ্তাহের শুরুর দিকে এক সশস্ত্র হামলায় ৫৪ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনের প্রশ্রয়ে ওই অঞ্চলে কেন্দ্রীয় সরকারের নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। সেই সাথে চলছে সমরাস্ত্র লুটপাটের চেষ্টা। আর এসব করছে টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট। ওই সহিংসতার পরই সেখানে জরুরি অবস্থা জারি করেন গত বছর বিশ্বশান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী আবি আহমদ। এভাবেই বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাওয়ার এক বছরের মাথায় তার নিজ দেশেই অশান্তির আগুন জ্বলে উঠল। হামলাকারীদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়ে নিরাপত্তাবাহিনীকে তাদের নির্মূলের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সংঘর্ষ চলছে। উভয় পক্ষ পরস্পরকে দায়ী করছে সঙ্কট উসকে দেয়ার জন্য। আবি আহমদ এরই মধ্যে সেনাপ্রধান, গোয়েন্দাপ্রধান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন। তবে এসব পদক্ষেপের কোনো কারণ দেখানো হয়নি। সেখানে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলছে। জাতিসঙ্ঘ বলেছে, আটটি বিভিন্ন এলাকায় টাইগ্রেরিয়ান সেনা ও ফেডারেল সেনাবাহিনীর মধ্যে লড়াই চলছে। এতে করে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা প্রতিবেশী দেশগুলোকেও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এ লড়াইয়ে ৯০ লাখ মানুষের স্থানচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে আগাম পূর্বাভাসও দিয়েছে জাতিসঙ্ঘ।

এদিকে টাইগ্রের নেতা ডেব্রেটসিয়ন জেরবাইমাইকেল এক বিবৃতিতে বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার যতক্ষণ না আলোচনায় সম্মত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত টাইগ্রে প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে। এর আগে তিনি আবির কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে তার রাজ্যে ‘আক্রমণ করার ষড়যন্ত্রে’র অভিযোগ এনেছিলেন। এ ছাড়া গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে আফ্রিকান ইউনিয়নকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানিয়েছেন। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন্দ্রীয় সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকার ভেঙে দেয়ার পর টিপিএলএফ কেন্দ্রের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাহস পায় কিসের জোরে? তাদের খুঁটির জোর কোথায়? এই প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বর্তমান সঙ্কটের মূল কারণটি।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, ইথিওপিয়া হলো আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি অস্ত্রসজ্জিত দেশ। আর ২০১৮ সালে আবি ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত টাইগ্রের নেতারা ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীসহ পুরো রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। ইথিওপিয়ায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে টাইগ্রের জনগোষ্ঠী হলো মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ। ইথিওপিয়া সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, পিটিএলএফের যে আধাসামরিক বাহিনী ও মিলিশিয়া গ্রুপ আছে তার সদস্য সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এই শক্তির জোরেই তারা জাতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রাখেন। সেই সাথে ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতির সাথেও তারা জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ আছে। আবি ক্ষমতায় এসে টিপিএলএফের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি দুর্নীতিবাজ অনেক নেতাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকিয়ে দেন। তবে টাইগ্রের নেতারা বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ‘অন্যায়ভাবে’ দুর্নীতির অভিযোগ আনা হচ্ছে।

এসব কারণে আবির ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পিটিএলএফ নেতারা নিজেদের বঞ্চিত ভাবছেন এবং কেন্দ্রের জোট সরকার থেকে বেরিয়ে গেছেন। তখন থেকেই তারা জাতীয় নির্বাচন দাবি করে আসছিলেন। কিন্তু আবি করোনা মহামারীর কারণে তাতে সম্মত হননি। আর টাইগ্রের নেতারা তাদের রাজ্যে নির্বাচন করে ফেলেছেন কেন্দ্রীয় সরকারকে উপেক্ষা করেই। এরপর আবি সরকার টিপিএলএফ নেতাদের অর্থ বরাদ্দ বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় সরকারের জন্য বরাদ্দ করে। এতে ক্ষিপ্ত হন টাইগ্রের নেতারা। তারা রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাত শুরুর হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেন। সেখানে সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে মোট পাঁচটি স্থানীয় দল অংশ নেয়। তাতে টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট টিপিএলএফ একাই পেয়েছে ৯৮.২০ শতাংশ ভোট। পার্লামেন্টের ১৯০টি আসনের মধ্যে ১৫২টি দখল করেছে তারা। বাকি চারটি দল মিলে পেয়েছে ১.৮০ শতাংশ ভোট এবং ৩৮টি আসন। ফলাফল দেখে না বোঝার কোনো কারণ নেই, নির্বাচন কেমন হয়েছে।

রাজ্যটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং সামরিক অভিযান শুরুর পর এখন ধারণা করা হচ্ছে, এই সঙ্ঘাত দেশটির আরো কিছু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে যেখানে অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম চলছে। শুধু তাই নয়, ইথিওপিয়ার সমস্যা আছে প্রতিবেশী মিসর ও সুদানের সাথেও। ইথিওপিয়া এরই মধ্যে সুদীর্ঘ নীল নদে বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণ করেছে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ রফতানিকারক দেশে পরিণত হতে, ইথিওপিয়ার মহাপরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে ৪০০ কোটি ডলারে নির্মিত গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম (জিইআরডি) নামের এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এই বাঁধ থেকে পানিপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বেশ কয়েক দফা আলোচনায় বসলেও ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয় মিসর, ইথিওপিয়া ও সুদান। মিসর বলেছে, নীল নদের পানির প্রবাহ এমনিতেই কমে গেছে। ইথিওপিয়ার বাঁধের কারণে এ সঙ্কট আরো বাড়বে। মিসরের ১০ কোটির বেশি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে নীল নদের ওপর নির্ভরশীল। এই বাঁধের কারণে সৃষ্ট বিরোধের ফলে মিসর এখন ইথিওপিয়ায় অস্থিতিশীলতায় ইন্ধন জোগাচ্ছে, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন সাবেক একজন মার্কিন কূটনীতিক।

আছে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বও। ইথিওপিয়া বেশ আগে থেকেই চীনের সহায়তায় উন্নয়নের পথ ধরেছে। ১৯৯৫ সালের পর থেকে দেশটি চীনের অর্থনৈতিক সহায়তায় এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের সার্বিক উন্নতির সাথে সাথে পাল্টে যাচ্ছে রাজধানী আদ্দিস আবাবাও। আকাশচুম্বী আধুনিক অট্টালিকা, উন্নত রেল যোগাযোগ এবং সুন্দর, ঝকঝকে তকতকে রাস্তাঘাট সবই গড়ে উঠেছে সেখানে। গত দুই দশকে চীন আদ্দিস আবাবায় ৮ কোটি ৬০ লাখ ডলারের সড়ক নেটওয়ার্ক, এক কোটি ২৭ লাখ ডলারের গোরেটা ক্রসরোড, ৮০ কোটি ডলার ব্যয়ে ইথিওপিয়ার প্রথম ছয় লেনের হাইওয়ে, চার বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ইথিও-জিবুতি রেলওয়ে নির্মাণ করেছে। এখানেই চীন নির্মাণ করেছে সাব-সাহারা অঞ্চলের প্রথম মেট্রোরেল সিস্টেম।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এমনও খবর এসেছে, একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি হলো ইথিওপিয়ার দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন। তবে বিশ্বব্যাংক ২০২০ সালে ইথিওপিয়ার সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির হার ৮.২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.৩ শতাংশ নির্ধারণ করেছে এবং ২০২১ সালের জন্য দেশটির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৮.২ শতাংশ থেকে ৬.৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তার পরও ইথিওপীয় সরকার আশা করছে, ২০২০ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশেরও বেশি হবে। এই উন্নয়ন সত্যিই বিস্ময়কর। আর এটাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের।

প্রধানমন্ত্রী আবি মুসলিম পিতা এবং খ্রিষ্টান মায়ের সন্তান হলেও নিজে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। আর এই সূত্রেই তিনি পাশ্চাত্যের অকুণ্ঠ মদদ পেয়ে আসছেন। তার নোবেল জয়ের পেছনেও পাশ্চাত্যের সেই আনুকূল্য কাজ করেছে- এমন জল্পনাও শোনা যায়। তাকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ইসরাইল নীল নদে বাঁধ দিয়ে মিসরসহ কিছু দেশকে চাপে রাখতে চায় এমনটাও মনে করেন অনেক পর্যবেক্ষক।

ইরিত্রিয়ার সাথে দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা, যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালে শান্তিতে নোবেল পান আবি। তিনি হয়তো শান্তির পথেই হাঁটতে চাইবেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘুঁটি যারা চালেন সেই আমেরিকা, ইসরাইল, চীন এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলো সে পথে তাকে নির্বিঘ্নে যেতে দেবে কি না সে বিষয়ে সংশয় আছে। চলমান সঙ্ঘাতের ফলাফলের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে।


আরো সংবাদ



premium cement